আমার_সংসার,পর্ব ১৩,১৪

0
1618

#আমার_সংসার,পর্ব ১৩,১৪
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১৩

লাল কৌটো হাতে করে উপরে চলে আসলাম দুজনে। অনেকদিন পর এতগুলো বাদাম পেয়েছি। ঠান্ডাটা আর ঠিক গায়ে লাগছে না। আমি আর সিয়াম ভাইয়া বেশ সাবধানে রুমে এলাম। বিছানায় বসে চাদর জড়িয়ে নিলাম গায়ে। উনিও এসে বসলেন পাশে। বালিশের পাশ থেকে সোয়েটার পড়ে নিলেন। কৌটাটা খুললাম। এরপর কৌটার মুখ পাশে রাখলাম কারন সমস্ত খোসা এটায় রাখবো। আমার আগেই উনি একটা বাদাম তুলে নিলেন। কিড়মিড় শব্দে খোসা ভেঙে মুখে পুড়ে দিলেন দুটো বাদাম। আমিও খেতে লাগলাম। খাওয়ার আওয়াজে আমাদের রুম মুখরিত! রাতের জন্য তা গাঢ় হয়ে কানে বাজছে। তখন বেলকনির পর্দা আর লাগানো হয়নি। চাঁদের মিষ্টি আলো এসে ঘরে ডুকেছে। আর সেই আলোয় চোখ বুজে বাদাম চিবুচ্ছি। কি শান্তি! হঠাৎ চোখ খুলে দেখলাম উনি অপলকভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করতেই উনি বাদাম তুলে খেতে লাগলেন। দেখতে দেখতে অর্ধেক বাদাম শেষ! পেট ভরে গেছে আমার। আমি খেয়ালও করিনি উনি কতগুলো খেয়েছেন। তবে আমি যে খুব একটা কম খাইনি তা বুঝছি। পেট ভরতেই আর একটাও খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শান্তির ঢেকুর তুলে পাশের টেবিলে রাখা একগ্লাস পানি ডগডগ করে খেয়ে নিলাম। এরপর একপাশে শুয়ে পড়লাম। উনি ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু পর রাগান্বিত গলায় বললেন,

‘ শুয়ে পড়ছিস যে? এগুলো কে সরাবে? ‘

ঘুমে চোখ লেগে আসছে। হাই তুলতে তুলতে বললাম,’ কে আবার? আপনি! ‘

‘ আমি পারবো না। ‘

‘ তাহলে আর কি? থাকুক ওগুলো বিছানায়। আপনি বরং পাউচে শুয়ে পরুন। ‘

‘ এই ছিলো তোর পেটে? ‘

‘ ইয়েস! ‘

বলেই চোখ বুজলাম। এরপর বেশ কিছুক্ষণ কাটলো। হঠাৎ অনুভব করলাম উনি পাশে এসে শুয়েছেন কেবল। একটু পর বলে উঠলেন,

‘ সিয়া! ‘

ক্ষিন স্বরে বললাম, ‘ জ্বি! ‘

‘ ঘুমিয়ে গেছিস একেবারে? ‘

একবার চেষ্টা করলাম চোখ খোলার। পারলাম না! মিনমিনিয়ে বললাম,

‘ না। ‘

‘ তোর চোখে কতটা খারাপ আমি? ‘

ওনার কথা মস্তিষ্কে পৌছালো না। অকপটে বললাম,
‘ জানিনা। ‘

‘ যখন সবটা জানবি তখন যদি খুব দেড়ি হয়ে যায়? কেউ মিথ্যে বললে কি তুই বিশ্বাস করে নিবি? জানিস? ত্রিধার সবটা জানার পর যখন সিদ্ধান্ত নেই, যে করেই হোক হতেই হবে এ বিয়ে, তখনি ভেবেছি। যাকে বিয়ে করবো তাকে সবটা দিয়ে আগলে রাখবো। খুব ভালোবাসবো। নিজের মন গহিনে রাখবো। জিবনে হয়তো ঝড়’ই বেশি। তাই তো তুই কতটা দূরে আমার থেকে। সত্যিই বলছি, ভালোবেসে ফেলেছি তোকে। ‘

