আমার_সংসার,পর্ব ৫,৬

0
1934

#আমার_সংসার,পর্ব ৫,৬
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৫

আকাশ নিকশ কালো। থেকে থেকে গর্জন করছে। চাঁদ নেই,তারা নেই। কি নিকৃষ্ট থমথমে আকাশ। কালো কুচকুচে মেঘ উড়ে বেরাচ্ছে আকাশ জুড়ে। হাড় কাঁপানো শিত পড়েছে। তার উপর আকাশের যা অবস্থা, বৃষ্টি নির্ঘাত নামতে। এই শিতে আবার বৃষ্টি নামবে? ভাবলেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। বেলকনি দিয়ে শিতল বাতাস সাঁ সাঁ করে ঘরে ডুকছে। শরীর হিম হয়ে আসছে। তবুও চোখে ঘুম নেই। উত্তেজনায় ঠান্ডাটাও গায়ে লাগছে না ঠিকমতো। কাল বড়মাকে, আব্বুকে দেখবো! তারাকি আনন্দে কেঁদে দেবে আমায় দেখে? বড়মা হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবে আনন্দে। আনন্দে থাকা চোখদুটি বুজলাম৷ না! ঘুমের লেশ মাত্র নেই। অনেকক্ষণ কিছু একটা ভাবলাম। পাশ ঘুরে শুতেই সিয়াম ভাইয়ার ঘুমন্ত মুখটা চোখে পড়লো। হঠাৎ করে খুব রাগ হয় লোকটাকে দেখে। কেন আমায় সংসারে ফেললো? আবার তার কষ্ট, নর্দমার মতো অতিত মনে পড়তেই শরীর ঝাঁকি দিয়ে বোঝায় যে আমার ভাবনা ভুল! পাষান ভাবনা!

দুপুরে কি ঠাট্টাটাই না করলো সিয়াম ভাই। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারো শুকরিয়া। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি আমি! কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম তখন। রাগও উঠেছিলো। তারপর রেজাল্ট পেয়ে সব গলে গেছে। মামা-মামী কি খুশি! মামীর চোখে পানি দেখেছি। আর মামার চোখে গর্ব। ইচ্ছে করেই আব্বুকে রেজাল্টটা বলিনি। আমিযে যাব তাও বলিনি। কাল বলবো! নিশ্চই আমার পছন্দের আলুর পরোটা বানিয়ে দিবে শুনে! দু দাঁত বের করে একাএকা হাসলাম অনেকক্ষণ।

হঠাৎ ঠান্ডাটা জেঁকে বসলো। হাড় কাঁপিয়ে শিত রগে রগে ডুকে পড়ছে। ছুটে গিয়ে বলকনির পর্দা টানিয়ে দিলাম। শরীর থেমেথেমে কাঁপছে। বিছানায় গা এলিয়ে কম্বল জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে রইলাম। চোখে ঘুমের আভাস পাচ্ছি। কখন তন্দ্রায় তলিয়ে গেলাম জানা নেই।

___

নিল রঙা কুর্তি পড়েছি। চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছি। এলোমেলো থাকুক একটু। ভেজা চুল। ওড়নাটা গলায় জড়িয়ে সিয়াম ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি বিরক্তিতে ‘চ’ জাতিয় কিছু উচ্চারণ করলেন। আমি মুখ বাকিয়ে বললাম,

‘ আমি রেডি,চলুন। ‘

‘ অবশেষে মহারানির সাজগোছ হয়েছে। ‘

শুনতেই কটমটে চোখে তাকালাম আমি। কি লোক রে বাবা! কি এমন সেজেছি আমি? চোখদুটি নিজেকে না চাইতেও দেখলো। সাজিনি বেশি। কাঠ কাঠ গলায় বললাম,

‘ চোখে ছানি পড়েছে আপনার? দেখতে পাচ্ছেন না আমি একটুও সাজিনি। ‘

‘ তোর কানে খোল জোমেছে! আমি বললাম কেউ এত দ্রুত কিভাবে সাজতে পারে? ‘

লোকটা অদ্ভুত! না না কিম্ভুত! না রে বাবা, এ কেমন লোক? কি অদ্ভুত সব কথা বলে। কি জানি, মাথার কি তারতুর ছিঁড়ে গেছে? মুখ বাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম। উনি রুমে পেটে হাত গুজে হো হো করে হাসছেন। আমি শুনলাম দরজার বাইরে থেকে। রাগে কপালে ভাজ পড়েছে আমার।

