#অপ্সরী-২
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাইশা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদা মাইশার পুরোনো অভ্যেস। কাঁদতে কাঁদতে চোখ নাক কতটুকু ফুলে উঠলো সেটা দেখতেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদা। অজানা কারণে টুকটুকে লাল হয়ে ফুলে উঠা চোখ নাক দেখতে মাইশার ভীষণ ভালো লাগে। নিজেকে খুব আদুরে লাগে দেখতে৷ তাইতো বাবা তাকে কাঁদতে দেখলে খুব আহ্লাদ করে৷ দুই চার লিটার কোকাকোলা কিনে তার বিছানায় সাজিয়ে রাখে। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– যতক্ষণ না মন ভালো হচ্ছে ততক্ষণ কোক খেতে থাক। বাবা আছিতো, শেষ হয়ে গেলে আবার কিনে আনবো৷
এসব ভাবতেই হঠাৎ মনে পড়লো বাবা কোথায়? তার কোকাকোলার বোতল কোথায়? এক্ষুনি একটাবার ফ্রিজ চেক করা জরুরী। গাল মুছে তখনি তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো মাইশা। ডাইনিং রুমে আসতেই ড্রইংরুম থেকে কথার আওয়াজ শুনতে পেলো সে। কে কথা বলছে? বাসায় তো কেউ নেই। হলুদের অনুষ্ঠান ফেলে কেউ বাসায় আসারও কথা না৷ তবে কে এলো? চোর? টেবিলের উপর থেকে কাঁচের প্লেট নিয়ে ড্রইংরুমের দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো সে। পর্দার আড়াল থেকে ঘরের দিকে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো মা বাবার সঙ্গে বসে দুজন মহিলা গল্প করছে। দেখে মনে হচ্ছে মা-মেয়ে। মুখজোড়া চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছে এই দুজনকে? আর মা বাবা কেন অনুষ্ঠান রেখে এখানে চলে এসেছে তাদের দুজনের সঙ্গে গল্প করতে?
– চোরের মতন দাঁড়িয়ে আছো কেন?
চমকে গেলো মাইশা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো হাসিব পিছনে দাঁড়িয়ে৷ চেহারা কুঁচকে এলো মাইশার। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
– আপনি আমার বাসায় কেন এসেছেন?
– ওহ এটা তোমার বাসা! বাসা ভাড়া তুমি দাও?
– না, আমার বাবা দেয়।
– তাহলে তোমার বাসা কিভাবে হলো? এটা আংকেলের বাসা।
– বাবার সবকিছু আমার।
ভেতর থেকে মুন্নি বেগম ধমকে বললেন,
– মাইশা, ঝগড়া করে না৷ ভেতরে আসো, আন্টি আর আপুর সঙ্গে পরিচিত হও।
গুটি গুটি পায়ে ড্রইংরুমের দরজার এককোনায় দাঁড়ালো মাইশা৷ পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে বড় বোনের পাশে হাসিব বসে পড়লো৷ মাইশার বাবা হাফিজুর রহমান মেয়েকে ইশারায় তার পাশে এসে বসার জন্য ডাকলেন৷ প্লেট হাতে বাবার গা ঘেষে পাশে এসে বসলো সে। মুন্নি বেগম বললেন,
– উনি হাসিবের মা আর ও হাসিবের বড় বোন তমা।
ঠোঁটের কোণে মিথ্যে হাসির রেখা টেনে মাইশা জিজ্ঞেস করলো,
– ভালো আছেন আন্টি? ভালো আছেন আপু?
আহ্লাদী স্বরে হাসিবের মা বললো,
– হ্যাঁ ভালো। বাবা, তুমি এতক্ষণ কাঁদছিলে? হাসিব উল্টাপাল্টা বলেছে তাই না?
