“রূপগঞ্জের রূপসী”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
উৎসর্গে – Imran Mahmudul
.
.
“হেই, ওয়েট ওয়েট! তুমি হঠাৎ এভাবে কথা বলছো কেন?”
“বন্ধুদের সাথে কিভাবে কথা বলে! তুই ই না বললি বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে!”
“অহ! ওকে। বায়।”
কল কেটে দিলো ইমরান। নেহার আচরণ হঠাৎ এমন বদলে যাবে ভাবতেই পারেনি সে!
কিছুক্ষণ পর,
ইমরান গোসল করে রুমে এসে দেখলো নেহা তার বেড এ শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে ফোন দেখছে। ইমরানকে দেখে নেহা বললো,
“কি রে! তোর শাওয়ার নিতে মেয়েদের মতো এতো সময় লাগে!”
ইমরান আলমারি থেকে শার্ট নিতে নিতে বললো,
” বন্ধু হলেও এটা মাথায় রাখা উচিত আমি একটি ছেলে, আর মেয়েদের সবসময় শালীনতা বজায় রাখা উচিত।”
নেহা ইমরানের কথায় একটু হকচকিয়ে গেল! প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি ইমরান কেন এই কথা বললো। তাই নিজের দিকে একবার তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো তার টপ্সটা একটু উপরে উঠে পেট দেখা যাচ্ছে। এবার সে লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে টপ্সটা ঠিক করে নিলো। এবং বললো,
“ওহ! সরি…!”
বাথরুম থেকে বের হওয়ার পরই এক পলক তাকিয়েছিলো ইমরান। ত্রুটির কারণে সে দ্বিতীয়বার তার দিকে না তাকালেও নেহা তার কথায় লজ্জা পেয়েছে খুব। তাই দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে নীলার কাছে চলে গেলো সে।
দুপুরে একসাথে সবাই লাঞ্চ করতে বসলো। নীলা খাবারের প্লেট ইমরানের দিকে এগিয়ে দিলে নেহা টেনে প্লেট ওর দিকে নিয়ে নিলো। ইমরান হতবাক হয়ে যাচ্ছে তার এমন সব আচরণ দেখে! আপু, ভাইয়া ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নেহার দিকে! সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নেহা বললো,
“কি হলো! সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
অত:পর ইমরানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“বন্ধুর প্লেট তো বন্ধু নিতেই পারে, তাই না?”
ইমরান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
“হুম।”
এছাড়া আর কি বলবে সে! সে-ই তো বলেছে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতে। নেহা হয়তো সেটাই করছে।
নীলা আপুর উদ্দেশ্যে নেহা বললো,
“তাকে আর এক প্লেট দিলেই তো হয়।”
নীলা মৃদু হেসে বললো,
“হুম, দিচ্ছি।”
লাঞ্চ শেষ করে ইমরান রুমে এসে ফোন নিয়ে সোফায় বসে আছে। নেহা এসে পাশে বসলো, ইমরানের ফোন টেনে নিতে গেলে ইমরান অন্যদিকে সরিয়ে নিলো। নেহা ব্রু কুচকে বললো,
“ফোন দে, তোর গার্লফ্রেন্ডের ছবি দেখব।”
ইমরান কথায় সামান্য বিরক্তি এনে বললো,
“এসব কি শুরু করেছো এসব! দিবো না ফোন।”
” না, দিতে বলেছি দে….”
কথাটা বলেই নেহা ফোন নেয়ার জন্য জোরাজোরি করতে গিয়ে ইমরানের উপর পরে গেল। দুজনেই সোফায় আধশোয়া অবস্থায়! ইমরান নিচে আর নেহা তার উপর হেলে! এবার দুজনেই থমকে একে অপরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নেহা চট করে তার দুহাত দিয়ে ইমরানের গাল দুটো আলতো করে ধরে রাখলো। সাথে সাথে নেহার চোখে পানিও এসে উঁকি দিয়েছে! ব্যথিত গলায় সে ইমরানের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
” ইমরান, লাইফ একা কাটানো যায় না। সবারই লাইফ পার্টনার প্রয়োজন। তুমি যার জন্য বসে আছো সে তো ঠিকই তার লাইফ সাজিয়ে নিয়েছে। তুমি কেন পারছো না? আই রেইলি লাভ ইউ। প্লিজ, ডোন্ট রিজেক্ট মি। ক্যান ইউ এক্সেপ্ট মি?