ঘুমে তলিয়ে গেছি আমি। আর কিছু মনে নেই।

_____

সকালে ঘুম ভাঙলো চেচাঁমেচির আওয়াজে। আজও কারো বাহুডোরে আবদ্ধ আমি। ওনার ঠোঁট কপাল ছুঁয়ে রয়েছে! শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে গেলো। ট্রেনের গতিতে ছোটা হৃদপিণ্ড আর তার দ্রিম দ্রিম শব্দে হাত পা অসর করে তুললো। কথা বলতে গিয়েও আটকে গেলাম। কথা বলতে পারছি না আমি। কাটার মতো গলায় কিছু বিঁধছে। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলাম,

‘ শুনছেন? ‘

সাথেসাথে চোখ মেলে তাকান উনি। হাত ছেড়ে উঠে বসেন। উনি ছাড়তেই জোরে শ্বাস নিলাম। আড়মোড়া ভেঙে বসে বিদ্রুপ কন্ঠে বললাম,

‘ এভাবে জড়িয়ে ধরবেন না। অস্বস্তি হয় আমার। ‘

উনি কিছু বললেন না। নিচে আবারো চেঁচামেচির আওয়াজ। উনি কপাল কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। বললেন,

‘ নিচে কেওয়াজ কিসের? ‘

বিছানা থেকে একলাফে উঠলাম। বিরক্ত ভঙ্গিতে বললাম,’ আপনিও যেখানে আমিও সেখানে। নিচে গেলেই জানা যাবে সবটা! ‘

বলেই বেড়িয়ে গেলাম রুম থেকে। সিঁড়ি দিয়ে হাই তুলতে তুলতে নামতেই অবাক আমি। সিনথি, সায়েমকে অপরাধীদের মতো দাড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মামীর হাতে কাঠের স্কেল। মামী শাসিত স্বরে বলছেন,

‘ ঠিকঠিক বল, এতোগুলো বাদাম কি করেছিস? ‘

ওরা বাধ্যের মতো মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। অর্থাৎ ওরা খায়নি! আর সত্যিই তো বাদামগুলো ওরা খায়নি। আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে এগোতেই মামী আমার কাছে এলেন। রাগি স্বরে বললেন,

‘ সিয়া জানিস? কাল ভাজা বাদামের অর্ধেকই নেই! সকালে উঠে সিঁড়িতে অনেকগুলো বাদামের খোসা পেয়েছি। আমি নিশ্চিত এইগুলো রাতে ওরা খেয়েছে। এখন বলছে দুটোতে নাকি জানেনা। ‘

আমি শুকনো ডোগ গিলে সিঁড়ির দিকে তাকালাম। সত্যিই সিঁড়িতে বাদামের খোল পড়ে আছে। কালকে তো আমিই ওনাকে বাদামের খোসাগুলো ফেলতে বলেছিলাম। একটা কাজও ওনার দ্বারা হবে না। আবারো শুকনো ডোগ গিলে সিনথি আর সায়েমের কাছে গিয়ে দাড়ালাম। একটু কাঠিন্য স্বরে বললাম,

‘ তোমরা কি সত্যিই রাতে বাদাম চুরি করে খেয়েছো? ‘

সায়েম জোর গলায় বললো, ‘ আরে না সিয়া আপু। আমরা জানিই না এ ব্যাপারে। ‘

ভয়ে বুক আৎকে উঠলো। ধুকপুক করছে বুকটা! জানাজানি হলে মান সন্মান সব শেষ হয়ে যাবে। কি করি? ওদের উপর দোষ চাপালে মামী নির্ঘাত মারবে। কিছু একটা করতে হবে। কিছুক্ষণ ভেবে গম্ভীর গলায় বললাম,

‘ তোমরা সত্যিই খাওনি? ‘

সিনথি ছলছল চোখে তাকালো আমার দিকে। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,’ না গো সিয়া আপু। আমরা খাইনি। ‘

মায়া হচ্ছে ওদের জন্য। কিন্তু কি করবো? উপরে তাকাতেই দেখলাম সিয়াম ভাইয়া একপ্রকার দৌড়ে ঘরে ডুকলো। কই এখানে এসে বাঁচাবে তা না করে ঘরে চলে গেলো? নিষ্ঠুর লোক একটা। আমাকেই এই বিপদ থেকে ওতরাতে হবে। আমি মামীর কাছে গিয়ে শিতল গলায় বললাম,

