#চন্দ্রপুকুর,৪৪ ও ৪৫তম পর্ব
– ঈপ্সিতা শিকদার
“বেগম! বেগম! তাড়াতাড়ি নিদ্রা হতে জাগ্রত হন!”
আতঙ্কিত ভঙ্গিমায় চেঁচাচ্ছে মোহিনী। যামিনী হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়।
“কে মরেছে মোহিনী যে এভাবে চেঁচাচ্ছো?”
“বেগম আমাদের ছোট্ট রোহিণী…” কাপড় মুখে চেপে ফুঁপিয়ে উঠে সে।
রমণীর তন্দ্রাভাব এবার পুরোপুরি কেটে যায়। একরাশ দুশ্চিন্তাই শুধু স্পষ্ট করছে তার ললাটে বিদ্যমান সূক্ষ্ম ভাঁজগুলো।
“মানে? রোহিণীর কী হয়েছে? কোথায় সে? ডাকো আমার নিকট!”
“বেগম, রোহিণীর অবস্থা খুবই শোচনীয়। বৈদ্য তার চিকিৎসা করছে। এই আঁধার রাতে কে যেন আক্রমণ করে তাকে ছুড়ি দিয়ে।”
দ্রুতো উঠে দাঁড়ায় যামিনী।
“কী! কোথায় সে? নিয়ে চলো আমাকে! এতোটুকু কন্যার প্রতি কার এতো ক্ষোভ জমলো!”
“আর কে হবে বেগম! এই অন্দরমহলে আপনার শত্রুদল আর কে-ই বা আছে! শাহাজাদি মেহনূর আর বেগম নূর বাহারই নিশ্চয়ই। আপনার ক্ষতি করতে না পেরে আমাদের ক্ষতি করে আপনাকে দুর্বল করতে চাচ্ছে।”
ক্রোধ, প্রতিশোধস্পৃহা ও দুঃখের এক অদ্ভুৎ অনুভূতির মিশ্রণে ক্ষত-বিক্ষত হয় যুবতী জমিদারনি। নৈশব্দেই গায়ে রাজকীয় ওড়না খানা জড়িয়ে বের হয়ে পড়ে সে মোহিনীর সাথে।
বৈদ্যশালার ছোট্ট এক কামরায় চিকিৎসা চলমান কিশোরী কন্যাটির। ফ্যাঁকাসে মুখে শায়িত সে। দিলরুবাও সেখানে উপস্থিত।
আদুরে স্পর্শে হাত বুলিয়ে দেয় মনিব তার ললাটে। তার ছোটোবেলা হতেই এক খান ছোটো বোনের সখ ছিল, যা কখনোই পূরণ হয়নি। কারণ মামার সন্তানের উটকো ঝামেলা ব্যতীত অন্য কোনো দৃষ্টিতে তাকে দেখেনি।
তবে এই মেয়েটি তাকে বোন স্বরূপ বোধ করেছে, যামিনী নিজেও ছোট্টো বোনটির ন্যায় ভাবতো তাকে। ইচ্ছে ছিল পরিস্থিতি ও ক্ষমতা তার হস্তের মুঠোয় এলে রোহিণীকে একটি ভালো পর্যায় রাখার চেষ্টা করবে, নিজ হাতে সুপাত্রের সঙ্গে বিবাহ দিবে।
আজ সেই ইচ্ছের জলাঞ্জলি হতে নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে ইচ্ছে করছে সেই মানুষগুলোকে যাদের জন্য এই কন্যার এমতাবস্থা।
বৈদ্যের পানে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“এখন কী অবস্থা রোহিণীর?”
“দুঃখিত, বেগম। এই কন্যার সুস্থা হওয়ার আশঙ্কা খুবই স্বল্প, চমৎকার হলেই সম্ভব এও বলা যেতে পারে। কারণ এখানে আসার পূর্বেই অনেক রক্ত বের হয়ে গিয়েছে।
আবার ছুড়িটি বিষ মাখানা ছিল। তাই কোনো সম্ভবনাই আপাতত আমরা দেখছি না। আল্লাহর ইচ্ছে, তিনি যা চান তা-ই হবে৷ আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”
“ইনশাআল্লাহ, রোহিণী সুস্থ হবে। দিলরুবা, কীভাবে হলো এসব? কোথায় থেকে উদ্ধার করলে তোমরা তাকে?”
