শ্রাবণ_আঁধারে #পর্ব_৩

0
772

#শ্রাবণ_আঁধারে
#পর্ব_৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

“ভবিষ্যত কোথায়? বাবা তো এখন থেকেই আমার জন্য পাএ খুঁজছেন!”

জীবাশ্ম জ্বালানীর মতোন কঠিন রূপে দ্বগ্ন হচ্ছিলো অন্তঃকরণের আশপাশটা। নগন্য কয়েকটা মুহূর্তের জন্য সম্ভবত যমরাজকে আমার মুখাপেক্ষী হতে দেখলাম। অতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে ও উনি আত্নাটা ছাড়াই শূণ্য হাতে প্রস্থান নিলেন। হয়তোবা “দাহ” বিলম্বিত অধ্যায়ে আছে। ঈশ্বর আমাকে সুযোগ দিয়েছেন আরো একবার বাঁচতে! আরো একবার আমার অর্ধাঙ্গিনীকে দেবী রূপে দেখতে!

পরলোক গমনের আশা ছেড়ে আমি অতি বাস্তবে মনোনিবেশ করলাম। বোধগম্য হচ্ছে না অবশ্যি, কি বলল এই পাগলী মেয়ে? তার জন্য নাকি পাএের সন্ধান চলছে? আরে পাএ তো স্বয়ং তার সিঁথি রাঙ্গিয়ে বসে আছে পবিএ সিঁদুরে। সে যে, “আজ থেকে আমার অর্ধাঙ্গিনী, এই আরাধ্য সেনগুপ্তের অর্ধাঙ্গিনী!”

চিএার অতি নন্দিত, প্রখর স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ মুখপানে চেয়ে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বিড়বিড়িয়ে বললাম,,

“নির্বোধ চিএা! তুই কি কখনো বুঝবি না আমার অন্তর্দহনের আকুতি? তোকে ঘিরে যে আমার হৃদয়ের লম্বচ্ছেদে বরাবরই এক বিস্ফোরক কম্পনের সৃষ্টি হয় তা ও কি তুই বুঝবি না? আমার নেএ জোড়ায় ধ্যান লাগিয়ে ও বুঝতে পারিস না তোর প্রতি গড়ে ওঠা আমার লালিত ভালোবাসার সীমা, পরিসীমা, বৃদ্ধি পাওয়া একক ভালোবাসার সীমাহীন বলিরেখা? এই যে আমার আঙ্গুলে তোর আঙ্গুল ছুঁয়ে আছে, তুই কি ক্ষনিকের জন্যে ও উপলব্ধি করতে পারছিস না, তোর আলতো হাতের স্পর্শে আমার হিমশীতল রক্তবিন্দু ঠিক কতোটা উষ্ণ হয়ে আছে? এই যে, সিঁথিতে এতো চওড়া করে সিঁদুর পড়ে আছিস, এখনো কি সেই সিঁদুরকে তোর আবিরের সামান্য রঙ্গ বলেই মনে হচ্ছে? একবার ও অনুভব করতে পারছিস না? ওটা আবির নয়, ওটা সিঁদুর! কোনো মহিমাই জেগে উঠছে না, সিঁদুরের পবিএ ছোঁয়ায়? তুই তো দেবীপক্ষের অন্যতম এক দেবী চিএা। তুই কি দিব্যদৃষ্টিতে ও তোর সিঁথি পূর্ণ সিঁদুরে আরাধ্যকে ঠাঁই দিতে পারছিস না? ইসসস তোকে তো কখনো বলাই হয়ে উঠে নি চিএা, “ভালোবাসার আকুতি বাদে পৃথিবীর সমস্ত আকুতি আমি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারি। ভালোবাসা মানেই শুধু প্রকাশিত কয়েক গুচ্ছ শব্দের বাক্যাংশ নয়, কোনো অসাধ্য ও সাধন নয় বা যাদুকরী কোনো দৈবিক শক্তি ও নয়। আমার কাছে ভালোবাসা মানে মোটে ও অতি রঞ্জিত, অতি মোহনীয় বা অতি প্রদর্শনীয় ও কিছু নয়! ভালোবাসা তো অতি সাধারন, নিত্যদিনের স্বাভাবিক, সরল, গোছানো, চলমান ধারার এক জীবন যাএা মাএ। ভালোবাসা আদৌতে ভালো একটা অভ্যেস। সেই অভ্যেসটা একবার গড়ে উঠলে খারাপ থাকা থেকে দূরে থাকা যায়! আমি ও ভালোবাসার মতোন স্বাভাবিক অনুভূতিটাকে নিয়ে ভালো আছি, ভীষণ ভালো আছি!”