এবার ইমরান নেহাকে ঠেলে সোজা করে বসিয়ে সে নিজেও সোজা হয়ে বসলো। অত:পর বলতে লাগলো,
“নেহা, আমি তোমাকে যা বলার তা আগেই বলেছি। তোমার সাথে আমার বিয়ে হলেও আমি মন থেকে তোমাকে হয়তো কখনো গ্রহণ করতে পারবো না। আর সেরকম কিছু হলে কখনো তুমি সুখী হতে পারবে না। শুধু শুধু কেন অনিশ্চিত জীবনে পা রাখতে চাইছো? আর আমি নেক্সট উইক এ বাংলাদেশ ফিরে যাচ্ছি। সেটা নিশ্চয়ই জানো তুমি!”
“না গেলে হয় না?”
“বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। নিজের জন্মভূমিকে, মাকে ছেড়ে আমি এখানে থাকবো কিভাবে! অনেকদিন যাবত নিজের মায়ের কাছ থেকে দূরে পড়ে আছি। তাছাড়া বাংলাদেশে আমার জন্ম, আমি চাই আমার শেষ নিশ্বাসও যেন বাংলাদেশেই পড়ে।”
নেহা মলিন মুখে তাকিয়ে আছে ইমরানের দিকে। ইমরান একটু থেমে ছোট খাটো এক নিশ্বাস ফেলে আবার বললো,
“আমার মনে হয়, রাফসান তোমাকে পছন্দ করে।”
“আমি জানি রাফসান আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু আমি তোমাকে…”
“হুহ! কি আজব এই পৃথিবী! তাই না? যে আমাদের পছন্দ করে তাকে আমরা অবহেলা করে বেড়াই, আর যে আমাদের অবহেলা করে তার পিছনে আমরা ঘুরে বেড়াই!”
নেহা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো ইমরানের দিকে। কিন্তু ইমরান থেমে নেই!
” রাফসান অনেক ভালো। তুমি চাইলে তাকে নিয়ে ভেবে দেখতে পারো। হয়তোবা, তার সাথে তুমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে।”
“সবসময় আমরা মেয়েরা কেন সেক্রিফাইস করবো? তুমি কেন মানিয়ে নিতে পারবে না আমার সাথে?”
“আল্লাহ তায়ালা মেয়েদের অসীম ধৈর্য দিয়েছেন, যেটা হয়তো ছেলেদের কাছে নেই! মেয়েরা ধৈর্য ধরে সকল পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ছেলেরা সেটা পারে না। পারলেও খুব কম। একজন মেয়ে যতটা ধৈর্য নিয়ে কোনো ঘরে বন্দী থাকবে, একজন ছেলে মোটেও ততটা ধৈর্য ধারণ করবে না। আশপাশে দেখো, একটা মেয়েকে কোনো কাজের জন্য তুমি সহজেই রাজি করিয়ে ফেলতে পারবে কিন্তু একটা ছেলেকে দিয়ে জোরপূর্বক সেই কাজ তুমি করাতে পারবে না। একটু পাষাণই হয়ে থাকে ছেলেরা।”
“আফসোস! রূপসী এমন একজন মানুষকে পেয়েও হারিয়ে ফেললো। বাংলাদেশে যাওয়ার আগে দেখা করো আবার। আমার তো যখন ইচ্ছে ছুটে আসি। তুমি তো আর এমন নয়। ভালো থেকো….”
কথা বলে নেহা উঠে দরজার কাছে যেতেই ইমরান প্রশ্ন করলো,
“আমার ব্যাপার টা কি মাথা থেকে নামিয়েছো?”
