চন্দ্রপুকুর,৪০তম পর্ব

0
419

#চন্দ্রপুকুর,৪০তম পর্ব
– ঈপ্সিতা শিকদার

মেহমাদ শাহ গুরুগম্ভীর হয়ে হিসাবকার্য সম্পন্ন করছে। সহায়ক হিসেবে খাঁস ভৃত্য মিনার তো আছেই।

“জমিদার বাবু, ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। তবে একখান কথা পেটে কুড়মুড় করছে, না বলে স্বস্তি পাচ্ছি না।”

“বলতে থাকো।” হিসাবের খাতা হতে চোখ তুলে তাকিয়ে জবাব দিল যুবক।

“আমার মনে হয়… মানে আমার মন বলছে বেগম চন্দ্রমল্লিকাকে সব খুলে বললে ভালো হতো।”

“মতিভ্রষ্ট হয়েছে তোমার! সবকিছু খুলে বলা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। উত্তরাধিকারী শাহাজাদা হওয়ার পূর্বে শপথ করেছিলাম বংশের বাহিরে বিবাহ করলে সন্তান পৃথিবীতে আগমনের পূর্বে বিবাহিতা স্ত্রীকে এই নবাব বংশের কোনো রহস্য খুলে বলা যাবে না।”

“দুঃখিত, মার্জনা করবেন জমিদার বাবু। আমি সেটার কথা বলছিলাম না। বেগম যে আপনাকে ভুল বুঝলো সেই কথা বলছিলাম। আপনি যদি বেগমকে বলে দিতেন শাহাজাদি মেহনূরকে আপনার স্ত্রী শাহাজাদি মেহনূর নয়, বেগম চন্দ্রমল্লিকা স্বরূপ পরিচয় করিয়েছেন, তাহলে হয়তো তিনি এতোটা ক্রুব্ধ হতেন না।”

“ক্যানো বলবো? সে আমাকে বলেছিল তার গর্ভধারণে সমস্যা হওয়ার কথা? সে বিনা কারণে আমার হতে তথ্য আড়াল করতে পারে, তখন আমিও কারো নিকট বাধ্য নই। জমিদার আমি! জমিদার নবাব মেহমাদ শাহ!”

“যা আপনি বলেন জমিদার বাবু।”

“হু” বোধক ধ্বনি নির্গত হয় যুবকের দেহ হতে। আবারও কাজে ডুবে সে। হুট করেই কিছু একটা মনে পড়তেই মিনারের পানে তাকায়।

“ভালো চিকিৎসকের খোঁজ করো চন্দ্রমল্লিকার এই সমস্যা নিবারণের জন্য, শহরে নাহলে ব্রিটেইনে। জনাব হকিংস চলে গেলেই আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। মানে আর তিন মাস পর।”

মুচকি হাসে ভৃত্য। মানুষটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে ঐ নারীর উদ্দেশ্যে প্রেমের গন্ধ, যা চাপিয়ে যায় তার কঠোরতাকেও।

“যথা আজ্ঞা জমিদার বাবু। আপনার স্নান করার সময় হয়েছে আমি আপনার জন্য হাম্মামখানা তৈরি করে আসি।”

ইশারায় তাকে অনুমতি দেয় মেহমাদ শাহ। বিদায় নেয় মিনার।

___

বেগম লুৎফুন্নেসার কামরায় করাঘাত করে শাহাজাদি জান্নাতুল। বেগম লুৎফুন্নেসা অনুমতি প্রদান করেন।

“আসসালামু আলাইকুম আম্মিজান। কী সৌন্দর্য আপনার! আল্লাহ আপনাকে নেক হায়াত দান করুক।”

“আমিন, আমার জান জান্নাতুল। দাঁড়িয়ে আছো ক্যানো? এসে বসো পাশে।”

“অবশ্যই, আম্মিজান।”

নূরানি চেহারা বিশিষ্ট মধ্যবয়স্ক নারীটি শিমুল তুলোর তুলতুলে গদিতে এসে বসেন। বৃদ্ধা আদুরে ভঙ্গিমায় দেখেন নিজের একমাত্র কন্যাকে।

“বলো আমার জান্নাতুল, আমার আদুরে বিড়াল, আমার হৃদয়ের পক্ষী, কী অবস্থা তোমার? ভালো আছো তো তুমি?”