গলা ঝাঁকিয়ে আমি ক্ষীণ হেসে চিএাকে বললাম,,

“পাএ খুঁজলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না তাই না? তুই অযথাই বেশি ভাবছিস!”

চিএা শুকনো মুখে আমার পানে চেয়ে বলল,,

“বাবা ভীষণ তৎপর৷ ভাবছে, হঠাৎ যদি যমরাজ এসে যায়? তখন তার অনাদ মেয়েটার কি হবে? কে দেখবে তাকে? মায়ের অভাবে, অযত্নে, অনাদরে লকলকে বেড়ে ওঠা ঢিঙ্গি মেয়েটা কার আশ্রয়াধীনে থাকবে তখন? বাবা চলে গেলে তো বাবার সমস্ত তুলে রাখা আদর, যত্ন, ভালোবাসা সর্বোপরি ছাঁয়াটা ও বাবার সঙ্গে “দাহ” হয়ে যাবে। তখন তো এই এি-ভুবনে আপন বলে আমার আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। তাই হয়তো খুব শীঘ্রই একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে যেতে চাইছেন বাবা। বাবা হওয়ার পরম মহান দায়িত্বটা তো আর অস্বীকার করতে পারেন না।”

ভীষণ রাগ হলো আমার। বেশিক্ষণ চেঁপে রাখতে পারছিলাম না সেই রাগ। আলতো হাতে ছুঁয়ে রাখা চিএার বা হাতটা আমি কাঠিন্য রূপে চেঁপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললাম,,

“কেবল আপন না, বরং আপনের চেয়ে ও পরম আপন কেউ এখনো এই ভুবনে অবশিষ্ট আছে। কাকুকে তোর বিষয়ে অধিক ভাবতে হবে না। অন্য কোথাও ও তোর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে না। কাকুর অনুপস্থিতিতে তোর কোনো অবহেলা, অনাদর, অযত্ন আমার এই জীবদ্দশায় হবে না।”

চিএা হাসল, মলিন হাসল, পরক্ষণে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,,

“বাবা ছাড়া পরম আপন এ ভুবনে আর কে আছে আমার? বাবা তো আমার ছাঁয়া সঙ্গী রে। ঈশ্বরকে বলেছি, আমার জীবনের সর্ব অংশ যেনো বাবার ললাটখন্ডে লিপিবদ্ধ করে। আমার বাবা বেঁচে থাকুক যুগ যুগ ধরে। আমি বেঁচে থাকতে সম্ভবত বাবার মুখাগ্নি করতে পারব না আমি।”

টুপ করে চিএার চক্ষু কোটর বেয়ে এক ফোঁটা জলকণা গড়িয়ে পড়তেই আমি হাতের মুঠোয় জলকণাটা তুলে নিলাম। ক্রন্দনরত অবস্থাতে ও চিএা অট্ট হেসে বলল,,

“তুই ও না আরাধ্য! ভীষণ বেখেয়ালীপূর্ণ প্রলাপ বকিস। বাবার চে পরম আপন কেউ এি ভুবনে আমার নেই!”

প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে আমি চিএার টলমল নেএে দৃষ্টি রেখে বললাম,,

“তোর পাশে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে তোর আপন মনে হয় না? এক যুগের বেশি সময়টা তো তোর সাথেই আমি কাটিয়েছি চিএা। ১২ বৎসর কি অতি ক্ষুদ্র সময়? আমাকে আপন ভাবার?”

চিএা মাথা নত করে ইতস্ততবোধ করে বলল,,

“তুই শুধুমাএ আমার বন্ধু আরাধ্য। ভাগ্য করে হয়তো তোর মতো বৃহৎ বড় জাতের কাউকে আমি বন্ধু রূপে পেয়েছি। সেই জায়গা থেকে তোকে আপন ভাবাটা আমার পাপ। বন্ধুত্ব কখনো আশ্রয়ের স্থান হতে পারে না। বন্ধুত্ব শুধামাএ ভালো, খারাপ জেনে ও কিঞ্চিৎ প্রশয়ের স্থান।”

চিএার হাতটা ছেড়ে আমি চিএার সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললাম,,

“তুই শুধুই আমাকে বন্ধু ভাবিস চিএা? কখনো এর অধিক ভাবতে পারিস নি?”