‘ থাক, তুমি ওদের কিছু বলো না। ছোট মানুষ না বুঝে খেয়ে ফেলেছে। ‘

সায়েম গলা উঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘ আমরা খাইনি! ‘

মামী কড়া দৃষ্টিতে তাকাতেই ও মাথা নিচু করে নিলো। আমায় বললো,

‘ যদি পেটের সমস্যা দেখা দিত? ‘

‘ আরে কিছু হবে না। সায়েম, সিনথি তোমরা উপরে যাও। ‘

ওরা চলে গেলো। আমি মামীকে বললাম, ‘ ফ্রেশ হয়ে আসছি। ‘

মামী হাসলো। আমি উপরে উঠবো,তখনি নেমে এলেন সিয়াম ভাইয়া। এসেই মামীর কাছে জানতে চাইলেন, ‘ কি হয়েছে? ‘ আমি জানি! এখন ন্যাকার মতো সবটা শুনবেন উনি। ভারি চতুর লোক। ফুঁসতে ফুঁসতে উপরে চলে এলাম। এখন কি ত্রিধার ঘুম ভাঙেনি? দেখবো একবার ফোন দিয়ে?

যেই ভাবা সেই কাজ! টেবিল থেকে ফোন তুলে দিলাম কল। একটু রিং হতেই ত্রিধা আপু ফোন রিসিভ করে বললো,

‘ কে বলছেন? ‘

‘ সিয়া, চেনেন আমায়? ‘

‘ আমি চিনি না। রাখছি! ‘

সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠলাম, ‘ আপু ওয়েট! সিয়াম ভাইয়ার ব্যাপারে একটু জানার ছিলো! ‘

ত্রিধা ফোন কাটলো না। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,

‘ কি জানবে? ‘

‘ একটু দেখা করতে পারবেন আপনি? বেশিক্ষণ নেব না, শুধু কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে। ‘

‘ কখন আসবে আর কোথায়? ‘

ভাবিনি আপু রাজি হবে। অনিমেষে বললাম, ‘ দুপুরে একটা কফি সপে দেখা করি? ‘

‘ ওকে! ‘

ফোন কেটে দিলো ত্রিধা। তারমানে আমি সিয়া বলার পর আমায় চিনেছিলো। তাহলে প্রথমে চিনিনা কেন বললো? না চিনলে এখন রাজিই বা হলো কেন? আর সিয়াম ভাইয়ার কথা বলতেই রাজি হয়ে গেলো? নিশ্চই কিছু জানতে পারবো। জানতে আমাকে হবেই!

____

দুপুরে বাড়িতে কেউ থাকে না। সিয়াম ভাইয়া অফিসে চলে গেছেন। মামীকে কিছু কেনার প্রয়োজন বলে বেড়িয়ে এলাম বাড়ি থেকে। কফিসপে গিয়ে দেখি ত্রিধা আপু আসেনি। বসে পড়লাম একটা টেবিলে। খানিক বাদেই আসলো চলে এলো ত্রিধা। অবাক হলাম কারন সরাসরি আমার পাশেই এসে বসলো। সর্বাঙ্গে তার আধুনিকতার ছোঁয়া। তার লাল টুকটুকে গাল, অধর লম্বা তবে সরু, চুলগুলো রং করা! চিবুকে লাল লিপস্টিক। ঠিক যেন নাইকা সামনে বসে আমার। আমার ঠিক সামনের চেয়ারটাতে বসলো ও। নিজেকে শক্ত করে নিলাম। কোন কথায় ভেঙে পড়লে চলবে না!

