#অপ্সরী-১
-মিম
বাড়ির ছাদে ফুল ভলিউমে হিন্দি গান বাজছে৷ গানের তালে টুকটাক কাজের ফাঁকে কোমড় দুলিয়ে যাচ্ছে মাইশা। আজ তার ছোটবেলার বান্ধবী নিপার গায়ে হলুদ। সম্পর্কের নাম বান্ধবী অথচ মায়ার অনুভূতুগুলো যেন ঠিক আপন বোনের মতই৷ ছোটবেলা থেকেই মাইশার সমস্ত হাসি কান্নার অনুভূতিগুলো জমা রাখার সিন্দুকটা হলো নিপা। প্রিয় মানুষটা পরের বাড়ি চলে যাবে। আগের মতন যখন তখন ফোন করা হবে না, যখন তখন বাসায় এসে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যাবে না। এসব ভাবতেই বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসছে মাইশার৷ তবুও হাসিমুখে হৈ চৈ করে বেড়াচ্ছে। পাশাপাশি বাসা হওয়া সত্ত্বেও তিনদিন আগেই ব্যাগ গুছিয়ে নিপার বাসায় চলে এসেছে বিয়ের আগের শেষ দিনগুলো দুজনে একসঙ্গে কাটাবে বলে। খানিক বাদেই ছেলেপক্ষ আসবে নিপাকে হলুদ লাগাতে। নিপার বাবা এসে বলে গেলো বরপক্ষ খুব কাছেই আছে। এই বাড়ি পৌঁছে যাবে যখন তখন৷ বরপক্ষকে বরণ করার ডালাগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা সেদিকটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে মাইশা। হঠাৎ পিঠের উপর কেউ একজন এসে সজোর চড় বসিয়ে দিলো৷ এই চড় মারা হাতটা মাইশার বহুবছরের পরিচিত। ছোট থেকে এই হাতের চড় খেয়েই বড় হয়েছে তাই চোখবন্ধ থাকা অবস্থায় চড় খেলেও মাইশা ফটফট বলতে পারে এই চড়টা তার মায়ের হাতের। চেহারায় তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো সে। ভ্রু কুঁচকে মুন্নি বেগম তাকিয়ে আছেন তার মেয়ের দিকে। হাত উল্টিয়ে পিঠ ডলে নিচ্ছে মাইশা। বিরক্ত ভরা কন্ঠে মাকে বললো,
– এসব কিন্তু ঠিক না আম্মু! যখন তখন চড় কেন দাও? বড় হয়েছি না আমি! আমার একটা প্রেস্টিজ আছে তো নাকি!
– তর প্রেস্টিজ আছে, আমার নাই? ইজ্জত মারা কাজ কারবার ক্যান করোস?
– আমি কি করলাম?
– ফকিন্নির মতন ঘুরতাছোস ক্যান? সাজোস নাই ক্যান?
– কে বললো সাজিনি! সাজলাম তো! জামদানী তো পড়লাম। গায়ে হলুদে কি কাতান পড়ে ঘুরবো?
– আমি তোরে সাজের কথা বলছি। সাজ, সাজ! কাজল আর টিপ পইড়া চইলা আসছোস। ঠোঁটে একটু লিপস্টিক লাগাস নাই। চোখের আইশ্যাডো কই তোর? আইলাইনারও তো দেস নাই। কানে ছোট জিনিস আর গলায় কি পাতলা একটা হার! তোরে আমি কোনোকিছু অভাব রাখছি? ফকিন্নির মতন ঘুরঘুর করোস, মানুষ বলবো আমি তোরে কিছু কিনে দেই না।
– লিপস্টিক দেইনি কে বললো? ন্যুড কালার দিয়েছি এজন্য বোধ হয় বুঝতে পারছো না।
– রাখ তোর ন্যুড ফ্যুড। লিপস্টিক হইতে হবে লাল, খয়েরী, টকটকা গোলাপী। এইগুলা হইলো গিয়া সুন্দর কালার। ক্ষ্যাত লাগতাছে তোরে। যা, নিচে যা। খয়েরী রঙের লিপস্টিক লাগায়া আয়৷
মায়ের তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি মাইশা বেশ দ্বিধায় পড়ে গেল। এতখানি সাধ করে কেনা লিপস্টিকটা আজকেই সবে লাগালো, অথচ মা কি না এভাবে মুখের উপর বলে গেলো এই লিপস্টিক মুছে গাঢ় কিছু লাগাতে! খয়েরী লিপস্টিকে নিজেকে একবার কল্পনা করতেই চোখ ঝলসে আসছে মাইশার। কল্পনায় নিজেকে কি বিদঘুটে লাগছে! মায়ের দিকে অসহায় চোখে একবার তাকালো সে৷ মা কে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে,
– কেন আম্মু, কেন? কি আছে এই খয়েরী রঙে? এত কেন ভালোবাসো খয়েরীকে?