চিএা মাথা তুলে চঞ্চলা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল,,

“বললাম তো, তোকে অধিক কিছু ভাবাটা আমার পাপ।”

গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে আমি চিএার সম্মুখ থেকে সরে দাঁড়ালাম। চিএা অল্প সময় মৌণ থেকে অকস্মাৎ মৃদ্যু হেসে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বলল,,

“হ্যাঁ রে, তোর ঐ নতুন বন্ধুর নাম কি? যে তোর ক্রিকেট খেলাকে এতোটা ভালোবাসে? সে নিশ্চয়ই তোর মতো খুব বড় জাতের তাই না?”

চোয়াল শক্ত করে আমি চিএার হাত চেঁপে ধরে তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম,,

“কোনো বন্ধু, টন্ধু নেই আমার। আজ থেকে তুই ও আমার বন্ধু না।”

চিএার হাত ছেড়ে আমি উল্টো দিকে প্রস্থান নিলাম। চিএা ব্যাকুল কন্ঠে পেছন থেকে আমাকে ডেকে বলল,,

“এই আরাধ্য? তুই কি সত্যিই আজ কাশিয়ানী ফিরে যাবি? পদ্মবিলে যাবি না আমার সাথে? তুই কিন্তু কথা দিয়েছিলি, গোপালগঞ্জ এলেই তবে আমার জন্য এক গুচ্ছ ফুটন্ত পদ্ম এনে দিবি।”

থমকে দাঁড়ালাম আমি। পিছু ঘুড়ে চিএার দিকে চেয়ে রাগী কন্ঠে বললাম,,

“তুই তো আমাকে আপন ভাবিস না, তবে আমি কেনো তোকে আপন ভেবে বিলের মাঝখান থেকে এতো ঝুঁকি নিয়ে পদ্ম তুলে দিবো? আমার এতো ঠেকা কিসের?”

চিএা ফ্যাল ফ্যাল চোখে বলল,,

“তুই তো আমার বন্ধু। বন্ধু হয়ে বন্ধুর দায়িত্ব পালন করবি না?”

চিএার দিকে তেড়ে এসে আমি চিএার সিঁথিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললাম,,

“তবে তোকে ও যে একটা বন্ধুর দায়িত্ব পালন করতে হবে! বল করবি?”

চিএা স্বাভাবিক চোখে ভ্রু যুগল প্রশ্বস্ত করে বলল,,

“বল না, কি দায়িত্ব?”

“সিঁথিতে সর্বদা আবির ছুঁয়ে রাখবি। যেনো দ্বিতীয় কেউ টের না পায়।”

মুহূর্তের মধ্যে চিএা ভ্রু যুগল অধিক কুঁচকে বলল,,

“ইসস। তুই ভীষণ অবুঝ আরাধ্য। এ আবার কোনো দায়িত্ব হলো? এ তো পুরো ছেলে মানুষী রে!”

আমি তটস্থ কন্ঠে বললাম,,

“তোর কাছে ছেলে মানুষী হলে ও আমার কাছে এটাই বাস্তবতা। বন্ধু হয়ে বন্ধুর দায়িত্ব পালন করবি না?”

চিএা অট্ট হেসে বলল,,

“ঠিকাছে যা, তাই হবে। দায়িত্ব আমি পালন করব। এবার তুই ও তোর দায়িত্বটা পালন কর!”

আমি ম্লান হেসে চিএার বাঁ গালে লেগে থাকা হলির নীল আবছা রঙ্গটা আঙ্গুলের স্পর্শে নিশ্চিহ্ন করে বললাম,,

“রোজ পড়ে থাকবি কিন্তু। আমি কাশিয়ানী ফিরে গেলে ও পড়ে থাকবি।”

পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিঁদুর মিশ্রিত আবিরের একটা পলি ব্যাগ বের করে আমি চিএার হাতে তুলে দিয়ে বললাম,,

“এই আবিরটা পড়বি রোজ। আমি দূরে থাকলে ও কিন্তু ঠাহর করতে পারব তুই রোজ নিয়ম করে আদৌ আবিরটা পড়েছিস কিনা!”

চিএা আবিরের পলিব্যাগটা হাতে নিয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে বলল,,

“কি আছে ঐ আবিরে? কেনো এতোটা উদগ্রীব তুই? কেনো আমাকে এই আবিরটাই পড়তে হবে? চলছে কি বল তো?”