‘ কেমন আছো? ‘ বললো ত্রিধা। প্রতিত্তোরে হেঁসে বলে উঠলাম,

‘ সে ভালোই আছি! আপনিও ভালো নিশ্চই? ‘

‘ এইতো। ‘

একটু সময় নিয়ে বললাম, ‘ আমায় কিভাবে চিনলেন? ‘

উনি স্বাভাবিক হাসলো। গাঢ় লিপস্টিক দেয়া ঠোঁটদুটি প্রসারিত করে হেঁসে উত্তর দিলো,

‘ ওর সব কাজিন দের দেখিয়েছিলো একবার। আর তোমাকে স্পেশাল ভাবে। ‘

চমকে উঠলাম। আমায় স্পেশাল ভাবে কেন? নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম,

‘ আমায় স্পেশাল ভাবে মানে? ‘

‘ তুমি নাকি ওকে ভয় পেতে? তাই আলাদা করে তোমার ব্যাপারে বলেছিলো। ‘

‘ এবার মূল বিষয়ে আসা যাক? ‘

ত্রিধা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ সেটা কি? ‘

‘ চিঠিতে বলা সবটা কেন লিখেছিলেন আপনি? ‘

উনি অবাক হওয়ার ভান ধরলেন। ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে বলে উঠেন,

‘ কেন চিঠির কথা বলছো? ‘

‘ কেন? বিয়ের আগে যেটা দিয়েছিলেন? ভুলে গেছেন? ‘ স্বাভাবিকের গলায় বললাম। তার হাসি মুখ মুহুর্তে পালটে জড়তা দেখা দেয়। চুপচাপ উনি কফির কাপের দিকে তাকিয়ে আছেন। আবারো বললাম,

‘ এসব সত্য? ‘

তবুও চুপ ত্রিধা। তাহলে কি আমিই ভুল? আন্দাজে ঠিল ছোড়া উচিত হয়নি আমার? কিন্তু আমায় সম্পূর্ণ অবাক করে বললো ত্রিধা,

‘ কাল আরেকবার আসতে পারবে? সব প্রমান সমেত তুলে দিবো! ‘

ভূমন্ডল কেঁপে উঠলো আমার। সব প্রমান দিবে মানে? মানে উনি আসলেই খুনি? নাকি আমায় ভুল বোঝানো হচ্ছে। নাকি আমিই সঠিক! আড়ষ্ঠ গলায় বললাম,

‘ তাহলে চিঠি আপনিই দিয়েছিলেন? ‘

‘ হুম। আর ওই সন্তান আমার আর সিয়ামের! ‘

#চলবে……

#আমার_সংসার
লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১৪

বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে। উনি ল্যাপটপে বিজি! ঘৃনায় চোখমুখ উল্টে আসছে আমার। মাথা ফাঁকাফাঁকা লাগছে। উনি হঠাৎ আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তবুও তাকিয়ে রইলাম। সন্তানটা ওনার এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার। বুক ফাটা আর্তনাৎ করে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ কেন এমন করলেন? সবার চোখে ভালোমানুষীর মুখোশ পড়ে আপনি এত বড় অন্যায় করলেন? মামা মামীর মুখটা মনে পড়েনি আপনার? এতটা খারাপ আপনি? নিজের সন্তানকে এভাবে শেষ করতে হাত কাঁপলো না? ‘ মুখ ফুটে বলতে পারছি না! শরীর অসহনীয় যন্ত্রনায় ছারখার করে দিচ্ছে। আবার একটু পর যখন আব্বু আর মামীর কথা মনে পড়ছে তখন আরও বুক বিষিয়ে উঠছে! আমান মন বলছে উনি নির্দোষ! কিন্তু পরিস্থিতি বলছে সব দোষ ওনার!

‘ কিছু ভাবছিস? ‘

টনক নড়লো আমার। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালাম ওনার দিকে। টুপ করে চোখের জল গালে এসে পড়লো। অথচ আজ ওনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই! যে মানুষটা আমার চোখের কোনে পানি দেখলেও ছুটে আসতো আজ এলো না। দৃষ্টি সরিয়ে বিছানায় চুপ করে বসে রইলাম। উনি ফের বললেন,

‘ কিছু বলেছি তোকে। ‘ কন্ঠ কেমন শোনালো। চোখের পানি মুছে বললাম,

‘ ভালো লাগছে না। ‘

‘ শরীর খারাপ? ‘ কন্ঠ একদম স্বাভাবিক! অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে।

‘ তেমন কিছু নয়। ‘

‘ আজ কই গিয়েছিলিস? ‘

কি বলবো আমি? সত্যি বলবো? নাকি আগে আগে থেকেই উনি জানেন সবটা?

