চন্দ্রপুকুর,৬ষ্ঠ পর্ব,০৭

0
520

#চন্দ্রপুকুর,৬ষ্ঠ পর্ব,০৭
-ঈপ্সিতা শিকদার

অতীতের কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে যামিনী। মেহনূরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানান দেওয়া দিনটি কী যন্ত্রণাদায়কই না কেটেছিল তার! প্রথম প্রথম সে বিশ্বাস করতে চায়নি। তবে যেদিন নবাবের মহল থেকে আসা বাঁদীদের মুখেও একই কথা শুনতে পায় সেদিন সম্পন্ন রূপে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তার সকল প্রত্যাশা।

মেহমাদ শাহের মা বেগম নূর বাহার। অবিলম্বেই তার মুখখানা মলিন হয়ে যায়।

“ময়-মুরব্বিদের থেকে শুনে এসেছি শয়তানের নাম নিলে শয়তান হাজির হয়। আজ তা স্বয়ং দেখলামও।”

উপস্থিত সকলে ভ্রু কুঁচকে তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে যামিনীর দিকে তাকায়। সাথে সাথেই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন বেগম লুৎফুন্নেসা।

যামিনী খুব দ্রুত ঝুঁকে বলে উঠে,
“আসসালামু আলাইকুম, দাদীজান ও আম্মিজান। কী অপরূপা দেখতে আপনারা! আপনাদের দর্শন পেয়ে ধন্য হলাম।”

যামিনী এগিয়ে তাদের দিকে যেতে নিলে বেগম লুৎফুন্নেসা দাঁড়িয়ে যান।
“আমি উঠছি, মেহনূর, নূর বাহার। আমার দ্বারা এই কলঙ্ককে এক মূহূর্ত দর্শন করা সম্ভব নয়। আর আমার জান শাহাজাদি মেহনূর, অন্ধকার থেকে দূরে রাখ নিজেকে। এদের কাজই আলোকে গ্রাস করা।”

“আমিও চলছি শাহাজাদি। নিজের খেয়াল রাখবে ও নবাবকে কাছে রাখবে। যেই আঁধার নেমেছে গগনের বুকে, প্রথম দিনই মহফিলে ব্যাঘাত ধরিয়ে দিল।”

বেগম লুৎফুন্নেসা ও বেগম নূর বাহার উভয়ই গমন করেন নিজ নিজ গন্তব্যে। তবে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যামিনী। নিমিষেই আঁখি ভরে উঠেছে নোনাজলে। এতোটা অবজ্ঞা ও অপমান তার গলাধঃকরণ করতে বেশ কষ্টই হচ্ছে। যদিও বেগম নূর বাহার মেহমাদ শাহের কে তা জানে না যামিনী, তবুও কটু ভাষা কি আর গায়ে না লেগে থাকে!

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আসুন। বসুন আমার সাথে। গল্প-গুজব করি। এই মহলে আমার বয়সের কেউ নেই, আজ আপনাকে পেলাম। আসুন, কথা বলি।”

মেহনূরের হাস্যময় কণ্ঠ শুনে চমকিত হয়ে তাকায় যামিনী। বেশ শান্ত হয়ে তার পাশে যেয়ে বসলো।

“তোমার বিষয়ে অনেক শুনেছি যামিনী শাহের নিকট। সত্যিই দেখতে অনেক মোহনীয় তুমি!”

“সুন্দর ও বিপরীত বাক্যে অপমান করলেন বুঝি শাহাজাদি? আমি রূপ, বংশ হীন আমি জানি। যেখানে সবাই আমাকে আঁধার ডাকে সেখানে আপনার প্রসংশা পুরোটাই অমানানসই।”

“নানীজানের কথা বলছো? তাঁর কথায় মন খারাপ কোরো না। তিনি মানুষটা মন্দ নন। আসলে সবাই-ই তো চায় নিজের ঘরের জন্য যোগ্য পুত্রবধূ আনতে। নানীজানও চাইতেন শাহের জন্য, তুমিই একবার ভাবো তুমি নবাবের যোগ্য না কি শুধু ভাগ্যলিখনের জোরে পেয়ে বসেছো? যাকগে চলো তোমাকে অন্দরমহল ঘুরে দেখাই।”