“বিশেষ কিছু মাহাত্ম্য নেই এই আবিরে। অতিরিক্ত খরচ বাঁচাতে আবিরটা আমিই কিনে দিলাম তোকে!”

চিএা ব্যাকুল চাহনীতে শঙ্কাজনক কন্ঠে বলল,,

“তুই কাশিয়ানী কবে ফিরবি? আজই কি তবে ফিরে যাবি?”

চিএার ডান হাতটা মুষ্টিমেয় করে আমি চিএার দৃষ্টিতে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“১ মাসের পূর্বে কোথাও নড়ছি না আমি। পরবর্তী ম্যাচ থেকে টিমে যোগ দিবো। এই ১ মাসটা অন্তত তোর কাছাকাছি থাকতে চাই।”

“কিন্তু জেঠু তো বললেন, আজই তোকে কাশিয়ানী ফিরে যেতে!”

“ছাড় তোর জেঠুর কথা। রাগ পড়লে তোর জেঠু এমনিতেই শান্ত হয়ে যাবেন।”

“তবে তোর খেলাধূলোর তো ক্ষতি হবে তাই না?”

“১ মাস বিস্তর সময় না। আগামীতে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।”

চিএা উল্লাসিত চোখে আমার মগ্ন দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“আজ সন্ধ্যায় শুভীদের বাড়িতে নাচের অনুষ্ঠান আছে। আমি ওখানে নাচব। তুই আসবি তো আরাধ্য? আমার নাচ দেখতে?”

আমি নাক ছিটকে বললাম,,

“ছ্যাঁ। মেয়েদের নাচ আমি দেখব? চরম বিরক্তিকর। তাছাড়া তোর নাচ তো আমার মোটে ও পছন্দ না। এখনো হয়তো স্টেপ তুলতে পারিস না ঠিক মতোন। শোন? তোর এই উশৃংখল নাচ আমি পরিদর্শন করতে যেতে পারব না। সরাসরি বলে দিলাম। আমার অপেক্ষায় থাকিস না কিন্তু!”

চিএা রাগান্বিত কন্ঠে বলল,,

“তোর খেলা ও আমার পছন্দ না বুঝলি? এই জীবনে তোকে দেখলাম না, ৪/৬ পেটাতে। ফিল্ডিং ও তো করতে পারিস না ভালো মতে। পরবর্তীতে আমি ও কখনো তোর খেলা দেখতে যাবো না। এই বলে দিলাম!”

চিএার মাথায় আমি গাড্ডা মেরে বললাম,,

“খেলার মানে তুই বুঝিস নাকি? মানে বুঝলে পরেই তো খেলার আসল মজাটা উপলব্ধি করতে পারবি! অকালকুষ্মাণ্ড একটা।”

চিএা ঝগড়ুটে ভাব নিয়ে বলল,,

“নিজের বেলাতেই শুধু ষোলো আনা তাই না? পরের বেলায় এক আনা ও না? তুই ও তো নাচের অর্থ বুঝিস না, বুঝলে পরেই তো নাচের প্রতিটা তাল উপলব্ধি করতে পারবি! অপারদর্শী ছেলে একটা।”

আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,,

“আচ্ছা, এখন ওসব কথা ছাড়। কাকুর সাথে আমার কিছু বিশেষ কথা আছে! চল তোদের বাড়ি যাই।”

চিএা ঠোঁট উল্টে বলল,,

“পদ্মফুল?”

চোখের পাঁপড়ীতে অনবরত দোল খাওয়া কয়েকটা কেশরাশি চিএার অনুভূতিকে ভীষণ ভাবে জ্বালাচ্ছিলো। আঙ্গুলের স্পর্শে আমি অশোভন কেশরাশিকে কানের পিছনে গুজে বললাম,,

“বিকেলে। যখন রোদ পড়বে। ১০১ টা পদ্মফুল তুলে দিবো। খুশি তো?”

চিএা উচ্চ শব্দে হেসে আমার নাক টেনে বলল,,

“শুধু খুশি? মহা খুশি বুঝলি?”

