চন্দ্রপুকুর,১৩তম পর্ব,১৪

0
534

#চন্দ্রপুকুর,১৩তম পর্ব,১৪
-ঈপ্সিতা শিকদার

গোটা অন্দরমহলে যেন ঈদের উচ্ছ্বাস লেগে আছে। দাস-দাসী ও খাদিমরা ব্যস্ত নিজ নিজ কার্য সম্পূর্ণ করতে। রন্ধনশালা হতে খাবারের সুবাস ছড়িয়ে গিয়েছে, যা ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতে জিভে জল এসে পড়ছে প্রায় প্রত্যেকেরই।

মেহনূর সকল থেকেই ব্যস্ত নিজেকে নবাবের চরণে অর্পণ করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করতে। দ্বিতীয় তলায় দাঁড়িয়ে থেকে মানুষের কাজকর্ম ও কলরব দেখছে সে।

মনে মনে বলছে,
“বলেছিলাম শাহ আপনি আমার হবেন। হচ্ছেনও। আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি, আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।”

“শাহাজাদি, দেখছেন তো কী আমেজ আপনার বিবাহের! অবশেষে শেরপুর তার আসল জমিদারনিকে পাবে। তবে তাড়াতাড়ি আসুন শাহাজাদি কারিগর ঐ নারী আপনার জন্য বেনারসি নিয়ে অপেক্ষা করছে।”

সায় জানিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে রমণী। কক্ষের এক ভাগ জমিন জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রগরগে রঙের নিখুঁত হস্তে তৈরি বেনারসি। তবে মেহনূরের হৃদয় ছুঁতে পারছে না কোনোটাই।

“এগুলো আমার যোগ্য নয়। আপনার নিকট গাঢ় টকটকে লাল রঙের বেনারসি নেই?”

“কী যে বলেন শাহাজাদি! এখন আর লাল শাড়ি পরার যুগ আছে? এখন যুবতীরা নীল, গোলাপী, সবুজ কত রঙা শাড়ি পরে।”

“আমি শাহাজাদি মেহনূর, কোনো সাধারণ নারী নই। আমাকে অন্যের মতো ভাবার ভুল না করাই শ্রেয়।”

যুবতী মিষ্টির হাসির সহিত শক্ত কথা খানা শুনে বিক্রেতার হাসি বিলীন হয়ে যায়। সাথে আনা বস্তা খানা হতে লাল বেনারসিগুলো বের করে।

একটা শাড়ি এপিঠ ওপিঠ করে দেখতেই মুখশ্রীতে বিদ্যমান হাসি বিস্তৃত হয় মেহনূরের।
“অতি মনোমুগ্ধকর! এই বস্ত্রটিই আমার যোগ্য, আমার রূপ আজ ঐ চাঁদকে জ্বলাবে। আপনি প্রস্থান করতে পারেন এখন।”

বিক্রেতা নিজের সাথে আনা কারিগরদের দিয়ে শাড়িগুলো গুছিয়ে নিয়ে বিদায় হয়। মনে মনে একশত বকা দেয় ক্রেতা নারীটিকে তার অনাকাঙ্ক্ষিত আচারণের জন্য।

মেহনূর বেনারসি শাড়িটি গায়ে জড়িয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে নিজেকে দর্পণে। রত্নার মুখমন্ডলেও চওড়া হাসি বিদ্যমান প্রিয় মনিবের আনন্দে।

“শাহাজাদি, কিছু মনে করবেন না। একটা প্রশ্ন করছি। এতো রঙ থাকতে এই গাঢ় রগরগে লাল রঙটাই ক্যানো পছন্দ করলেন? আপনার প্রিয় তো নীল।”

“লোকে বলে লাল ভালোবাসার রঙ, তবে লাল কিন্তু উদ্দীপনা, উষ্ণতা এবং কামের রঙও। আমি আমার ভালোবাসাকে পেতে চলেছি, তবে আমি তার ভালোবাসা নই। তবে তার নিকট কামনাময়ী তো হতে পারি।”