মেহনূরের সূক্ষ্ম খোঁচা অতি সহজেই অনুধাবন করয়ে পারে যামিনী। যুবতীর নির্লজ্জভাবে হাসা দেখে তার হৃদয় তো বলছে কঠোর দু’টো বাণী শুনিয়ে দিতে, তবে সে তা করলো না। বরং, খুব সৌজন্যতার সহিত প্রত্যাখ্যান করলো তার প্রস্তাব।

“দুঃখিত শাহাজাদি। আজ যেতে হবে, অন্য একদিন ইনশাআল্লাহ।”

যামিনী নিজের কক্ষের পথে হাঁটা ধরলো। কক্ষের যাওয়ার সরু রাস্তায় এক বয়োজ্যেষ্ঠ নারী বিদ্রূপ করে উঠলো,
“কেমন লাগলো অপমানিত হয়ে বেগম? এই রাজমহল হলো বিশালাকৃতির এক অজগর, হয় লড়তে হবে, নয় মরতে হবে। অন্যান্য গ্রামের সাধারণ সংসারের ন্যায় চাইলেও এখানে মাটি কামড়ে থাকা যায় না। পদে পদে দংশিত হতে হতে, একসময় বিষে ডুবে মরতে হয়।”

হাসতে হাসতে তিনি চলে যান। কিশোরীকে কিছু বলার একদফা সুযোগও দেন না। তবে এই নারীর কথাবার্তায় তীব্র আক্রোশের স্পষ্ট ছোঁয়া পায় সে।

নিজের হৃদয়ের আর্তনাদের মাঝে এতো সব খেয়াল করতে পারে না সে। নিজের কক্ষে চলে যেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে কাঁদতে শুরু করে।

___

মাগরিবের নামাজ শেষ করে যামিনী উদাস মনে কক্ষের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় একজন দাসী নিয়ম মোতাবেক সালাম দিয়ে জানালেন,
“বেগম, জমিদার নবাব শাহ আপনাকে তাঁর কক্ষে ডেকেছেন।”

রমণী মেহমাদ শাহের আদেশ মোতাবেক দাসীর সাথে তাঁর কক্ষের বাহিরে দাঁড়িয়ে দরজায় কড়াঘাত করে। যুবক আদেশ করলে প্রহরী দরজা খুলে দেয়।

প্রবেশ করতেই কোনোদিকে না তাকিয়েই ছুটে যেয়ে গলা আঁকড়ে ধরে তার প্রিয়তমের যামিনী। ক্রন্দনোন্মুখে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি কোথায় ছিলেন বাবু মশাই? আপনি জানেন না আপনাকে ছাড়া কতোটা অসহায় আপনার চন্দ্রমল্লিকা এই নিষ্ঠুর জগতে। দুনিয়ার মানব আমাকে কথার দড়িতে গলা চেপে হত্যা করতে প্রস্তুত শুধু আপনার স্ত্রী হয়েছি বলে।”

মেহমাদ শাহ দু’হাতে প্রেয়সীর মুখশ্রী আঁকড়ে ধরে অনুভূতি মাখা চুম্বন করে ললাটে। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে জমিদার নিজেই যেন।

“আমি জানি যামিনী। আমি সবটুকু জানি। তবে এই অন্দরমহল বা কারো হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। তোমার স্থান ও মর্যাদা তোমাকেই তৈরি করে নিতে হবে।”

কিছুটা সময় বিরতি নিয়ে পুনরায় মুখ খুলে যুবক,
“যাই হোক। এখন আমার এই মুখশ্রী থেকে সকল ক্রন্দন, হতাশা, বেদনার ছাপ সরিয়ে ফেল। এখন তোমাকে আমি গোটা অন্দরমহল ঘুরে দেখাবো।”