ইসস! চিএার এই উচ্চ হাসির ঝংকারে আমার তপ্ত হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি নামছে রিমঝিম শব্দে। সিক্ত হৃদয় কাননে তিপ তিপ শব্দে বেজে উঠছে বৃষ্টির রাগিনী। যার জন্য আমার এই বুকভরা অনুভূতি, সেই নির্বোধ, বোকা মেয়েটাই ঘুনাক্ষরে টের পাচ্ছে না আমার অন্তঃকরণের টুইটুম্বুর ভালোবাসার পরিণতি! একটু কান পেতে তো শুনতে পারিস চিএা, আমার হৃদপিন্ডে তোর নামের তীব্র, প্রখর প্রতিধ্বনিটা। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস? আমার “দাহ” হওয়ার পরে ও হয়তো স্বর্গ, নরক এই দু স্থানেই, যেখানেই আমি থাকি না কেনো, আমার হৃদয় জুড়ে এই একইভাবে তোর নামের প্রতিধ্বণি বাজবে। আমার দেহটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে ও আমার মনে তোর বসবাস থাকবে পৃথিবী ধ্বংসের আগ পর্যন্ত। আমার রোধন হলে ও, আমার প্রেমের রোধণ হবে না চিএা! তুই যে আমার মনে বাস করা স্বয়ং দেবীর প্রতিমূর্তি। দেবীদের কখনো মৃত্যু হয় নাকি? তারা তো আদি, অনন্ত, অনাদি।”

চিএা উৎফুল্লতায় অভিভূত হয়ে আমার হাত ধরে হেঁটে চলছে বড় রাস্তার মোড়ে। সামনের টং দোকানটায় পায়ের উপর পা তুলে বসে নিরন্ঞ্জন দা সিগারেট ফুঁকছেন, সাদা রঙ্গের পাঞ্জাবিতে অবশ্য দোলের রঙ্গ লেগে আছে, মুখমন্ডলে ও আংশিক দোলের দাগ স্পষ্ট। বখাটে ছেলে ফেলে সমেত নিরন্ঞ্জন দা কে দেখা মাএই আমি চিএার হাতটা ছাড়িয়ে লুকিয়ে পড়লাম মাঝারি আকারের কৃষ্ণচূড়া গাছের অন্তরালে। প্রত্যক্ষণ করতে চাইছি, আমার অনুপস্থিতিতে একলা একা চিএাকে পেয়ে নিরন্ঞ্জন দা এর গতি প্রকৃতি। চিএা এখনো আঁচ করতে পারে নি অবশ্য আমি তার পাশে নেই। আনমনা হয়ে সে হেঁটে চলছে বড় রাস্তা ধরে। চিএাকে দেখা মাএই নিরন্ঞ্জন দা ঠোঁটের আলিজে বিদঘুটে হাসি ফুটিয়ে সিগারেট টা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে উচ্চ শব্দে চিএাকে ডেকে বলল,,

“এই চিএা শোন?”

চিএা দাঁড়ালো৷ রাস্তার অপাশে দৃষ্টি নিবন্ধন করে চিএা নিরঞ্জন দা কে দেখা মাএই শুকনো ঢোক গিলে চোখ জোড়া ফিরিয়ে তার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে আমাকে খুঁজতে লাগল৷ নিরঞ্জন দা সেই সুযোগে রাস্তা পেরিয়ে চিএার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে বলল,,

“কি রে কেমন আছিস?”

উড়নাটা চওড়া করে বুকে জড়িয়ে চিএা নিজেকে পরিপাটি রূপে জাহির করে জোরপূর্বক হাসি টেনে মাথা নত করে বলল,,

“ভালো আছি।”

“চল, তোকে আবির মেখে দেই। ভেবে তো রেখেই ছিলাম আমিই তোকে প্রথমে দোলের আবিরটা মাখাবো৷ তবে এখন তো দেখছি তুই এর পূর্বেই দোলে স্নান করে পরিশুদ্ধ হয়ে আছিস।”

চিএা অস্থির দৃষ্টিতে আশপাশ ফিরে আমাকে খুঁজছে। নিরঞ্জন দা উনার গাল থেকে লাল আবিরটা ডান হাতে মেখে চিএার গালে পড়ানোর পূর্বেই আমি গাছের আড়াল থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলাম। বুকের পাজরে হাত গুজে আমি কঠিন ভাব ভঙ্গি নিয়ে চিএার পাশে দাঁড়াতেই নিরঞ্জন দা ভড়কে উঠলেন। চোখ দুটো প্রকান্ড করে নিরঞ্জন দা আমার দিকে চেয়ে বললেন,,

“তুতুতুই?”