নিচে নেমে এলাম। ড্রইংরুমের মামী আর সিনথি বসে আছে। ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, বললো ওর কোচিং, স্কুল আছে। তাই এলোনা। আমি আসতেই মামী আমার কাছে এসে চিন্তিত স্বরে বললেন,

‘ আকাশ দেখেছিস সিয়া? কেমন গুমট! বৃষ্টি নামবে বোধহয়। মেঘও ডাকছে। যদি বৃষ্টি চলে আসে? ‘

থেমে গেলাম! মামীর কথায় যুক্তি আছে। সারারাত মেঘ ডেকেছে। আকাশ এখনো থমথমে। শিতও আছে অবশ্য। তাহলে কি আব্বুর সাথে দেখা হবে না আমার? বুক হু হু করছে। সিয়াম ভাইয়া লাগেজ নিয়ে নেমে পড়লেন। কাল সব কাপড় ওনার লাগেজে ডুকিয়ে দিয়েছি। ভাইয়া দূর থেকেই বললো,

‘ সিয়া দ্রুত গিয়ে গাড়িতে উঠ। বৃষ্টি আসার আগেই। ‘

আমি হাটতে যাচ্ছিলাম। মামী কিছু একটা বলতেই থেমে গেলাম। আকাশের গর্জন বাড়ছে। আমার থামাতে সিয়াম ভাইয়া ক্রুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললো,

‘ তোকে যেতে বলেছি না? যাবি নাকি থাকবি বলতো? ‘

আমি সোজা গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম। সিয়াম ভাইয়াও আসবেন তখনি পিছু ডেকে বললো মামী,

‘ তুই এ অবস্থায় যেতে রাজি হলি? ঝড় আসতে পারে। ‘

উনি ম্লান হেঁসে বললেন,

‘ সে সারারাত উদ্দিগ্ন হয়ে ছিলো কখন যাবে। হতাশায় ফেলতে চাইছি না। আসছি। ‘

সামনের ছিটে সিয়াম ভাইয়ার পার্শেই বসলাম। মেঘ হুড়মুড় করে উঠলো৷ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামতে লাগলো ঝিরিঝিরি। আমি ভাবতেই পারিনি আমরা বসতেই বৃষ্টি শুরু হবে। দিনটা অন্ধকার! সূর্য যে মেঘের কোন অতলে হাড়িয়ে গেছে তা জানা নেই। গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হাইওয়ের পথে চলতে লাগলো। আজ অতিরিক্ত গাড়ি নেই হাইওয়েতে। বৃষ্টি আসায় ঠান্ডার তিব্রতা বেড়েছে।
লোমকূপ খাড়া হয়ে উঠছে। কই বাড়িতে তো এতো শিত করেনি? হয়তো বৃষ্টি এসেছে বলেই এতো শিত করছে! আমার পাশের জন বেশ বিন্দাসে গাড়ি চালাচ্ছে। সাদা শার্ট পড়েছে, তার উপরে কালো ব্লেজার, আবার তার উপরে কোট। ঠান্ডা লাগার জায়গা আছে? এদিকে আমি মরছি ঠান্ডায়। রগে রগে কাঁপুনি ধরছে আমার।

‘ আসার সময় চাদরটা গায়ে জড়ালে কি সাজ নষ্ট হতো তোর? ‘

তুখোড় দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। মন দিয়ে ড্রাইভিং করছেন উনি। আরে বাবা সেটাই করো। কে বলেছে কম্পিত আমার দিকে তাকাতে? মুখ বাঁকিয়ে জানালার দিকে চোখ রাখলাম। চিবুক, চোখের পাপড়ি তিরতির কাপছে! গুটিশুটি হয়ে বসে রইলাম।

‘ যদি ভাবিস, সিনেমার নায়কের মতো কোট খুলে জড়িয়ে দেবো, তাহলে বলবো ইউ রং সিয়া। এমন কিছুই করছি না আমি। ‘

মেজাজ এবার তুঙ্গে চড়ে বসলো। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বললাম,