সায় জানায় রমণী। অতঃপর দুজন বেড়িয়ে পড়ে অন্দরমহল পরিদর্শনে।

মেহমাদ শাহ একে একে অন্দরমহলের প্রতিটি কোণাকে পরিচিত করায় যামিনীর সাথে। অন্দরমহলের সাজসজ্জা ও আভিজাত্য দেখে কিশোরীর মনে হচ্ছে সে অন্য এক জগতে পা রেখেছে।

অন্দরমহল হলো নবাববাড়ি তথা মহলের অভ্যন্তরের ও পিছনের ভাগ। যার বাগান ও বাহিরের সীমানা সম্মুখের অংশ থেকে পৃথক করা হয়েছে উঁচু দুটো দেয়াল দ্বারা এবং মহল থেকে বিভক্ত করা হয়েছে তিনটি প্রকাশ্য ও বেশ কিছু গোপণ দরজার দ্বারা। বিরাটকার আঙ্গিনা, বাগান, বা’দিকে দু’টো পুকুর ও একপাশে মহল থেকে আলাদা করে গড়ে তুলা হয়েছে দু’কক্ষের একটি রঙ্গালয়। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা।

যাত্রা শেষে যামিনী ও মেহমাদ শাহ তার কক্ষে ফিরে আসে। যুবক তার প্রেয়সীর হাত দু’টো মুঠোয় নিয়ে প্রশ্ন করে,
“কেমন লাগলো তোমার নিজের বাস্তব ঠিকানা? মানে এই নবাববাড়িকে কেমন লাগলো?”

“আসলেই কি আমার বাস্তব ঠিকানা এটা নবাব? তবে কেন আরেকজন নারীকে নিজের জীবনে জড়াচ্ছেন? এ বিষয়টি যে ছুড়ি হয়ে হৃদয়ে আঘাত করছে আমার।”

তার আবেগঘন এই বচনে সেদিনের ন্যায় আজও ক্ষিপ্ত হয় মেহমাদ শাহ। দূরে সরে যায়।

“তোমাকে সেদিন কঠোর ভাবে নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি পুনরায় আমার সিদ্ধান্তের কৈফত চাওয়ার দুঃসাহস করছো! কেমন অশিষ্টতা! চলে যাও! চলে যাও আমার নজরের বাইরে!”

যামিনী ওড়নায় মুখশ্রী ঢেকে চাপা কাঁদতে কাঁদতে স্থান ত্যাগ করে। নিজের কক্ষে যেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। দিলরুবার সান্ত্বনা বাণীও শ্রবণগোচর হচ্ছে না আজ।

এমন সময় দরজা খোলার শব্দ। দ্রুতো নয়নযুগল ও কপোল মুছে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায় কিশোরী। চোখ উঠাতেই দেখেতে পায় মোর্শেদা খাতুনকে।

“আসসালামু আলাইকুম, আম্মাজান।”

তিনি এগিয়ে এসে মাথায় বাহুতে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে হস্ত রাখেন। চিবুক ধরে মুখ উঠিয়ে শুধান,
“অশ্রু লুকানোর প্রয়োজন নেই, আমার তো অশ্রু ও বেদনার সাথে আদিকাল থেকে সম্পর্ক। তবে নিজ অভিজ্ঞতা থেকে একটা উপদেশ দিতে পারি।

এই কান্না, আত্মচিৎকার সব বিফলে যাবে। সুতরাং, নিজেকে আর ক্লান্ত করবে না চন্দ্রমল্লিকা। এই নবাববাড়ির মানুষের সম্ভ্রম ও সম্পত্তি যতো বিশাল, ততোই ক্ষুদ্র তাঁদের শ্রবণশক্তি। কিছুই তাঁদের কানে যাবে না।”

যামিনী ঢুকরে কেঁদে উঠে।
“যতোই হৃদয়কে বুঝাই আম্মাজান, হৃদয় যে আপনার পুত্রের প্রেমে ডুবে। কী করে মেনে নিবে তার ভাগ অন্যকাউকে নিতে দেখে! না চাইতেও যে অশ্রু বর্ষণ হয়ে যায়।”