“আলহামদুলিল্লাহ, আম্মিজান। আল্লাহ বেশ রেখেছেন।”

“তোমার সাথে এতোকাল সাক্ষাৎ তো দূরে থাক চিঠিও প্রেরণ করিনি তোমার জন্য। আম্মিজানের উপর কোনো ক্রোধ নেই তো তোমার? আমির কি এখন তোমার সাথে আর কঠোর আচারণ করে?”

“পরিস্থিতির শিকার ছিলেন আপনি, আম্মিজান। আমি সে সম্পর্কে জ্ঞাত। আর আলহামদুলিল্লাহ, আমি বেঁচে তো আছি, ভালো ভাবেই হোক বা খারাপ ভাবেই হোক। অতীতের কথা বাদ দেন। আমি বস্তুত, অন্য কিছু জানতে এসেছি।”

দ্বিধান্বিত হন বেগম লুৎফুন্নেসা। হাসির সহিতই প্রশ্ন করেন,

“অর্থাৎ? আমি বোধগম্য করতে পারিনি তোমার কথা।”

“অর্থ অতি সহজ আম্মিজান। আমি চন্দ্রমল্লিকার বিষয়ে কথা বলতে চাই।”

“চন্দ্রমল্লিকা?” আপন মনেই বিড়বিড়ায় বৃদ্ধা। বোধ করতে পারেন কন্যার কথার সারমর্ম।

“আম্মিজান, আপনি কি কোনো খোঁজ নেননি তার? আমার হৃদয় অনুভূতির জোয়ারে যা ব্যক্ত করছে তা আপনার হৃদয় ব্যক্ত করেনি?”

“করেছে আমার জান্নাতুল, করেছে। আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম, খোঁজ নিয়েছিলাম চন্দ্রমল্লিকার বিষয়ে। কিন্তু কিছুই জানতে পারিনি তার পিতৃপরিচয় সম্পর্কে।”

“জানতে পারোনি না কি নিজেদের পুঞ্জিভূত পাপকর্মের ভীতিতে খোঁজ নেওনি তার সম্পর্কে ঠিকভাবে? যাকগে, এখন আমি তথা শাহাজাদি জান্নাতুল এসে পড়েছি, সবাই সবার যোগ্য স্থান ফিরে পাবে। নিজের বাস্তবতা এবং পরিচয়ও।”

উত্তর দিলেন না বয়স্ক নারীটি। খুবই সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে গেলেন।

“রাখো এসব ঝামেলার কথা৷ নিজের বিষয়ে জানাও আম্মিজানকে, আমার চাঁদের টুকরো।”

“দুঃখিত, আম্মিজান। এখন একটু কাজ পড়ে আছে আমার। তাই যেতে হবে। বিদায়।”

সায় জানালেন বেগম লুৎফুন্নেসা। শাহাজাদি জান্নাতুলও আর অপেক্ষা করেন না। নিঃশব্দে কক্ষে ত্যাগ করেন।

___

জনাব আরহানের নিদ্রা ভঙ্গ হয় এক ফালি সোনালি আলো চোখে উপচে পড়ায়। চোখ ডলে উঠে বসে সে স্বাগতম জানায় নব এই পরিবেশকে।

গতকাল যাত্রার জন্য বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। তাই আর নিজ কামরা হতে বের হয়নি। খাবার-দাবার কোনোরকম সেড়ে রাজ্যের ঘুমে তলিয়ে যায় সে।

তবে এখন পড়েছে মহা বিড়ম্বনায়। সকাল সকাল পরিস্কার হতে গোসলখানায় যাওয়ার প্রয়োজন, তবে কোথায় তা অবস্থিত জানা নেই তার।

ব্রিটেইনে তার ছোট্ট বাসাটিই তার নিকট বিপুল পরিমাণ ভালো মনে হচ্ছে। লাগোয়া গোসলখানাটাকে এখন মনে হচ্ছে বিরাট বড়ো কোনো সুবিধাজনক কিছু।

কামরা থেকে বের হতে যেয়েও থেমে যায় সে। ভাবে,
-দেখা যাক, যদি কেউ আসে।

এখানের বারান্দাতেও ভিন্ন এক ধারা খেয়াল করে যুবক। বারান্দার কোনো দোয়ার নেই বা কক্ষ হতে বারান্দা পৃথককারী কোনো দেয়াল তুলে দেয়া হয়নি। বরং, পাতলা পর্দায় আলাদা করা মাত্র।

উন্মুক্ত ও সতেজ বাতাসে শ্বাস গ্রহণ করে চমৎকার এক তৃপ্তি বোধ করে সে। চুমু খায় আকাশ পানে তাকিয়ে।

