আমার_সংসার,পর্ব ৯,১০

0
1521

#আমার_সংসার,পর্ব ৯,১০
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৯

শরীর কাঁপছে! রাগে থরথর করে কাঁপছে। আধঘন্টা হলো ফোন করেছি এখনো উনি আসেনি। কেন? বিছানার চাদর খিচে নিলাম। চিঠিটা পড়ার পর রিকশা থেকে নেমে পরি আমি। ট্যাক্সি করে চলে এসেছি মামীদের বাসায়। নিচে সবাইকে উপেক্ষা করে ছুটে আমাদের রুমে চলে এসেছি। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য লাগছে। কাল আব্বু কত শক্ত কন্ঠে বলেছিলো,’ পৃথিবী উল্টে গেলেও যেন তাকে ভুল না বুঝি! ‘ কথাগুলো বারবার প্রতিধ্বন্নি হয়ে কানে বাজছে। আর সেখানে লোকটা নিজেই একটা শিশুর খুনি? কেন উনি খুন করেছেন একটা শিশুর? কতটুকু ছিলো বাচ্চাটি? ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে আসছে! অথচ মুখে কাঠিন্যে ভাব! কতটা কষ্টকর! তবুও রেখেছি। আজ আমার সকল প্রশ্নের উত্তর ওনাকে দিতে হবে! জানতেই হবে সবটা আমায়।

‘ এভাবে এখানে আসার মানে কি সিয়া? কিসব অভদ্রতা বলবি আমায়? ‘

সিয়াম ভাইয়ার স্বর পেতেই কড়া চোখে তাকালাম আমি। উনি হাঁপাচ্ছেন। হয়তো ছুটে এসেছেন সিঁড়ি দিয়ে। আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম এই লোকটার দিকে। উনি আবারো বলতে আরম্ভ করলেন,

‘ নিচে কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছিস কেন তুই? মা চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। ‘

……

‘ ওয়াট রং উইথ ইউ? চুপ করে আছিস কেন তুই? ‘

……

‘ এবার কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। ওদিকে তোর আব্বুও চিন্তিত! ‘

উনি রাগে গজগজ করতে করতে ছুটে এলেন আমার সামনে। বাহু ঝাঁকিয়ে কর্কশ গলায় বললেন,

‘ তুই কিন্তু লিমিট ক্রস করছিস! ‘

শান্ত দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার হাতের দিকে। আমার অদ্ভুত চাউনিতে উনি ভ্রু কোঁচকালেন। শান্ত গলাতেই বলে উঠলাম,

‘ কে সেই ছেলেটি সিয়াম ভাইয়া? কার খুনী আপনি? ‘

বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সিয়াম ভাই। তার মুখ মুহুর্তে পাল্টে যায়। চোখ শিতল হয়। মুখশ্রীতে রাগ নেই। চাউনি অবাক! কেবল পাথর মুর্তির মতো একচোখে আমার দিকেই তাকিয়ে রইলেন উনি।

‘ বলবেন না? কেন খুন করেছেন? ‘

‘ কিভাবে জানলি তুই? ‘ কন্ঠ কেমন শোনালো। ঘার থেকে হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম আমি। বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। উনি ধপ করে বসে পরলেন বিছানায়।বললাম,

‘ অজানা কেউ আপনার মুখোশ খুলে দিয়েছে আমার সামনে। ‘

উনি আমার পিছনে এসে দাড়ালেন। তার মুখেচোখে ভয়! সব হারাবার ভয় পুলকিত হতে লাগলো। উনি স্তব্ধ কন্ঠে বলে ওঠেন,

‘ কে বলেছে তোকে? ‘ কন্ঠ কত করুন, আক্ষেপে জর্জরিত শোনালো। আমার নিজেরই বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছে আমি যাতে মুগ্ধ সে খুনী! কোন বাচ্চাকে নরপশুদের মতো খুন করেছে। বুকের জ্বালা বেড়ে দ্বীগুন হলো। আমার ওষ্ঠাদ্বয় তিরতির করে কাঁপছে! বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ঝলসে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না, ঘুরে গিয়ে তার কলার চেপে চেঁচিয়ে উঠলাম,