রত্না অপলক দৃষ্টিতে শ্রবণ করে তার কথা। বাণীগুলো উচ্চারণ করার সময় রমণীর মুখে যেন অন্যরকম উত্তেজনা, উদ্দীপনা ও তৃপ্তি।

“যাকগে আমার জন্য মুলতানি মাটি, চন্দন ও কাঁচা হলুদ বাটার ব্যবস্থা হয়েছে। অনেক মোহনীয়, আসক্তিকর লাগতে চাই আমি আজ।”

“অবশ্যই শাহাজাদি। সব ব্যবস্থা করা আছে, শুধু আপনার হাম্মাম খানায় প্রবেশ করতে দেরি।”

___

যামিনী নিজের কামরার বাহিরে দাঁড়িয়ে উৎসবের উদ্দেশ্যে সকলের তোরজোর দেখছে। তার মুখশ্রীতে বাঁকা হাসি স্থির।

কণ্ঠ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছিয়ে সে অন্দমহলের মাঝ বরাবর যেয়ে ডাকতে শুরু করে দাসীদের৷

“কী হলো মেয়েরা? তোমরা কোথায় গিয়ে মরেছো? মহলে অনুষ্ঠানের রঙ লেগেছে, আমাকে তৈরি হতে হবে না? কতো বার ডাকিয়েছি। আসোনি তারপরও। ভুলে গিয়েছো আমি কে? জমিদারনি আমি, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। এক মুহূর্তের মাঝে শ্বাস কেড়ে নিব।”

উপস্থিত প্রতিটি দাসী, খাদিম মাথা নত করে দাঁড়িয়ে। আড়চোখে প্রশ্নসূচক চাহনিতে দেখছে রমণীকে। চেনা বেগমের এমন অপরিচিত ও অসামঞ্জস্য আচারণে এই প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক।

“নিঃশ্চুপ হয়ে আছো ক্যানো? এখন আসো আমরা কামরায়। দিলরুবা পাঁচজন কর্মঠ দাসী নিয়ে আসো।”

“যথা আজ্ঞা বেগম।”

কিশোরী মাথার ওড়নাটা আরও ভালোভাবে টেনে পরে নিয়ে হনহন করে কক্ষে চলে যায়। তার পিছন পিছন অন্যান্য দাসীদের নিয়ে প্রবেশ করে দিলরুবা।

“দিলরুবা যে উত্তরীয়গুলো এনেছো ঐ শহুরে কারিগর থেকে, তা এক এক করে দেখাও। আর দাসী তোমরা আমার জন্য হাম্মাম খানা প্রস্তুত করো। চন্দন, গোলাপ জল, বেলি, দুধ ও মধুর ব্যবস্থা করা আবশ্যক। আর তোমরা আমার গায়ে জয়তুনের তেল মালিশ করে দাও। আজ রাতে আমি নিজেকে নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপে দেখতে চাই।”

দাসীরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে দ্বিধান্বিত হৃদয়ে। আজই প্রথম তারা দেখছে কোনো নারীর তারই স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে এতো উদ্দীপনা।

“কী বলেছি কানা যায়নি! যাও নিজ নিজ কাজে!”

তার ধমক যেন মহা ঔষধি হলো। বিদায় জানিয়ে কার্য সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ছুটলো সকলে।

খাটিয়ার উপর বক্ষ মিলিয়ে শুয়ে আছে যামিনী। তিনজন দাসী তাকে মালিশ করতে ব্যস্ত। দিলরুবা এবং আরেক জন দাসী তাকে তার চয়ন করা শাড়িগুলো দেখাচ্ছে।

কিশোরী প্রতিটি শাড়িকেই প্রত্যাখ্যান করছে, প্রতিটিই যেন হতাশ করছে তাকে। হুট করেই তার নয়নযুগল বিমোহিত হয় ময়ূরপঙ্খী রঙের শাড়িটিকে দেখে।

