#শ্রাবণ_আঁধারে
#পর্ব_৪
#নিশাত_জাহান_নিশি
“কথায় বিশ্বাস করি না আমি। স্বয়ং চাক্ষুস প্রমাণে বিশ্বস্ত আমি। ল্যাপটপের পাসওয়ার্ডটা বল।”
বেঘড়ক পিটুনি খাওয়ার পরে ও নির্লজ্জ, বেহায়া নিরঞ্জন কোনো ক্রমেই মুখ খুলতে চাইছে না। শক্ত হয়ে দৃঢ় প্রতীঙ্গতার সহিত এক রোঁখা স্বভাবের পরিচয় দিচ্ছে। আমি কিন্তু মোটে ও স্থগিত হচ্ছি না। একের পর এক লাথ, ঘুঁষির আঘাতে তার দেহটাকে থেতলে দেওয়ার প্রয়াসে আছি। পৃথিবীর সমস্ত উশৃঙ্খলতা সহ্য করলে ও আমি চিএার সঙ্গে এক রত্তি উশৃংখলতা সহ্য করতে পারব না। এই অসীম ক্ষমতা আমার মধ্যে বিদ্যমান নাই। আমাদের সম্পর্কটা যেখানে স্বয়ং ঈশ্বরের পবিএ আর্শীবাদ সেখানে, সেই পবিএতম স্থানে উশৃংখলতার কোনো ঠাঁয় নাই। যতক্ষণ না এই বেহায়া, নির্লজ্জ, অসভ্য ছেলেটা মুখ খুলছে ততক্ষণ অব্দি আমার পিটুনি স্থগিত হবে না। আমার মধ্যে নিহিত কোনো ক্লান্তি বা শ্রান্তির ও আবির্ভাব ঘটবে না। চাইলে হয়তো তাকে আঘাত করার মনোভাব বৃদ্ধি পেতে পারে ক্রমবর্ধমান হারে।
মাএাতিরিক্ত মার ধরের অন্তিম পর্যায়ে ঠেঁকতেই নিরঞ্জন দা অস্ফুটে স্বরে খুক খুক শব্দে কেশে বলল,,
“ল্যাপটপটা আমার হাতে দে। আমি লকটা খুলে দিচ্ছি।”
বিরাম নিলাম আমি। নিরঞ্জনের পাঞ্জাবির কলারটা অতি আগ্রহের সহিত ছেড়ে আমি মুখমন্ডল থেকে জবজবে ঘাম রাশি নিশ্চিহ্ন করে উর্ধ্ব গতিতে ক্রমাগত কয়েকটা শ্বাস নির্গত করে টেবিলের উপর থেকে ল্যাপটপটা এনে নিরঞ্জনের অস্থিমজ্জায় ঠাঁয় দিলাম। ক্লান্ত কন্ঠে আমি প্রখর রাগান্বিত দু চোখে ঝাঁঝালো কন্ঠে নিরঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,
“এক মিনিট সময় দিলাম। জাস্ট এ্যা মিনিট। লকটা অতি দ্রুত খুলে দে। আর ভ্রান্তিতে ও কোনো ডকুমেন্ট ডিলিট করার কিঞ্চিৎ পরিমান সাহস দেখাবি না। নতুবা শ্মশান ঘাটে যেতে তোর খুব বেশি বিলম্ব হবে না।”
নিরঞ্জন দা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে উর্ধ্বে মাএ একবার আমার রাগান্বিত মুখমন্ডলটা প্রদর্শন করল। শুকনো ঢোক গিলে উনি দৃষ্টি ঘুড়িয়ে পুনরায় ল্যাপটপ অন করে ক্ষনিকের মধ্যে ল্যাপটপটা আমার দিকে ঘুঁড়িয়ে রক্ত বাহিত মুখমন্ডল সমেত নিস্তেজ কন্ঠে বলল,,
“ডান।”
বেহুশ হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল নিরঞ্জন দা। নির্দয়, কাঠিন্য মনে আমি ঐ কুলাঙ্গারের দিকে কোনো রূপ দৃষ্টিকোণ না করে অস্থির নেএে ভিডিও ফাইল অনুসন্ধান করতে তৎপর হয়ে পড়লাম। কাঙ্ক্ষিত ফাইলটা খুঁজে পাওয়ার পরক্ষনেই আমি ফাইলটাতে ক্লিক করে ১০ মিনিটের একটা ভিডিওতে ক্লিক করলাম। উৎসাহের সাথে জাস্ট ৩০ সেকেন্ড ভিডিওটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আমার অস্থির চোখ দুটো নিস্তেজ হয়ে এলো। মুহূর্তের মধ্যে ঠাস করে আমি ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলাম। রক্তচক্ষু নিয়ে আমি বেহুশ অবস্থায় জণাজীর্ণ হয়ে ভূমিতে লেপ্টে থাকা নিরঞ্জনের নাক বরাবার শক্ত এক ঘুঁষি নিক্ষেপ করতেই নিরঞ্জন বাস্তবে ফিরে উচ্চ শব্দে আত্নচিৎকার করে উঠল। ভয়াল থাবা বাড়িয়ে আমি নিরঞ্জনের নাক বরারর পুনরায় আরো এক ঘুঁষি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,,
“তুই আমার বোন শর্মিলাকে ও ছাড়লি না? ঐ হাঁটু সমান মেয়েটার ও সর্বনাশ করতে উঠে পড়ে লাগলি?”