‘ আমিকি চেয়েছি, নাকি বলেছি? ‘

‘ চাসনি, হ্যা বলিস ও নি। আমার মনে হলো আশা আছে। ‘

শরীর রাগে কাঁপছে। বাড়ছে বৃষ্টির বেগ। ধুপধাপ শব্দ তুলছে। আছড়ে পড়ছে গাড়ির ছাঁদে, গ্লাসে। সময় কাটছিলো কষ্টে। দেখতে দেখতে চলে আসলাম বাড়ির সামনে। হুট করেই ব্রেক কষতেই হকচকিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। উনি আমাকেই দেখছেন। পেছন থেকে দুটো ছাতা বের করে এগিয়ে দিলেন,

‘ লাগবে? ‘

এমনিতেই ঘা, তার উপর লবন ছিটাচ্ছে। একটানে কেড়ে রাগে ফুসতে লাগলাম। উনি বেড়িয়ে গেলেন গাড়ি থেকে। আমিও বেরোবো তখনি, চোখ পড়লো পিছনের সিটে! সাদা কাগজ! মুড়িয়ে বলের মতো পড়ে আছে। মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো। রাগ গলে রহস্যের গন্ধে অবহিত হলাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, সিয়াম ভাইয়া লাগেজ বের করছে। এটাই সুযোগ। ভাগ্য ভালো তাই পেলাম। ঝুঁকে তুলে নিলাম চিঠিটা। হাত শিরশির করছে। নিশপিশ করছে পড়ার জন্য! কি লেখা আছে চিঠিতে? কে ছিলো সেই আগুন্তকঃ?

‘ বেরো এবার..’

সিয়াম ভাইয়ার গলায় ভাবনা ছুটলো। সময় আরো পাবো। হাতে মুঠো করে বের হয়ে এলাম গাড়ি থেকে। প্রবল বর্ষন হচ্ছে। বড়বড় ফোঁটা রাস্তায় পড়ে সেগুলো ছিটকে এসে গায়ে লাগছে।
__
কলিং বেল চেপে চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। মন খুশিতে টগবগ করছে। মনে হচ্ছে বছর খানেক বাদে দেখা পাবো সবার। একটু পর কন্ঠ ভেসে এলো,

‘ কে….

বলতে বলতেই দরজা খুলে দিলো বড়মা। ঝাপিয়ে পড়লাম বুকে। বড়মা হকচকিয়ে উঠে, হাত উঁচু করে নিলো। শান্তি! ময়াময় শান্তিতে ছেয়ে গেলো আমার বুক। ছটফটানি থেমে প্রসান্তির খেলা দুটো বুকে। ধুপপুক করছে দুটি হৃদপিণ্ড। যেন লাফিয়ে বাইরে আসতে চাইছে। কি অনুভুতি! শান্তি! অস্রুসজল চোখে মাথা উঁচু করে তাকালাম বড়মার দিকে। চোখ বেয়ে জল পড়ছে বড়মার।

‘ কই বলিস নি তো আজ আসবি? ‘

আমি কাঁপা গলায় বললাম,’ সারপ্রাইজ। ‘

‘ এখনো ছোট আছিস, জামাইয়ের সামনে…ছাড়! ‘

বলেই কিয়দংশ দূরে গিয়ে দাড়ালো বড়মা। এরপর হেঁসে আমাদের ভেতরে আসতে বললো। সোফায় বসতেই চিঠিটাকে শক্ত করে নিলাম। এরপর বড়মাকে বললাম,

‘ আব্বু কই বড়মা? ‘

‘ জানি না। বেরোনোর সময় বললো রাজধানী যাবে। ‘

টনক নড়লো আমার। কাল বাজারে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমায় কল করে বলেছিলো আব্বু। আর আজ ঢাকা চলে গেলো অথচ জানালো না? কিছু একটা লুকিয়ে রাখতে চাইছে কি আব্বু? কিন্তু কি? কটু ভাবনায় বিষিয়ে উঠলো মন। আব্বু অসুস্থ নয়তো?

#চলবে…..