“এই ময়ূরপঙ্খী রঙা বস্ত্রটিই আমার ও আজকের দিনের জন্য সুযোগ্য। আয়েশা খাতুনের মুখে একবার শুনেছিলাম এই রঙ আভিজাত্য, মর্যাদা ও রাজকীয় সম্মানের প্রতীক। আমি আজই আমার ভাগ্যের দ্বারা প্রাপ্ত আভিজাত্য ও রাজকীয় মর্যাদাকে আপন করে নিব।”

এর মাঝেই একজন দাসী এসে জানায়,
“বেগম, আপনার জন্য হাম্মামখানা প্রস্তুত।”

“চলো, তবে যাওয়া যাক।”

___

অন্দরমহলের বৈঠকখানায় কাবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজী ও মেহমাদ শাহ ব্যাতিত কোনো পুরুষ উপস্থিত নেই, তাদেরও পর্দার দ্বারা পৃথক করা হয়েছে। অন্যপাশে সকল নারী।

একটু বাদেই মেহনূর উপস্থিত হয়। তার রূপ যেন উপচে পড়ছে। নারীটি এমনিতেই অসামান্য সৌন্দর্যের অধিকারী, সাজসজ্জা ও পোশাকের রগরগে রঙ যেন সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

দেখেই সকলে উচ্চারণ করে, “মাশাআল্লাহ!”।

বেগম লুৎফুন্নেসা নিজ আসনে মৃদু হাসি নিয়ে বসে। বেগম নূর বাহারের মুখশ্রীতে তো রাজ্যের হাসি। মেহমাদ শাহ গুরুগম্ভীর, তার হৃদয় ও মস্তিষ্কে কী চলছে তা বোধগম্যতার বাহিরে।

বেগম নূর বাহার বললেন,
“কাজী সাহেব, এবার কাবিনের কার্যক্রম শুরু করু আল্লাহর নাম নিয়ে।”

“থামুন! এই বিয়ে সম্ভব নয়।”

বজ্রকণ্ঠ শুনে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো সকলে বাক্যের উৎসের দিকে। যামিনীকে দেখে আরও চমকিত হলো, সেই সঙ্গে বেশ ক্ষুব্ধও পরিবারের সদস্যগণ।

“স্পর্ধা কী করে হয় তোমার কন্যা এ বিষয়ে দখলদারি করার!”

“এসব ছোটোলোকদের এটাই সমস্যা। বসতে দিলে শুতে চায়। কত বড়ো স্পর্ধা!”

হেসে দেয় যামিনী মৃদু শব্দ করেই। হাসি থামিয়ে বেগম নূর বাহার ও বেগম লুৎফুন্নেসার দিকে ধ্যান দেয়।

“স্পর্ধা তো আমার থেকে আপনাদের অধিক। তা-ই তো নিয়ম ভঙ্গ এবং অমান্য করছিলেন। আমি তো আরও যোগ্য জমিদারনির দায়িত্ব পালন করছি।”

“এই মেয়ে কী বলছো তুমি এসব? পরিস্কার ভাবে কথা বলো বেয়াদব।”

“পরিস্কার কথাই তো বলছি। আপনাদের স্পর্ধা সীমা লঙ্ঘন করেছে বলেই তো নবাব ইউসুফ শাহের উইল ও নবাব বংশের আইন বদল করতে চলেছিলেন। এখনও বুঝেননি আম্মিজান?”

দাদীজানকে একটু বিচলিত হতে দেখা গেল। বেগম নূর বাহারের প্রতিক্রিয়া আগের ন্যায়ই।

“কীসের নিয়ম? কী বলছো তুমি?”