“একজন প্রহরী রক্তাক্ত অবস্থায় অন্দরমহলের উত্তরের দিকে পড়ে থাকতে দেখে তাকে। সে-ই তাকে তুলে নিয়ে আসে। আমি জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম বেগম, আশেপাশে কাউকে দেখতে পায়নি সে।”
অনেকটা নিচু কণ্ঠেই উত্তর দেয় দিলরুবা। যামিনী আর প্রশ্ন করে না।
ধীরে ধীরে সময় কাটতে শুরু করে। সেই সাথে যেন রোহিণীর জীবনপ্রদীপের তৈলও ধীরে ধীরে ফুড়িয়ে যাচ্ছে। ফজরের আজান দিতে আর খাণিকটা সময় বাকি, সেই মুহূর্তে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় সে।
যামিনী এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলায়। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“এখন কেমন লাগছে রোহিণী? তুমি চিন্তা কোরো না, অতি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি।”
রোহিণীর অবস্থা করুণ। এটিই যেন মৃত্যু ঘনিয়ে আসার পূর্ব মুহূর্ত। বেঁচে থাকা এই স্বল্প সময় সে অন্য কোনো কথায় অপচয় করতে চায় না। বরং, প্রিয় এই মনিবকে জানিয়ে যেতে এক মহা সত্য।
কষ্ট হলেও কোনোরকম কম্পিত কণ্ঠে সে উচ্চারণ করে,
“কাউকে ব-বিশ্বাস করবেন না বেগম। য-যা দেখছেন সব মিছে, আপনার অতি নিকটের ম-মানুষগুলোই আপনার মহা শত্রু। বিশ্বাস ঘাতক আপনার ভৃত্য!”
বিস্মিত রমণী। কী বলছে এই কন্যা!
“বিশ্বাসঘাতক! কে বিশ্বাসঘাতক রোহিণী?”
তার প্রশ্ন করতে করতে কিশোরীর কথা বলার ক্ষমতা ফুড়িয়ে গিয়েছে। দেহে বাকি বিদ্যমান শক্তিটুকু একত্রিত করে হাতটা কোনোরকম উঁচিয়ে যামিনীর পিছনের দিকে ইশারা করে সে। রমণী পিছনে ঘুরে মোহিনী ও দিলরুবা দাঁড়িয়ে সেখানে।সামনে ঘুরতেই দেখতে পায় প্রাণহীন এক দেহ।
নিজের বক্ষে ও বেদনায় পাথর চেপে হাত দিয়ে রোহিণীর চোখ দুটো বন্ধ করে দেয় সে। তার মুখশ্রীতে কোনো বেদনার ছাপ নেই, আছে একঝাঁক কঠোরতা।
শুধু বিড়বিড়ায়,
“আমার প্রিয় শুভকাঙ্ক্ষী যার জন্য তোমার এই দশা, তার আরও জঘন্য দশা আমি করব। এ আমার ওয়াদা।”
উপস্থিত দেহরক্ষীদের সে আদেশ করে,
“রোহিণীর মৃত্যুর সংবাদ জানানো হোক সকলকে। আর তার জন্য সুষ্ঠুভাবে জানাজার ব্যবস্থা করা হোক।”
কিশোরীর লাশ বয়ে নিয়ে যায় দাসীরা। যামিনী সন্দিহান দৃষ্টিতে মোহিনী ও দিলরুবার দিকে তাকায়।
দিলরুবার মুখশ্রী বিবর্ণ, তবে কি সে কোনো কিছুর ভীতিতে ছিল? সত্য ফাঁস হওয়ার? মোহিনী এখনও কাঁদছে, যা নিছকই কুমিরের অশ্রু মনে হচ্ছে তার নিকট। কারণ মোহিনীর সাথে কখনোই সুসম্পর্ক তো দেখেনি সে রোহিণীর। তবে কি সবটাই নাটক?
