তোমায়_আমি_দেখেছিলেম_বলে,পর্ব:৮,৯

0
787

#তোমায়_আমি_দেখেছিলেম_বলে,পর্ব:৮,৯
#লেখা:মৌলী আখন্দ
পর্ব:৮

ল্যাপটপ সংক্রান্ত ঝামেলার পর কথাবার্তা বন্ধ দুজনের মধ্যে। অপরিচিত দুই রুমমেটের মতই রুম শেয়ার করছে এলিনা আর রাইয়ান।
আজকে অফিসে আসতে একটু দেরিই হয়ে গেছে এলিনার। সামনের গাড়িটা আচমকা কোনো সিগনাল না দিয়েই লেন চেঞ্জ করল।
এক চুলের জন্য বড় মাত্রার একটা কলিশন হতে হতে হলো না। কিন্তু গাড়ির বাম্পারে লেগে ঠিকই ছিটকে পড়ে গেল এলিনা।
ফলাফল এক দফা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় আর অফিসে আসতে দেরি। ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে ঢুকে ব্যাগ টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে এলিনা দেখল সিমি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
রাগে গা জ্বলে গেল এলির। কিছু কিছু মানুষ অন্যকে বিপদে পড়তে দেখলে এত খুশি হয় কেন কে জানে?
গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল সিমি। “এলি, তোমাকে স্যার ডেকেছেন।“
মৃদু গুঙিয়ে উঠল এলি। নিশ্চয়ই দেরি করে আসার জন্য এক দফা ঝাড়বেন।
এলির গোসল করে আসা খোলা চুল, হাতে পেঁচিয়ে রাখা মোটা রাবার ব্যাণ্ডটা দিয়ে চুলটা আটকে নিতে নিতে বলল, “যাচ্ছি!”
“দিন দিন যে রূপ খুলছে! অভিসার আজকাল বেশি হয়ে যাচ্ছে মনে হয়?”
চোখ টিপল সিমি। প্রত্যুত্তরে হাসল না এলি।
মাঝে মাঝে রাইয়ানের ফ্ল্যাটে থেকে যাওয়ার কথাটা জানে সিমি, তাই ইঙ্গিত করল আসলে। যদি জানত এক রুমে থেকেও দুজনের মধ্যে দূরত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে…!
তাড়াহুড়ো করে স্যারের রুমের দরজা ফাঁক করে নক করল এলি। “মে আই কাম ইন স্যার?”
স্যার হাসিমুখে বললেন, “আরে, এসো, এসো! এত দেরি কেন এলিনা?”
‘জি মানে স্যার আসলে…” আমতা আমতা করল এলিনা। বাইক এক্সিডেন্টের কথাটা বলতে গিয়েও বলল না।
বড্ড বেশি অজুহাতের মত শোনাবে।
“থ্যাংক ইউ সো মাচ, এলিনা! অবশেষে তোমার জন্যই কম খরচে লিকুইড নাইট্রোজেনের ব্যবস্থা হয়েছে।“
“আমার জন্য?”
“এত অবাক হচ্ছ কেন? তুমি আরিয়ান কেমিক্যালসে যোগাযোগ করনি?”
“ও হ্যাঁ! জি স্যার, করেছিলাম, কিন্তু সেটা যে ক্লিক করবে আসলে বুঝতে পারিনি তো স্যার!”
“জেন্টলমেন, মিট হার, আমার সেকশনের জুনিয়র, এলিনা হক রাস্না। এলিনা, উনি আরিয়ান কেমিক্যালসের সেলস ম্যানেজার।“
বসের সামনে চেয়ারে যে লোকটি বসে ছিল, এতক্ষণ তার চেহারা দেখতে পায়নি এলিনা। এবার এলিনাও সামনে এল, আর উঠে দাঁড়াল লোকটিও।
এলিনার বাড়ানো হাতে হাত রেখে হাসিমুখে বলল, “রাইয়ান হাসান।“
“আমি এলিনা।“ রাইয়ানকে দেখে চমকে গেলেও দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল এলিনা।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত হাতটা ধরে রাখল রাইয়ান, তর্জনী দিয়ে আঁচড় কাটল এলিনার হাতে। হাতটা ছাড়িয়ে নিল এলিনা।
রাইয়ানের হাতে কালো ব্রেসলেটটা দেখে অনেক দিন পর শরীরে অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছে এলিনার। সব রাগ অভিমান ভুলে ওই হাতের কঠিন নিষ্পেষণে মোমের মত গলে যেতে মন চাইছে।
এলিনা ফিরল বসের দিকে। “স্যার আপনি কি ডীল ফাইনাল করে ফেলেছেন?”
“আমাদের হাতে সময় আছে আর কতদিন?”
“খুব বেশি সময় তো নেই। তারপরও এতটা কমও নেই স্যাম্পল টেস্ট দিয়ে পাইলটিং আর ইন্টার্নাল মিটিং কল না করে ডিসিশন নিতে হবে।“
হাত ওল্টালেন বস। “আমি তো ভেবেছিলাম তোমার রিকমেণ্ডেশন পেয়েই উনি এখানে এসেছেন।“
এলিনার মুখ পাথরের মত শক্ত, “কথাটা সত্যি। তারপরেও আমাদের প্রোটোকল মানা প্রয়োজন যাতে কোথাও কোনো ফাঁক না থাকে।“
“তুমি কীভাবে করতে চাও?”
“আমি আমার টিম নিয়ে পাইলটিং করে দেখব। টিম এপ্রোভাল দিলে তারপর আপনি ডীল ফাইনাল করবেন। আফটার অল”, এলিনা আড়চোখে রাইয়ানকে দেখে নিল একবার, “লো কস্টের জন্য কোয়ালিটি তো কম্প্রোমাইজ করতে পারি না আমরা!”
রাইয়ান ভীষণ অবাক হলেও চেহারায় প্রকাশ করল না তা। এলিনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে অফারটা লুফে নেওয়ার বদলে সে বরং বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! তুমি কাজ শুরু করে দাও।“
রাইয়ানের দিকে ফিরে ছোট্ট করে নড করে বেরিয়ে এল এলিনা। মুখে দুশ্চিন্তার রেখা।