‘ কোন মায়ের বুক খালি করেছেন আপনি? কাকে মেরেছেন উত্তর দিন! ‘

আমার প্রশ্নে তার চিবুক কেঁপে ওঠে। দৃষ্টি এলোমেলো, কনকনে শিতে তার কপালে গুচ্ছ গুচ্ছ ঘামের কনা। আমার বুক বিরতিহীনভাবে ওঠানামা করছে। উনি চুপ! চুপ থাকারই তো কথা। খুন করে অন্তত কেউ বরগলায় কিছু বলতে পারে না। কিন্তু ওনার চুপ থাকা যে আমার রাগ কয়েকশোগুন বাড়িয়ে তুলছে। কপালের রগ দপদপ করছে আমার।

‘ এভাবে চুপ থেকে প্রমান করবেন না আপনি দোষী! বলুন। সবটা বলুন। ‘

উনি চুপ। একচোখে তাকিয়েই আমার দিকে। ফের বললাম,

‘ কি হলো বলুন! কে সেই ছেলেটি সিয়াম ভাইয়া? ‘

আমার প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে কলার থেকে হাত নামিয়ে দুহাত শক্ত করে ধরে নিলেন উনি। উত্তজিত গলায় বললেন,

‘ তুই? সিয়া তুই বিশ্বাস করিস আমি খুন করতে পারি? আমি…এই আমি কাউকে খুন করেছি তোর বিশ্বাস হয় সিয়া? ‘

গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। তার চোখ ভর্তি আকুতি! আমার উত্তরের অপেক্ষা সে চোখে। শুকনো ডোগ গিলে কড়া গলায় বললাম আমি,

‘ করি! বিশ্বাস করি আমি। ‘

হাত ছেড়ে দূরে গিয়ে দাড়ালেন উনি। চোখ ছলছল করছে ভাইয়ার। কি করবেন কি না করবেন ভেবে পাচ্ছে না। বিছানার পাশে রাখা টেবিলটা থেকে উনি কাঁচের একটি টপ তুলে নিলেন। অজানা ভয়ে আৎকে উঠলাম আমি। একমুহূর্ত না দাড়িয়ে ছুটে গিয়ে হাত আটকে নিলাম ওনার।

‘ কি করছেন আপনি? ‘

আমার প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে জড়িয়ে নিলেন আমায় উনি। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তার হৃদপিণ্ড দ্রুততম বেগে লাফাচ্ছে। হয়তো তুফান বইছে। এত শিতেও তার শরীরে একটি শার্ট ছাড়া কিছু নেই। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রইলেন উনি। শরীর ঘেমে একাকার ভাইয়ার। একটু পর অস্ফুটস্বরে বললেন,

‘ তুই পারিস না আমায় ভুল বুঝতে। পারিস না। ‘

থেমে হেলাম। ছোটবার তেজটা কমে এলো। সান্ত গলায় বললাম,

‘ কেন পারি না? অবশ্যই পারি! ‘

‘ না…না….কিছুতেই না। ‘

‘ আমায় বলুন সবটা। ‘

দূরে ছিটকে ফেলে দিলেন উনি। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পরলাম। কিংকর্তব্যবিমুঢ় চাউনিতে তাকালাম ওনার দিকে। শুকনো ঠোঁটে কিছু বিরবির করছেন উনি। আবারো আমার পাশে মেঝেতে বসে পরলেন। উন্মাদ, পাগল লাগছে। দু হাত আমার মুখে রেখে বললেন,

‘ কিভাবে জেনেছিস তুই? সিয়া বল! কে বলেছে তোকে? ‘

আলতো করে চিঠিটা হাতে দিলাম ওনার। উনি ভ্রু কুঁচকে হাত থেকে নিয়ে নিলেন। এরপর পড়তে লাগলেন। ফুপিয়ে উঠলাম। গাল ভিজে গেলো নোনাজলের স্রোতে!