“খুব সহজ আম্মিজান। নবাব বংশের নিয়ম এবং দাদাজান নবাব ইউসুফ শাহের উইল অনুযায়ী কোনো জমিদার বংশের সদস্য বা শাহাজাদা বা জমিদার বিবাহ ব্যাতিত কোনো নারীর নিকট যেতে পারবে না এবং জীবনের প্রথম নারী তথা স্ত্রীর মৃত্যু না হওয়া অবধি দ্বিতীয় বিবাহ তো দূরে থাক অন্য নারীর সংস্পর্শেও আসতে পারবে না। যদি আসে তবে গোটা জমিদারি ও শেরপুরের সম্পত্তি থেকে তাকে ত্যাজ্য করা হবে। সে শেরপুরেও কোনোদিন প্রবেশ করতে পারবে না।”

সকলে স্তব্ধ। মেহমাদ শাহের মা তো সবচেয়ে অধিক।

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি শুধালেন,
“আম্মিজান, আপনি কিছু বলছেন না ক্যানো এই অসভ্য কিশোরীকে।”

“অদ্ভুৎ! আমি ভুল কিছু বলেছি না কি যে কিছু বলবেন দাদীজান? একদম শতভাগ সত্য বলেছি। এজন্যই দাদীজানের খুব কাছের একজনকে শেরপুর ছাড়া হতে হয়েছিল, তাই না দাদীজান?”

বেগম লুৎফুন্নেসা নৈশব্দে নিজের আসন থেকে উঠে চলে গেলেন। এর দ্বারা সবারই বোধগম্য হলে যামিনীর বচন সত্য।

“আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকা কাজী সাহেব। আপনি এখন যেতে পারেন। এখানে কোনো বিবাহ অনুষ্ঠান হচ্ছে না। হচ্ছে তো শুধু বেগম চন্দ্রমল্লিকা ও জমিদার মেহমাদ শাহের বিবাহের আনন্দ উদযাপন।”

কাজী সাহেব কিছু না বলেই উঠে চলে গেলেন। মেহনূর ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে হনহন করে বেড়িয়ে গেল বৈঠকখানা হতে।

যামিনী রাজ্য জয়ের হাসি দিল। তার ইশারাতে পর্দা খুলে দিল দিলরুবা। রমণী এগিয়ে যেয়ে নিজের বাবু মশাই তথা মেহমাদ শাহের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো, ইতিমধ্যে যুবক আসন ত্যাগ করে দাঁড়িয়েছে।

নিজের হাতের কঙ্কন দু’টো খুলে দিয়ে দিলরুবার হাতে ধরিয়ে দেয়। ঘোষণা করলো,
“আমাদের বিবাহ উপলক্ষে তোমাদের কিছু দেওয়া হয়নি। এই দু’টো আমাদের পক্ষ হতে। খাবার উপভোগ কোরো।”

অন্দরমহলে বিদ্যমান দাসী ও খাদিমদের মাঝে আনন্দ দেখা গেল। অতঃপর যামিনী ও মেহমাদ শাহ উভয়ই নিজের মতোম বিদায় হলো সেই স্থান থেকে।

এদিকে শাহাজাদি মেহনূর নিজের কক্ষে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছে আক্রোশ ও ক্রোধ না নিয়ন্ত্রণ করতে পেরে। নিজের দেহের গহনাও ছিড়ে ফেলছে। এক সময় ক্লান্ত হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই বসে পড়ে সে।

___

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, এই চন্দ্রপ্রভা রাত্রি যাপন করার জন্য আপনাকে কামরায় আগমনের নির্দেশ দিয়েছে জমিদার নবাব শাহ।”

দাসীর কথা শুনে অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে তাকালো যামিনী।

চলবে…

#চন্দ্রপুকুর
||১৪তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, এই চন্দ্রপ্রভা রাত্রি যাপন করার জন্য আপনাকে কামরায় আগমনের নির্দেশ দিয়েছেন জমিদার নবাব শাহ।”