#আমার_সংসার
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৬

প্রিয় সুন্দরী,

কেমন আছো তুমি? ভালো নিশ্চই? ভালো থাকারই তো কথা। যাগগে, অনেকদিন পর ভারাক্রান্ত মনে লিখতে বসেছি। সম্মোধনটা প্রিয় দিয়ে করাটা উচিত হয়নি বোধহয়। কারন এখন তো তুমি আর আমার নও। চড়া দাতে ভুষীত আমার ব্যাক্তিত্ব। তোমায় না পাওয়ার যন্ত্রনা একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছে আমাকে। বুকে রক্তক্ষরণ চলছে! কেন চলে গেলে সুন্দরী? আমার সুন্দরী? নিজের থেকেও তো বেশি ভালোবাসি তোমায়! তোমার বড়বড় চোখ, অথই নদীর পানি তাতে। কত গভীর! সুন্দর! দেখলে মন জুড়িয়ে আসে। দিনে কতবার তোমার ছবি দেখি জানো সুন্দরী? হাজারবার! শ্যামলা চেহারার মুখখানা আমায় পাগল করে তোলে। ঘোরে ডুবিয়ে রাখে। তোমার ব্যাক্তিত্ব কত শক্ত ছিলো সুন্দরী? কত মজবুদ। সে ব্যাক্তিত্ব নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগবে ভাবতে পারিনি আমি। তুমিই তো বলেছিলে, অনার্স ফাইনাল না দিয়ে কখনোই বিয়ের কথা মুখে আনবে না। তাহলে কি করে পারলে বিয়ে করতে? কে সে সৌভাগ্যবান পুরুষ? চিনিনি তো! তাকে হিংসে হচ্ছে। খুন করতে ইচ্ছে করছে। আমার সুন্দরী আজ তার কাছে! কাছে থাকার হালাল সনদ তার হাতে! এ কেমন বিষাক্ত অনুভুতি? বুক জ্বালানো কষ্ট? চোখ ধাধানো আগুনে জ্বলা হৃদপিণ্ড? আমার যে সহ্য হচ্ছে না প্রেয়সী! হচ্ছে না সহ্য! এগুলো কি সপ্ন হলে পারতো না? ভয়াভয় দুঃসপ্ন হলে খুশি হতাম।

লিখতে হাত কাপেঁ, বুক কাঁপে। ডায়রির পাতা ভিজে ওঠে কোন পুরুষের কান্নায়। চোখ ডুমুরের মতো ফুলেছে। লাল টকটকে চোখ! সামি তপ্তশ্বাস ছাড়লো। বুক ছারখার হয়ে আসছে। হৃদপিণ্ড চিঁড়ে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। কষ্টে গলায় দলা পাকিয়ে আসছে তার। সামি অস্ফুটস্বরে উচ্চারন করে ‘ সুন্দরী…আমার সুন্দরী ‘ সে কন্ঠে কত কষ্ট! কত জ্বালা! ধা ধা আগুন! একটা মানুষকে এতটা নিখুঁত ভালোবাসা যায়? যায় বুঝি! নয়তো সামির এতটা কষ্ট হতো না।

অন্ধকার ঘর। টেবিল ল্যাম্পের বাতিটার পাওয়ার একদম লো। হালকা রশনি ছড়িয়েছে সে। যেন শুধু টেবিলটাই আলোকিত করা কাজ তার। সামি দু হাতে মুখ গুজে হু হু করে কেঁদে উঠলো। ছেলেরা নাকি কাঁদতে জানে না? তাদের নাকি কষ্ট হয় না? তাহলে সামির বুকপোড়া কষ্ট কেন হচ্ছে? ভেতরটা ছারখার হয়ে আসছে কেন? শুধুইকি তার সুন্দরীকে আর পাবে না বলে, নাকি অন্য পুরুষের সংস্পর্শে তার সুন্দরী! কোনটা?

মহুয়া দরজা থেকে ছুটে গেলেন শ্বামীর কাছে। ছেলের এতো নির্মম বেদনা তার সহ্য হচ্ছে না। তারও ঠিক সামির মতোই ব্যাথায় বুক ফেটে আসছে। একটি মাত্র সন্তান। আর তার এই হাল? এ কিছুতেই মানতে পারছেন না মহুয়া। রুমে এসে দেখলেন তার স্বামী পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাচ্ছে। ছুটে গিয়ে স্বামীর পা জড়িয়ে বুক ফাটা আর্তনাৎ করে কেঁদে উঠলেন মহুয়া। কম্পিত কণ্ঠে বললেন,