“শোনো চন্দ্রমল্লিকা, আমি ব্যর্থ হয়েছি এই জমিদারি, নবাববাড়ির খেলায়। তুমি ব্যর্থ হয়ো না সবটা হারাবে। রুখে দাঁড়ানো শিখো, নিজের অস্তিত্ব শুধু থাকলেই হবে না, সবাইকে বুঝাতে হবে তুমিও আছো। বুদ্ধিমতীর জন্য ইশারাই যথেষ্ট। আশা করি তোমার ক্ষেত্রেও তাই হবে।

মনে রেখো, নবাব হতে শুধু রাজ্য জয় করলেই চলে, রাজত্ব ও মর্যাদা একাই আসে। কিন্তু মল্লিকা হতে হলে নবাবের হৃদয়, রাজ্য, রাজত্ব, কূটনীতি ও যোগ্যতা সবই অর্জন করা লাগে।”

তিনি বাঁকা হাসি দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যান। যামিনী নিজের মাঝেই তাঁর কথাগুলো বিশ্লেষণ করতে শুরু করে।

ইশার আজান পড়ে যায় তার বিচার-বিশ্লেষণ করতে করতে। অতঃপর মুখশ্রীতে এক দৃঢ় হাসি ফুটে উঠে। বিড়বিড়ায়,
“যা আমার তা আমারই থাকবে।”

নামাজ পড়ে উঠতেই দাসী উপস্থিত হয়। অনুময়ি পেয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, একটু বাদেই খাবারের সময়। নবাব উপস্থিত হবেন। আপনাকে ভোজনশালায় উপস্থিত থাকতে বলেছেন মোর্শেদা খাতুন।”

“ঠিক আছে, তুমি যাও। আমি আসছি।”

রমণী কিছু একটা ভেবেই ভোজনশালায় যাওয়ার পূর্বে মেহমাদ শাহের কক্ষের দিকে। নিকটে পৌঁছাতেই খেয়াল করে নবাব বেশ খাণেক দূরে অবস্থিত একটি কক্ষে প্রবেশ করেছেন। পাশের এক দাসীকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই জানায় কক্ষটি মেহনূরের। অনতিবিলম্বেই চুপিসারে দরজার সম্মুখে যেয়ে আড়িপাতার উদ্দেশ্যে দাঁড়ায় যামিনী।

প্রহরী তার আগমনের খবর উচ্চারণ করতে যাবে তার পূর্বেই সে হৃদয়ের ভীতি ঢেকে তীব্র রাগান্বিত ও চাপা কণ্ঠে বলে উঠে,
“একদম চুপ থাকো! তুমি জানো কে আমি? আমি নবাব মেহমাদ শাহের একমাত্র বিবাহিত স্ত্রী বেগম চন্দ্রমল্লিকা। মুখ খুললে তোমার এই দৃঢ়কায়ের থেকে গর্দানটা খুলে পড়তে সময় লাগবে না।”

তার উদ্দেশ্য সফল হয় প্রহরীরা নিঃশ্চুপ থাকে। সে আবারও দরজায় কান বসায়।

শুনতে পায় তার বাবু মশাই মেহনূরের উদ্দেশ্যে বলছে,
“এই গোপন কথা যেন তোমার আমার মাঝেই স্থির থাকে শাহাজাদি। এর বিপরীতে কিছু হলে তার মূল্যও তোমায় দিতে হবে। আর যদি আমার কার্য ঠিক-ঠাক সম্পাদন তবে তুমি যেটা চাও, সেটাই প্রাপ্তির খাতায় তুলবো আমি।”

“আপনি চিন্তা করবেন না শাহ। আপনার গোপন কথা, আমারও গোপন কথা। ইনশাআল্লাহ আপনি আমার দিকে হতাশ বা রাগান্বিত কিংবা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকানোর সুযোগ পাবেন না। তবে একটা কথা…?”

“হ্যাঁ, বলো চন্দ্রপ্রভা?”