চোয়াল শক্ত করে আমি নিরঞ্জন দার পাঞ্জাবির কলার চেঁপে ধরে চিএার সম্মুখ থেকে সরে বড় রাস্তা পেরিয়ে গলির মোড়ে টেনে হেছড়ে নিয়ে এলাম উনাকে। নিরঞ্জন দা অতিব আতঙ্কে বিমূর্ষ হয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললেন,,

“তুতুতুই? কককবে এলি?”

পাঞ্জাবির কলার টা অধিক শক্ত হাতে চেঁপে ধরে আমি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললাম,,

“এই? তুই তোতলাচ্ছিস কেনো? যমরাজ ভাবছিস নাকি আমাকে? ভয় পাচ্ছিস আমাকে?”

“আমি তোর বড় দাদা হই আরাধ্য। তুই, তুকারি করছিস কাকে? কলারটা ছাড় বলছি। প্রতিবার লোকজনের সামনে তুই আমাকে অসম্মান করতে পারিস না কিন্ত।”

“বড় দাদার সম্মান তুই রাখতে পারলি কই? অশ্রাব্য ভাষাই তোর প্রাপ্য। এখনো ছুকছুকানি কমে নি তোর তাই না? এতো নির্লজ্জ, বেহায়া কেনো তুই? আত্নসম্মান বোধ নেই তোর? পুরুষ জাতির লজ্জাষ্কর প্রতীক তুই!”

“কি করেছি আমি? ছোট বোন হিসেবে চিএাকে আবির মাখাতেই পারি। এতে অন্যায় কি?”

“৫ মাস পূর্বের নোংরা কাহিনীটা তুই নিশ্চয়ই ভুলে যাস নি তাই না? আমার চিএাকে সম্মানহানি করতে চেয়েছিলি তুই। শুধু তাই নয়, গোটা পাড়ায় চিএাকে নোংরা অপবাদ দিতে ও তৎপর ছিলি তুই। চিএার প্রস্ফুটিত জীবনটা তোর নোংরামোতে নষ্ট হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছিলো। ভাগ্যিস সঠিক সময়ে আমি তোর নোংরামীটা ধরে ফেলেছিলাম। নতুবা এতো গুলো দিনে আমার চিএা লজ্জায়, অপমানে, অসম্মানে আত্নাহুতি দিতো!”

“বললাম তো, ঐ ভিডিওটা আমি ডিলিট করে দিয়েছি। এই জন্মে আমি চিএার দিকে চোখ তুলে তাকাবো না। শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। দয়া করে এবার তুই আমার কলারটা ছাড়।”

“তুই মোটে ও আমার বিশ্বাসযোগ্য নস। চোখের সম্মুখেই তো এইমাএ দেখলাম, চিএার দিকে তুই কতোটা অশোভন দৃষ্টিতে চেয়েছিলি। লালসা ভরা ছিলো তোর ঐ পাপী চক্ষু জোড়ায়। তুই বারংবার ভুলে যাস না? “দেবীকে সদাসর্বদা পবিএ নয়নে দেখতে হয়। লোভ, লালসার অতি উর্ধ্বে তারা।” আচ্ছা? এই ৫ মাসে আমার অনুপস্থিতিতে সুযোগ বুঝে তুই আবার নতুন কোনো ভিডিও তৈরী করে ফেলিস নি তো? দেখি তোর ফোনটা বের কর, তোর ফোন সার্চ করব আমি।”

“আরাধ্য, তুই কিন্তু এবার সীমা লঙ্ঘন করছিস। পাড়ার জমিদারের ছেলে বলে তুই আমাদের মতোন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের সাথে যা তা করতে পারিস তা কিন্তু মোটে ও শোভাজনক নয়। সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গেলে না? জেঠুর কাছে নালিশ জানাতে আমার এক মুহূর্ত ও বিলম্ব হবে না!”

ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে আমি নিরঞ্জন দার পাঞ্জাবির কলারটা ছেড়ে পান্ঞ্জাবির পকেটে হাত ডুবিয়ে ফোনটা নিয়ে বললাম,,

“খুব শখ, পাড়ার লোকজনদের কাছে বেঁচে থাকা অতি ক্ষুদ্র মান-সম্মান টুকু ও খোঁয়ানোর তাই না? নালিশ করলে কি হবে জানিস? গোটা সমাজ জেনে যাবে তোর ক্যালেঙ্কারির ঘটনা। চরিএে এবার জঘন্যভাবেই কালো দাগ লাগবে। নাক, কান কাটা যাবে তোর। পরিবারের দিকটা ভেবে দেখেছিস?”

