#চন্দ্রপুকুর,৩৭তম পর্ব
– ঈপ্সিতা শিকদার
নিজেকে সামলে মেহমাদ শাহ জিজ্ঞেস করে,
“বিশিষ্ট সাংবাদিক আর.কে. হকিংস! তিনি কেন আসছেন? আর তাঁর সাথে মেহনূরের আগমনের সম্পর্ক কী?”
“শেরপুর ভ্রমণ করতে, সে আমাদের শাসন ও স্থান নিয়ে ডকুমেন্টারি করতে চান, আর্টিকেল লিখবেনও হয়তো। আর আমার সিংহ, তুমি জানো না কী সম্পর্ক মেহনূরের আগমনের? চন্দ্রমল্লিকা জ্ঞাত এই নবাববাড়িতে চাপা পড়া রহস্য সম্পর্কে? যা লোকচক্ষুর সামনে আসলে ধ্বংস নামবে।”
“তবে চন্দ্রমল্লিকাকে ব্যক্তিগত ভাবে আমরা সকলে জানা ও বোঝাই এই রহস্য। তাহলেই তো হয় দাদীজান।”
বিরক্তি মাখা চাহনি নিক্ষেপ করে বেগম লুৎফুন্নেসা।
“মতিভ্রষ্ট হয়েছে তোমার না কি? জানো না ও গ্রামের কন্যা, তোমার আম্মিজান বা আমার ন্যায় এই বংশের বা শহরের মেয়ে নয়। যদি গ্রামের মানুষের কথা ভেবে রহস্য উন্মেচন করে ফেলে তখন…?
তাই বলছি তাড়াতাড়ি একটা সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দর্শন করাও। তবে তার পায়ে বেঁধে যাবে দরি, আর আমরাও তখন দ্বিধাহীন হয়ে গোটা গুপ্ত কথা তাকে জানাতে পারব।”
কিছু না বলেই ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে যুবক। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়।
“তোমার বিবাহের খবর শহরেও পৌঁছিয়েছে, জমিদারনি হিসেবে কাউকে তো বেগমের বেশ ধরে সাংবাদিকদের সম্মুখে যেতে হবে। শহুরে বাবুদের সাথে কথা বলতে হবে। এই নবাববাড়ির যে রহস্য অন্তরালে আছে, তা অন্তরালে রাখতে এ কাজ করবে শাহাজাদি মেহনূর।”
“আমির হাওলাদার অর্থাৎ ফুপাজান কি পুনরায় পাঠাবেন তাঁর আদরের কন্যাকে? যেখানে এক দফা অপদস্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে।”
কিছুটা রহস্যচ্ছলে দাদীজান উত্তর দেন,
“সে বিষয়ে তোমার ভাববার প্রয়োজন নেই। তুমি শুধু পাশে থেকো, সমর্থন করো। আর ভাবতে হলো চন্দ্রমল্লিকাকে নিয়ে ভাবো। সে যদি উত্তরাদিকার দিতে অসক্ষম হয়, তবে জানোই কী হবে।”
হাতের মুঠি শক্ত হয় যুবকের। নয়নযুগল অসহায়ত্ব ও ক্রোধে জ্বলজ্বল করছে।
“আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি, দাদীজান। তবে মেহনূর যেন আমার চন্দ্রমল্লিকা হতে দূরে থাকে। এবার যদি সে চন্দ্রমল্লিকার ক্ষতি সাধনের চেষ্টাও সে করে তবে আল্লাহর শপথ তার গর্দান যাবে।”