নিরঞ্জন ব্যাথায় কুঁকিয়ে বলল,,
“তোর বোন নিজে থেকে আমার কাছে এসেছে। আমি জেঁচে যাই নি তোর বোনের কাছে!”
“আমার বোনের ক্যারেক্টার সম্পর্কে তোর থেকে কোনো সার্টিফিকেট নিতে হবে না আমার। আমি জানি আমার বোন কেমন। সরলতার সুযোগ নিয়েছিস তুই তাই না? একটা মেয়েকে বদনাম করার জন্য? তাকে নিচে নামানোর জন্য? মায়ের জাত, বোনের জাত কোনো জাতেরই ভেদাভেদ নেই তোর কাছে?”
“তোর বোনই আমাকে তৎপর করেছিলো রুম ডেইটে যেতে। যদি আমি কোনো রকম জোর করতাম না? তবে নিশ্চয়ই সে এতো উৎফুল্ল মনে গভীরভাবে আমার সাথে মিশত না! এরপরে ও যদি তোর বিশ্বাস না হয় তবে তোর বোনকে সবটা জিগ্যেস কর! সবটা জটলা স্পষ্ট হয়ে যাবে।”
চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে আমি লজ্জায় মাথা ঝুঁকাতে বাধ্য হয়েছি। যদি ও নিরঞ্জনের কথা আমি এক রত্তি ও বিশ্বাস করি না, তবে নিজের কাজিন সম্পর্কে নেতিবাচক কথা এবং স্বয়ং চোখে দেখা কার্যকলাপ আমি সহ্য করতে পারছি না। শর্মিলা নিজ থেকে এতো গভীরভাবে এই নির্লজ্জটার সাথে মিশবে তা আমি কল্পনা শক্তিতে ও ঠাঁয় দিতে পারছি না। অথচ এই লজ্জাষ্কর বিষয়টা আমার সামনে বাস্তবেই এইমাএ ঘটে গেলো। নিজের বোনকে ঐ অবস্থায় দেখতে হলো। নিচু গলায় আমি নিরঞ্জনকে বললাম,,
“কতোদিন ধরে চলছে এসব?”
“দু মাস হলো।”
চোখ তুলে আমি পুনরায় ভয়াল দৃষ্টিতে বললাম,,
“ভিডিও গুলো এক্ষনি ডিলিট কর আমার সামনে। এরপর তোর মুখে কিভাবে চুন, কালি মাখাতে হয়, ন্যাঁড়া করে পাড়া থেকে তাড়াতে হয়, আমার খুব ভালো ভাবে জানা আছে।”
নিরঞ্জন অট্ট হেসে বলল,,
“আমার ক্ষতি করার চিন্তা ভ্রান্তিতে ও করিস না আরাধ্য। এসবের প্রভাবে কি হবে জানিস? তোর বোনের মুখে চুন, কালি পড়বে, তোর পরিবারের মান-সম্মান খোঁয়া যাবে, তোর বোনের নামে কলঙ্ক উঠবে, চরিএে দাগ পড়বে। ভেবে দেখেছিস তো বিষয়টা?”
