শ্রাবণ_আঁধারে #পর্ব_৬

0
605

#শ্রাবণ_আঁধারে
#পর্ব_৬
#নিশাত_জাহান_নিশি

ফোনটা কান থেকে সরিয়ে আমি বিছানার উপর ছুড়ে মারলাম। চিএার পাশে এই মুহূর্তে দাঁড়ানোটা আমার ভীষন জরুরি। আর এক মুহূর্ত ও বিলম্ব করা যাবে না আমার। আজহারকে কিছু না বলেই আমি এক কাপড়ে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে পাগলের মতো ছুটে চললাম বাস স্টপের উদ্দেশ্যে।

রাত ৮ঃ৩০ বাজার কাছাকাছি সময়টাতে আমি গোপালগঞ্জ এসে পৌঁছলাম। রিকশায় উঠে চিএাদের বাড়ির গলির দিকে মোড় নিলাম। উদ্বিগ্নতা, অস্থিরতা, আতঙ্কতায় আমার সারা শরীর তীব্র ঝড়ের বেগে টালমাটাল হয়ে পড়া বৃক্ষরাজিদের মতোন কাঁপছে। মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে যে, কেউ সুইসাইড করে আবার সেই সুইসাইড নোটে চিএার নাম লিখে গেছে! ভাবা যায় এসব? চিএার মতোন সহজ, সরল একটা মেয়ের পক্ষে কিভাবে সম্ভব কারো সুসাইডের মোটিভ জানা? বিষয়টা ভীষণ সন্দেহপ্রবণ হলে ও দুঃশ্চিন্তার লেশ রয়ে গেছে তিনগুন, সাথে কৌতুহল প্রবনতা তো রয়েই গেছে। না জানি চিএা এখন কতোটা খারাপ পরিস্থিতিতে আছে। পারছে তো একলা একা এই বিরূপ পরিস্থিতি সামালাতে? ভুল তো আমারই। আমি কেনো কাশিয়ানী থাকা অবস্থায় চিএার সাথে কোনো রূপ যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম না? কেনো চেয়ে ও অশান্ত মনক এতোটা শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখলাম? পিশাচ এবং জালিয়াতি মনের পরিচয় দিয়েছি আমি। চিএার সম্পূর্ণ বিপরীত আমি। চিএা যতোটা সহজ, সরল, অল্প একটু অভিমানী। আমি ততোটাই উগ্র, অভদ্র, ভীষণ রাগী এবং জেদী। আচ্ছা? আমি যে তার বেটারহাফ ভুলে গিয়েছিলাম কথাটা? হয়তো ভুলে গেছি! যদি নাই ভুলতাম তবে নিশ্চয়ই চিএার সাথে দু দন্ড কথার অন্তত ছোট্ট এটা চেষ্টা করতাম। তার হাল, চাল জিগ্যেস করতে পারতাম, তার সাথে দৈনন্দিন কি ঘটছে না ঘটছে সম্পূর্ণ খবরাখবর জানার চেষ্টায় থাকতাম। খুব অপরাধ মনোভাব কাজ করছে আমার আমার মধ্যে। চিএার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহসটা অব্দি যোগাতে পারছি না আমি। দারুন হীনমন্যতায় ভুগছি। অপেক্ষার পথ যেনো ফুরুচ্ছেই না। মনে হচ্ছে খুব দীর্ঘ এই পথ। এতো সহজে ফুরাবে না এই পথ! দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। চিএাকে আমি এক্ষনি, এই মুহূর্তে চোখের সম্মুখে দেখতে চাইছি। এতোটাই সম্মুখে দেখতে চাই যতোটা কল্পনায় আমি চিএাকে আমার খুব আশেপাশে অনুভব করি।

অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে এলো মাএ। চিএাদের গলির মোড়ে রিকশাটা থামিয়ে আমি ভাড়া মূল্য পরিশোধ করে ভৌঁ দৌঁড়ে চিএাদের বাড়ির জং ধরা গেইটটায় জোরে এক লাথ মেরে গেইটটা খুলে ছুটে এলাম চিএার ছোট্ট কামড়াটায়। দু দুটো রুমের দরজাই উন্মুক্ত অবস্থায়। রুম গুলো নীরবতায় খাঁ খাঁ করছে। জন প্রাণীর সামান্য চিহ্ন পর্যন্ত নেই রুম দুটোয়। রুম গুলোর পাশাপাশি বাড়িটা ও কেমন ঘোর নিস্তব্ধতায় তলিয়ে আছে। কোলাহল শূণ্যতায় শাঁ শাঁ করছে পুরো বাড়িময় এবং পুরো ঘরময়। জবজবে ঘর্মাক্ত অবস্থায় আমি শুকনো ঢোক গিলছি ক্রমাগত। অস্থিরতায় আমার বুকটা টিউটিউ শব্দে বোধ হয় ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। কপালের অর্ধ অংশে লেপ্টে থাকা ঘামে সিক্ত চুল গুলো আমি পেছনের দিকে ঠেলে দৌঁড়ে চলে এলাম বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুর ঘাটটায়। এই স্থানটাই হলো চিএাকে খুঁজে পাওয়ার শেষ ভরসা আমার। এই স্থানে চিএাকে না পেলে চিএাকে আর কোথায় খুঁজে পাবো আমি জানি না!

সিমেন্ট যুক্ত পুকুর ঘাটের বড় বেঞ্চিতে আমার দুঃশ্চিতাগ্রস্থ চোখ দুটো স্থির হতেই উদগ্রীব, উত্তেজিত মনটা মুহূর্তের মধ্যেই শান্ত হয়ে এলো। প্রত্যাশিত ব্যক্তি দুটোকে আমার চোখের সম্মুখে খুব নিঁখুতভাবে অবলোকন করতে পারছি আমি। তাদেরকেই তো আমি দিশেহারা, উদাসী হয়ে এতোটা সময় যাবত খুঁজছিলাম। কাকুর বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে চিএা ক্রমাগত হেচকি তুলে কাঁদছে। চিএাকে বুকের সাথে মিশিয়ে কাকু চিএার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে নিজে ও চোখের জল ছাড়ছেন। মর্মান্তিক এই দৃশ্যটা দেখা মাএই আমার হৃদয়টা হু হু শব্দে কেঁদে উঠল। তবে চোখের কোটরে জলের বিন্দুমাএ লেশ ও ধরা দিলো না আমার। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই অব্দি কখনো আমি চোখের জল ভাসিয়ে কাঁদতে পারি নি। এই গুনটা আমার মধ্যে বিদ্যমান নাই। কেনো জানি না, হাজারটা কষ্ট পেলে ও আমি চোখ ভাসিয়ে কাঁদতে পারি না। খুব শক্ত মনের মানুষ আমি। অতি আঘাতে ও আমার চোখের কোণে অবাধ্য জলেদের ছুটোছুটি আরম্ভ হয় না। কষ্টের পরিমাণ যখন দ্বিগুন হারে বেড়ে যায় তখনই আমার হৃদয় হু হু শব্দে কেঁদে উঠে। ভেতরের খবরটা তো কেবল আমার ভেতরটাই জানে। সামনের বা আশেপাশের লোকজনরা এর কি জানবে বা বুঝবে? হৃদয়ের সেই বোবা কান্না তো শুধু আমিই উপলব্ধি করতে পারি। কার ভেতরের খোঁজ কে রাখে?

ধীর পায়ে হেঁটে আমি ঘাঁটে এসে দাঁড়ালাম। চিএা এবং কাকুর সম্মুখুস্থ হয়ে আমি গলা ঝাঁকিয়ে কাকুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,

“আপনারা এখানে কি করছেন কাকু? কি হয়েছে?”

ফট করে কাকুর বুক থেকে মাথা উঠিয়ে চিএা অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার দিকে সরল এবং স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শুভ্র মুখের আদলটা অতিরিক্ত ক্রন্দনের প্রভাবে টগবগে লাল রূপ ধারণ করেছে। কাজল কালো টানা চক্ষু জোড়া ফুলে ফেঁপে খর্বাকৃতি ধারণ করেছে। বিষাদের কালিমা মুখের সর্বএে তেজীয়মান। আমি উপলব্ধি করতে পারছি, আমার দিকে চোখ মেলে তাকাতে ও চিএার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মানতে পারছি না চিএার এই করুন অবস্থা আমি। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠছে আমার। প্রথম বার চোখ ভাসিয়ে কাঁদতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। তবে পারছি না। চোখের কোণে জলের ছিঁটেফোঁটা ও ধরা দিচ্ছে না!