এতক্ষণে তাদের দুজনের এই বাসায় আসার উদ্দেশ্য স্পষ্ট হলো মাইশার কাছে। তারা নিশ্চয়ই তাদের ছেলের অপকর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে এই বাসায় এসেছে মাইশাকে আদর করে কিছু সান্ত্বনা বাণী শোনাতে৷ সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ লুফে নিলো মাইশা৷ গা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসলো৷ এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগলো,
– আন্টি জানেন, আমাকে উনি ম্যানারলেস বলেছে। সবার সামনে বলেছে। আমি উনার কাছ থেকে কোক খাইনি তাই সবার সামনে আমাকে অপমান করলো! এভাবে অপমান করলে আমার কান্না পাবে না বলুন? কাঁদবো না আমি? এজন্য আমাকে ছিচকাঁদুনে বলেছে। আবার বলে আমার ভবিষৎ হাজবেন্ড নাকি আমাকে বিয়ে করে শান্তি পাবে না৷ এভাবে কেউ কাউকে অপমান করে আপনিই বলুন? আমি উনার ছোট বোনের মত। উনার কি উচিত হয়েছে উনার ছোট বোনের সঙ্গে সবার সামনে এমন খারাপ আচরণ করা?
মাথা নিচু করে বসে রইলো হাসিব। হঠাৎ শব্দ করে তমা হেসে উঠলো। হাসিবের পিঠে চাপড়ে বললো,
– ছিঃ হাসিব! এভাবে অপমান করা ঠিক হয়নি। ছোট বোনকে এক্ষুনি সরি বল।
– আমার ছেলেটা খুব পাজি৷ এই কাজটা একদমই ভালো করেনি৷ তুমি তো খুব লক্ষ্মী মেয়ে। এত লক্ষ্মী মেয়েকে কি কেউ এভাবে কাঁদায়! বাসায় ফিরেই আমি ওর বিচার করব। ঠিকাছে?
আবেগে ঠোঁট উল্টে আবারও কান্না পাচ্ছে মাইশার৷ লোকটার মা কি ভালো! সেচ্ছায় নিজের ছেলের অপকর্ম শুনে গেলো আবার বিচারের আশ্বাসও দিয়ে গেলো! কি আহ্লাদ করে কথা বলে মানুষটা! ইচ্ছে হচ্ছে ঐপাশের সোফাটায় গিয়ে মানুষটার গা ঘেষে বসে থাকতে৷
হাফিজ সাহেব মেয়ের কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,
– মেহমানদের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আয়।
সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো মাইশা। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবছে, ভদ্রমহিলাকে এককাপ চমৎকার চা অবশ্যই খাওয়াতে হবে। চায়ে আজ এলাচি আর এক্সট্রা পাউডার মিল্ক যোগ করবে। চায়ের উপর বাদাম গুঁড়া ছিটিয়ে পরিবেশনও করবে। ধন্যবাদ হিসেবে এতটুকু তার পাওনা।
– আমার মেয়ে তো এখনো ছোট। দেখলেনই তো আপনি, আহামরী জ্ঞান-বুদ্ধি এখনো হয়নি৷ হাসিব কি বললো না বললো, সে কান্নাকাটি করে চোখ মুখে ফুলিয়ে ফেলেছে। ছোটদের মত আপনার কাছে বিচারও দিলো। আমার এই মেয়ে কিভাবে সংসার করবে বলুন?
স্বামীর হাতে গোপনে চিমটি কাটলেন মুন্নি বেগম৷ তার কথাবার্তায় মাথায় আগুন চড়ে যাচ্ছে৷ এত ভালো প্রস্তাব কেউ এভাবে না করে দেয় নাকি?
আড়চোখে হাফিজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলো হাসিব। লোকটার চেহারা দেখে শুরুতেই বুঝে গিয়েছিলো এই লোক বিয়েতে রাজি না৷ এখন তো স্পষ্ট না করেই দিচ্ছে৷ এই লোকটা কি জানে তার মেয়েকে মন দেওয়ার পর থেকে রাতে ঠিকঠাকমত এই অসহায় ছেলেটা ঘুমাতে পারছে না? কি চায় এই লোকটা? না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে পাগল হয়ে যাক?