নিরঞ্জনের মুখ থেকে চিরন্তন সত্য কথা গুলো শুনে আমি কথার পিঠে কোনো কথা আওড়াতে পারছিলাম না। সত্যিই তো, নিরঞ্জনের বদনাম হওয়া মানেই তো শর্মিলার বদনাম হওয়া। নিরঞ্জনের বিপক্ষে সমাজে এই কটু কথাটা রটালে নিরঞ্জন ও নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না, নিরঞ্জন ও শর্মিলার বিপক্ষে যাবে। এতে মান হানি তো আমাদেরই হবে। শর্মিলার চরিএে ও গভীর ভাবে কলঙ্কের দাগ পড়বে!
নিশ্চুপ হয়ে আমি ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড নিয়ে পুনরায় ল্যাপটপটা অন করে প্রথম ভিডিওটা ডিলিট করে হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে ল্যাপটপটা চিরতরে ধ্বংস করার জন্য ফ্লোরে ছুড়ে মারলাম। খন্ড হয়ে ল্যাপটপের প্রতিটা পার্ট এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। নিরঞ্জনের পান্ঞ্জাবির পকেট থেকে জোর করে ফোনটা বের করে আমি ভিডিও ফোল্ডার ঘেঁটে ঐ একই ভিডিওটা দেখা মাএই এক চাঁপে ডিলিট করে দিলাম। নিরঞ্জন শরীরের ব্যাথায় কুঁকড়ে মরছে। হুহু শব্দে কেঁদে উঠছে অনবরত। ব্যাথার উপশম চাইছে সে।
ইতোমধ্যেই দরজার ওপাশ থেকে বাবার কঠিন কন্ঠস্বর আমার কর্ণকুহরে প্রখর ভাবে প্রতিধ্বনি তুলতে আরম্ভ করল। বুঝতে আর বিলম্ব হলো না, জেঠু, জেঠিমনি আমাকে হাজার ডেকে ও কুল কিনারা না পেয়ে পরিশেষে বাধ্য হয়েছেন আমার বাবাকে বাড়ি থেকে ডেকে আনতে।
নিজেকে শান্ত এবং স্বাভাবিক করে আমি দরজার খিল খুলে দিতেই বাবা হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। বেড সাইডে নিরঞ্জন দা কে আহত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা মাএই বাবা ঠাস করে আমার গালে দীর্ঘ এক চড় বসিয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন,,
“বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই নিজের আসল রূপ দেখাতে তৎপর হয়ে উঠেছ? পুনরায় আমার মান সম্মানকে তুমি নিলামে তুলতে চাইছ? এই দিনের জন্য আমি তোমাকে মানুষ করেছিলাম?”
জেঠু, জেঠিমনি ক্রন্দনরত অবস্থায় নিরঞ্জন দার উভয় পাশে বসে চোখ বুজে রাখা নিরঞ্জন দাকে নাম ধরে ডাকছেন। নিরঞ্জন দা আধ খোলা চোখে অস্ফুটে স্বরে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“জেঠু। আপনার ছেলে অযথাই আমাকে বেঘড়ক পিটিয়েছে। শুধুমাএ চিএার দু, একটা ছবি আমার ফোনের গ্যালারিতে দেখেছিলো। জানি না কি হলো, আপনার ছেলে আমাকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে মারতে আরম্ভ করল। আমার ল্যাপটপটা ও ভেঙ্গে দিলো। আমি এর বিচার চাইছি আপনার কাছে জেঠু। আর এ ও জানতে চাইছি, চিএার সাথে আরাধ্যের কি সম্পর্ক?”
রক্তিম চোখে আমি নিরঞ্জন দার দিকে তাকিয়ে উচ্চ শব্দে বললাম,,
“ইউ ব্লাডি। প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইছিস তুই? চিএাকে এবং আমাকে ফাঁসাতে চাইছিস? বলব? বাবার কাছে তোর অপকর্মের কথা?”