নীরবতা ভেঙ্গে কাকু মাথা নিচু করে ডান হাতের কব্জি দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জলরাশি গুলো মুছে নিচু গলায় আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“কি থেকে কি হয়ে গেলো বাবা। কিছুই মস্তিষ্কে ধরছে না। আমার মেয়েটা অকারণে এভাবে ফেঁসে যাবে ভাবতেই পারছি না।”

আমি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললাম,,

“কি হয়েছে কাকু? আমাকে একটু খোলসা করে বলবেন?”

কাকু মাথা তুলে আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার পূর্বেই চিএা কাকুকে থামিয়ে তুখাড় রেগে উচ্চ শব্দে চিৎকার করে বলল,,

“বাবা তুমি থামো। কাউকে কিছু বলতে হবে না তোমার। তুমি বা আমি আমরা কেউই বাধ্য নই কাউকে কিছু অবগত করার। দায় পড়ে নি আমাদের। আমাদের সমস্যা আমরা নিজেরাই বুঝে নিবো।”

চিএার রাগান্বিত চক্ষু জোড়ায় আমি ক্রোধের শিখা দেখছি। অযথাই রণচন্ডী রূপ ধারণ করে নি আমার চিএা। বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ তো নিশ্চয়ই আছে। জানি না, চিএার এই অফুরন্ত ক্রোধ আমি ভেতর থেকে নির্মুল করতে পারব কি না, তবে চেষ্টা তো করতেই পারি। নতজানু হয়ে আমি কাকুকে উদ্দেশ্য করে ছোট কন্ঠে বললাম,,

“কাকু। আমি চিএার সাথে একান্তে কিছু সময় কথা বলতে চাই৷ আপনি যদি অনুমতি দিন তো আমি একটু সুযোগ পাই!”

চিএা তেজর্শিনী রূপে আমার পানে চেয়ে রাগে ফুসফুস করে বলল,,

“আমি তোর সাথে কোনো রূপ কথা বলতে চাই না আরাধ্য। তুই দয়া করে আমার সামনে থেকে দূর হ। বিরক্ত লাগছে তোর উপস্থিতি আমার। ভীষণ বিরক্ত লাগছে।”

চিএার রাগকে কোনো রকম প্রশ্রয় না দিয়ে আমি কাকুকে উদ্দেশ্য করে আবদারের স্বরে বললাম,,

“প্লিজ কাকু৷ আমার এই মিনতিটা রাখুন। একবার সুযোগ দিন আমাকে প্লিজ!”

কাকু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিএার দিকে একবার শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জায়গা থেকে উঠে দ্রুত পায়ে হেঁটে প্রস্থান নিলেন। চিএা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থেকে আচমকা ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে বেঞ্চি থেকে উঠে আমাকে পাশ কাটিয়ে প্রস্থান নিতেই আমি পেছন থেকে চিএার ডান হাতটা টেনে ধরলাম। চিএা আকস্মিক ফুঁফিয়ে কেঁদে পিছু ফিরে আমার পানে চেয়ে বলল,,

“হাতটা ছাড় আরাধ্য। তোর স্পর্শে আমার ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে৷ দয়া করে আমাকে আর জ্বালাস না। এমনিতেই আমি জ্বলছি। ভেতরটা প্রতিনিয়ত দ্বগ্ধ হচ্ছে আমার।”

চিএার কাকুতি, মিনতিতে কোনো রূপ ভ্রুক্ষেপ না করে আমি হেচকা টান দিয়ে চিএাকে বুকের পাজরের সাথে মিহিভাবে মিশিয়ে নিলাম। চিএা অধিক ছটফট করলে ও আমি গভীর প্রশান্তিতে ডুবে আছি। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কোনো বাঁধা ছাড়াই স্বস্তির শ্বাস ছাড়ছি মন ভরে। মনে হচ্ছে কতো কাল পর যেনো আমি একটু মুক্ত ভাবে শ্বাস নিতে সক্ষম হচ্ছি, ঈশ্বর বুঝি আমাকে সেই সুযোগটা আবারো করে দিলেন! বুকে জমে থাকা দুরারোগ্য রোগটা ও যেনো চুটকিতে বিদেয় নিলো আমার। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চিএা ক্লান্ত হয়ে ঢুকড়ে কেঁদে বলল,,