“আপনি এই কথাগুলো যামিনীকে বলছেন না কেন? এতে তো তার-ই…”

“এই নবাববাড়িতে যার যার স্থান তাকে নিজেই অর্জন করে নিতে হয়। তাকেও তা করতে হবে। নাহলে বিলিন হনে এটাই সত্য। এখন চলো, ভোজনশালার দিকে যাওয়া যাক।”

আর ভাবার সময় পেলো না শেষবাক্যটি শুনে। তড়িৎ গতিতে দূরে সরে গেল। দীর্ঘশ্বাস নির্গত হলো দেহ থেকে তবে এবার আর সে কাঁদলো না। তবে শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করা কথোপকথন নিয়ে ভাবনার আসর বসিয়ে সেও ভোজনশালার দিকে অগ্রসর হলো।

দেখতে পেল নবাব পরিবারের সবাই খাবার সাজিয়ে রাখা চৌকির সম্মুখে বসে গল্প করতে ব্যস্ত। সেও নৈশব্দে যেয়ে বসলো নবাবের আসনের ডান দিকের আসনে। একটু ক্ষুণ্ণ দেখালো এবার উপস্থিত মানুষদের।একটু বাদেই প্রবেশ করলো মেহমাদ শাহ ও মেহনূর। সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো।

বেগম নূর বাহার বলে উঠলেন,
“মাশা আল্লাহ! কী সুন্দর লাগছে আমার পুত্রকে মেহনূরের সাথে! যেন চন্দ্রপ্রভা বস্তুতই এসে পড়েছে আমার সিংহের গায়ে।”

“খাওয়া শুরু করা যাক। বিসমিল্লাহ্‌।”

নৈশব্দে ভোজন শুরু করলো উপস্থিত সকলে। নানা পদের খাদ্য। যামিনী চেয়েও স্বাদ নিতে পারছে না কিছুর। থালায় বিদ্যমান খাবার নড়াচড়া করেই যাচ্ছে শুধু।

বেগম লুৎফুন্নেসা খাওয়ায় খাণিক মুহূর্তের বিরতি নিয়ে আদেশ করে উঠেন মেহমাদ শাহকে,
“তোমায় কাল চার দিনের জন্য শহরে যেতে হবে মেহমাদ। জরুরি দরকার পড়েছে ব্যবসার কাজের। তুমি নিজে না যেয়ে দেখলে চলবে না।”

এই বচন কর্ণগোচর হতেই দেহ শীতল হয়ে পড়ে যামিনীর। তবে কি তার বাবু মশাইয়ের অনুপস্থিতিতেই তার সাথে ভয়ংকর কিছু করেই তাকে তাড়ানোর পরিকল্পনা করেছেন দাদীজান?

চলবে…

#চন্দ্রপুকুর
||৭ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিশুতি রাত্রি, দিলরুবা যামিনীর সিক্ত চুলগুলো অতি যত্নের সাথে শুকিয়ে দিচ্ছে ধোঁয়ার সহায়তায়। রাত্রির নীরবতা গ্রাস হয় ঠক-ঠক শব্দে। চমকে উঠে যামিনী।

নিজের কোমরে শাড়ির ভাজে গুঁজে রাখা ছোট্ট ছুরিটা হাতে চেপে ধরে দিলরুবাকে ইশারা করে দরজা খোলার জন্য। দরজা খুলে দিলরুবা। হেলেদুলে প্রবেশ করেন সেই অপরিচিত মাঝবয়সী নারী।

“কী গো কন্যা ভীতিগ্রস্ত হয়েছিলে না কি অর্ধরাত্রিতে কারো আসার শব্দ পেয়ে?”