“কি বলবি তুই? তোর কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”
প্রখর ক্ষিপ্ত হয়ে আমি পুনরায় নিরঞ্জনকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে তেঁড়ে যেতেই অপর পাশে বাবা দ্বিগুন রাগান্বিত হয়ে পেছন থেকে আমার পাঞ্জবির কলার চেঁপে ধরে যতো ইচ্ছে পেরেছে চড়, থাপ্পড় মেরে আমাকে এক ধাক্কায় রুম থেকে বহিষ্কার করে ঝাঁঝালো কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল,,
“তোমার মতো কুলাঙ্গার ছেলের আমার প্রয়োজন নেই। যে ছেলে নিচু জাতের একটা মেয়ের জন্য উদ্দেশ্যহীন ভাবে তার পাড়া, প্রতিবেশী এবং বড় দাদার গাঁয়ে হাত তুলে তাকে ক্ষত, বিক্ষত করতে দ্বিধাবোধ করে না, বস্তুত সেই ছেলে আমি চাই না। চিএার ভূত তোমার মাথা থেকে কিভাবে নামাতে হয়, আমার বেশ ভালোভাবে জানা আছে আরাধ্য। আজ রাতের বাসেই তুমি কাশিয়ানী যাবে৷ তোমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা আমি করছি।”
বাবার কথা বিপরীতে কোনো রূপ প্রতিত্তুর না করে আমি মাথা নিচু করে বাতাসের বেগে নিরঞ্জন দার বাড়ি থেকে প্রস্থান নিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে, বাবা আমার সম্পূর্ণ কথা না শুনেই আমাকে ভুল বুঝলেন। সর্বদা উনি আমাকে উল্টোটাই বুঝলেন। ঘুনাক্ষরে ও ভাবতে পারি নি, নিজের বোনের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে আজ আমাকে ঐ লম্পট নিরঞ্জনের সম্মুখে মাথা ঝুঁকাতে হলো। মধ্যখান থেকে চিএাকে ও অপদস্ত হতে হলো। চড়ের দাগ হয়তো একটু পরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বাবা, তবে তোমার দেওয়া কষ্টের আঘাত এই জন্মে মোচন হবে না হয়তো। এতো সহজাধ্য নয় আমাকে কাশিয়ানী পাঠানো বাবা। চিএাকে ছেড়ে আমি কোথাও নড়ছি না। তবে এর পূর্বে আমাকে শর্মিলার মুখোমুখি হতে হবে। লুকায়িত সত্যিটা জানতে হবে। বাবাকে ও আপাতত শর্মিলার বেহায়াপনার বিষয়টা অবগত করা যাবে না। বংশের সম্মানহানির অপরাধে বাবা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে দ্বিধাবোধ করবেন না। শর্মিলাকে ও কঠোর কোনো শাস্তি দিতে উনি পিছপা হবেন না।
হাজারো প্রশ্নের দলা মস্তিষ্কে গেঁথে আমি অগ্নিরূপ নিয়ে মেইন রাস্তায় উঠতেই চিএাকে পূর্বের জায়গায় ঘর্মাক্ত অবস্থায় ছপফটে ভাব নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সিঁধিয়ে জনাজীর্ণ অবস্থা তার৷ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোভাতুর পুরুষ মহল লালসা ভরা দৃষ্টিতে চিএার আপাদমস্তক প্রদর্শন করছে। ফট করে রাগটা মাথায় চড়ে বসবে মুহূর্তের জন্য ও ভাবতে পারি নি আমি। তড়িৎ গতিতে চিএার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম,,
“অসভ্য মেয়েদের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? পুরুষ লোকদের লোভী চাহনী দেখতে ভীষণ ভাল্লাগছে?”
চিএা কাঠিন্য কন্ঠে বলল,,
“তোর জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম। তোর কি মনে হয়? আমি ইচ্ছে করে লালসার শিকার হচ্ছিলাম?”
চিএার ডান হাতটা শক্ত করে চেঁপে ধরে আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম,,
“হুম৷ তাই মনে হয় আমার। যাওয়ার পূর্বে আমি কিন্তু বারংবার বলে গিয়েছিলাম তোকে বাড়ি ফিরে যেতে। নিশ্চয়ই তুই কানে কালা নস, শুনেছিলি সব।”
ব্যাথা পাওয়ার ভঙ্গিতে চিএা তার চেঁপে ধরা হাতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অকস্মাৎ চোখে, মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটিয়ে আমার রক্তাক্ত হাতের আঙ্গুলীতে আলতো স্পর্শ করে বলল,,
“তোর হাতটা হঠাৎ কাটল কিভাবে আরাধ্য? কি হয়েছে?”