বর্তমানে প্রত্যেককেই সন্দেহ হচ্ছে তার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, আর কাউকেই বিশ্বাস করবে না সে।
___
অন্দরমহল কলরবমূখর, কন্যাদের ফিসফিসানির আওয়াজে পরিপূর্ণ পরিবেশ। রোহিণীর দেহ স্নানাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই ধরণীতে শেষ স্নান দিতে।
আঙিনায় বেগম লুৎফুন্নেসা, বেগম নূর বাহার, শাহাজাদি জান্নাতুল, শাহাজাদি মেহনূর সংবাদ সাদা পোশাক পরিধান করে উপস্থিত। হাফেজা সাহেবাও এসে পড়েছেন।
“চুপ করো কন্যারা! মৃত্যু হয়েছে অন্দরমহলে। তোমাদের এতো কথা বলার স্ফূর্তি আসে কোথা থেকে? আল্লাহকে ভীতি করো, আমাদেরও অন্ত হয়তো ঘনিয়ে আসছে আমাদের অজান্তেই।
কোরআন শরীফ পাঠ করো, তসবিহ পাঠ করো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মৃত্যুবরণকারীর আত্মার মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে। নেক দিল নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে তার জন্য। আল্লাহ মহান নিশ্চয়ই এতো মানুষের দোয়া উপেক্ষা করবেন না”
বেগম লুৎফুন্নেসার চেঁচানোতে নিস্তব্ধ হয় গোটা পরিবেশ। প্রবেশ করে যামিনী তার পরনে কালো রঙের পোশাক। অবাক হন সকলে।
দাদীজান বলে উঠেন,
“আমি জানি তুমি অনেক শোকাহত চন্দ্রমল্লিকা, তবে পোশাকের বিষয়ে তো একটু খেয়াল রাখবে। কারো মৃত্যুতে নবাব বাড়িতে শুভ্র রঙের পোশাক পরিধান করে, কারণ শুভ্র পবিত্রতা, ভালোবাসা, শান্তি ও অকপটতার প্রতীক। কালো অন্ধকার, মন্দ, কপটতা ধারণ করে।”
হেসে দেয় যামিনী। বেগম লুৎফুন্নেসা সহ সকলেই অবাক। প্রায় তাঁরা সকলেই জ্ঞাত রোহিণীর সাথে এই যুবতীর সুমধুর সম্পর্কের বিষয়ে। তার এমন উদাসীন আচারণ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
“দুঃখিত, তবে মৃত্যুটা তো আর শুভ্র ছিল, ছিল কপটতার দরুন, অন্যায়ের প্রতীক। হত্যা করা হয়েছে তাকে, প্রাকৃতিক ভাবে মরেনি সে। আমার প্রতি কারো ক্ষোভের শিকার সে।”
শেষবাক্যটি সূক্ষ্মভাবে শাহাজাদি মেহনূরের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করে। সেই সাথে অলক্ষ্যেই তার কপোল ভিজে যায় আঁখিজলে। উপস্থিত চার জন ক্ষমতাধারী নারীই বুঝতে পারে তার কথার প্রকৃত অর্থ। তাঁরা ব্যক্ত করতে চায় এ কাজে তাঁদের হস্তক্ষেপ নেই, তবুও বিশ্বাসের খাতায় তাঁদের নাম নেই ভেবেই নিঃশ্চুপ।
হাফেজা কোরআন শরীফ পাঠ করতে শুরু করে। যামিনীও কোরআন শরীফ নিয়ে বসে। একটু বাদেই রোহিণীর খাটিয়া এনে রাখা হয় মাঝখানে। সবাই শেষ দর্শন করতে এগিয়ে যায় একে একে।
নিয়ম অনুযায়ীই প্রথমে বেগম লুৎফুন্নেসা যান। তারপর শাহাজাদি জান্নাতুল ও বেগম নূর বাহার।
রমণী প্রিয় ব্যক্তিটির প্রাণহীন দেহ দেখে আর সহ্য করতে পারে না। চিৎকার করে কেঁদে দেয়। এই প্রথম সে স্বজন হারানোর ব্যথা অনুভব করছে, কারণ জন্ম হতেই তো এতিম সে। এরপর আর তেমন কোনো স্বজন হয়নি জীবদ্দশায় যার মৃত্যু হয়েছে।
“আল্লাহ তোমায় জান্নাত নসীব করুক রোহিণী। আর তুমি একদম চিন্তা কোরো না। যাদের জন্য তোমার জীবন কুরবানি দিয়েছো আমার হয়ে, তাদের মৃত্যু হতে ভয়ংকর শাস্তি দিবে এই চন্দ্রমল্লিকা।” তার বজ্রকন্ঠ শিহরিত করে প্রত্যেককেই।
দাফন করার উদ্দেশ্যে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খাটিয়া। যামিনী আরও শব্দ করে কেঁদে দেয়। মোর্শেদা খাতুন এগিয়ে আসেন তার দিকে।
“কেঁদো না মা চন্দ্রমল্লিকা। এই দুনিয়া ক্ষণিকের পরীক্ষাগৃহ, একদিন না একদিন সময় শেষ হয়ে গেলে সবাইকেই মায়া ত্যাগ করে মাটিতে মিশতে হবে। এভাবে ভেঙে পড়বে না তুমি। সামনে আরও কঠিন বিপদ হয়তো অপেক্ষারত, লড়তে হলে শক্ত থাকতে হবে।”
যামিনী শান্ত হয়। চোখের নোনাজল মুছে নেয় এক মুহূর্তে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে একদফা শাহাজাদি মেহনূর ও বেগম নূর বাহারকে দর্শন করে দ্রুতো পদচারণায় নিজের কামরায় ফিরে যায় সে।
বদ্ধ কামরায় বেদনা আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে তাকে। গুমরে মরে যাচ্ছে সে যেন এই অনুভূতির পোড়নে। দিলরুবা এগিয়ে এসে তাকে জল ভর্তি পানপাত্র এগিয়ে দেয়।
রমণী পান করতে নিয়েও ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তার সেই ক্ষণে মনে পড়ে রোহিণীর বলা কথা। এই আশঙ্কিত মুহূর্তে তার কাউকেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
কষ্ট আরও তীব্র হয় যখন বোধ করে এতো গভীর মুহূর্তেও তার পাশে এসে দাঁড়ালো না প্রিয় পুরুষটি। নিশ্চয়ই সে অজ্ঞাত নয় এতো বড়ো অঘটন সম্পর্কে। তার বাবু মশাইয়ের নিকট বুঝি এখন এতোটাই অবহেলার পাত্র সে!