হো হো করে হেসে উঠেন তিনি। বেশ কাছাকাছিও এসে পড়েন কিশোরীর। তাঁর গা থেকে নির্গত লাগামছাড়া দুর্গন্ধের সহ্যে করতে না পেরে পিছিয়ে যায় যামিনী।

দিলরুবা বলে উঠে,
“আদব বজায় রাখুন। বেগম থেকে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলুন।”

“যে পেলো না শেরপুর, জমিদারি সে আবার হবে জমিদারনি? ভালোই রসিকতা করতে পারো দাসী।”

“কী চান আপনি আমার নিকট? কেন এসেছেন এখানে? বের হন, নাহলে আমি প্রহরীদের ডাকতে বাধ্য হবো।”

দমিত ভয় নিয়ে চোখ রাঙায় যামিনী। তাতেও যেন দমার নয় এই নারী।

বরং, একদম নিকটে যেয়ে ফিসফিসিয়ে শুধায়,
“আমার সব শেষ করে দিয়েছে এই নবাববাড়ি, বাকি রেখেছে শুধু রহস্য হৃদয়ে গেঁথে রাখা আমাকে। ডাকো কাকে ডাকার। আমি গুলবাহার খাতুন, অমবস্যার ঐ কালরাত্রি আমি যাকে সমাপ্ত করতেও কেউ তার সম্মুখে আসতে চায় না।

তোমাকে পোড়াতে আমার বেশ লাগে। মনে হয় যন্ত্রণা ভাগাভাগি করছি। কন্যা, জমিদারি চাইলে জমিদারকে খুশি রাখা আর জমিদার চাইলে জমিদারিকে যথার্থ রাখা আবশ্যক। আজ পূর্ণিমার এই রজনীতে শাহের কক্ষ যে শূণ্য রেখেছো না যেয়ে, অন্যকেউ পূর্ণ করছে কি না তাও চিন্তা-চেতনায় রেখো।”

গুলবাহার খাতুন তাঁর মতোই একই পথ দিয়ে হেলেদুলে চলে যান। যামিনী তাঁর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দিলরুবাকে প্রশ্ন করে,
“জানো কে এই নারী?”

“না, বেগম। এতোটা সময় অন্দরমহলে ঘুরাঘুরি করেছি, উনাকে মাত্র দু’বার দেখলাম। উনার বিষয়ে দাসীরাও কিছু জানে না, আর খাদিমরা মুখ খুলে না। আমার তো মনে হয় তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত মাতাল। মদের কী বাজে গন্ধই না আসছিল তাঁর দেহ থেকে!”

“আমি জানতে চাই উনার পরিচয়। সাধারণ কেউ তো এতোটা দুঃসাহসিকতা দেখাতে পারবে না। তুমি চেষ্টা করো জানার উনি কে? তবে উনি যা বললেন তা নিয়ে তোমার কী মনে হয় দিলরুবা?”

“বেগম, ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। আমি জানি আমি কেউ না আপনাকে উপদেশ দেওয়ার, তবুও আমি একমত এই খাতুনের সাথে।”

“হুম। আমার এ পর্যন্ত আসা পোশাক থেকে মৃদু গোলাপি বর্ণের মোলায়েম উত্তরীয়টি বের করো। রাণী গোলাপি শালটাও। আমার সেবায় নিয়োজিত দাসীদের ডাকাও। এতোটা মোহনীয় ভাবে সাজাও আমায়, যাতে মায়াজালে ফেঁসে যান বাবু মশাই।”

যামিনী অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে তৈরি করে নিজেকে তার বাবু মশাইয়ের জন্য। অতঃপর মাথা ওড়নায় ঢেকে সে দাসীদের সাথে অগ্রসর হয় মেহমাদ শাহের কক্ষের দিকে।

মেহমাদ শাহ আগামীকাল শহরে যাওয়ার জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করতে ব্যস্ত। প্রহরী এসে জানায়,
“জমিদার নবাব শাহ, বেগম চন্দ্রমল্লিকা এসেছেন। আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন তিনি।”

“তাকে বলো আমি ব্যস্ত…”

বলতে বলতেই থেমে যায় যুবক। এই নারীটিকে কেন যেন সে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না প্রতিবারই। গোপণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়।