তড়িঘড়ি করে আমি হাত গুটিয়ে চিএার উদ্বিগ্ন আদলে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,
“বাড়ি যা তুই। আমি বিকেলে আসছি।”
চিএা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে বলল,,
“নিরঞ্জর দার সাথে আবার ঝগড়া করেছিস তাই না? আমার সাথে সামান্য কথা বলেছে বলে? এজন্যই তুই উনার পিছু ছুটছিলি?”
“বেশি কৌতুহল ভালো না চিএা। যেহেতু আমি বিষয়টাকে প্রতিবার ইগনোর করতে চাইছি, নিঁখুতভাবে আড়াল করতে চাইছি, সো তোর বুঝা উচিত বিষয়টা নিয়ে আমি বিরক্ত বা বিষয়টা সম্পর্কে তোকে অবগত করতে চাইছি না। কেনো বার বার এতো গর্জ দেখাচ্ছিস? বুঝছিস না আমি বিরক্ত হচ্ছি?”
চিএার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হলো না সে আমার হৃদয় ভাঙ্গা কথায় বিন্দু পরিমান আঘাত পেয়েছে বলে। চোখে, মুখে বিষাদের নীল রঙ্গ ভাসিয়ে চিএা আমার ডান হাতটা খপ করে চেঁপে ধরে রক্তবিদ্ধ জায়গাটায় আলতো হাত ছুঁইয়ে বলল,,
“ইসসস রক্ত পড়ছে তো! তুই আমার সাথে বাড়ি চল। ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি। অয়েন্টমেন্ট আছে বাবার।”
কপালের ভাঁজে বিরক্তি ভর করতেই আমি তিক্ত কন্ঠে বললাম,,
“হাতটা ছাড়। আমার এক্ষনি বাড়ি যেতে হবে। বিশেষ কাজ আছে।”
চিএা তেজর্শিনী কন্ঠে বলল,,
“কাজ ছাড়৷ আগে চল। দেখছিস না? কিভাবে রক্ত ঝড়ছে? তোর এই বেপরোয়া স্বভাবটা আমার মোটে ও পছন্দ না।”
আমি হেয় হেসে বললাম,,
“যত্নের অভাবে একটু পরে নিজে থেকেই রক্তপাত স্থগিত হয়ে যাবে। অভিমান তো সবার ই থাকে তাই না?”
চিএা সরল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি পুনরায় হেয় হেসে বললাম,,
“প্রশ্রয় দিস না বেশি। তোর কাছে বন্ধুত্ব মানেই তো কিঞ্চিৎ প্রশয়ের স্থান। দেখা যাবে অতি প্রশয়ে আশ্রয় খুঁজতে চাইবে। তোর কাছে তো বন্ধুত্বের কোন আশ্রয় নেই তাই না?”
চিএা গলা জড়ানো কন্ঠে বলল,,
“বেশি কথা বলিস তুই। জেদ একটু কমাতে পারিস না? কখন থেকে বলছি, তোর হাতে অয়ন্টমেন্ট লাগাতে হবে, শুনছিস তুই আমার কথা?”
“গলা ধরে আসছে কেনো তোর? আমার ব্যাথায় ব্যথিত হচ্ছিস? এই ভুলটা মোটে ও করিস না। ব্যাথা অপসরনের দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। যেখানে ব্যাথার কারণ স্বয়ং আমি নিজেই!”
চিএাকে ডিঙ্গে আমি গলির মোড়ে পা বাড়াতেই চিএা পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলল,,
“প্লিজ একটু থাম আরাধ্য। একবার পিছু ঘুড়ে আমার দিকে মোড় নে না! সামান্য যত্নই তো করতে চাইছি। বিশেষ কিছু তো চাইছি না!”