দাসীর কথা শুনে অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে তাকালো যামিনী। ঠিক দাসী নয়, নারীটি মহাপরিচারিকার সহকারী মধ্যবয়সী মালিহা খাতুন।

“মালিহা খাতুন, আপনি খবর পাঠান আমি আসছি। তাঁর উদ্দেশ্যে তৈরি হবো, একটু সময়ের তো প্রয়োজন।”

“আপনার মর্জি বেগম। বিদায়।”

মালিহা খাতুন বেড়িয়ে যান। রমণীর মুখে ফুটে উঠে তীব্র ক্ষোভ ও ক্রোধ। ঠোঁট কামড়ে ধরে

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, কিছু ভাবছেন বুঝি আপনি? তবে আজ যা হলো না খুব ভালো হলো। ঐ শয়তান মেহনূর এবার বুঝবে আসল বেগম কে। তবে চিঠিটা কে পাঠালো?”

“চিঠি কে দিয়েছে সেটা মুখ্য বিষয় না। চিঠিতে থাকা তথ্য আমাদের কাজে এসেছে সেটাই মুখ্য।”

“বেগম, ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। আপনাকে সমর্থন করে বা পছন্দ করে এমন কেউ নবাববাড়িতে নেই। অপছন্দ করে এমন অনেকেই আছে বটে। তবে আপনাকে সহায়তা করার উদ্দেশ্য কিছু একটা তো হবেই। কারণ এই নবাববাড়ি কিছুই কারণ ছাড়া হয় বা। তাই সেই মানুষটিকে চেনা এবং তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক।”

“তা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছো দিলরুবা। চিঠির রহস্য তো আবিষ্কার করতে হবেই। মহাপরিচারিকার ও অন্দরমহলের অন্যান্য দাসী ও খাদিমদের থেকে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করো। কেউ দেখেছিল কি না চিঠিদাতা কে। তবে হ্যাঁ, সবটাই যেন আড়ালে হয়, সম্পূর্ণ গোপনে। আর সব কিছুর পূর্বে বর্তমানে অন্য কাজ সম্পন্ন করতে হবে।”

সচকিত হয়ে প্রশ্ন করলো দিলরুবা,
“অন্য কাজ?”

“আমাকে তৈরি হতে সহযোগিতা করো। দাসীদের ডেকে আনো। আমি আজ এমন মদ হতে চাই, যাকে দেখেই মাতাল হয়ে যায় বাবু মশাই। কারো হৃদয় ভাঙতে হবে, তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে চাই।”

রগরগে রাণী গোলাপি বর্ণের পোশাক, পুরোটা জুড়ে সোনালী সুতোর কাজ। দিলরুবা সহ প্রতিটি দাসীরই চোখজোড়া থমকে যায় এর সৌন্দর্যে।

“কী সুন্দর দেখতে! একদম নয়ন ধাঁধানো সুন্দর!”

যামিনীর অধরজোড়ায় বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। ইচ্ছাকৃত ভাবেই দাম্ভিকতার সহিত বলে উঠে,
“জমিদার মেহমাদ শাহ মানে আমার বাবু মশাই আমাকে উপহার দিয়েছেন। সুদূর কলকাতা থেকে আনা।”

উপস্থিত সকল নারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঈর্ষা এবং ভালোবাসার আনন্দ উভয়ই বোধ হয় সকলের।

মূল্যবান বস্ত্র, অলংকার, সুগন্ধি ও সজ্জায় নিজেকে রাঙিয়ে ফেলে রমণী। অতঃপর চুল, মুখশ্রী ও গায়ে বেগুনি বর্ণের রাজকীয় ওড়নাটি জড়িয়ে নেয়।

একদা ভেবেছিল এই নবাববাড়ির আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক ওড়নাটি সে সবার সমর্থন অর্জন করার পরই পরিধান করবে। পরিস্থিতির নিষ্ঠুরতা তার নীতি পরিবর্তন করেছে আজ বটে।