“যাকে এভাবে রক্ষা করতে চাচ্ছো, সে যদি বাঞ্ছা হয় তখন তাকে ব্যতীত থাকবে কী করে? নিজেকে সামলে নেও আমার সিংহ, জমিদারদের জমিদারি ছাড়া অন্য কিছুতে মন দেওয়ার অধিকার নেই।”
“আমার নিজেকে সামলানোর প্রয়োজন নেই, দাদীজান। চন্দ্রমল্লিকা অক্ষম হলেও প্রয়োজনে আমি তাকে স্ত্রী স্বরূপ রেখে আরেকটি বিবাহ করব। যা আমার সাথে আপনার পূর্বেও কথা হয়েছিল।
তবে তালাক দান? তা কখনোই হবে না আমার দ্বারা। তাই স্পষ্ট ভাবে বলে দিচ্ছি কেউ যদি আমার হতে তাকে পৃথক করার সামান্য চেষ্টা করে আমি প্রলয় হয়ে সব ধ্বংস করে দিব, ওয়াদা।”
দাঁতে দাঁত চেপে বচনগুলো উচ্চারণ করে কক্ষ ত্যাগ করে সে। বেগম লুৎফুন্নেসা অদ্ভুৎ ভাবে বেশ নির্লিপ্ত পৌত্রের কার্য দর্শনের পরেও।
___
মেহমাদ শাহের কক্ষে বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছে যামিনী। তার চোখ-মুখ ফুলে আছে ক্রন্দনে। বারবার কপোল মুছছে হাতের পিঠে, যদিও পরমুহূর্তেই আঁখিজলে ভিজে যাচ্ছে তা।
দ্বার খোলার শব্দে নোনাজল মুছে উঠে দাঁড়ায় রমণী। মাথা ঝুঁকে সালাম জানায় মেহমাদ শাহকে।
“আসসালামু আলাইকুম, বাবু মশাই। আল্লাহ আপনাকে নেক হায়াত দান করুক।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি এখানে যামিনী?”
যুবকের উচ্চারিত ‘যামিনী’ শব্দটি কর্ণকুহরে পৌঁছালে মানসিক ধাক্কা লাগে তার। মানুষটি যখন তার উপর অসন্তুষ্ট হয় তখনই এই নামে ডাকে তাকে, তা সম্পর্কে সে জ্ঞাত।
“এমনিতেই আপনাকে দেখতে মন চাইলো। আপনার কি কোনো কারণে মন খারাপ বাবু মশাই?”
“সে বিষয়ে তোমার জানার প্রয়োজন নেই। দাসীকে আদেশ করো অন্দরমহলের বা’দিকে যে শূন্য কামরাগুলো আছে তার দু’টি পরিষ্কার করে রাখতে, শাহাজাদি মেহনূর আসছে। হয়তো ফুপিজানও আসবেন সাথে।”
হৃদয় পাহাড় সম ভার অনুভব হয় তরুণীর। তবুও নিজেকে সামলে নেয়।
আজ যে তার নিজের প্রিয় পুরুষটিকে কেমন যেন অচেনা লাগছে। যেমনটা লেগেছিল সেই পাঁচ বছর পূর্বে শাহাজাদি মেহনূরের সাথে বিবাহের সংবাদ শ্রবণ করার পর।
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বাবু মশাই। আপনি তো শাহাজাদি মেহনূরকে এই নবাববাড়ি হতে বহিষ্কার করে দিয়েছিলেন। তবে আবার সে কী করে ফিরে আসছেন এই অন্দরমহলে পুনরায়?”