‘ তুমি তো আই পি এস অফিসার। তুলে নিয়ে আসো ওই মেয়েকে। যেভাবেই হোক সামির মুখে হাসি ফোটাও। একমাত্র ছেলেটা একটা মেয়ের জন্য ধুকে ধুকে মরবে আমি মানতে পারছি না। কিছু করো তুমি। ফোর্স পাঠাও। তুলে আনো মেয়েটাকে। ‘

তজমুর বিরক্তি নিয়ে চেয়ার ছাড়েন। মহুয়ার হাত, পা থেকে ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে দাড়ান। মহুয়া স্বামীর অবহেলায় ফুঁপিয়ে ওঠে। দুদীন যাবৎ মহুয়া বলছে, মেয়েটাকে তুলে আনতে। এটা কি সম্ভব? সে নিজেও চিন্তিত ছেলের কষ্টে। কিন্তু সব জায়গায় কি জোর চলে? মেয়েটা হয়তো নিজ থেকে বিয়েটা করেছে। মহুয়া কঠিন গলায় বলে ওঠে,

‘ তুমি কিছু করবে না? ‘

চুপ রইলেন তাজমুর। বোঝাতে বোঝাতে সে ক্লান্ত।

মহুয়া উঠে দাড়ায়। স্বামীর কলারে হাত দেয়ার মতো স্পর্ধা দেখায় সে। হঠাৎ আক্রমণে থতমত খেয়ে গেলেন তাজমুর। মহুয়া কাটখোট্টা মানুষ। অল্পতেই ভয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকে। তাজমুরের মনে হচ্ছে মহুয়ার শরীরে জ্বিন প্রবেশ করেছে। আর সে’ই মহুয়াকে করে তুলছে ধৈর্যহারা, উত্তেজিত। মহুয়ার কন্ঠ শিতল,

‘ তুমি সত্যিই কিছু করবে না? ‘

এমন কন্ঠ কখনো শোনেনি তাজমুর। মহুয়ার ডান চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। তার চোখ আগুন ঝলসানো। গাঢ় লাল। তাজমুর ভিত গলায় বললেন,

‘ না। ‘

মুহুর্তে দমে গেলেন মহুয়া। দৃষ্টি শান্ত হতে লাগলো। হাত আলগা করে ছিটকে দূরে গিয়ে দাড়ালেন উনি। চোখমুখ কুঁচকে বললেন,

‘ আমি পারছি না সহ্য করতে। পারছি না। ‘

___

দুপুর হয়ে এসেছে। আকাশ পরিষ্কার। আকাশের জ্বলজ্বলে সূর্য কিরন ছড়াতে ব্যাস্ত। ঘরির কাটার তখন দুটোর ঘরে। আব্বু এখনো আসেনি। কোথায়, কি করছেন কে জানে। আসার পর থেকে একগ্লাস পানি অব্দি খাইনি। মামী আর আমার কথায় সিয়াম ভাইয়া খেয়েছে। ঘরে উনি। কি যেন কাজ আছে বললেন। আমার মন টিকছে না। দরজার দিকে চেয়ে আছি তীর্থের কাকের মতো। কখন আসবে আব্বু?

আমার ভাবনার মাঝেই দরজায় এসে দাড়ালো আব্বু। ছুটে গেলাম আব্বুর কাছে।

‘ কই গিয়েছিলে তুমি? একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? ‘

আমাকে দেখেই শুকনো ঠোঁটে হাসলো আব্বু। মুখ ফ্যাকাশে। শরীর শুকিয়েছে অনেক। থমকে গেলাম। এ কি হাল আমার পিতার? উনি ভেজা গলায় বললেন,

‘ কখন এসেছিস শুনি? একবারও জানাবি না আমায়? তুই বললে কি আমি যেতাম রে পাগলি? ‘

‘ তার আগে এটা বল তুমি কেন গিয়েছিলে রাজধানী? কাউকে কিছু না বলে? ‘

কড়া গলায় বললাম। আব্বুর দৃষ্টি এলোমেলো। আমায়,আমার প্রশ্নকে এড়িয়ে ভিতরে ডুকলো আব্বু। কি হয়েছে ওনার? আমায় এড়াচ্ছে? তার সিয়াকে? চোখভর্তি পানি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনি ভেতরে গিয়ে হাতের ফাইলটা রেখে জুতো খুলতে খুলতে বললো,