___

মেহমাদ শাহ তার খাঁস ভৃত্য মিনারের নিজ কামরায় বসে আছে বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে। এমন গম্ভীরতর পরিস্থিতিতেও এই জমিদারির দায়িত্ব পালন হতে মুক্তি নেই।

মিনার খেয়াল করে তার মনিব কাজের মাঝেই হুটহাট মিটমিট হাসছে। আশ্চর্য বোধ হয় তার, এই পুরুষটিকে কাজের সময়ে হাসতে তো দূরে থাক, গম্ভীরতা ব্যতীত চেহারাতে কোনো কিছুই অবস্থান করে না।

“জমিদার নবাব শাহ, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি জানি সামান্য দাস হয়ে আপনাকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা আমায় মানায় না। তবুও আমার শাহের এতো দিন থাকা মলিন মুখশ্রীতে এই সুন্দর হাসির কারণ জানতে প্রচণ্ড মন টানছে।”

যুবক কাগজপত্র থেকে চোখ উঠিয়ে মিনারের নত মুখ খানার দিকে নজর দেয়। তার মুখমণ্ডলে তখনও মুচকি হাসি লেগে আছে।

“মিনার, তোমাকে আমি আমার ছোটো ভাইয়ের ন্যায় ভাবি। আর এর সম্পর্কে তুমিও জ্ঞাত। আর মুখের হাসি, তা হলো ক্ষণিকের মোহের ন্যায়। এই থাকে, এই যায়। তবে আসে কারো কর্মেই, হয় নিজের, না হয় অন্যের। আমার মুখশ্রীর এই হাসির সাক্ষাৎ কোনো মুগ্ধতার দরুনই। আর তা একটু ভাবলে তুমিও বুঝে যাবে।”

আলতো হাসে মিনার। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়।

“তোমাকে কিছু একটা আনতে বলেছিলাম মিনার। এনেছো?”

“অবশ্যই হুজুর। আপনি বলবেন, আর আমি সে কাজ সমাপ্ত করবো না তা কি আর হয়? একদম অনন্য পাথর ও হিরায় জড়ানো আংটিটি। আপনি যেমন আকারের চেয়েছিলেন তেমনই।”

নিজের হাতে থাকা ছোট্ট কাঠের বাক্সটি এগিয়ে দেয় সে। মেহমাদ শাহ তা হাতে নিতেই দ্বার খোলার শব্দ, প্রবেশ করে যামিনী। মিনার তাকে দেখে বিদায় জানিয়ে মাথা নত করে বেড়িয়ে যায়।

মেহমাদ শাহ এগিয়ে যেয়ে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে তার চন্দ্রমল্লিকাকে। তার চুলে মুখ ডুবিয়ে দীর্ঘ প্রশ্বাস নেয়, এতো ক্ষণে যেন তার তৃষ্ণা মিটলো। গায়ের ওড়না ফেলে দিল যামিনী।

দু’হাত ধরে আবেগ সিক্ত চুমু খেয়ে বললো,
“স্বাগতম আমার চন্দ্রমল্লিকা। আমার হৃদয় যেন থমকে ছিল তোমার জন্য। আমার আঁধারিয়া ঘরে চন্দ্রের প্রবেশ হলো। এটা উপহার তোমার জন্য।”

যামিনী গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো তার বাবু মশাইয়ের দিকে। বক্ষে মাথা ঠেকালো।

“আমার হৃদয়টাও থেমে গিয়েছিল আপনাকে হারানোর চিন্তায়। থেমে গিয়েছিল আমার সবকিছু। অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলাম আমি, হারিয়ে যাচ্ছিলাম বাবু মশাই। আপনাকে ডেকেছিলাম বারবার আমার হস্ত খানা আঁকড়ে ধরে আমায় এই আঁধারিয়া নদ থেকে তুলে নিতে।

আফসোস আমার কণ্ঠ তো আপনার কর্ণে পৌঁছিয়েছে আপনি আসেননি। আপনি তো মোহে ডুবে ছিলেন কারো রূপের, বন্দী হয়ে গিয়েছিলেন কারো আয়না ঘরে। আমায় মনে পড়েনি আপনার। যেই আমি সেই আয়না ভেঙে চুরমার করলাম সেই আপনার নিকট আমার মূল্য হলো। কতো অদ্ভুৎ!”