মায়ের কুঁচকে থাকা ভ্রু জোড়া দেখে মনের জানালায় উঁকি দেয়া প্রশ্নগুলো আবারও মনের ঘরে লুকিয়ে যায়। মা কে আর জিজ্ঞেস করা হয় না৷ মায়ের একান্ত বাধ্যগত লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে মাথা নিচু করে বাসার উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই বাধ সাধলো তার বান্ধবী হিমু। হাত চেপে ধরে বললো,
– জলদি আঙুরের প্লেটটা ধর। বরপক্ষ উপরে আসছে। বরণ করতে হবে৷
হাফ ছেড়ে বাঁচলো মাইশা। হিমুর হাত থেকে প্লেট নিয়ে দ্রুত পায়ে চললো সিঁড়ির দিকটাতে। নিজের চুলের খোপায় জড়ানো গাদা ফুলের মালাটা ঠিক করতে করতে মুন্নি বেগম বিড়বিড় করে বললেন,
– বয়স হইলো বিশ, ভান ধরে চল্লিশ। আমার মতন ফুরফুরা মনের মানুষটার ঘরে এমন দাদী আম্মা কেমনে জন্ম নেয় সেটাই আশ্চর্যের!
ছাদের গেইটের পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিপার বান্ধবী আর কাজিনরা৷ কেউ ফুল ছিটাচ্ছে তো কেউ মিষ্টি ফল আচার বিলি করছে৷ টুথপিকে গেঁথে রাখা কালো আঙুরগুলো বন্টনের দায়িত্ব মাইশার কাঁধে। হাসিমুখে সবার হাতে একপিস আঙুর ধরিয়ে দিচ্ছে সে৷ গায়ে হলুদের ডালা হাতে বরপক্ষের কোনো এক যুবক এসে দাঁড়ালো মাইশার মুখোমুখি। অন্য সবার মতো মাইশা তার দিকে আঙুর বাড়িয়ে দিতেই যুবক খানিকটা এগিয়ে এসে হা করে দাঁড়িয়ে রইলো। গোলাকৃতির সেই হা মাইশাকে জানান দিচ্ছে,
– অনুগ্রহপূর্বক নিজ হাতে আঙুরখানা আমার মুখের ভেতর পুরে দিন।
মাইশার হাসিমাখা মুখটাতে আর হাসি নেই। খানিকটা অবাক হয়ে বোকা বোকা ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো যুবকের দিকে৷ ক্ষীণস্বরে বললো,
– আমি কাউকে খাইয়ে দিতে পারবো না। অন্য সবার মতো এটা আপনাকে হাতে নিতে হবে।
– কিভাবে নিবো বলুন তো? আমার হাত দুটো তো ডালা ধরে রাখতে খুব ব্যস্ত।
– ডালা টা তো আপনি এক হাতেও নিতে পারেন। এটা তো আর আহামরি ভারী জিনিস না যে আপনি এক হাতে ধরতে পারবেন না।
– আমি বড্ড দুর্বল। গায়ে এতো জোর নেই। তাই দুই হাতে ধরে রেখেছি।
যুবকের দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলো মাইশা। মানুষটা হাসছে। তার সমস্ত চেহারা জুড়েই হাসি খেলা করছে। অদ্ভুত হাসি, দুষ্টুমির হাসি। চোখজোড়া যেন কি এক ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে ! অথচ সেই ইঙ্গিতের অর্থ বুঝা যাচ্ছে না। তড়িঘড়ি করে কৌতুহলী মনের লাগাম টেনে ধরলো মাইশা। গম্ভীর হয়ে বললো,