চিএার বুক ভরা আকুতি আমার উদ্দেশ্য পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। উদগ্রীব হয়ে পিছু ঘুড়ে তার শরনাপন্ন হতে হলো। চোখে উদয়মান টলমল জল নিয়ে ও চিএা টোল পড়া গালে মৃদ্যু হাসল। ব্যাস থমকে গেলাম আমি। দৃষ্টি আটকে গেলো তার রোমাঞ্চকর হাসিতে। চিএার এই অতি দুঃখে ও প্রখর সুখে মুর্ছে যাওয়া হাসিটা আমার ভীষণ প্রিয়। দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রথমবারের মতোন চিএার এই অদ্ভুত হাসিতে আমি ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তখন টেস্ট পরীক্ষা চলমান পর্যায়ে ছিলো। প্রিয় বান্ধুবীকে পরীক্ষার হলে হেল্প করতে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে স্যার যখন আকস্মিক চিএার খাতাটা কেড়ে নিয়েছিলো, পরীক্ষার হল থেকে প্রচন্ড শাসন করে বের করে দিয়েছিলো। ঐ মুহূর্তে চিএা ভীষণ কেঁদেছিলো। পাশের ক্লাসরুম থেকে আমি সবটা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। মাঝ পথে পরীক্ষা ছেড়ে দিয়ে আমি ও অহেতুক কারণে ম্যামের সাথে তর্কে জড়িয়ে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে চিএার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। ম্লান কন্ঠে শুধু চিএাকে এটুকুই বলেছিলাম,,
“ম্যাম আমাকে ও বের করে দিলো। একটু ও ভাবিস না তুই৷ আমরা কেউই ফেল করব না। কাকুকে বলে দুজনই মোটামুটি একটা পাশ মার্কের ব্যবস্থা করে নিবো।”
চিএা ঐ দিন ঠিক এই হাসিটা হেসেছিলো। মনে গেঁথে গেছে আমার এই হাসিটা। হয়তো আজ নতুন করে আবারো এই হাসিতে আটকে গেলাম। পরের বার হয়তো এর’চে গভীর ভাবে আটকে যাবো! কেনো জানি না, ভালোবাসার মানুষ গুলোর আকর্ষনীয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। যতো দিন যায় তাদের প্রতি আকর্ষণ ততোই বাড়ে!
শুভ্র জর্জেট উড়নাটার এক অংশ ফ্যাস শব্দে ছিঁড়ে চিএা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উড়নাটা আমার রক্তবিদ্ধ জায়গাটায় শক্ত করে বেঁধে দিলো। মুহূর্তের মধ্যে শুভ্র উড়নাটা রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠল। ম্লান হেসে আমি চিএার চিন্তিত মুখ পানে চেয়ে আপন মনে গুঞ্জন তুলে বললাম,,
“ভাগ্যিস নিরঞ্জন দাকে মারতে গিয়ে হাতটা কোনোভাবে কেটে গিয়েছিলো। নয়তো সৌভাগ্য হতো নাকি? নিবোর্ধ অর্ধাঙ্গিনী থেকে এতোটা আদর, যত্ন পাওয়ার? অতি রঞ্জিত মুহূর্তটা ক্ষনিকের জন্য থমকে গেলে হয়তো ভালো হতো। তখন হয়তো সময় ও আমাকে প্রশ্ন করত, বাচ কার ইয়ার! হামারি পাচ ভি ইতনা টাইম নেহি হে!”
রক্তাক্ত উড়নাটা থেকে চোখ উঠিয়ে চিএা উতলা চোখে আমার পানে চেয়ে বলল,,
“জেঠুকে দেখলাম তুই আসার কিছুক্ষণ পূর্বে ভীষণ আক্রোশিত হয়ে বড় রাস্তা ধরে কোথাও একটা যাচ্ছেন। সম্ভবত নিরঞ্জন দার বাড়িতে। তুই ও কি ওখানে ছিলি? নিরঞ্জন দার সাথে মারপিট করেই কি তোর হাতের এই অবস্থা হয়েছে আরাধ্য?”