___
মেহমাদ শাহ গোটা একটি দিন ও রাত্রি বাহিরে কাটিয়ে সবে মহলে ফিরেছে। জনাব আরহান করিম তার দলবল সমেত শেরপুরে আসার পর হতেই তার ব্যস্ততা পুরো দমে বেড়ে গিয়েছে।
দিনের বেলা তাদের সঙ্গ দেওয়া, আর রাত হলে জমিদারি, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ সামলানোতে যায় তার। যেমন কারখানায় একটু ঝামেলা হওয়ায় ও কিছু কাজ বাকি থাকায় আজ তাকে কারখানাতেই রাত্রি কাটাতে হলো।
ক্লান্ত দেহে কামরায় যাওয়ার পথে হাঁটছে সে। পথিমধ্যে খাঁস ভৃত্য মিনারের সাথে সাক্ষাৎ।
“আসসালামু আলাইকুম জমিদার বাবু। আপনি এতো দেরিতে এসেছেন মহলে…”
বিড়ম্বনায় পড়ে জমিদার বাবু।
“দেরিতে বলতে? আমার কি দ্রুতো আসার কথা ছিল? আর তোমার মুখশ্রী এমন ফ্যাঁকাসে ও দুশ্চিন্তায় পরিপূর্ণ ক্যানো? আমার অনুপস্থিতিতে কি কিছু হয়েছে অন্দরমহলে?”
মিনার রোহিণীর মৃত্যুর ঘটনা জানায় মনিবকে। আশ্চর্য এক মুহূর্ত শব্দই উচ্চারিত হয় না যুবকের মুখ থেকে। ক্রুব্ধ হয় সে ভৃত্যের উপর।
“এতো বড়ো একটা অঘটন ঘটে গেল আর তুমি আমাকে এখন জানাচ্ছো? এতো বড়ো অসাবধানতা তুমি কী করে করতে পারো মিনার!”
“আস্তাগফিরুল্লাহ্ জমিদার বাবু। আপনার সেবায় আমি কোনোদিন এক বিন্দু হেলাফেলা করিনি। আমি মোর্শেদা খাতুনকে বলেছিলাম আপনার নিকট এই সংবাদ পাঠাতে, তিনিও আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। আর আমাকে তো আপনি একমুহূর্তের জন্যও এই শহুরে বাবুদের একা ছাড়তে নিষেধ করেছেন তাই আমি নিজে যেয়ে কাজটি করতে পারিনি।”
“আম্মাজান? তিনি এতো বড়ো ত্রুটি করতে পারেন না তাঁর দায়িত্ব পালনে। আর চন্দ্রমল্লিকা? মেয়েটার তো করুণ দশা এখন, আমার এই মুহূর্তে তার নিকট যাওয়া উচিত।”
দ্রুতো অন্দরমহলের দিকে যায় মেহমাদ শাহ। তাকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়ায় যামিনী।
“আসসালামু আলাইকুম বাবু মশাই। আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুক।”
যুবক নৈশব্দে জড়িয়ে ধরে তার প্রেয়সীকে। আজও সে খেয়াল করে নারীটির আচারণ যেন পূর্বদিনের তুলনায় অধিকই আড়ষ্টভাব।
“আমি দুঃখিত, আমার চন্দ্রমল্লিকা। আমি গতকাল সারা রাত্রি কাজের ব্যস্ততায় বাহিরে ছিলাম। তাই তোমার নিকট আসতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দাও আমার মায়ারাজ্যের রাজকন্যা। আর অভিমান ধরে রেখো না।”
দু’হাতের মাঝে মুখশ্রী নিয়ে চুমু খায় ললাটে সে। আবেগঘন দৃষ্টি তার তবে এই মুহূর্তে তা কোনোক্রমেই ছুঁতে পারে না যামিনীকে। বরং, একঝাঁক তাচ্ছিল্যের হাসি বিদ্যমান তার চেহারাতে। আজকাল মানুষটার সকল কথা মিথ্যে বাহানা বৈকি কিছুই মনে হয় না তার।