খুনী সিয়াম?,
হাতচেঁড়া মৃতের মতো সে দৃশ্য কত ভয়ঙ্কর, নিকৃষ্ট ছিলো,মনে আছে তো তোমার? ওর মাথায় গুলি করা হয়েছিলো। জানো সিয়া? তোমার সাথে যার বিয়ে হলো সে একজন খুনী। আমি জানি না কে হও তুমি ওর। কিন্তু এটুকু বুঝেছি তুমি একটু স্পেশাল ওর কাছে! সিয়ামের মুখে তোমার নাম শুনেছি বহুবার। কিন্তু একটা মেয়ে হিসেবে তো আমারই উচিত তোমায় বাঁচানো তাইনা? তাই বলছি! আমি চেয়েও পারিনি বিয়ের আগে চিঠিটা পৌছাতে। লিখছি খুব তারাতাড়ি। কি লিখছি জানা নেই। তাও তুমি আসরে বসার পর লিখছি। যাইহোক, একটা আশা রাখবো তোমার কাছে, তুমি শুধু জানতে চাইবে কেন খুন করেছিলো ও। ব্যাস এতটুকুই! আমি মনে করি ওকে ছেড়ে দেয়া উচিত তোমার। আমায় খোজার চেষ্টা করোনা। এ চিঠিটা যেন কারো হাতে না পড়ে। আমায় খোজার বৃথা চেষ্টা করে নিজের সময় নষ্ট করোনা। মনে করতে পারো তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী আমি।

চিঠিটা পড়তেই পানিভরা দৃষ্টিতে তাকালেন উনি। তুফান বয়ে যায় বুকে তার তাকানোর ভঙ্গিতে। তার চাউনি দেখলে বুক ফেটে আসে। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে হয় ,’ সবটা বলো! সবটা। ‘ কেন এমন হচ্ছে। আমিকি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি? তাহলে তো এগুলো নাটক ছিলো! এতকিছু আনা,নাটক ছিলো সবটা! তবুও কেন এখনো মায়া হচ্ছে আমার? কেন ওনার চোখের পানি নরম করছে আমায়?

_____

আজ নিয়ে কেটে গেছে দুদীন। ভাইয়া দুদীন কোথায়, কেমন আছে জানা নেই। ফোন দিলে রিসিভ করেন না উনি। মামা-মামী চিন্তা পাগল হয়ে যাচ্ছেন। ড্রইংরুমের সোফায় চিন্তিত হয়ে বসে আছি আমি। উনি উধাও হয়ে কেন গেলেন? আমিতো বলিনি সবাইকে সব বলবো! তাহলে? গুম হয়ে এটা বোঝাচ্ছে যে উনি নির্দোষ? নাকি এটা বোঝাচ্ছে আসলেই সব দোষ ওনার। আর কে সেই চিঠি প্রেরক? ত্রিধাপুর কথা মাথায় এসেছিলো, কিন্তু ত্রিধা হয়ে থাকলে কি আবার কোন ইঙ্গিত দিতো না? সব গুলিয়ে আসছে! এ কোন বেরাজালে আবদ্ধ হলাম আমি? দুদীন ধরে তার দেখা নেই! চিন্তাও যে কম হচ্ছে তা নয়!

‘ মা, ভাবি কই তোমরা? ভাইয়া ফোন রিডিভ করেছে। ‘

কথাটা কর্নকুহরে পৌছাতেই পিছু ফিরে তাকালাম আমি। সায়েম একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামছে। সোফা ছেড়ে উঠে আমি এগোতেই মামী ছো মেরে ফোনটা হাতে নিলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

‘ সিয়াম…বাবা কই তুই? ফোন কেন রিসিভ করছিলি না? ফিরে আয়। ‘

ওপাড় থেকে কিছু বলতেই মামী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ কেউ ভালো নেই। তুই জলদি ফিরে আয় বাবা। ‘

আবারো ওপাড় থেকে কিছু বললেন ভাইয়া। মামী হু হু করে কেঁদে উঠলো। হয়তো আসবে না বলছে! সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ বিগড়ে গেলো আমার। মামীর কাছে গিয়ে বললাম, ‘ ফোনটা দাও! ‘ ফোন দিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো মামী। শক্ত গলায় বললাম,

‘ শুনতে পাচ্ছেন মায়ের কান্না? কেমন ছেলে আপনি? এখানে সকলে কত চিন্তায় রয়েছে জানেন আপনি? আজকের ভিতরে আপনাকে বাড়িতে দেখতে চাই আমি। কোন এক্সকিউজ শুনতে চাইছি না। আপনার এতটুকু মনুষ্যত্ববোধ থাকলে আজই চলে আসেন। ‘

একটানে কথাগুলো বলে দম ফেললাম। উনি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললেন,

‘ এতটা ঘৃনা তোর আমার প্রতি? ‘

‘ ঘৃনা, অবিশ্বাস কিছুই নেই! মামীর কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি চলে আসুন। ‘