অতি ক্ষুব্ধ হয়ে আমি তের্জশী কন্ঠে বললাম,,
“ঈশ্বর আমাদের কান দিয়েছেন দুটো আর মুখ দিয়েছেন একটি। তাই কথা কম বলতে হয় আর কানে বেশি শুনতে হয়। তুই শোনার বদলে, বলছিস বেশি। পুনরায় বলছি, বাড়ি ফিরে যা। আমি বিকেলে তোর বাড়িতে যাচ্ছি।”
প্রস্থান নিলাম আমি। পিছু ফিরে অন্তত একবারের জন্য ও চিএার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। আপাতত আমাকে খুব দ্রুত বাড়ি পৌঁছাতে হবে, শর্মিলার মুখোমুখি হতে হবে। জল বেশি দূর গড়াতে দেওয়া যাবে না। বিষয়টা অতি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যাওয়ার পূর্বে আমাকে বিরাম চিহ্নের দাড়ি বসাতে হবে।
_______________________________________
ঘড়িতে দুপুর দুটো।
বাড়ি ফিরেই আমি শর্মিলাকে আমার রুমে ডেকে শর্মিলার ঠিক মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলাম। দরজার খিল আটকে আমি একান্তভাবে শর্মিলার সাথে খোলসাভাবে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি। খেয়াল রাখছি এখনই যেনো বাড়ির কেউ বংশের কুকীর্তির বিষয়টা না জানে। কৌতুহলী দৃষ্টিতে শর্মিলা খাটের এক কোণায় জনাজীর্ণ ভাবে বসে আমার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,,
“কি হয়েছে দা? হঠাৎ তোমার রুমে আমাকে ডাকলে কেনো?”
রাগ সংযত করে আমি শান্ত কন্ঠে বললাম,,
“নিরঞ্জন দার সাথে তোর কতো দিনের সম্পর্ক?”
কৌতুহলী ভাব ভঙ্গি পাল্টে শর্মিলা শুকনো মুখো হয়ে উঠলো মুহূর্তের মধ্যে৷ চোখে, মুখে তার নিদারুন ভয় এবং উদ্বিগ্নতার ছাপ। হাতের সমস্ত আঙ্গুল কচলে শর্মিলা অস্পষ্ট স্বরে বলল,,
“কিকিকি যা তা বলছ? নিনিনবরঞ্জন দার সাথে আআমার আবার কিসের সম্পর্ক?”
“চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েই আমি তোর মুখাপেক্ষী হয়েছি। অযথা কথা ঘুড়ানোর চেষ্টা ভুলে ও করিস না। প্রথম থেকে শেষ অব্দি সকল বৃত্তান্ত খুলে বল আমাকে। এই ঘটনায় যদি তোর কোনো সায় বা অন্যায় না থাকে তবে নিরঞ্জনকে কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় আমার খুব ভালো করে জানা আছে।”
শর্মিলা অধিক বিচলিত হয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,,
“নিরঞ্জন দার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই দাদা। তুমি অযথাই ভুল বুঝছ আমাকে!”
শান্ত খোলস ছেড়ে আমি কঠিন কন্ঠে চোয়াল শক্ত করে বললাম,,
“সময় থাকতে সত্যিটা স্বীকার কর বলছি। নিরঞ্জন দা যদি তোর সাথে কোনো বেহায়াপনা বা জোর জবরদস্তি করে থাকে তাহলে এটা ও খুলে বল আমাকে। সত্যিটা সহজ ভাবে মুখ দিয়ে স্বীকার কর। আমি চেষ্টা করব তোকে সেইফ করার।”
ভয়ে সিক্ত হয়ে শর্মিলা আমার হাত দুটো চেঁপে ধরে অসহায় ভঙ্গিতে কেঁদে বলল,,