‘ মা বললো তুই নাকি বেড়িয়েছিলি। ‘

কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম, ‘ একটু দরকার ছিলো।’

‘ সবকিছু লুকাস কেন তুই? ‘

চমকে উঠলাম। কপালে ঘাম জমছে। তারমানে উনি জানেন সবটা? উনি এবার তাকালেন আমার দিকে। ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে বললেন,

‘ কিছু প্রয়োজন হলে বলিস না কেন তুই? টাকা লাগলেও মুখ ফুটে বলিস না। হোয়াই? এটা কিন্তু দায়িত্ব আমার সিয়া! ‘

সস্তির শ্বাস ছাড়লাম। বুক থেকে যেন বড় এটকা পাথর কমে গেলো। ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে বললাম,

‘ নেক্সট টাইম বলবো৷ ‘

‘ হয়তো….’ বিরক্ত কন্ঠে বললেন কথাটুকু উনি। চুপ রইলাম। কিছু ভালো লাগছে না! কিছুই না!

_____

রাত আটটা! সিয়াম ভাইয়া বেড়িয়েছে কোথাও। বেলকনির গ্রিলে হাত রাখতেই দমকা হওয়ায় মাথার চাদর ঘারে এসে ঠেকলো। তাকিয়ে রইলাম আকাশ পানে। কাল জানিনা কিসের সম্মুখীন হতে হবে। মানুষ কতটা শিওর হলে প্রমান দেখাতে চাইবে? কিন্তু বুক খচখচ করছে। দেখতে দেখতে সময় কেটে গেলো। মামী খুব জোরাজুরি করলো খেতে, ইচ্ছেই জাগেনি! উনিও একটি বারও বলেননি খেতে আসতে। ভাইয়া এসে খেয়ে শুয়ে পড়েছে। বলছিলো কাল খুব ইমপর্টেন্ট মিটিং আছে। খুব তারাতাড়ি আমিও শুয়ে পড়লাম। রাতটা আনচান করতে করতে কাটলো। সকালে প্রতিদিনের মতো আজও ওনার বুকে থাকবো ভেবেছিলাম, কিন্তু নিজেকে একপ্রান্তে আবিষ্কার করলাম। উনি অপরপ্রান্তে কাত হয়ে শুয়ে। উঠে পড়লাম! শুয়ে থাকতে এতটুকু ভালো লাগছে না। আজ একটু তারাতাড়ি অফিসে বেড়িয়ে গেলো সিয়াম ভাইয়া। কোন কথা বলেনি সকালে একটিবারও। সকালের নাস্তা খুব কষ্ট করে খেলাম। দুপুর গড়াতেই আজ মামীকে বলে বেড়িয়ে পড়লাম। শরীরে মনে হচ্ছে শক্তি নেই! একজন মৃত মানুষ লাগছে নিজেকে। কি হবে? ভাবতেই শরীরে কাটা দিচ্ছে। কালকের কফি সপে নেমে পড়লাম আমি। রিকশাওয়ালাকে ভারা মিটিয়ে ভেতরে ডুকতেই ভূমন্ডল কেঁপে উঠলো আমার। রগে রগে শিতল কিছু বয়ে যায়। একই টেবিলে তিনটে ছেলে সাথে ত্রিধা! অবাক করার বিষয় এটি নয়! সাথে সয়ং সিয়াম ভাইয়া বসে। নিশ্বাস আটকে আসছে। উনি মাথা নিচু করে বসে। একপা একপা করে এগিয়ে গেলাম। পাশের ছেলেদের মধ্যে একজনকে চিনি আমি! ছেলেটাকে ভাইয়ার সাথে দেখেছি বহুবার। ত্রিধা আপু থমথমে মুখে বসে আছে। কেউ একজন বলে উঠলো,

‘ এতটা ফার্স্ট? ওকে, আসুন। ‘

কথা বলা ছেলেটা ফরসা ধবধবে। উনি চেয়ার এগিয়ে দিয়ে ইশারা করলেন বসতে। কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলাম। বসার আর ইচ্ছে হলো না। সিয়াম ভাইয়া মাথা নিচু করে রয়েছেন। আকম্মিক বললেন,