তাচ্ছিল্যে মাখামাখি রমণীর কণ্ঠ ও হাসি। বুক থেকে সরে আসে সে। অত্যন্ত কাছে যেয়ে দাঁড়ায় মেহমাদ শাহের।

চোখে চোখ রেখে শুধায়,
“আপনার বিবাহের স্বপ্নে অগ্নি দিলাম। আপনি চন্দ্রপ্রভাকে কখনোই পাবেন না। আপনার আঙিনায়, বাগানে একমাত্র চন্দ্রমল্লিকার বাস হবে। যেখানে তাকাবেন, সেখানেই আমি থাকবো। তবে আমাকেও পাবেন না আপনি। আর এই উপহারটাও গ্রহণ করলাম, কারণ আপনার সবকিছুতেই শুধু আমার অধিকার।”

যামিনী কথাটা বলেই নৈশব্দে শয্যায় যেয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। সে গমন করতেই মেহমাদ শাহের গম্ভীর মুখশ্রীতে এক গাল হাসি ফুটে উঠে।

কিশোরীর তেজস্বী, ক্রুব্ধ ও গর্বিত রূপ তার নিকট অপছন্দনীয় কি আদৌ? তবে তার মনে উদিত প্রশ্ন হলো, এই গোপনীয় তথ্য সম্পর্কে তো সে নিজেই জ্ঞাত নয়, তবে কে জানালো? যদিও প্রশ্নটির উত্তর নিয়ে এখন মাথা ঘামাতে ইচ্ছুক নয় সে।

ধীর পায়ে এগিয়ে শয্যার পাশের চৌপায়ায় রাখা কাঠের বাক্সটি থেকে আংটিটি পরিয়ে দেয় তার প্রেয়সীকে। ললাটে ভালোবাসা সিক্ত স্পর্শ এঁকে আপন মনে বিড়বিড়ায় সে,
“আমার বাচ্চা বাঘিনী।”

___

এসপি সাহেব এসেছেন বেগম লুৎফুন্নেসার সাথে সাক্ষাৎ করতে। অনুমতি পেয়ে কক্ষ প্রবেশ করে সে।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম লুৎফুন্নেসা। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি এখানে কী করছো? তোমাকে আমি শেরপুর ত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছিলাম আমি।”

“আপনার আদেশ আমার জন্য সর্বপ্রথম। তবে প্রথমে এই চিঠিটা পড়ে নিন।”

প্যান্টের পকেট হতে ছোট্টো কাঠের বাক্সটি বেড় করে। খুলে চিঠিটি বেড় করে এগিয়ে ধরে। বেগম লুৎফুন্নেসা ইশারা করে আয়েশা খাতুনকে। তিনি নিয়ে আসেন চিঠিটি।

তা পড়ে শক্ত দৃষ্টিতে তাকায়।
“তুমি যেতে পারো। শুধু এ বারের জন্য তোমার ত্রুটি ক্ষমা করলাম, পরের বার এমন হাজারটা চিঠিও কাজে আসবে না।”

এসপি মাথা ঝুঁকে মাথা উপর নিচ করে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। কক্ষের দ্বার হতে বাহিরে পা রাখতেই তার মুখশ্রীতে বিস্তীর্ণ হাসি ফুটে উঠে।

বিড়বিড়ায়,
“জাদুর বাক্স! জাদুর বাক্স! সব কাজই সমাপ্ত করে জাদুর বাক্স।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here