‘ তোর রেজাল্ট সিয়া? ‘

‘ ফার্স্ট ক্লাস। ‘ কথার ভঙ্গিতে বিরক্তি আমার। উনি আমার দিকে তাকালেন। ওষ্ঠদ্বয় টেনে বললেন,

‘ আমার সিয়ার এতো রাগ? জোর করে বিয়ে দিয়েছি বলে? নাকি এখন এড়ালাম বলে সে কষ্ট পেয়েছে? যাগগে,সন্ধ্যায় সব বলবো। ‘

বলেই একপ্রকার ছুটে উপরে চলে গেলো আব্বু। কোথথেকে বড়মা এসে টেনে নিয়ে গেলো টেবিলে। ভাত মেখে খাইয়ে দিলো। খাওয়ার মাঝে বললাম,

‘ তুষার ভাই কই বড়মা? ‘

‘ জানি না। কিছু বলে যায়? ‘ কন্ঠে ক্ষত বড়মার। একমাত্র ছেলেটা মাদকাসক্ত! কি নির্মম পরিস্থতি! শুকনো গলায় বললাম,

‘ বড় আব্বু? ‘

‘ উনি বরিশাল গেছে কোন কাজে। কাল ফিরবে। ‘

আর কথা হলো না। খাওয়া শেষে চুপচাপ ঘরে এলাম। রুমে ল্যাপটপে কাজ করছেন সিয়াম ভাইয়া। ঘরে ডুকলাম।
উনি ল্যাপটপে কিছু দেখছে আর নোটপ্যাডে লিখছে। শান্ত হয়ে বিছানার এক কোনে বসলাম আমি।

‘ আব্বা এসেছেন? ‘

‘ হুম মাত্রই। ‘

উনি ওনার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। যেন এটা শোনা ওনার আরেক কাজ ছিলো।

‘ শুনছেন? ‘

উনি ব্যাস্ত চোখে তাকালেন আমার দিকে। মৃদু স্বরে বললেন,

‘ হুম। ‘

‘ কি করছেন আপনি? ‘

‘ ওয়ার্ক ফর্ম হোম। ‘

আগ্রহ বাড়লো। উৎফুল্ল কন্ঠে বললাম,’ আমি যখন চাকরি করবো তখন আমিও বাড়িতে শুধু কাজ করবো। অফিসে যাবোই না। ‘

‘ সবাই এটা পারে না। কাজে ভুল থাকতে পারে, যেটা অফিসে থাকলে শোধরানো সহজ। একজন দক্ষ কর্মীই পারে বাড়িতে কাজ করতে। আর তুই নাকি অফিসার হবি? তো তখন তো তোকে দিনরাত এক করে কাজ করতে হবে। বাড়িতে তো কাজ করা অসম্ভব! ‘

অবাক চোখে তাকালাম আমি। উনি কি করে জানলেন আমি অফিসার হতে চাই? অবাক কন্ঠে বললাম,

‘ কে বলেছে আমার হবি নিয়ে? ‘

‘ তোর আব্বু। ‘

চকিতে তাকালাম আমি। আব্বু বলেছে? আর কিছু বললাম না। উৎসাহ জেগেছিলো। ধামাচাপা দিয়ে জানালায় দৃষ্টি রাখলাম।
___
সন্ধ্যা নেমেছে। হালকা বাতাসে শরূর কাঁপিয়ে তুলছে একদম। ছাঁদের হাতল বরফের মতো ঠান্ডা। তাই একটু দুরুত্ব দেখেই দাড়িয়ে আছি। গায়ের চাদর বাতাসে উড়ছে। ঠান্ডা পড়ছে খুব! আব্বু সেই কখন আসতে বললো এখনো তার দেখা নেই।

‘ সন্ধ্যায় এখানে তুই? ‘

সিয়াম ভাইয়ার গলা পেতেই সেদিকে তাকালাম। সোয়েটারে হাত গুঁজে অন্যরকম মুখ ভঙ্গিমায় দাড়িয়ে উনি। বললাম,

‘ আব্বু আসতে বলেছে! তা আপনি? ‘

হঠাৎ অবাক হলেন উনি। বললেন,

‘ তোকেও আসতে বলেছে? আমাকেও তো বললো। ‘

‘ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন হয়তো। ‘

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here