সামান্য প্রশয়ের সুযোগ পেয়ে নিরঞ্জন দা আমার হাত থেকে ফোনটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে বড় রাস্তায় দৌঁড়োতে আরম্ভ করল। বুঝতে আর বিলম্ব হলো না কিছু একটা গোপনীয় বিষয় তো আছে। ভৌঁ দৌঁড়ে আমি নিরঞ্জন দার পিছু নিতেই ভয়ে চুপসে থাকা চিএা পেছন থেকে উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বলল,,

“এই আরাধ্য থাম। কি হয়েছে তোদের? তোরা দুজনই এভাবে দৌঁড়চ্ছিস কেনো?”

পিছু ঘুড়ে আমি চিএাকে বললাম,,

“তুই বাড়ি যা চিএা। কিছুক্ষণ বাদেই আমি তোর বাড়ি যাচ্ছি।”

“দয়া করে আর কোনো ভেজালে জড়াস না আরাধ্য। জেঠু জানতে পারলে তোকে সত্যি সত্যিই আজ কাশিয়ানী পাঠিয়ে দিবেন। খুব শাস্তি দিবেন তোকে।”

আমি প্রখর রাগে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললাম,,

“তোকে আমি বাড়ি যেতে বলেছি। বাড়ি যা তুই। আমার জন্য তোর এতোটা উদগ্রীব হতে হবে না। আমি সঠিক সময়ে তোর বাড়ি পৌঁছে যাবো।”

কিছুদূর যেতেই দোল উৎসবে মাতোয়ারা লোকজনদের ভীড়ে নিরঞ্জন দা কে হারিয়ে ফেললাম আমি। শত খুঁজে ও লম্পটটাকে খুঁজে পেলাম না। মুহূর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো ঐ অসভ্য, ইতর ছেলেটা। মন বলছে, নিরঞ্জন দা নতুন কোনো নোংরা জাল বিছিয়েছেন আমার সরল চিএার বিরুদ্ধে। কিছু একটা তো আমার তৎক্ষনাৎ করতেই হবে। যদি ও কোনো অশ্লীল ভিডিও নিরঞ্জন দা তৈরী করেই থাকেন, তবে নিশ্চয়ই ভাইরাল হওয়ার অপেক্ষাতেই আছে সেই ভিডিওটা!

দুপুর ১ টা পর্যন্ত নিরঞ্জর দা কে পুরো পাড়ায় খুঁজে সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে আমি অতঃপর নিরঞ্জন দার বাড়িতে উঠলাম। বসার ঘরে কদম রাখতেই জেঠু, জেঠিমনি, বাড়ির অন্যান্য আত্নীয়, স্বজনরা আমাকে ঘিরে ধরলেন। কৌশল বিনিময়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সবাই। জেঠিমনি লেবুর শবরত করতে রান্না ঘরে পা বাড়ালেন। সুধীর কর্মকার (নিরঞ্জন দার বাবা) আমার ক্রিকেট খেলার প্রসঙ্গ নিয়ে নানান কথা বার্তা বলছেন। অপর পাশে আমি শকুনের দৃষ্টিতে পুরো বাড়িটায় নিরঞ্জন দা কে খুঁজছি। মিনিট পাঁচেক পর সুধীর জেঠুকে থামিয়ে আমি ইতস্তত বোধ করে বললাম,,

“নিরঞ্জন দা কোথায় জেঠু? বস্তুত আমি নিরঞ্জন দা এর সাথেই দেখা করতে এসেছি।”

সুধীর জেঠু মৃদ্যু হেসে বললেন,,

“নিরঞ্জন? নিরঞ্জন তো বাড়িতে নেই বাবা। হয়তো বন্ধুদের সাথে হলি খেলছে।”

পরক্ষণে সুধীর জেঠু কপালের ভাঁজে কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্নতা ফুটিয়ে বললেন,,

“আবার কিছু করে নি তো নিরঞ্জন? হঠাৎ নিরঞ্জনের সন্ধানে এলে কেনো তুমি?”