“যেখানে মান নেই, সেখানে অভিমান ধরে রাখার সুযোগ থাকে না। যাকগে সেসব আপনার সত্যিই তো ব্যস্ততা ছিল, মিথ্যে তো আর বলছেন না। তাই অভিমান রাখার প্রশ্নই আসে না। তবে আমার আপনার সাথে কথা ছিল অন্য এক বিষয়ে।”
“হ্যাঁ, বলো আমার জান।”
“রোহিণীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তাকে হত্যা করা হয়েছে তা তো জানেনই। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই, যা করা একজন জমিদার হিসেবে আপনার কর্তব্যও।”
একটু বিচলিত হয়ে যায় মেহমাদ শাহ এ কথা শুনে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে যামিনীকে বক্ষে নিয়ে শুধায়,
“আমার চন্দ্রমল্লিকা, এখন সেই পরিস্থিতি নেই। তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো জনাব আরহান করিম সহ তিনজন শহুরে লোক এসেছেন। তাঁদের কর্ণকুহরে এ অঘটনের খবর পৌঁছালে খুব বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে।
বাহিরের দুনিয়ার সম্মুখে ঝুঁকে যাবে আমাদের নবাব পরিবারের সম্মান। তবে আমার ওয়াদা শুধু আর পনেরো-বিশ দিন অপেক্ষা করো, তাঁরা চলে গেলেই আমি আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করে তোমার চরণতলে তার গর্দান এনে ফেলবো।”
রমণী বিপরীতে কিছু উচ্চারণ করে না। নৈশব্দে বক্ষে মিশে থাকে। তবে তার নিকট কোনো কথা বা ওয়াদাই এখন বিশ্বাসযোগ্য নয়।
মনে মনে বলে,
“খাঁটি সোনাও পুড়তে পুড়তে একসময় ছাই হয়। খাঁটি ভালোবাসা আর বিশ্বাসও হয়তো তার ব্যতিক্রম নয়। আমার হৃদয়ে যে পোড়ন হচ্ছে, তাতে পুড়ছে ভালোবাসা। একসময় শত খুঁজলেও ছাই বাদে কিছুই পাওয়া যাবে না, না আপনি, না আমি।”
দরজায় করাঘাতের শব্দে ভাবনার সুতো কাটে দম্পতির। অনুমতি প্রদান করে মেহমাদ শাহ কামরায় প্রবেশের।
একজন দাসী জানায়,
“আসসালামু আলাইকুম, বাবু মশাই। আপনাকে শহুরে বাবুরা খুঁজছে বলে জানাতে বলা হয়েছে।”
___
জনাব আরহান করিমের সাথে কথোপকথন সমাপ্ত করে নিজের কামরায় ফিরছে মেহমাদ শাহ। পথিমধ্যে মোর্শেদা খাতুনের সাথে সাক্ষাৎ।
“আসসালামু আলাইকুম আমার শাহ। আল্লাহ তোমায় সদাই এমন সুস্থ রাখুক।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম আম্মাজান। আপনার দোয়া কবুল হোক। তবে আমাকে আপনার একটা প্রশ্ন করার আছে। মিনার আপনাকে বলেছিল রোহিণীর মৃত্যুর সংবাদ আমার নিকট পাঠানো ব্যবস্থা করতে, কিন্তু দুঃখের বিষয় তা হয়নি।”
আফসোসের ভঙ্গিমা স্পষ্ট হলো মোর্শেদা খাতুনের চেহারায়।
“ইশ! আমি দুঃখিত আমার শাহ। এত্তসব ঝামেলায় আমার একদম মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল এ কথা। আমাকে ক্ষমা কোরো তুমি।”
“না, না, আম্মাজান। মানুষ মাত্রই তো ভুল। আপনি যেখানে যাচ্ছিলেন যেতে পারেন।”
চলবে…