‘ তোর কান্না দেখে বাঁচতে বলছিস? ‘

চোখ ছলছল করে উঠলো৷ এতক্ষণ শক্ত হয়ে কথা বললেও গলা ভেঙে আসছে আমার। উনি আবারো বললেন,

‘ আসছি, আজ সব বলবো তোকে। ‘

ফোন কেটে দিলেন উনি। ফোনটা সায়েমের হাতে দিয়ে ‘ উনি আসছেন। ‘ বলে চলে গেলাম উপরে। বিকেলে বিদ্ধস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরলো সিয়াম ভাইয়া।

#চলবে…

#আমার_সংসার
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১০

দুপুরের মিষ্টি রোদ আর নেই। সূর্য হেলে পড়তেই গা হিম করা ঠান্ডা পড়তে আরম্ভ করেছে। বাতাসের তিব্রতা বেড়ছে। সাঁ সাঁ শব্দ তুলে ছুটছে ওরা। মন, শরীর কাঁপিয়ে তুলছে। দরজায় ঠকঠক আওয়াজে শিরদাঁড়া বেয়ে শিতল স্রোত বয়ে গেলো। বড়মা, মামী এমনকি আব্বুও চলে এসেছেন। বেশ কয়েকবার রক্তচক্ষু দেখিয়েছে আব্বু। আমি জানিনা কেন, কিন্তু তবুও ভয়ে জড়সড় হয়ে মামীর পাশে দাড়িয়ে ছিলাম। কোথথেকে জুঁই ছুটে এসে দরজা খুলে দিলো। বাইরের দমকা হওয়া ঘরে প্রবেশ করে। একটু কেঁপে উঠি আমি। এরপর দরজার দিকে তাকাতেই চোখ কপালে উঠলো আমার। শুধু পাতলা একটি টি শার্ট আর কালো একটি প্যান্ট ওনার শরীরে। ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে সিয়াম ভাইয়া। মামী ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে নিলো সিয়াম ভাইয়াকে। কিন্তু ওনার দৃষ্টি আমাতে স্হির। অস্বস্তি হয় তার তাকানোয়, কিন্তু তবুও উনি তাকান। আমি নিজেই চোখ নামিয়ে নিলাম। মামী টেনে ভিতরে ডোকালেন ওনাকে। শাসিয়ে বললেন,

‘ এমন বিদ্ধস্ত অবস্থায় তুই বাইরে ছিলি? কেন তুই এভাবে হ্যারাস করাস সিয়াম? দেখ, সবাই কতটা চিন্তিত তোকে নিয়ে। আর তুই এই ঠান্ডায় একটা শার্ট পড়ে ঘুরছিলিস? ‘

উনি কিছুই বললেন না। মামী আবারো বললো,

‘ এক্ষুনি রুমে গিয়ে সোয়েটার পরবি। যা রুমে যা। ‘

রুমে যেতে বলছে মানে? কেউ কিছুই বললো না? কেন? কোথায় ছিলো, কেন ছিলো কেউ কিছু জানতে চাইলো না কেন? সিয়াম ভাইয়া সোজা উপরে চলে গেলেন। আমি মামীর সামনে দাড়িয়ে বলে উঠলাম,

‘ তুমি জানতে চাইলে না উনি কোথায় ছিলো? ‘

‘ না! কেন বলতো? ‘ কন্ঠ স্বাভাবিক মামীর। কিছুই বুঝছি না আমি। কিছুক্ষণ আগেই মানুষটাকে সচক্ষে কাঁদতে দেখেছি। আর এখন এতটা স্বাভাবিক? এমনকি জানতেও চাইবে না উনি কেন এবং কোথায় ছিলো? আমি শুকনো ঠোগ গিলে কৌতুহল চাপা দিয়ে বললাম,

‘ কিন্তু মামী…’

‘ ও এমনি! তুই নতুন এ বাড়িতে। সবটা জানবি। তবে দুদীন কখনো ও বাড়ির বাইরে থাকেনি, কম হলে একদিন! এর বেশি নয়। তাই চিন্তা হচ্ছিলো। ‘

এরপর আমার দু হাত মামী মুঠো করে নিলো। আস্বস্ত কন্ঠে বললো, ‘ তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস, আমার সিয়াম কখনোই কোন ভুল করতে পারে না। ‘

বলেই জুঁইকে তাড়া দিয়ে চলে গেলো মামী রান্নাঘরে। একগাদা প্রশ্ন জাঁকিয়ে দিয়ে গেলো মনে। হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলাম আমি। আমার কাছে সবটা অগোছালো লাগছে। সবটা!