ভাইয়ের দিকে তাকালো তমা। ছেলেটার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে লোকটার আপত্তি শুনে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ভাইকে ভীষণ যত্নে সে আর মা আগলে রেখে বড় করেছে। কোনো অপূর্ণতা রাখেনি জীবনে৷ মাইশাকে দেখার পর থেকে সর্বক্ষণ হাসিব অস্থিরতায় ভুগছে তা চোখ এড়ায়নি তমার। আজ এসে হাত ধরে আবদার ধরলো,
– আপু এই পরীটা আমার চাই, খুব জলদি চাই। আজই বিয়ের একটা বন্দোবস্ত কর নয়তো আমাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দে।
তাই আজ মা কে নিয়ে কথা বলতে চলে এলো মাইশাদের বাসায়। মেয়ের মায়ের হাবভাবে বুঝা যাচ্ছে উনি রাজি, কিন্তু বাবা তো জানিয়েই দিলো এই ছোত মেয়েকে বিয়ে দিতে নারাজ। লোকটা অসম্মতি জানালে চলবে না। তাকে রাজি করাতেই হবে৷ নড়েচড়ে বসলো তমা। একগাল হেসে বললো,
– কি নিয়ে এত ভাবছেন আংকেল? ওর মাঝে খানিকটা বাচ্চামি ভাব আছে সেটা জেনেই আমরা বিয়ে করাতে চাচ্ছি।
– আমার মেয়ে সংসার করতে পারবে না মা। এতবড় এখনো সে হয়নি।
সোফা ছেড়ে উঠে মুন্নি বেগমের পাশে এসে বসলেন হাসিবের মা৷ তার হাতজোড়া মুঠো করে ধরে বললেন,
– আপা মেয়ে নিয়ে কিচ্ছু ভাববেন না। একদম নিরিবিলি সংসার আমার। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি৷ ঘরে শুধু আমার ছেলে, আমি আর কাজের লোক। কোনো দায় দায়িত্ব নেই মাইশার উপর। আমার মেয়েটাকে তো বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ি দিয়ে দিলাম। আপনার মেয়েটাকে আমি তমার জায়গায় বসাবো। সংসার করতে পারবে না বলছেন, সংসার করার দরকারও নেই। ও শুধু আমার বাসায় থাকবে, খাবে, পড়ালেখা করবে আর আমার ছেলের সঙ্গে ঘুরবে। তাকে দিয়ে তো আমি কাজ করাব না। আমি আছি, কাজের লোক আছে আমরাই সংসার দেখব। দরকার হয় তো আরো একজন লোক রাখব। আমার ছেলেটা খুবই ভালো৷ একটু দুষ্ট কিন্ত আপনার মেয়েকে খুব আদরে রাখবে। প্লিজ আপনারা আপত্তি করবেন না। খোঁজ খবর যা নিতে চান, নিন। খোঁজ নেয়ার পর আপনাদের অপছন্দ হবে না এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি।
হাফিজ সাহেব মাথা চুলকাচ্ছে। মুন্নি বেগম কড়া চোখে তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে। ফোনে কথা বলার বাহানায় রুম থেকে বেরিয়ে এলো হাসিব। দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে পেলো মাইশা চুলার পাশে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইছে আর কোমড় দুলিয়ে যাচ্ছে। হেঁচকা টানে মাইশাকে দেয়ালে ঠেকিয়ে মুখ চেপে ধরলো হাসিব৷ মাইশার ডান কান মুচড়ে ধরে বললো,
– তুমি আমার ছোট বোনের মতন তাই না? আমার ছোট বোন হওয়ার খুব শখ ? থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেয়া উচিত। জ্ঞান বুদ্ধি কিচ্ছু নেই। মানুষের চোখ দেখলেও বুঝে না কে তাকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখছে! বউ হও তুমি আমার, বউ। তোমাকে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখি আমি। আর যদি কখনো এই কথা শুনেছি তো কান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো বেয়াদব। আর তোমার বাবাকে বলবা হয় তোমাকে আমার কাছে বিয়ে দিতে নয়তো আমার ঘুম ফিরিয়ে দিতে। খবরদার একদম চিৎকার করবা না৷ করলেই একদম ঘর থেকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলবো, আজকে রাতেই করবো।
হাসিব কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলার মিথ্যেমিথ্যি নাটক করতে করতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দেয়ালে গা ঠেকিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে রইলো মাইশা৷ থরথর করে কাঁপছে সে।
(চলবে)
-মিম