“প্লিজ আরাধ্য। ছাড়া আমায়, প্লিজ।”

আমি চোখ বুজে শান্ত কন্ঠে বললাম,,

“আগে বল কি হয়েছে। এরপর ছাড়ছি।”

“তোকে আমার এক রত্তি ও সহ্য হচ্ছে না আরাধ্য। প্লিজ ছাড় আমায়।”

শক্ত কন্ঠে আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম,,

“সময়টা এখন রাগ, অভিমানের নয় চিএা। অনেক সময় পড়ে আছে জেদ দেখানোর। ভনিতা না করে দয়া করে আমাকে বল তোদের বাড়িতে পুলিশ এসেছিলো কেনো? কি কারণে?”

কান্নার পরিমান দ্বিগুন বাড়িয়ে চিএা আধো কন্ঠে বলল,,

“নাচের একাডেমীতে একটা মেয়ে সুইসাইড করেছে আরাধ্য। কেনো জানি না, মেয়েটা সুইসাইড নোটে আমার নাম লিখে গেছে। এজন্য পুলিশ এসেছিলো আমাকে জিগ্যাসাবাদ করতে।”

আমি উদগ্রীব হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে বললাম,,

“তুই কি সত্যিই এই সুইসাইডের বিষয়ে কিছু জানিস চিএা?”

শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে চিএা আমাকে জোরালো এক ধাক্কা মেরে অস্থির কন্ঠে বলল,,

“আআআমি কিছু জানি না। কিকিকিছু না। প্লিজ আমাকে মাফ কর। তুই অন্তত আমাকে জেরা করিস না। একা ছেড়ে দে আমায় প্লিজ।”

মুখ চেঁপে কেঁদে চিএা ভৌঁ দৌঁড়ে আমাকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে ঘর বন্দী করে নিলো। চিএার চোখে, মুখে প্রখর আতঙ্কের পাশাপাশি আমি না বলা অনেক অস্থিরতা, দ্বিধা দ্বন্ধ দেখতে পারছি। চিএা নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু গোপন করছে। যা আমার তৎক্ষনাৎ জানতে হবে। অতি দ্রুত জানতে হবে। আগ পাছ না ভেবে আমি ও চিএার পিছুপিছু ছুটলাম। চিএার রুমের বদ্ধ দরজাটায় জোরালো ভাবে টোকা মেরে আমি উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বললাম,,

“চিএা দরজাটা খোল। প্লিজ আমাকে খুলে বল কি হয়েছে। মুখ খুলে কিছু না বললে তো আমরা কেউই কিছু বুঝতে পারব না তাই না?সমস্যা টা ও সমাধান করতে পারব না।”

চিএা জোরে চিল্লিয়ে বলল,,

“আমি কিছু করি নি আরাধ্য, বিশ্বাস কর। মৃনালী আমাকে খামোখা ফাঁসিয়ে গেছে।”

নিজেকে শান্ত করে আমি কোমল কন্ঠে বললাম,,

“ওকে ফাইন। আমি বুঝতে পেরেছি। তুই কিছু জানিস না। এখন দয়া করে দরজাটা খোল। আমি তোর সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই। প্লিজ আমার রিকুয়েস্টটা রাখ।”

কাকু হম্বিতম্বি হয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে আমাকে বললেন,,

“মেয়েটাকে বুঝাও বাবা। কিছুতেই কিছু বলতে চাইছে না মেয়েটা। দারুন ভয় পেয়ে আছে মেয়েটা। খবরটা শোনার পর থেকে শুধু কাঁদছে। আপন মনে বিড়বিড়িয়ে কি যেনো বলছে। পুলিশ নানা ধরনের জেরা করে গেছে মেয়েটাকে। কোনোভাবে কোনো কথাই বের করতে পারে নি মুখ থেকে। বার বার বলছে, আমি কিছু জানি না, আমি কিছু জানি না। কাল সকাল সকাল আবার চিএাকে নিয়ে একবার পুলিশ স্টেশান যেতে হবে। পুলিশদের জেরা এখনো শেষ হয় নি হয়তো!”