‘ সিয়া! ‘

আব্বুর গলা পেতেই ফিরলাম তার দিকে। উনি আমার সামনে এসে সন্দিহান হয়ে বললেন,

‘ সিয়াম প্রমিজ করেছিলো, ও বিয়ের পর কখনো না বলে বাইরে রাত কাটাবে না। তাহলে দুদীন ও বাইরে কাটিয়ে এলো? তোদের মধ্যে কিছু হয়েছে সিয়া? ‘

অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম আব্বুর দিকে। কই সেই রাতে তো আব্বু এতোকিছু বলেনি আমায়? আমি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম,

‘ আব্বু সত্যি করে বলোতো, এ বিয়ের আর কত কাহিনি বাকি? ‘

‘ সবটাই জানাতাম, সিয়াম মানা করেছে! ‘

মাথায় বাজ পড়লো আমার। সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে রইলাম আব্বুর দিকে। কি এমন কাহিনি এ বিয়ের যে ভাইয়া বলতে মানা করেছে? আর কত গভীরে গেলে উত্তর পাবো? আব্বুকে চেপে ধরলে কোন উত্তর পাবো না জানি আমি। সিয়াম ভাইয়া মানা করে থাকলে একটা শব্দও বের করবে না আব্বু! মাথা ঘুরছে আমার। আব্বু আবারো অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘ সিয়া? ‘

তাকালাম ওনার দিকে। একটু কাঠিন্যে গলায় বললেন উনি,

‘ আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পাইনি আমি। ‘

‘ কোন প্রশ্ন? ‘

‘ কি হয়েছে তোদের মধ্যে? ‘

পানিশূন্য গলায় কেশে উঠলাম। আমতাআমতা করে বললাম, ‘ কি…আবার হবে? ক্ কিছুই না। ‘

‘ কিছু না হলেই ভালো। আশা রাখবো তুই আমার কথার অমান্য করবি না! কি বলেছিলাম মনে আছে? পৃথিবী উল্টে গেলেও সিয়ামকে এতটুকু ভুল বুঝবি না তুই! ‘

আবারো একই কথা বললো আব্বু। একটু আগে মামীও বলেছে! কিন্তু কেন? তারা যখন জানবে একটা ছোট্ট শিশুর খুনি উনি, তখনো কি আমায় তাকে বিশ্বাস করতে বলবে? নাকি নিজেরা করবে? কিছু না বলে ছাদে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ানোর শক্তি নেই আমার!

____

দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়েছে। লাল আভায় অসম্ভব সুন্দর চারপাশ। কিন্তু নিজেকে বুঝতে, আব্বু, মামী সবাইকে বুঝতে ব্যার্থ আমি। মামী কতটা উঁচু গলায় বললো যে উনি কোন অন্যায় করতে পারেন না। আব্বুও ঠিক এটাই বললো! কিন্তু ওনার নামে খুনীর অপবাদ! আবার এই অজানা শুভাকাঙ্ক্ষীটাই বা কে? চিঠিতে লিখেছিলো, আমি মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ হতে দিতে পারবো না। তাহলে কি ভাইয়া আরও কোন রিলেশনে ছিলেন? কথাগুলো ভাবলেই মাথা ঘুরে ঘুরে উঠছে। অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করছে।

হঠাৎ ফোনের শব্দে টনক নড়লো আমার। পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম ‘সামি’ ফোন করেছে। আমি রিসিভ করতেই সামি বলে উঠলো,

‘ আজ কলেজে আসলি না কেন? ‘

‘ খারাপ লাগছিলো। ‘

‘ কালই ভর্তির ডেট পড়েছে। আসবি তো? ‘

‘ হুম যাবো। ‘

কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা! এরপর সামি আড়ষ্ট গলায় বললো,