– সোজাসাপটা বলে দিলেই তো হয় আপনি আমার হাতে খেতে চাচ্ছেন।
– বুঝেই যেহেতু ফেলেছেন তাহলে কথা বাড়াচ্ছেন কেন? খাইয়ে দিলেই তো পারেন।
– খু ঢং তাই না? খাওয়াবো না আমি৷ যান, সামনে যান। আপনার পেছনে আরো লোক দাঁড়িয়ে আছে৷
– ঢং আমি কোথায় করলাম? ঢং তো আপনি করছেন। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি একটা আঙুর খাওয়ার জন্য অথচ আপনি কথা পেঁচিয়েই যাচ্ছেন।
মাইশা উত্তরে কিছু বলার আগেই যুবকের হাত জড়িয়ে ধরলো নিপার হবু ননাশ। খিলখিল শব্দে হাসতে হাসতে মাইশার প্লেট থেকে আঙুর ঢুকিয়ে দিলো মাইশার মুখে। বললো,
– আরে মাইশা, এটা আমাদের ফুফাতো ভাই হাসিব। সম্পর্কে তো তোমার বেয়াই হয়। বিয়ে তে বেয়াই বেয়াইনদের মধ্যে একটু আধটু দুষ্টুমি না হলে কি চলে নাকি? একটা আঙুরই তো তোমার হাতে খেতে চাচ্ছে বেচারা। দাও, খাইয়ে দাও।
হাসিবের দিকে আঙুর বাড়িয়ে দিতেই স্টেজের দিকে হাঁটা ধরলো সে। যেতে যেতে বলে গেলো,
– আমি এত রিকুয়েষ্ট করে কারো কাছ থেকে কিছু খাইনা। তোমার আঙুর তুমিই খাও।
আঙুর হাতে হাসিবের চলে যাওয়া দেখছে মাইশা। নাক কুঁচকে ভাবছে লোকটা এত অদ্ভুত কেন?
কুসুম রঙা শাড়ী গায়ে জড়িয়ে ফুলের গয়না পড়ে স্টেজে বসে আছে নিপা। দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা জীবন্ত পুতুল! একে একে সবাই এসে হলুদ লাগিয়ে যাচ্ছে নিপাকে। শামিয়ানার শেষের সাড়িতে মাইশা আর তার বান্ধবীরা বসে গল্প করছে, ফাঁকে ফাঁকে ছবি তুলছে। গল্পের এক ফাঁকে মাইশার পাশের চেয়ারটাতে টুপ করে বসে পড়লো হাসিব। তার হাতে মিনি সাইজ দুই বোতল কোকাকোলা। এক বোতল মাইশার দিকে এগিয়ে হাসিব বললো,
– দেখো, তোমাকে আপনি-টাপনি বলতে পারব না। তুমি করেই বলি কেমন? নাও, কোক খাও।
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মাইশা। পাশে বসা বান্ধবীদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। ওপাশ থেকে তাড়া দিলো হাসিব। বললো,
– কি হলো! নাও, বোতলটা ধরো।
– আমি কোক খাইনা৷
– মিথ্যুক! তুমি ভাতের মত কোক গিলতে থাকো সেই খবর আমি জানি। ভাঁওতাবাজি না করে কোকটা ধরো।
– আমি এখন খাবো না৷ আপনি রেখে দিন এটা।
– ম্যানারলেস! কেউ কিছু দিলে ফিরিয়ে দিতে হয়না। মুচকি হেসে সেটা নিয়ে থ্যাংকস জানাতে হয়৷ বাসা থেকে এতটুকু ভদ্রতা শিখায়নি তোমাকে?