চলবে

#তোমায়_আমি_দেখেছিলেম_বলে
।।৯।।
এলিনা ঠিক করল আজ অফিস থেকে বাসায় ফিরে সরাসরি কথা বলবে রাইয়ানের সাথে। কথা বলা বন্ধ করে রেখে আসলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।
চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে কিছুটা অবাক হলো এলিনা। রাইয়ান ফেরেনি এখনো।
সাধারণত রাইয়ান আগেই বাসায় ফিরে আসে, এলিনারই দেরি হয় ফিরতে। ফ্রেশ হয়ে রাতের রান্নার প্রস্তুতি নিতে নিতে কথার ছক সাজাতে লাগল এলিনা।
যদিও জানে রাইয়ানকে দেখামাত্র সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে তার। মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে।
হাত চলছে, চপিং বোর্ডে টুকরো হচ্ছে ক্যাপসিকাম। অপেক্ষার প্রহর যেন আর কাটছে না।
দরজা খোলার শব্দ হতেই ন্যাপকিনে হাত মুছে এগিয়ে এল এলিনা। এদিকে পিঠ ফিরিয়ে দরজা বন্ধ করছে রাইয়ান।
এদিকে ফিরে এলিনাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সেও। তারপর এমন একটা কাজ করে ফেলল যার জন্য এলিনা মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিল। বয়ে গেল আরো একটা মুহূর্ত।
মাত্র একটা দ্বিধান্বিত মুহূর্ত, কিন্তু যেন কেটে গেল এক মহাকাল। এলিনা ছুটে এসে ঝাঁপ দিল রাইয়ানের বুকে।
পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে চূড়া করে বাঁধা এলিনার চুল খুলে দিল রাইয়ান। এলিনার অস্থির আঙুল তখন রাইয়ানের শার্টের বোতাম খুঁজছে।
কীভাবে যে তারা ভেতরের ঘর পর্যন্ত এল নিজেরাও বলতে পারবে না। সন্ধিটা হলো বড় অদ্ভুতভাবে।
অনেক দিন ধরে দূরে থাকা তৃষিত দম্পতির পরস্পরের কাছে আত্মসমর্পণের ঝড়ের বেগে উড়ে যাওয়া মাতাল সময় শেষে রাইয়ান যখন পাশে শুয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে এলিনা তখন ওর দিকে ফিরল।
“তুমি আরিয়ান কেমিক্যালসে জয়েন করল কবে?”
মুখ বাঁকাল রাইয়ান। “সেটা তোমার জানা থাকা উচিত ছিল! হাজব্যাণ্ডের কোনো খোঁজ খবরই তুমি রাখো না!”
সামান্য অপ্রস্তুত হলেও সেটা ঝেড়ে ফেলে দিল এলিনা, “বাজে কথা রাখো। তুমি আমাকে বলেছিলে তুমি ফ্রি ল্যান্সার। আর গত মাসেও তুমি সাইট ভিজিট করতে যেতে…“
“আমি ওদের সাথে গত বছর একটা প্রোজেক্টে ছিলাম। অনেক দিন ধরেই এপ্লাই করছিলাম। এবার পোস্ট ফাঁকা হওয়ার পর ইন্টারভিউতে রিকমেণ্ডেড হয়েছি। এ মাসেই জয়েন করেছি। আর কিছু?”
“না, আর কিছু না।“ উঠে পড়ল এলিনা।
“তাড়াতাড়ি রান্না শেষ কর”, হুকুমের সুরে বলল রাইয়ান। “অনেক দিন ধরেই ফাঁকিবাজি করছ, সব সুদে আসলে আদায় করা হবে আজকে।“
আর কথা বাড়াল না এলিনা। কিন্তু সে যখন চিন্তিত মুখে মাটিতে পড়ে থাকা ম্যাক্সিটা তুলে নিয়ে শরীরে গলাচ্ছিল তখনও তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করছিল তাকে।
কিছু একটা ঠিক নেই, কিছু একটা গোপন করে যাচ্ছে রাইয়ান। কিন্তু কী সেটা?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here