শান্ত কন্ঠে আমি কাকুকে বললাম,,

“আপনি ব্যস্ত হবেন না কাকু। আমি চিএাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সব বলছি। চিএা যা জানে নিশ্চয়ই আমাকে সব বলবে। এই দায়িত্বটা আমার উপর ছেড়ে দিন প্লিজ।”

কাকু সরল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। পুনরায় আমি অধিক ধৈর্য্য সমেত দরজায় টোকা মারতে আরম্ভ করলাম। চিএা এক রোঁখা ভাব নিয়ে এখনো নিজের কথাতেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অতিষ্ট হয়ে আমি কর্কশ কন্ঠ বললাম,,

“চিএা আমি কিন্তু এবার দরজা ভাঙ্গতে বাধ্য হবো। ভালোয় ভালোয় দরজাটা খুলে দে বলছি। হাত জোর করছি, আমাকে রাগাস না প্লিজ!”

মিনিট পাঁচেক পর চিএা দরজার খিলটা খুলে দিলো। ফুঁফিয়ে কেঁদে চিএা রনচন্ডী ভাব নিয়ে অনবরত আমার গালে চড়, থাপ্পড় মেরে বলল,,

“যখন তোর দরকার ছিলো, তখন তো তোকে পাশে পাই নি। এখন কেনো এসেছিস বল? আমাকে শান্তনা দিতে? আমি কতোটা অসহায় বুঝাতে? আমি যা করি নি, জোর করে আমার মুখ থেকে তা আদায় করতে? আমাকে দোষী প্রমাণ করতে?”

চিএাকে থামতে বলছি না আমি মোটে ও। যতো পারুক আমাকে মারধর করে নিজের জেদটা অন্তত শান্ত করুক। ভেতর থেকে রাগ, জেদ নির্মুল হলে তবেই সে স্বস্তিবোধ থেকে সমস্ত কাহিনী আমাকে খুলে বলবে। কোনো রূপ জড়তা তার মধ্যে কাজ করবে না। চড়ের ব্যাথায় আমি যতোটা না কোঁকাচ্ছি, তার’চে অধিক কোঁচাচ্ছে চিএা। হয়তো হাত ব্যাথা করছে নয়তো নরম হাত জ্বালা ধরেছে তুমুলে। প্রায় ২০ থেকে ২৫ টা চড় মারার পর চিএার জেদ বোধ হয় সামান্য ক্ষান্ত হলো। হাঁফিয়ে উঠে চিএা হেচকি তুলে কেঁদে ম্লান কন্ঠে বলল,,

“তুই ঐ দিন কথা রাখিস নি আরাধ্য। একবারের জন্য ও আমার সাথে দেখা করতে আসিস নি। না খেয়ে কতো অপেক্ষা করছিলাম তোর জন্য জানিস? পরের দিন সকালে জানতে পারলাম, তুই কাশিয়ানী ফিরে গেছিস। তুই খুব শক্ত মনের জানতাম, তবে তুই যে প্রতারক ও তা ঐদিন জানতে পারলাম।”

গাল দুটো অসম্ভবভাবে জ্বলছে আমার। তবু ও যেনো চোখের কোণে জল জমছে না। গলাটা ও ধরে আসছে না। মিহি কন্ঠে আমি চিএার মুখটা উপরে তুলে দু হাতে ধরে চিএার রাগী চোখে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“কথা ঘুড়ানোর চেষ্টা করছিস তুই তাই না? আমাকে এড়িয়ে যাওয়াটা কি এতোই সহজ?”

চিএা ভড়কে উঠে কম্পিত কন্ঠে বলল,,

“কেকে কথা ঘুড়াচ্ছে? আআআমি কোনো কথা ঘুড়াচ্ছি না!”

“তোর চোখ বলছে, তোর কন্ঠ বলছে তুই কথা ঘুড়ানোর চেষ্টা করছিস। বল তুই কি লুকানোর চেষ্টা করছিস?”

চিএা দ্বিগুন চেঁচিয়ে বলল,,

“আমি কিছু লুকানোর চেষ্টা করছি না। বললাম তো! কেনো জোর করছিস আমাকে?”

“আমি তোকে শান্ত কন্ঠে কথা বলতে বলেছি। তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো? আচমকা এতো রেগে যাচ্ছিস কেনো? তুই যদি কিছুই না জেনে থাকিস তবে তো তোর খুব শান্ত থাকার কথা। কিন্তু না তুই তো উগ্র হয়ে উঠছিস!”