“তোমার জন্য।” কিছুটা চাপা ক্রোধের আভাস তার জবাবে।
অবাক হয় যামিনী। বিড়ম্বনাতেও পড়ে।
“মানে? বুঝলাম না বাবু মশাই।”
“মানে তেমন বিশেষ কিছুই নয়। দিন তিনেক বাদে শহুরে বাবুরা আসছেন এই শেরপুর ঘুরে দেখতে। তাদের সম্মুখে তোমার পরিবর্তে মেহনূর আমার স্ত্রী ও বেগম রূপে যাবে।
তারা যতোদিন থাকবে, ততোদিন তুমি একটু আড়ালে থাকবে। আর এমন কোনো ঝামেলা ঘটানো আমি চাই না যার জন্য তাদের সামনে সত্য চলে আসুক। সুতরাং, মেহনূরের সাথে তোমার কোনোরকম তর্কাতর্কি আমি শুনতে চাই না।”
বিস্ময় ও বেদনা ভরা নয়নে তার কথাগুলো শুনলো আঁধার কন্যা। অশ্রু রোধে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
কোনোরকম উচ্চারণ করে সে,
“কিন্তু আপনার স্ত্রী তো আমি…”
মেহমাদ শাহ কঠোরতার মাঝেই কিছুটা নম্র হয়।।নমনীয়তার সাথে তার বাহু আঁকড়ে ধরে।
“দেখো চন্দ্রমল্লিকা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভেবো না। যতোটুকু বলা হয়েছে ততোটুকুই কর্মতে রূপান্তর করো। দেখো শহুরে বাবুরা আসবে, তাদের সাথে কথা বলায় অনেক বিষয় আছে, অনেক কিছু খেয়াল রাখার আছে।
তুমি লৌকিক সভায় ভাষণদানে একদম অপটু, নব। তোমার দ্বারা কোনো ত্রুটি সম্পাদন হতে পারে, যার জন্য গোটা জমিদার বংশ প্রশ্ন উঠবে। তাই এই ব্যবস্থা করো।
সমর্থন করো, অযথা কোনো সমস্যা দাঁড় কোরো না বা সমস্যা ভেবে নিজেকে ব্যস্ত কোরো না।”
“যথা আজ্ঞা, বাবু মশাই।”
কোনোরকম বিদায় নিয়ে যামিনী বেড়িয়ে যায়। নিজের ব্যক্তিগত কামরার সম্মুখে আসলে দিলরুবা প্রশ্ন করতে এগিয়ে আসে।
“আমি একা থাকতে চাই।”
হুড়মুড়িয়ে কক্ষে ঢুকে দরজা লাগায় সে। দোয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দেয় সে।
“আল্লাহ, আমাকে শক্তি দান করো। আমাকে শক্তি দান করো, উপায় দেখাও। আমি যাতে এই কঠিন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে পারি।”
___
অন্দরমহলে দাঁড়িয়ে আছে সকল দাসী। বেগম লুৎফুন্নেসা নিজের নরম গদিতে বসে, তার চোখজোড়ায় অন্য রকম তৃষ্ণা। বেগম নূর বাহার এবং যামিনী তার পাশে দাঁড়িয়ে।
আজ প্রায় পনেরো বছর পর এই নবাববাড়িতে পা রাখছেন এ বংশের একমাত্র কন্যা শাহাজাদি জান্নাতুল।
মেহমাদ শাহ প্রবেশ করেন শাহাজাদি জান্নাতুল ও শাহাজাদি মেহনূর সহ। দাসীরা সমস্বরে সালাম জানায়।
শাহাজাদি জান্নাতুল হেসে ইশারায় জবাব দেয়। এগিয়ে যায় তিন ক্ষমতাধর নারীর দিকে।
“আম্মিজান” অনুভূতি মাখা কণ্ঠে সবার প্রথমে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। বেগম লুৎফুন্নেসাও পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে স্বীয় কন্যাকে।
“আমার জান্নাতুল, কেমন আছো তুমি? আমার হৃদয়ের রাণী তোমার জন্য তড়পাচ্ছিলাম আমি এতোকাল। আমার হৃদয়ের তৃষ্ণা যেন মিটলো।”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি আম্মিজান। আপনার দোয়ায় অনেক অনেক ভালো আছি। আর ভাবীজান, তুমি কেমন আছো।”
“যেমন দেখছে শাহাজাদি।”
ফিকেল হাসি দেন শাহাজাদি জান্নাতুল। অতঃপর নজর টিকান যামিনীর দিকে।
“তুমি নিশ্চয়ই চন্দ্রমল্লিকা, আমার সিংহ বাবার বেগম।”
এতো সময়ে এই প্রথমবার চোখ তুলে তাকায় রমণী নব আগত এই নারীর দিকে। তাকাতেই বিস্ময়ে চোখজোড়া কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায় যেন। অবিকাল তার চেহারা, এমন কী থুঁতনির তিলটাও যেন মেপে মেপে এক। রঙ মাত্রই পার্থক্য, সে কালো, তিনি শুভ্র।
“কোথায় হারালে আদুরে কন্যা?” তুড়ি বাজিয়ে প্রশ্ন করলেন ফুপিজান।
“মার্জনা করবেন ফুপিজান। আসসালামু আলাইকুম। আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো আপনার?”