পেছনে তাকিয়ে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো নেহা। তারপর বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।
ইমরান বুঝতে পেরেছে নেহা কষ্ট পেয়েছে আর জোরপূর্বক হেসেছে। তবে এটা বিশ্বাস করছে, নেহা তাকে ভুলতে চেষ্টা করছে নতুবা করবে।
রাতে আবার নেহা কল করলে ইমরান রিসিভ করে বললো,
“হ্যালো…”
“কি করছো?”
” কিছু না।”
“কিছু না মানে! আমার সাথে কথা বলছো না!”
ইমরান হেসে বললো,
“ওহ, হ্যাঁ।”
“ইমরান, অনেক ভেবে একটা ফাইনাল ডিসিশন নিলাম।”
“জানতে পারি কি?”
” হুম, জানানোর জন্যই কল করেছি। ভাবছি, রাফসানকে একটা সুযোগ দিবো।”
” মানে?”
“লাইফ পার্টনার হিসেবে রাফসানকেই বেছে নেই, কি বলো?”
ইমরান উৎফুল্লতার সাথে বললো,
” ইট’স গ্রেট!”
“কিন্তু কিভাবে সুযোগ দিবো, সেটাই তো বুঝতে পারছি না!”
“কেন? কি হয়েছে?”
“ডাম্বেল টা তো আজও কিছু বলেনি। প্রতিদিন ফোন দেয়, আর জিজ্ঞেস করে কেমন আছো, কি করছো, খেয়েছ ব্লা ব্লা ব্লা…..”
ইমরান শব্দযোগে হেসে বললো,
“তুমিই বলে ফেলো। নেহা তো সবসময়ই ফাস্ট!”
“ভয় হয়, সে যদি আবার তোমার মতো রিজেক্ট করে!”
রিজেক্টের কথা শুনে ইমরান চুপ হয়ে গেছে। কোনো সাড়া না পাওয়ায় নেহা বললো,
“কি হলো? কিছু বলো…”
“আচ্ছা, ডাম্বেল টার সাথে আমি কথা বলে দেখি, সে কি বলে।”
“ওকে। এই তোমার নাকি বাংলাদেশে বিয়ে ঠিক হয়েছে? এবার তো তাকেই বিয়ে করবে, তাই না?”
“নেহা আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি আমার লাইফে কাউকে আনতে পারবো না। আগে দেশে যাই, পরে সেই মেয়েকে বুঝিয়ে বলবো। তারপর দেখা যাক কি হয়!”
নেহা ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে বললো,
” ওকে।”
“ওকে, রাফসানের সাথে কথা বলে তোমাকে জানাচ্ছি।”
“ওকে।”
পরের দিন ইমরান রাফসানের সাথে কথা বলেছে নেহা সম্পর্কে। কথা বলে জানতে পারলো এদিকে রাফসানও ভয় পাচ্ছে নেহাকে প্রপোজ করতে। ইমরান এ নিয়ে প্রথমে কিছুটা মজা নিলো এবং পরবর্তীতে কিছুটা সংকোচ কাটিয়ে দিয়ে এলো। বাকিটা কি হয় তা জানার আশায় রইলো সে।
২দিন পর নেহা কল করলো ইমরানের কাছে। ইমরান রিসিভ করতেই নেহা বিস্ময়কর ভাবে বললো,
“ইমরান, শুনছো?”
“হুম বলো…”
“সর্বনাশ হয়ে গেছে, ইমরান! খুব বড় সর্বনাশ!”
“কি হয়েছে?”
“রাফসানের বাবা-মা আজ ডিরেক্টলি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে!”
ইমরান কিছুটা অবাক হলো এবং কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলো,
” আংকেল আন্টি কি বললো?”
“আব্বু আম্মু রাফসান কে পছন্দ করেছে।”
কথাটা বলে নেহা নিজেই হেসে ফেলেছে! তার এভাবে বলার উদ্দেশ্যই ছিলো ইমরানকে চমকে দেওয়া! ইমরানও এবার মৃদু হেসে বললো,
“তাহলে তো খুশির খবর। বিয়েটা কবে হচ্ছে?”
