#আমার_সংসার,পর্ব ১
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
১.
মামাতো ভাইয়ার বিয়ে খেতে এসে যে আমাকেই পাত্রীসন নিতে হবে ঘুনাক্ষরেও ভাবতেই পারি নি আমি। শোনামাত্র ভূমন্ডল কেঁপে উঠে আমার। চোখে পানি ছলছল করে ওঠে! অস্রুভরা চোখে তাকালাম আব্বুর দিকে। পাথর,মূর্তীর মতো দাড়িয়ে উনি। মেঝের দিকে তার দৃষ্টি স্হির। আমার থেকে ছয় বছর বড় সিয়াম ভাইয়া! এতোদিন শুনে এসেছি উনি খুব ভালো মানুষ! কাজিন মহলে তাকে অনুসরণ করতাম খুব! কিন্তু সামনে যেতাম না। আমার খুব লজ্জা হতো তার সামনে আসতে। আর এখন তার স্ত্রী হতে হবে আমায়? কোথায় ভেবেছিলাম কত কত মজা করবো আর সেখানে আমায় হতে হবে পাত্রী! চোখ বেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।
বিয়ের আসর নীরব,থমথমে। বাড়িভর্তী মানুষজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আমার দিকে। চাইছে আমার মত! চাইছে সারাটা জিবন! তার রেজাল্ট, তার প্রোফেশনে এতকাল মুগ্ধ ছিলাম আমি। উনাতে তো নয়! তাহলে? আবারো চোখে পানি ভরে উঠলো। পাত্রকে লগ্নভ্রষ্টা হতে হবে বলেই কি আমার জিবন সংসারে হঠাৎ ঠেলে দেয়া? হঠাৎ তাকে বাঁচানোর মিথ্যে নাটকে তার অর্ধাঙ্গিনি হওয়া? এ কেমন যুক্তি? শক্ত রেল পাথরের ন্যায় কোঠোর পিতাও আজ চুপ করে রইলো। তার নিশ্চুপতায় যে আমায় বিদ্ধগ্ধ করছিলো, বুক ফেটে আসছিলো সে কি বুঝছে না? বুঝছে না তার সিয়ার নিশ্চুপ বুকফাটা আর্তনাত? তাহলে বুঝি মিথ্যে সপ্ন দেখিয়েছিলো আমায়! নিজ পায়ে আর দাড়ানো হবে না আমার। গলায় দলা পাকিয়ে আসছে। যেন গলাটা মরীচিকাময়! কথা বলতে কন্ঠনালিতে বড্ড বেগ পেতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা আমার সৃতিচারণ হতেই ফুপিয়ে উঠলাম আমি। আব্বু অপরাধি চোখে তাকালেন আমার দিকে!
_____
‘ সিয়া শুনেছিস ঘটনা কি ঘটেছে? ‘
কাজিনরা মিলে সাজছিলাম আমরা। বড়মার এমন কথায় গানের দুলটা পড়তে পড়তে ফিরে তাকালাম আমি। বড়মার মুখে চিন্তার ছাপ! কপাল ঘেমে উঠেছে। আমি একটু এগিয়ে আসতেই আমার হাত শক্ত করে ধরে নিলো বড়মা। আমি আস্বস্ত কন্ঠে বললাম,
‘ কি হয়েছে? এমন চিন্তিত কেন লাগছে তোমায় বড়মা? অসময়ে ঘামছোই বা কেন? ‘
আমার প্রশ্নের পরপরই বড়মা বলে ওঠে,
‘ পাত্রীপক্ষ এ রিসোর্ডে আসবে না বলেছে। বলেছে এ বিয়েতে ত্রিধা রাজি নয়! কিসব প্রতিশোধ ট্রতিশোধ বলছিলো ফোনকলে! এবার কি হবে সিয়া? ‘
কথাগুলো কর্নকুহরে পৌছাতেই পুরো রুমের খুশি মুহুর্তে বিলীন হয়ে গেলো। অলভী,অনু,তনু আপু চমকানো চাউনিতে তাকালো বড়মার দিকে। সাথে আমিও। ষোল বছর বয়স থেকে শুনে এসেছি এই ত্রিধার কথা! বাবা বলতো সিয়াম ভাইয়ার মতো একজন মানুষ সে পেয়েছে, সে নাকি বড্ড লাকি। মামির মুখে শুনতাম তাদের নিয়ে কতো কতো কথা৷ বলতো,ত্রিধা প্রানের থেকেও বেশি ভালোবাসে সিয়ামকে। আর আজ এত বড় দুর্দশা সৃষ্টির মূলে সে? তার ভালোবাসার মানুষের সাথে এত বড় বিশ্বাস ঘাতকতা? আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। বড়মার মুখ আরও অস্থির হয়ে উঠলো। তনু আপু ছুটে এলো বড়মার কাছে। নিজের দিকে ফিরিয়ে ভার গলায় বলে উঠলো,