“একদমই না। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন যুবতী আমিকে দেখছি। শুধুই বর্ণের পার্থক্য। আমার মেহনূর তো পুরো দমে নিজের আব্বাজান আর আম্মিজানের প্রতিমূর্তি হয়েছে। আমার কিছুই সে পায়নি। তুমি যেন আমারই ছায়ামূর্তি।”
“তাতে আমি গর্বিত ফুপিজান। আপনার সৌন্দর্য”
হাস্যোজ্জ্বল মুখে মাথা ঝাঁকায় মধ্যবয়স্ক নারীটি। সেই মুহূর্তে ক্ষীণ কণ্ঠে শাহাজাদি মেহনূর প্রস্তাব রাখে,
“আম্মিজান, আমি খুবই ক্লান্ত। আপনারও তো মাথা ব্যথা করছিল গাড়িতে। চলুন এখন একটু আরাম করতে যাওয়া যাক।”
“তুমি তোমার জন্য নির্ধারিত কামরায় যাও। আমি আম্মিজানের সাথে একটু একাকি সময় কাটাতে চাই।”
আয়েশা খাতুন শাহাজাদি মেহনূরকে নিয়ে চলেন তার কামরার দিকে। বিদায় নেন শাহাজাদি জান্নাতুলও বেগম লুৎফুন্নেসার সাথে। একই সঙ্গে স্থান ত্যাগ করে প্রত্যেকে।
কামরায় ঢুকে মায়ের কোলে মাথা রেখে পালঙ্কে শোন শাহাজাদি জান্নাতুল। ব্যথিত গলায় প্রশ্ন করেন,
“মা, এই কন্যার সাথে কী করে এতোটা নির্দয় হতে পারলে? এর চেহারাই তো তোমার হৃদয়ের তৃষ্ণা লাঘবে জল হওয়ার কথা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। নীরবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এই স্পর্শে মমতার সাথে বেদনাও স্পষ্ট।
___
পুনরায় জরুরি ভাবে মেহমাদ শাহের ডাক পড়েছে বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষে। এ ক’দিনে জরুরি ভাবে যেয়ে বারবার দুঃসংবাদ শ্রবণ করে তার বিতৃষ্ণা কাজ করছে। তবুও উপায়হীন হয়ে যাচ্ছে সে।
“আসসালামু আলাইকুম, দাদীজান।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। এসে এখানে বসো।”
যুবক শান্ত ভাবে দাদীজানের নিবেদনে আসন করে। পৌত্রের প্রশ্নসূচক চাহনি পেতেই চোখ সরিয়ে সে কোনো প্রকাশ বাঁধা ও বিড়ম্বনা ব্যতীত বললেন,
“আরমানের থেকে চিঠি এসেছে। সে মিস্টার হকিংসের সাথে শেরপুর আসতে ইচ্ছুক।”
বসা হতে দাঁড়িয়ে যায় মেহমাদ। ক্ষোভে তার দেহ কম্পিত হচ্ছে।
“অসম্ভব! কোনো ভাবেই না! ঐ বেইমান, জানোয়ার আমার পবিত্র ভূমিতে কিছুতেই পা রাখতে পারবে না। আমি হতে দিব না।”
“জিভের লাগাম টানো তরুণ। আরমান তোমার..
চলবে…