“কি বলো! বিয়ে এখনো ঠিক হয়নি।”
“কেন?”
“আব্বু আম্মু আমার মতামত জানতে চেয়েছে। আমি কিছু বলিনি।”
“কেন!”
“নিজের বিয়ের কথা শুনেই হ্যাঁ বলে দিবো! আব্বু আম্মু কি ভাববে! হুহ্!”
” হাহাহা…. এখন যদি তারা না ভেবে নেয়, তাহলে তো বিয়ে ক্যান্সেল!”
“ঠিকই তো! ওকে, আমি এখনই হ্যাঁ বলে আসছি। বাই, বাই……”
ইমরান হাসলো নেহার পাগলামোতে।
.
ছোট বোন সুমি নীলার কাছে কল করলো কথা বলার জন্য। নীলা রিসিভ করে বললো,
” হ্যালো, সুমি…”
“কেমন আছো আপু?”
“এইতো ভালো। তুই কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ। বাসার সবাই কেমন আছে?”
“ভালো। এখনো ঘুমাসনি যে!”
” এখনো ডিনার ই করা হয়নি। সবাই খাবার টেবিলে বসে ঝিমাচ্ছে।”
” কেন?”
“আরোশীর আব্বু এখনো বাইরে, বাসায় এলে তারপর সবাই একসাথে খেয়ে ঘুমাবো।”
” একজনের জন্য সবাই বসে আছিস!”
” বাবা-মা আর বাচ্চারা খেয়েছে। আর আমরা বাকিরা বসে আছি। ভাই-বোনের অদ্ভুত কান্ড এসব।”
“মানে?”
“দেশে আসো আগে, তারপর দেখো। আচ্ছা এখন রাখি, আরোশীর আব্বু এসে পড়েছে বোধহয়।”
” আচ্ছা..”
এখন তারা ফ্লাইটে। ইমরান, বড় আপু, দুলাভাই, আরোহী বাংলাদেশে ফিরছে। আসার আগে নেহা আর রাফসানের সাথে দেখা করে এসেছে ইমরান। দুএক মাসের মধ্যেই হয়তো তাদের বিয়ে হবে। পরিবার থেকে দিন তারিখ ঠিক হলে নিশ্চিত বলা যাবে। তিন বছর আগে ফ্লাইটে থেকে রূপসীর কথা ভাবতে ভাবতে ইউএসএ এসেছিলো ইমরান। আজও তার ব্যাতিক্রম নয়। রূপসীর কথা ভাবতে ভাবতেই আবার নিজ দেশে ফিরছে।
“আচ্ছা, রূপসী তোমার সাথে কি আমার দেখা হবে না! তুমি কি এখনো রূপগঞ্জে আছো! তোমার তো বিয়ে হয়ে গেছে তাই না! তোমার তো হয়তো বাচ্চা ও আছে। সুখে আছো তো তুমি! আমাকে কি একটুও মনে নেই তোমার! আমি বাংলাদেশে ফিরছি রূপসী, অন্তত এক বারের জন্যও যেন তোমার সাথে দেখা হয় আমার।”
ভাবতে ভাবতে বৃহস্পতিবার সকালে বাংলাদেশে ফিরলো তারা। ছোট দুলাভাই এসেছে তাদের নিতে।
ইমরান পারভেজকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছেন ভাইয়া?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ।”
অত:পর একসাথে তারা সোজা ইমরানের বাসায় এলো। বাসায় মা শুধু একা। সুমি আপু আসেনি কারণ কাল তারাই আপুর বাসায় যাবে। কতোদিন পর মাকে দেখলো। প্রাণ জুড়ানো অনুভব মায়ের দর্শনে! ইমরান মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করে বেরিয়ে গেলো সোজা রূপগঞ্জের উদ্দেশ্যে।
রূপগঞ্জ এসে যা দেখলো সে, তা কখনোই প্রত্যাশিত ছিল না। ভাবতেও পারেনি, এখানে এসে এমন কিছু দেখতে হবে তাকে!