আমি জোর পূর্বক হেসে বললাম,,

“না তেমন কিছু না জেঠু। নিরঞ্জন দার ল্যাপটপটা আমার ভীষণ দরকার ছিলো, তাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে আসা।”

“ওহ্ আচ্ছা, এই ব্যাপার? নিরঞ্জনের শোয়ার ঘরেই ল্যাপটপটা আছে। তুমি দেখতে পারো!”

হন্ন হয়ে ছুটে এলাম আমি নিরঞ্জন দার শোবার ঘরে। বিছানায় ছড়িয়ে, ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল বই, ফটো, ম্যাগাজিন। মাথায় রাগটা যেনো চড়ে বসল আমার। জেঠিমনি কি ভ্রান্তিতে ও এই রুমে প্রবেশ করেন না? পুএের এসব কু-কীর্তি উনার মোটে ও নেএলোকন হয় না? আর ঐ লম্পট নিরঞ্জনটা ও বা কিভাবে পারে নিজের অশ্লীলতা এভাবে প্রকাশ্যে তুলে ধরতে? এতোটা বেহায়াপনা ও কি আমার সমজাতীয় পুরুষদের পক্ষে সম্ভব হয়? ভাবতেই গাঁ টা ঘিনঘিন করছে! এই কয়েকটা পুরুষের অশ্লীল লালসার জন্যই গোটা পুরুষ জাতির বদনাম হয়!

পড়ার টেবিলের উপর ল্যাপটপটা খুঁজে পাওয়া মাএই আমি ল্যাপটপটা অন করতেই পাসওয়ার্ড হীনতায় ভুগলাম। পাসওয়ার্ড ব্যতীত কোনো মতেই কিছু ডকুমেন্টস, কোনো ক্লু খুঁজে পাবো না আমি। ভয়ঙ্কর রেগে আমি ল্যাপটপটা ফ্লোরে ছুড়ে মারতেই হঠাৎ থেমে গেলাম। কিছুতেই এই ল্যাপটপটা ভাঙ্গা যাবে না। এই ল্যাপটপেই তো আছে সমস্ত প্রমান, অশ্লীলতার প্রতিটা ভিডিও। না জানি ঐ লম্পটটা আমার চিএার সতীত্বে কতোটা দাগ কেটেছে! চিএাকে ছেড়ে যাওয়াটাই হয়তো আমার ভুল ছিলো।

ইতোমধ্যেই রুমের দরজা ঠেলে নিরঞ্জন দা প্রবেশ করলেন। আমাকে দেখা মাএই নিরঞ্জন দা শুকনো ঢোক গিলে দৌঁড়ে রুম থেকে প্রস্থান নিতেই আমি তেড়ে গিয়ে নিরঞ্জন দার পাঞ্জাবির কলার চেঁপে ধরে নাকে, মুখে এলোপাথাড়ি কিল, ঘুষি বসিয়ে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললাম,,

“ফোনটা আমার হাতে দে, ল্যাপটপের পাসওয়ার্ডটা বল। বেশি সময় নেই আমার হাতে। যা করার তাড়াতাড়ি কর।”

নিরঞ্জন দা চিৎকার করে বললেন,,

“মা-বাবা কোথায় তোমরা? দেখো, আরাধ্য আমার রুমে ঢুকে আমাকে মারছে!”

হুড়মুড়িয়ে আমি রুমের দরজার খিল আটকে ধস্তাধস্তি সমেত নিরঞ্জন দাকে বেডের কার্ণিশের সাথে হাত দুটো রোমাল দিয়ে বেঁধে নিলাম। দরজার ঐ পাশ থেকে হাঁক ডাকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। জেঠু, জেঠিমা আর্তনাদ করে আমার নাম ধরে ডাকছেন, দরজার খিল খুলতে বলছেন। তাদের হাঁক ডাকে কোনো রূপ ভ্রুক্ষেপ না করে আমি নিরঞ্জন দার থুতনী চেঁপে ধরে দাঁতে দাঁত চেঁপে বললাম,,

“ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড বল?”

“বিশ্বাস কর আরাধ্য। চিএার স্নানের নতুন কোনো ভিডিও নেই আমার কাছে। বলতে গেলে, চিএার কোনো অশ্লীল ফটো ও আমার কাছে নেই। সব ডিলিট করে দিয়েছি আমি, সব!”

“কথায় বিশ্বাস করি না আমি। স্বয়ং চাক্ষুস প্রমাণে বিশ্বস্ত আমি। ল্যাপটপের পাসওয়ার্ডটা বল।”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here