চিএা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“সন্দেহ করছিস তুই আমাকে?”

“প্রশ্ন এটা না। প্রশ্ন হলো তুই কেনো এতো উত্তেজিত হচ্ছিস? আমাকে সোজা ভাষায় বুঝিয়ে বললেই তো আমি সব বুঝি!”

চিএা চোখ বুজে টলটলিয়ে চোখের জল ছেড়ে বলল,,

“বিশ্বাস কর আরাধ্য, আমি কিছু জানি না। মৃনালী কেনো সুইসাইড নোটে আমার নাম লিখে গেছে তা ও আমি কিছু জানি না।”

চিএার মুখ থেকে হাত দুটো ছাড়িয়ে আমি চিএার গাল বেয়ে পড়া জলরাশি গুলো খুব যত্নের সহিত মুছে চিএার ছলছল চোখে জিগ্যাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,

“মেয়েটা নিশ্চয়ই তোর খুব কাছের বন্ধু ছিলো?”

চিএা অস্থির কন্ঠে বলল,,

“না। আমাদের মধ্যে শুধু হায়, হ্যালো অব্দি সম্পর্ক ছিলো।”

“তার মানে মেয়েটাকে তুই ঠিকভাবে চিনিস ও না?”

“না।”

“হয়তো মেয়েটা তোকে খুব ভালোভাবে চিনে। এ ও তো হতে পারে তাই না?”

“হয়তো!”

“মেয়েটার বাড়ি কোথায়?”

“জানি না।”

“অদ্ভুত! মেয়েটার বাড়ি কোথায় তা ও জানিস না?”

“না। মেয়েটা হলে থাকত। গোপালগঞ্জের কোনো একটা ভার্সিটিতে পড়ত।”

“পরিবার সম্পর্কিত কোনো প্রবলেমের কথা মেয়েটা কখনো তোকে শেয়ার করেছে?”

“না। বললাম তো, মেয়েটার সাথে শুধু আমার হায়, হ্যাঁলো অব্দি সম্পর্ক।”

“ওকে ফাইন। এবার বল, মেয়েটার সাথে তোর লাস্ট কবে দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে?”

“৪/৫ দিন আগে।”

“মেয়েটা তো আজই সুইসাইড করেছে তাই না?”

“হুহুহুম।”

“কখন সুইসাইড করেছে?”

চিএা কম্পিত কন্ঠে বলল,,

“পুপুপুলিশ বলল বিকেল ৫ টায়। হহহল রুমেই গলায় ফাঁস দিয়েছে।”

“মেয়েটার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলো? মানে কখনো শেয়ার করেছে? বা কখনো কোনো ছেলের সাথে মেয়েটাকে দেখেছিস?”

চিএা আমার সম্মুখ থেকে সরে এসে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,,

“তুই কি আমাকে গোয়েন্দা ভেবেছিস? যে মেয়েটার পেছনে সারাক্ষণ আমি গোয়ান্দাগিরি করব?”

জিগ্যাসু দৃষ্টিতে আমি চিএার সম্মুখিন হয়ে বললাম,,

“যদি মেয়েটার সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নাই থেকে থাকে তবে মেয়েটা অযথা কেনো তোকে ফাঁসালো বল? কি মোটিভ থাকতে পারে? তুই নিজের অজান্তে কখনো, মেয়েটার কোনো ক্ষতি করিস নি তো চিএা?”

চিএা উন্মাদের মতো চুলের মুঠি চেঁপে ধরে দাঁতে দাঁত চেঁপে প্রখর চিৎকার করে বলল,,

“আমি কিছু জানি না আরাধ্য, কিছু না। আমাকে উদ্দেশ্য প্রবণ ভাবে ফাঁসানো হচ্ছে। জানি না, আমি কার ক্ষতি করেছি। কেনো ঈশ্বর আমাকে অযথা শাস্তি দিচ্ছেন!”

তন্মধ্যেই কাকু বড় বড় শ্বাস ফেলে বাটন ফোনটা হাতে নিয়ে চিএার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,,

“মেয়েটাকে গন ধর্ষণ করা হয়েছিলো চিএা। তুই যদি সত্যিই কিছু জেনে থাকিস দয়া করে আমাদের সব খুলে বল৷ মেয়েটাকে ন্যায় দেওয়ার চেষ্টা কর!”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here