‘ তুই ভালো আছিস সুন্দরী? ‘

স্মিত হেঁসে বললাম, ‘ হুম ভালো আছি। ‘

‘ ভালো থাকলেই ভালো। ‘

ফোন কাটতেই বুক হাহাকার করে উঠলো সামির। তার কেন বারবার মনে হচ্ছে তার সুন্দরী ভালো নেই? ভালো থাকলে এমন শোনায় না তার সুন্দরীর রিনরিনে কন্ঠ! সামির মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, ‘ সত্যিই কি ভালো আছো সুন্দরী? ‘ হাতের ফোন বুকে জড়িয়ে রাখে সযত্নে। এই ফোন থেকেই তার সুন্দরীর গলা শুনেছে। কতদিন দেখা হয়না তার বড়বড় পাপড়িওয়ালা দুটি চোখ। একপাক্ষিক ভালোবাসা এতটা কষ্টের কেন হয়? সামির সব সপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। নাকের ডগায় পানি পৌছাতেই ছামি মুছে নিলো। ডাটা অন করেই সিয়ার প্রফাইলে উঁকি মারতে গেলো সামি। সিয়া চায়নি বলেই সে কখনো একটা ছবি তোলেনি ওর। শুধু প্রোফাইলেই তার একটা ছবি। এটা দেখে জিবন পার করা সম্ভব হবে তো?

____

ছাদে আরও কারো অস্তিত্ব টের পেতেই ঘার ঘুড়িয়ে তাকালাম আমি৷ দূরে দাড়িয়ে আছেন সিয়াম ভাইয়া। আমি তাকিয়ে দেখে আমার পাশে এসে বসলেন উনি। কিছুক্ষন পিনপতন নীরবাতা। দুটি নীরব মানুষের মধ্যিখান দিয়ে বাতাস নিজ বেগে ছুটছে অজানা গন্তব্যে। নীরবতা কাটিয়ে আমিই বললাম,

‘ খেয়েছেন? ‘

‘ না। ‘ গলা শান্ত শোনায়।

‘ কেন খাননি? ‘

‘ তুমি খেয়েছো? ‘ আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো। লাল রঙা আকাশের দিকে তাকিয়ে তপ্তশ্বাস ছেড়ে বললাম,

‘ খাইনি। ‘

কথাটা শুনেই উনিও তাকালেন সূদুর আকাশে। একঝাক পাখি উড়ে যায়। হঠাৎ বললেন,

‘ আমার আর ত্রিধার অনেক আগেই ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিলো। ‘

চকিত নজরে তাকালাম ওনার দিকে। উনি আকাশ দেখছেন। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললাম,

‘ অনেক আগে মানে? ‘

‘ বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপর’ই। ‘

‘ কিন্তু কেন? ‘

‘ ত্রিধা কখনোই আমায় ভালোবাসে নি। টাকার লোভ, নয়তো মোহ ছিলো ওর। যা দুদীন ছিলো, এখন আর নেই। ‘

প্রতিটা বাক্য অবাক করে তুলছে আমায়। শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে বললাম,

‘ আপনি জেনেও রিসোর্ট বুক করেছিলেন? আর এত আত্মীয়-স্বজনকে এলাও করেছেন? ‘

‘ হুম করেছি। ‘

একদম স্বাভাবিক কন্ঠ! যেন সবটা পরিকল্পিত হয়েছে। কোন খুঁত নেই! নিখুঁত কাজ।

‘ যদি আমার আর আপনার বিয়ে না হতো? ‘

‘ হতো! হতেই হতো! ‘

হতো,হতেই হতো, কথাটা কানে বাজলো কয়েকবার। এটাও পরিকল্পনা করা ছিলো? নিচু গলায় বললাম,

‘ কেন? কেন হতেই হতো? ‘

উনি চুপ করে তাকিয়ে রইলেন আকাশে। সূর্য পুরোটা ডুবে গেছে। মৃদু অন্ধকার নেমে এসেছে ধরনীতে। আমি ফের বললাম, ‘ কি হলো বলুন? ‘

‘ কেন? জানতে চাস? কারন তোর আব্বু আমার পাশে ছিলো। ‘

বুক ধুক করে উঠলো। এতে আব্বুও সামিল? এরমানে আগে থেকেই প্লান করা সবটা।

‘ কিন্তু আপনাকে দেখলেই যে আমার জড়তা, ভয় কাজ করতো এ তো নিশ্চই অজানা ছিলো না আপনার। আর আপনিও তো আমায় তেমন পছন্দ করতেন না। ‘

‘ করতাম। এই ভয়, আমায় দেখলে পালানো, সামনে না আসা, আর কি বললি? জড়তা? এগুলোই ভালো লাগতো আমার। ‘

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here