হুট করে আশপাশ দেখতে দেখতে চোখজোড়া স্থির হয় এক কৃষ্ণবর্ণা রমণীর উপর। যদিও চেহারা সুস্পষ্ট দেখতে পায়।

এই বারান্দার শেষ কোণে কোণাকুণি দাঁড়ালে কিছুটা দেখতে পাওয়া যায় অন্দরমহলের বারান্দা। আরহানের চোখ যেয়ে পড়ে সেদিকেই।
যামিনী পুকুর পাড়ে বসে বসে গাছ লাগাচ্ছে। কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া গাছের চাড়া রোপণ করছে সে। ছোটো ছোটো চন্দ্রমল্লিকা ফুলের গাছ তো আছেই।

মূলত প্রিয় পুরুষটিকে উপহার দিতেই এমনটা করা। হাত-পা মাটিতে মেখে গিয়েছে। আঁচলটা তো কোন ক্ষণেই মাথা হতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে ভেজা ভূমিতে। কিন্তু এসবের মাঝখানে যে কেউ একজন একদৃষ্টিতে দেখছে তাতে তার কোনোরূপ ধ্যান নেই।

জনাব আরহানের ঘোর ভঙ্গ হয় কোনো বিপত্তি ব্যতীতই। বোধ হয় ভুল করছে সে এভাবে আড়াল হতে কোনো নারীকে দেখে। চোখ ফিরিয়ে নেয়, নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করে। তবে নিজেকে আটকেও রাখতে পারে না। দ্রুতো ক্যামেরাটা নিয়ে এসে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলে।

এর মাঝেই তার কক্ষের দোয়ারে করাঘাতের শব্দ। সে বিরক্তিতে ‘চ’ বোধক শব্দ উচ্চারণ করে সেখান হতে প্রস্থান করে।

দরজা খুলতেই একজন খাদিম প্রবেশ করে। ঝুঁকে সালাম জানায় তাকে।

“আসসালামু আলাইকুম সাহেব। আপনাকে খাওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করতে পাঠানো হয়েছে আমায়। আপনি কি কামরাতেই আহার করবেন না কি ভোজনশালায়?”

“সবার সাথে ভোজনেদ কার্য সম্পন্ন করতে চাই আমি মশাই। তবে সব কিছুর পূর্বে আমাকে গোসলখানায় তো নিয়ে চলুন। আই নিড টু টেক আ বাথ্।”

প্রাসাদে কার্যরত ও প্রায় সকল গ্রামবাসীই চলনসই শিক্ষিত। তাই খাদিমের অসুবিধা হয় না জনাব আরহানের কথা বোধগম্য করতে।

“যথা আজ্ঞা সাহেব। আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি ব্যবস্থা করছি আপনার স্নান করার।”

হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায় যুবক। খাদিমও বিদায় নেয় কার্য সম্পাদনে।

___

ভোজনশালায় অপেক্ষা করছেন সকলে মেহমাদ শাহ ও জনাব আরহান করিমের জন্য। আহিল, মিনার ও দিনার তিনজনও উপস্থিত। তারা পারে না, খাবারের জন্য আর্তনাদ করে উঠে, এতোটা ক্ষুধাবোধ হচ্ছে তাদের। অবশেষে অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে প্রবেশ করে উভয় ব্যক্তি।

পর্দার আড়ালে বসে আছে নবাব পরিবারের নারীরা। তারা উভয় প্রবেশ করতেই বেগম লুৎফুন্নেসা আয়েশা খাতুনকে কানে কানে আদেশ করেন,

“খাবার পরিবেশন করতে বলো সেবক ও সেবিকাদের।”

একে একে তৈরিকৃত নানান পদের খাবার পরিবেশন করা হয়। গোটা চৌপায়া ভরে যায় খাবারে। গরুর গোশতো ভুনা, শিক কাবাব, জালি কাবাব, শামি কাবাব, মুরগির কোরমা, পরোটা, লুচি, নিরামিষ; কী নেই! ঘ্রাণেই যেন জিভে জল চলে আসছে উপস্থিত ব্যক্তিদের।

“কেমন কাটলো রাত্রি আরহান করিম সাহেব? কোনো প্রকার অসুবিধা তো বোধ হয়নি আপনাদের?”

“অসুবিধা তো হয়েছে, একখান বিরাট অসুবিধা! যার জন্য দায়ী শুধুমাত্র আপনি!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here