দরজা খোলা হয়। ধীর পায়ে প্রবেশ করে রমণী। দরজা আটকানোর শব্দে মেহমাদ শাহ চোখ তুলে তাকান। তাৎক্ষণাৎ নিজের গায়ের শাল ছেড়ে দেয় যামিনী। মেহমাদ শাহের নিকটে যেয়ে নতজানু হয়ে তার হাত দুটো ধরে আবেগপ্রবণ চাহনি নিক্ষেপ করে।

“আগামীকাল, আমার নিকট থেকে আবার মাইল মাইল দূরে চলে যাবেন আপনি। বিরহ নামক অসহ্যকর যন্ত্রণা আবারও ভোগ করতে হবে আমাকে। এই যন্ত্রণায় ডুবার পূর্বে সান্ত্বনা স্বরূপও কি আপনার ছোঁয়ায়, চুম্বনরসে সিক্ত হতে পারি না আমি?”

মেহমাদ উপেক্ষা করতে পারে না। উঠে দাঁড়িয়ে বক্ষে জড়িয়ে নেয় নিজের চন্দ্রমল্লিকাকে। তাদের জীবনের আরেকটি রঙিন রাত্রির রচনা হয়।

___

মেহমাদ শাহ চলে গিয়েছে সবার থেকে বিদায় জানিয়ে। কক্ষে এসে মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে যামিনী। দিলরুবা তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টারত।

“আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না বেগম। এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি, অনেকটা যুদ্ধ করা বাকি। এই সামান্য কথায় অশ্রুর মতো দামী মুক্তোদানার বর্ষণ করলেই অচিরেই ব্যর্থতার মুখ দর্শন করতে হবে।”

যামিনীর হৃদয়ের যন্ত্রণা আজ কথার বাণেও হ্রাস পাচ্ছে না। তীব্রতর হচ্ছে বটে। এমন সময় দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেন মোর্শেদা খাতুন।

“কী ব্যাপার? তুমি এভাবে কাঁদছো ক্যানো চন্দ্রমল্লিকা? তোমার কি কোনো অসুবিধা বোধ হচ্ছে? কোনো অসুবিধা হলে আমাকে এক্ষনই জানাও, আমার পুত্র বিশেষ ভাবে তোমাকে আমার নিকট গচ্ছিত রেখে গিয়েছে। আমি তাকে অভিযোগের সুযোগ দিতে চাই না।”

তাঁর আতঙ্কিত কণ্ঠে স্তম্ভিত হয়ে ক্রন্দন থামিয়ে দেয় কিশোরী। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে।

দিলরুবা মুখশ্রীর হাসি চাপিয়ে মাথা নত করে শুধায়,
“এমন কিছু হয়নি মোর্শেদা খাতুন। জমিদার বাবু চলে যাওয়ায় বেগমের কান্না।”

মেহমাদ শাহের প্রিয় আম্মাজান খিলখিল করে হেসে দেন। এগিয়ে এসে কপোলের অশ্রু মুছে ললাটে চুমু খান।

“কী প্রগাঢ় ও উত্তেজনাকর ভালোবাসা! মাশা আল্লাহ! নজর না লাগে কালো হৃদয়ের অধিকারীদের। তবে বেগম আপনার ভালোবাসার মানুষ একজন জমিদার। সে ঘরে বসে থাকবে কি? সে তো এ প্রান্ত যাবে, ও প্রান্ত যাবে দেশের, শহরে যাবে। তাই বলছি, ক্রন্দনরত্ন এমন বিফলে যেতে দিয়ো না।”

“ক্রন্দনরত্ন?”

জিজ্ঞেসু দৃষ্টি যামিনী। এক গাল হাসেন মোর্শেদা খাতুন। কন্যাটি যে বড়োই অনঘ (নিষ্পাপ), নির্মল এই জমিদার বাড়ির জন্য।

“নারীদের জন্য সময়, পরিস্থিতির সাপেক্ষে ক্রন্দন শুধু অনুভূতির প্রকাশই হয় না, হয় মুখ্য হাতিয়ারও সবার ভাবনার উর্ধ্বে যেয়ে।

এসব এখন থাকুক। নিজের মন, বাহ্যিকতা শুধরাও, জমিদার গিন্নিদের এভাবে মানায় না।সামান্য শহরে গেলে কাঁদার কিছু নেই। আবার তো তোমার কামরাতেই ফিরবে তাই না?”