‘ এসব কি বলছেন? ত্রিধা আসবে না মানে? আসবে না মানে কি? কতশত আয়োজন, আশা নিয়ে হতে চলেছিলো এ বিয়ে! কত বড় রিসোর্ড বুক করে আয়োজন হয়েছে এ বিয়ের! তার থেকেও বড় কথা সিয়ামের কি হবে? ও তো পাগল হয়ে যাবে! খুব ভালোবাসে ওকে। তারা আসবে না বললেই হবে! এ বিয়ে হতেই হবে! ‘
একটানে কথাগুলো বলে থামলেন তনু আপু। তার কপালে সূক্ষ্ম তিনটি চিন্তার ভাজ। তখনি ঘরে ধির পায়ে প্রবেশ করলো মামী। তনু আপু মামিকে দেখেই ছুটে গেলো তার কাছে। মামীর মুখে বিষন্নতার ছাপ! ঘন কালো মেঘের এক টুকরো যেন। তনু আপু গিয়েই মামীর কাঁধে হাত রাখলো। চেঁচিয়ে বললো,
‘ এসব কি সত্যিই মামী? ত্রিধা সত্যিই বলেছে সে এ বিয়েতে রাজি নয়? সিয়াম কি করে মেনে নিলো বলতে পারো? কি হলো? তুমি কথা কেনো বলছো না? ‘
তনু আপু চিৎকার করে শেষের দু লাইন আওড়ালেন। মামীর মুখের কোন পরিবর্তন হলো না! দূরে দাড়িয়ে অনু ফোপাচ্ছে! আমার থেকে অনেক ছোট অনু। আর তনু আপু অনেক বড়। উনি বিবাহীত! কারো স্পর্শে চমকে উঠলাম। চকিত দৃষ্টিতে তাকাতেই এলোমেলো চাউনি নিয়ে সামনে দাড়িয়ে আছেন মামী। চোখ দুটি ঘোলাটে। যেন কোটরে ডুকে গেছে। আমার হাত সর্বশক্তিতে খিচে নিলেন উনি। আমি আস্বস্ত কন্ঠে বললাম,
‘ ক..কি হয়েছে মা..’
‘ তুই! তুই পারবি এতো বড় অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে। পারবি না সিয়া? পারবি না সিয়ামকে বিয়ে করতে? ‘
তখনি বাজ পড়লো মাথায়। তড়িৎ গতিতে পিছিয়ে গেলাম আমি। বুঝতে পারলাম আমার পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। মামীর আকুতি ভরা কন্ঠ। শোনামাত্র হাত পা অসর হয়ে আসতে লাগলো আমার। মাথা ভো ভো করছে। পানি ভরা চোখে মামীর দিকে তাকাতেই মামী হু হু করে কেঁদে উঠলো। তারমানে সব সত্য! সত্যিই ত্রিধাপুরা আসবে না। তারা ঠাকালো পুরো ‘সিয়ামভিলার’ মানুষকে। থমকে দাড়িয়ে রইলাম। জিবন যে এভাবে মোর নিবে আমি কখনো ভেবেছিলাম?
‘ কি রে সিয়া তুই রাজি না মা? ‘
মামী আবারো আকুতিভরা গলায় বললো। কি বলবো আমি? নোনাজলের স্রোত বইছে গালবেয়ে। গলা শুকিয়ে কাট। একফোঁটা পানি প্রয়োজন আমার। হঠাৎ আব্বুর কন্ঠে আমি থ হয়ে যাই,
‘ ও রাজি এ বিয়েতে। আপনারা আয়োজন শুরু করুন! ‘
কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি ছুটে গেলাম আব্বুর কাছে। বললাম,
‘ আমার স্বপ্ন? কেন? আমি এ বিয়ে করবো না! ‘
‘ রাজি হ মা, প্লিজ! ‘
‘ সবাই একটু বাইরে যাবে প্লিজ? সিয়ার সাথে আমার কথা আছে। ‘
দ্বিতীয় কোন পুরুষালি কন্ঠে চমকে উঠলাম। দ্বারে সিয়াম ভাইয়া দাড়িয়ে। কন্ঠ খাদে তার। একজন শক্ত মানুষ এমন ভেঙে পড়েছে তা দেখতেই এক পশলা ঘৃনা ছুড়লাম ত্রিধার উপর। উনি ধির পায়ে রুমে প্রবেশ করলেন। সকলে একচোখে তারই দিকে তাকিয়ে। উনি হঠাৎ বাজখাঁই গলায় বললেন,
‘ আমি রিপিট করা পছন্দ করিনা। প্লিজ! ‘
সকলে যেতে লাগলো। অলভীও চলে গেলো। আব্বু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকালো একবার। এরপর উনিও চলে গেলেন। ভয়ে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে রইলাম আমি। না জানি কি বলবেন। কন্ঠ খাদে নামিয়ে ক্ষিন স্বরে বললো ভাইয়া,
‘ সিয়া! ‘
জলভর্তি চোখে তাকালাম। উনি আমার দিকেই তাকিয়ে। আবারো চোখ অন্যদিকে ফেরালাম। উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
‘ এ বিয়েতে রাজি তুই? ‘
এক কথায় না সূচক মাথা নাড়লাম আমি। উনি আবারো বললেন,