মাইশা হতভম্ব হয়ে পড়লো। এভাবে কেন কথা বলছে? আশপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। কিছু গেস্ট আর বান্ধবীরা মাইশার দিকেই তাকিয়ে আছে। সবার সামনে অপরিচিত কেউ এসে এভাবে কখনো কথা শোনায়নি৷ কে এই লোক? পারিবারিক শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে কথা কেন শোনাবে? রাগে লজ্জায় কান্না পাচ্ছে মাইশার। চোখে পানি ছলছল করছে তার। বোতল থেকে এক চুমুক কোক খেয়ে মুখ বাকিয়ে হাসিব বললো,
– এ্যা মা, তুমি তো দেখছি ছিঁচকাঁদুনে! তেমন কিছুই তো বললাম না আর তুমি কি না কান্না জুড়ে দিলে! তোমার হবু বরের তো কপাল মন্দ। তোমার সঙ্গে একটু খায়েশ মিটিয়ে ঝগড়াও করতে পারবে না, কিছু বললেই ভ্যা ভ্যা করে কান্না করবে।
ভীষণ রাগ চেপে গেলে কথা বলতে কষ্ট হয় মাইশার৷ গলার মাঝে এসে সব কথা আটকে যায়। রাগ নেমে আসা অব্দি অনবরত নাক টেনে কাঁদতেই থাকে। আজও হাসিবকে কিছুই বলতে পারছে না সে৷ কান্নার বাঁধ ভেঙে যাবে যখন তখন। চোখের সীমানা পেরিয়ে দু গাল বেয়ে বইতে থাকবে গঙ্গা যমুনার পানি। হ্যাঁ, মা তো এভাবেই খোঁটা দেয়। তাকে কাঁদতে দেখলেই বলতে থাকে,
– ঐ যে ছুটছে, গঙ্গা যমুনার পানি ছুটছে দুই চোখ দিয়া।
অজান্তে মায়ের সেই খোঁটা মনে পড়তেই অশ্রুবাঁধ ভেঙেই গেলো৷ নিজেকে সংবরন করতে না পেরে কঠিন লজ্জার মুখোমুখি হয়ে পড়লো সে। আশপাশে বসা পরিচিত অপরিচিত সবাই তাকিয়ে দেখছে তাকে৷ চোখের সামনে নিজের মান সম্মানকে ধুলোয় মিশতে দেখে বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে মাইশার। কয়েক মিনিট বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে হাউমাউ করে কাঁদা জরুরী নয়তো বুকে ব্যাথা হয়ে মৃত্যু হবে যেকোনো সময়! একমুহূর্ত এখানে আর বসে থাকা চলবে না৷ এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে। চেয়ার ছেড়ে তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে পালাতে গিয়ে পায়ের সঙ্গে শাড়ীর কুঁচি পেচিয়ে উপুর হয়ে পড়তে যাচ্ছিলো তখনি হাসিবের হাতজোড়া সামলে নিলো মাইশাকে। শব্দ করে হেসে উঠলো হাসিব। বললো,
– ঠিকমত দৌঁড়াতেও পারো না দেখছি! উষ্ঠা খেয়ে পড়ার রোগ আছে তোমার।
ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদতে শুরু করলো মাইশা৷ হাসিবের দিকে একবার করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে শাড়ীর কুঁচি সামলে দৌঁড় দিলো সিঁড়ির দিকে। চোখজোড়া যেন হাসিবকে নিঃশব্দে বলে গেলো,
– আপনি কি নিষ্ঠুর!
চেয়ারে বসে আয়েশ করে ঠান্ডা কোকের বোতলে চুমুক দিচ্ছে হাসিব। ওপাশে ঘাড় ফেরাতেই দেখতে পেলো মাইশার বান্ধবীরা বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভ্রু নাচিয়ে হাসিব জিজ্ঞেস করলো,
– কি রমণীরা? খেয়ে ফেলবা নাকি আমাকে?
(চলবে)