“জী, বেগম। মোর্শেদা খাতুন একদম ঠিক বলেছেন। এবার তো একটু হাসি ফুটান মুখমণ্ডলে।”

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায় যামিনী। ভাবুক গলায় বলে,
“আচ্ছা দিলরুবা, তুমি কখনো শহরে গিয়েছো? শহর কেমন হয় দেখতে?”

“তওবা, তওবা, কী যে বলেন না বেগম! আমরা সাধারণ গ্রামবাসীরা আবার শহুরে যেতে পারি না কি? জানেন না গ্রামবাসীদের উপর অভিসম্পাত আছে শেরপুরের বাহিরে না যেতে পারার। যারা যারা এই গ্রাম ত্যাগ করে শহরের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে তিন-চারদিন পর তাদের সবার লাশ পাওয়া গিয়েছে সীমানায়। কেউ তো জীবনের ভয়ে বহু অর্থের সুযোগ পেয়েও এ দুঃসাহস দেখাবে না কখনও।”

শঙ্কায় আত্মা কম্পিত হয় রমণীর। ভীতচিত্তে মুখ খুলে,
“কী বলছো এসব দিলরুবা? বাবু মশাই তো সবে শহরের উদ্দেশ্যে বের হলো। তার কোনো ক্ষতি হবে না তো?”

“না, না, বেগম। তাঁর ক্যানো ক্ষতি হবে? জমিদার বংশের সকলেই তো আল্লাহর বিশেষ রহমত প্রাপ্ত। তাঁদের কখনও কোনো বিপদ বা বাধা আসেনি শহুরের পথে। এ অভিসম্পাত শুধুমাত্র সাধারণ মানুষদের উপরেই।”

“অদ্ভুৎ অভিসম্পাত! মর্যাদার ভিত্তিতে পরিণাম পরিবর্তন…”

“নীরব হও উভয়ে!”

আচমকাই ধমক দিয়ে উঠেন মোর্শেদা খাতুন। তাঁকে যেন বিচলিত হতে দেখতে পেল যামিনী। অবাককর লাগলো বিষয়টি।

হয়তো অসামঞ্জস্য পূর্ণ আচারণ করে ফেলেছেন তিনিও বুঝতে পেরেছেন। তাই ঠোঁট ভিজিয়ে মৃদু হেসে উপদেশ করেন,
“আসলে যোহরের আজান দিবে একটু বাদে। তবে এখনও স্নান নেওনি চন্দ্রমল্লিকা, তাই বলছিলাম। যোহরের সালাতের পরই ভোজনশালায় এসে পড়বে পরিবারের সদস্যেরা। তাই দিলরুবা গল্প-গুজুব বাদ দিয়ে বাকি দাসীদের নিয়ে চন্দ্রমল্লিকার জন্য হাম্মামখানা প্রস্তুত করো।”

হ্যাঁ বোধক ইশারা করে দিলরুবা। তিনি বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে যান। যামিনীর অদ্ভুৎ লাগছে এ বাড়িকে, সব কিছুই কেমন যেন বেমানান, রহস্যঘন, ছদ্মবেশী।

___

বাগানে বসে শরবতের স্বাদ নিতে নিতে গৌধূলী লগ্ন উপভোগ করছে যামিনী। তার মনোরঞ্জনে বাধাদান করে একজন দাসী এসে উপস্থিত হয়।

জানায়,
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আপনাকে অতি শিঘ্রই তাঁর কক্ষে উপস্থিত হতে আদেশ করেছেন বেগম লুৎফুন্নেসা।”

প্রতিটি কোষ কোষ কম্পিত হয় যামিনীর। শঙ্কিত সে, কী হতে চলেছে তার সাথে?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here