‘ তুই রাজি নস? ‘
হঠাৎ রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। চেঁচিয়ে বললাম,
‘ না না না! রাজি নই আমি। আপনিও নিশ্চয়ই রাজি নন? আমার মতো কালসেটে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে? ‘
উনি আমার দিকে দু’পা এগোতেই ভরকে পিছিয়ে গেলাম আমি। কখন দেয়ালে ঠেকেছি জানা নেই। দেয়ালে মিশে রইলাম। কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব আমাদের। হঠাৎ এহেম কান্ডে ভারছাড়া লাগছে আমার। হঠাৎ উনার গরম শ্বাস মুখে আছড়ে পড়তেই চোখমুখ খিঁচে নিলাম। উনি রাগ নিয়েই বললেন,
‘ আমি রাজি এ বিয়েতে! আর তোকেও রাজি হতে হবে। এ বিয়ে হতেই হবে সিয়া। ‘
কথাগুলো কর্নকুহরে পৌছাতেই চোখদ্বয় মেলে তাকালাম আমি। গলা ফাটা চিৎকার করে বললাম,
‘ আমি পারবো না এ বিয়ে করতে। কেন করবো? ‘
‘ আমি বলছি তাই! আমিও দেখবো ত্রিধা….’
কথা শেষ হওয়ার আগেই জোরে বলে উঠলাম আমি,
‘ তারমানে ত্রিধা আপুকে দেখানোর জন্য এ বিয়ে করছেন আপনি? তাহলে আমিই কেন? সিয়াই কেন? ‘
একহাত দেয়ালে রাখলেন সিয়াম ভাইয়া। তার গরম নিশ্বাস আঁচছে পরছে মুখে। মুখে রাগ স্পষ্ট! মুখ লালচে হতে লাগলো। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,
‘ ব্যাস সিয়া! অনেক হয়েছে। আবির ইরফান সিয়াম তোকে সিলেক্ট করেছে বলে তুই নিজেকে কি ভাবছিস শুনি? বড় সুন্দরী ভাবছিস? হুহ্, একটু ফরসাও তো তুই নস। শ্যামলা! তাতেই এত দেমাগ তোর? ‘
চুপসে দেয়ালে মিশে রইলাম। এহেন অপমানে চুল থেকে নখ থরথর করে কাঁপতে লাগলো আমার। প্রতিটা কথা বুক কাঁপিয়ে তুললো। ধুকপুক আওয়াজ কানে বাজছে। উনি বড় বড় শ্বাস নিয়ে দম নিলো
কিয়ৎক্ষন। এরপর ঠান্ডা,সিক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ দেখ সিয়া,আমি চাইনা তোর সাথে বাজে বিহেভ করতে, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড! তোর অমতে,জোর করে হলেও এ বিয়ে হবে। ‘
বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন সিয়াম ভাইয়া। যে তানজিলা তাবাসসুম সিয়া শক্ত, নিজ সিদ্ধান্তে অনড়, আজ সে দুমড়ে যাচ্ছে! নিজ স্হান হতে পেছোতে হচ্ছে তাকে। ধুপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম আমি। গগন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
‘ আমি রাজি নই এ বিয়েতে, রাজি নই আমি! ‘
______
গা ভর্তি রাশি রাশি গহনা আমার। পার্লার থেকে চারজন মেয়ে এসেছে। কড়া মেকাবে মিথ্যে সুন্দর্য আনতে বড্ড ব্যাস্ত তারা। আমার মন নেই সেদিকে, বটগাছের মতো উঁচু মস্তিষ্কে ভাবা লোকটা কিভাবে নিজের মেয়ের বিয়ে হুট করে দিতে পারে,ভাবাচ্ছে আমায়! বুক ছাড়খাড় হয়ে আসছে ভাবতে। সৌন্দর্য নিয়ে খুতখুতে বরাবরই সিয়াম ভাইয়া। কাজিন মহলে নিজ থেকে কখনো আমার খোজ উনি নেননি। তাহলে এ বিয়ের মূল কারন কি? কেন এ বিয়ে?
মস্তিষ্ক অচল,শূন্য হয়ে পড়লো। প্রশ্ন হাজারো, উত্তর নেই! কোথাও নেই। কার কাছে গেলে পাবো আমি উত্তর? ‘ যখন এতশত ভাবছি, তখনি বড়মা, মামী ঘরে ডুকলো। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। নিয়ে যাওয়া হলো আমায় দুই হাত উঁচু স্টেজে। পাশে বসে ছিলেন সিয়াম ভাইয়া।
চলবে…..
যা খোলসা হয়নি তা খোলসা হবে পরবর্তিতে।