“আমি নিরঞ্জন দাকে ভালোবাসতাম আরাধ্য দা৷ আবেগের প্ররোচনায় পরে একবার উনার সাথে ঘনিষ্ট হয়েছিলাম, তবে অতোটা ও ঘনিষ্ট না। যে ঘনিষ্টতায় আমাদের পরিবারের মান সম্মানে দাগ লাগবে। উনার মিষ্টি কথায় আমি হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য হয়ে এতোটা বিভোর হয়ে যাবো বুঝতে পারি নি আসলে। যখন বুঝতে পারলাম আমি পাপ করছি, অন্যায় করছি, আমার জন্য আমার পরিবারের মান সম্মান খোঁয়া যেতে পারে, ঠিক তখনি আমি এই সম্পর্কটা থেকে বের হয়ে আসি। বিশ্বাস করো দা, আমি যা বলছি একদম সত্যি বলছি। একটা কথা ও মিথ্যা না। প্লিজ এবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দাও। বাড়ির কাউকে এই বিষয়ে অবগত করো না প্লিজ।”
রাগে গজগজ করে আমি শর্মিলার সম্মুখ থেকে উঠে এলাম। বোনের মুখ থেকে এসব আপত্তিকর কথা শ্রবণ করতে পারছিলাম না আমি। দরজার খিল খুলে আমি শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললাম,,
“রুম থেকে বের হ৷ ফর দ্যা গড সেইক পুনরায় ভুল কাউকে পবিএ মনে ঠাঁয় দিয়ে নিজের চূড়ান্ত সর্বনাশটা করে বসিস না। সরল মনে কাউকে হুটহাট বিশ্বাস করে অন্তত নিজে প্রতারিত হস না। বার বার আমি তোকে বাঁচাতে ছুটে আসব না কিন্তু। নিজের চরিএ এবং সম্মানের হেফাজত নিজেকেই করতে হবে।”
শর্মিলা ক্রন্দনরত অবস্থায় আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল,,
“ভিডিও টা তুই দেখে নিযেছিস তাই না দাদা? এই ১ মাসে আমি শত চেষ্টা করে ও ভিডিও টা ডিলিট করতে পারি নি জানিস? ঈশ্বরের পায়ে কতো মাথা ঠুঁকেছি। পরিশেষে হয়তো ঈশ্বর তোকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমার বৃহৎ সমস্যাটা চুটটিতে উপসম করার জন্য। তোর মতো একজন আদর্শবান বড় দাদা পেয়ে আমি ধন্য। সবসময় তুই এভাবেই আমাদের বিপদে পথ আগলে দাঁড়াস দাদা। তোর থেকে আমরা অনেক কিছু প্রত্যাশা করি।”
হেচকি তুলে কেঁদে শর্মিলা আমার রুম থেকে প্রস্থান নিলো। রুমের দরজা আটকে আমি স্নান নিতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলাম। নিরঞ্জনকে চূড়ান্ত একটা শাস্তি দিতে না পারলে বোধ হয় আমার অপরিসীম রাগ, জেদ ক্ষান্ত হবে না। ঝর্ণা চালু করে আমি উন্মুক্ত শরীরে ঠান্ডা জলের ছোঁয়ায় মনকে শান্ত করার চেষ্টায় অটল আছি। আচমকা শরীরের কোনো একটা অংশে ব্যাথার অনুভূতি হলো। ব্যাথাটাকে অনুভব করে আমি ডান হাতের আঙ্গুলির দিকে নজর দিতেই চিএার বেঁধে দেওয়া উড়নার সাদা অংশটা আমার নেএলোকন হলো। সমস্ত রাগ, জেদ, ব্যাথা যেনো মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চহ্ন হয়ে গেলো। উড়নার ক্ষুদ্র অংশটায় দীর্ঘ একটা চুমো খেয়ে আমি মিহি কন্ঠে বললাম,,
“কতোটা যত্নে তুই আমার দেহের একটা অংশে মিশে আছিস চিএা। তোর ছোঁয়া আমার বড্ড প্রিয় জানিস? অজান্তেই তুই আমার মনের অলি-গলিতে চিরন্তন সত্যি হয়ে সর্বক্ষণ বিচরণ করছিস। আমার কি মনে হয় জানিস চিএা? ভালোবাসি কথাটা তোকে বুঝাতে হয়তো আমাকে পুনর্জনম নিতে হবে। এই যুগের মেয়েরা এতো বোকা হয় নাকি?”
মৌণ হেসে আমি পুনরায় বললাম,,
“তোকে অসীমভাবে চাওয়াটা কখনো আমার পাপ হতে পারে না চিএা। বরং তখনই পাপ হবে যখন তোকে এতোটা চেয়ে ও আমি একান্তভাবে নিজের করতে পারব না! নিজের মনের মালিক হওয়া সত্ত্বে ও মনকে নিঁগূঢ় ভাবে ভেঙ্গে দেওয়াটা আমার তখন চরম শাস্তি হয়ে দাঁড়াবে।”
#চলবে…?