‘ ত্রিধা, কি যেন বলবে ওকে বলেছিলে? ‘

ত্রিধা আপু মুখের ভঙ্গি পাল্টে না। সেভাবেই বসে। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। ভাইয়া মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মুখপানে। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘ বল, কি বলবি বলেছিলি? চুপ কেন? ‘

কেঁপে উঠলো ত্রিধা। কপালে ছোপ ছোপ ঘাম। মুখে আঁধার। তবুও তার কোন হেলদোল দেখা গেলো না। ফরসা গড়নের ছেলেটা ধারালো গলায় বললো,

‘ কি রে বল! চুপ কেন? বল কি কি বলবি বলছিলি? সিয়ামের জিবনে আর কত ঝড় তুলবি তুই? এখন চুপ কেন? ‘

একটানে কথাগুলো বলে দম ফেললো ছেলেটি। কিছু বুঝছি না আমি! সিয়াম ভাইয়া এখানে কেন? কে বলেছে আমরা এখানে মিট করছি? তাহলে কালকে সবটাই জানতেন উনি! মিছিমিছি নাটক করে গেছেন? আর আমায় বইতে হয়েছে এত এত মিথ্যা! হাত মুঠো হয়ে আসছে আমার। ত্রিধা আপুর সামনে গিয়ে শান্ত গলায় বললাম,

‘ বলছেন না যে? বলুন! ‘

‘ তোর আজ সকল প্রশ্নের উত্তর আমি দেই সিয়া? ‘

মাথা উঁচিয়ে বললেন ভাইয়া। ওনার ঠিক সামনেই বসে ত্রিধা। নির্বাক হয়ে বসে। উনি উঠে বলতে লাগলেন,

‘ ত্রিধা কাল তোকে ঠিক কি বলেছিলো? কোন একটা বাচ্চা ওর আর আমার! তাইনা? ‘ সাথেসাথে মুখ নিচু করে নিলাম। উনি ফের বলতে আরম্ভ করলেন,

‘ ত্রিধা আমার সাথে খুব বাজে একটি গেম খেলতে চেয়েছিলো। কুড়ি লক্ষ টাকা আমার নামে এখনো ব্যাঙ্কে রয়েছে। আর সেগুলোই চেয়েছিলো এই মেয়েটা। আমার নিজেরও জানা নেই একে ভালোবেসে কতগুলো টাকা খরচ করেছি আমি। ওর ড্যাড, অরফে নজিব উদ্দিনের ছিলো এতসব প্লান। কি রে ত্রিধা,তাইনা? ‘

মাথা তোলে ত্রিধা। তার চোখ দুটি শূন্য। হয়তো সে নিজেও জানে না এতকিছু সিয়াম জানলো কি করে। এবার আমার দিকে তাকালেন উনি। ফিক করে হেঁসে বলতে লাগলেন,

‘ পদে পদে আমি বুঝেছি, এই মেয়েটা শুধু টাকাকে ভালোবাসে। সেদিনিই বুকে পাথর জমিয়ে এ রিলেশন শেষ করতে বাধ্য হই আমি। অবশ্য সেদিন ত্রিধা আমার পায়ে পর্যন্ত পড়েছিলো। আমাদের বিয়েটাও কিছুদিন পর! ওর আব্বুর সামনে ভেঙে এসেছি বিয়ে। এসব জেনেছি আমার বন্ধ আসিফের সাহায্য! প্রমান অব্ধি ছিলো। কিন্তু আমাদের তো পুরো বাড়িই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আছে আমার বিয়ে নিয়ে! সকলে কত খুশি। রিসোর্ড পর্যন্ত বুক করা! অনেক ভেবে দেখলাম যদি এ বিয়ে হয় তাহলে সিয়ার সাথেই হবে! ওর আব্বুকে বলতেই উনি সরাসরি না বলে দিলেন। কিছুতেই রাজি হবেন না উনি। বারবার বলেছেন আমার সিয়াকে অনেক দূর যেতে হবে। খুব বড় পদে চাকরি করতে হবে। আমি আশাহত হই। হঠাৎ ই তার পরেরদিন হাজির হয় সিয়ার আব্বু। উনি নাকি রাজি এ বিয়েতে। তবে শর্তসাপেক্ষে! সিয়ার পড়াশোনা শেষ পর্যন্ত করাতে হবে, চাকরি করতে হবে ওকে, ওর যেকোনো কিছুর প্রয়োজন হলে যেন সবটা সামনে থাকে ওর। হঠাৎ ওনার মত পাল্টানোয় কিছুটা অবাক হলেও আমি রাজি হয়ে যাই! বিয়ের দিন সবাই মিলে রাজি করায় সিয়াকে এ বিয়ে করার জন্য। তখন আবারো নোংরা চাল চালে এই মেয়েটা! মিথ্যে চিঠি লিখে আমার জিবন থেকে সিয়া কে বের করতে উদ্ধত হয়! যে মেয়েটার সাথে দু মিনিটের বেশি কফিশপে গল্প পর্যন্ত করিনি আর সে আমায় তার মিথ্যে সন্তানের পিতা এবং তার’ই খুনি বানিয়ে দিলো। আমি ওই চিঠিটা প্রথম দিন’ই দেখেছি। কিন্তু পড়তে পারিনি। বিয়ের দিন যখন ত্রিধা নিজে এসে চিঠিটা সিয়ার হাতে গুজলো, তখনি খেয়াল করেছি আমি সবটা! তারপর কিছুদিন চুপচাপ! আমি হয়তো বিশ্বাসও করে নিয়েছিলাম সিয়া ওই চিঠিটাতে লেখা কথাগুলো বিশ্বাস করেনি। কিন্তু ও আমায় ভুল প্রমান করে সবটা বিশ্বাস করে নিলো। দূরত্ব বাড়লো! আমি নিজের বেস্টটা দিয়েছিলাম ওর কাছে থাকার। কোথাও হয়তো ভালো লাগতো আমার ওকে। ওর কান্নাও সহ্য হতো না আমার। আসিফের মাধ্যমেই জানতে পারি সিয়া কাল দেখা করেছে ত্রিধার সাথে। ভাবলাম আজকেই ওর সব ভুল ধারনাগুলো শেষ করে দেই? তাই এসেছি নিজে। ‘

থামলেন উনি। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। চোখ জলে ভরে উঠলো আমার। বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। ত্রিধার সামনে গেলেন উনি। স্বাভাবিক ভাবে বললেন,

‘ আর যেটুকু কনফিউশান আছে তুই দূর কর! বল আমার বলা প্রতিটা কথা আদেও সত্য কি’না। ‘

হাত কচলাতে শুরু করলো ত্রিধা। ভাইয়া আবারো বললেন,

‘ পুরো রিসোর্ডে কিন্তু সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিলো ত্রিধা। অল ফুটেজ আমার কাছে আছে। রিসোর্ডে বোরখা পড়ে শুধু একজনকেই ডুকতে দেখা গেছে। আর বাইরে এসে যে তুই বোরখা খুলে ব্যাগে ডুকিয়ে নিয়েছিলিস এটাও দেখা গেছে ত্রিধা! ‘

ত্রিধা চমকে তাকালো। খানিক পর আমাকে বললো,

‘ সিয়াম যা বলছে সব সত্য। আমি ওসব বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি। আর আজ যেগুলো প্রমান দেখাবো বলেছিলাম সেটাও মিথ্যে ছিলো। নেট থেকে বের করা একটি শিশুর ছবি ছিলো আমার কাছে। সেটাই…..

কথা থামার আগেই ছুটে গেলাম ওর কাছে। সবটা শক্তি দিয়ে কষে থাপ্পড় দিলাম। টাল সামলাতে না পেরে ত্রিধা বসে পড়লো চেয়ারে। কফিসপের সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে। এই কুশ্রী মেয়েটাকে আমি বিশ্বাস করেছি ভাবলেই নিজেকে শেষ করতে ইচ্ছে করছে। ঘুরে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালাম ভাইয়ার দিকে। উনি সহ সবাই চলে গেলেন। বড্ড একলা লাগছে। নিঃস লাগছে নিজেকে। মেঝেতে বসে হু হু করে কেঁদে উঠলাম। আব্বু, মামী কতবার করে বলেছে যেন আমি বিশ্বাস না হাড়াই ভাইয়ার প্রতি! সেখানে আমি….
সব ছন্নছাড়া লাগছে। অসহ্য জ্বলায় ফেটে আসছে বুক।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here