#তনয়া
#পর্ব-৩
অনেক ধরনের আত্মীয় স্বজনদের দিয়ে বাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে।দুদিন পরেই হলুদ। কাজিনরা সবাই বায়না করছে এবার মেহেদী অনুষ্ঠান আলাদা ভাবে করবে।হলুদের আগের রাতে মেহেদীর আয়োজন হবে ঘটা করে।সেখানে নাচ গান হৈ-হুল্লোড় সবকিছু হবে।সকাল থেকেই সব ভাই বোনরা এ নিয়ে কুটকুট করছে।তনু অবশ্য এসবের মাঝে থাকলেও নিজে থেকে কিছু বলছে না।কারণ তার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। মিশকাত ভাই তাকে উঠতে বসতে অপমান করছে।তনুর এখন হাসি পায় মাঝে মাঝে।মিশকাত দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে চাইছে।না ঘৃণা করতে পারছে না ভালোবাসা ভুলতে পারছে।দুটোর মধ্যে জট পাকিয়ে ফেলেছে।তাই তনুর সাথে ঠিক কি করা উচিত মিশকাত সেটাই বুঝে উঠতে পারে না।
তনু সিঁড়ির দিকে আনমনা হয়ে তাকাতেই
দেখতে পেল মিশকাত ভাই নামছে।কালো টিশার্টে মিশকাতকে দারুণ লাগছে। মিশকাতের গায়ে রং ফর্সা হওয়ায় কালো রং খুব ভালো মানায়।তনু চোখ সরিয়ে নিলো।বুকের ভেতর কোথাও খুব জ্বলছে। সে নিজের দিকে তাকালো। তার পরনে বটল গ্রিন কালারের সালোয়ার কামিজ।রাতের করা বিনুনিটাও খোলা হয়নি।মাথার ওপরটায় একটু চিরুনি চালিয়ে বের হয়েছে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা।তনু নিজের ঠোঁট কামড়ে নিরবে হাসলো।সে কোনো দিক থেকেই মিশকাত ভাইয়ের জন্য নয়!শুধু মিশকাত কেন সে কি কখনো কারও যোগ্য হতে পারবে?
মিশকাত এসে তনুর থেকে একটু দূরত্ব রেখে পাশে বসলো।তনু আরও গুটিয়ে গেল।তা খেয়াল করে মিশকাতের রাগ উঠে গেল।কি ভাবে নিজেকে তনু? কোন রাজ্যের পাটরানী সে?মিশকাতের জেদ চেপে গেল।সে তনুর আরও কাছ ঘেঁষে বসলো।তনু চমকে উঠলো মিশকাতের এমন আচরণে।
“তুমি সরে বসো মিশকাত ভাই।”
“তুই সরে বস।” মিশকাত দাঁতে দাঁত চেপে উওর দিলো।
“আর তো জায়গা নেই।পরে যাব তো আমি!”
“যা পরে,পরে মরে যা তুই।”
তনু ফাঁকা ঢোক গিললো। মিশকাত এই কয়দিনেই অন্য রকম হয়ে গেছে।ভালোই তো ছিল এতদিন ধরে। কেন যে বড় আপার বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল আর কেনই বা আবার মিশকাতের সাথে দেখা হলো তার?নিজেকে সে আর কত নিয়ন্ত্রণে রাখবে?মাঝে মাঝে মন ও মস্তিষ্কের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।মনটা জিততে খুব চেষ্টা করে।তনুর মনে হয় সে হাঁপিয়ে উঠেছে।এভাবে নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা যায় না।
তনু উঠতে চাইলো কিন্তু পারলো না।তার ওরনার ওপর বসে আছে মিশকাত।তনু মহা ফ্যাসাদে পরলো।কি চাইছে মিশকাত ভাই?মানুষটা এখনো কি সেই সময় গুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।
তনু জোরে একটা শ্বাস নিলো।ধীর স্বরে বলল,
“আমার ওরনার ওপর বসেছ কেন?”
মিশকাতের কোনো ভাবান্তর হলো না।সে অন্যদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।
তনু বাধ্য হয়ে সবাইকে বলল,
“গোল টেবিল বৈঠক শেষ করো তাড়াতাড়ি সবাই।বসে বসে কথা বললে তো হবে না সব আয়োজনও তো করতে হবে।”
“শান্তা ভ্রু কুঁচকে তাকালো তনুর দিকে।বলল,
সেটা নিয়েই তো আলোচনা হচ্ছে।তুই কি কানে শুনতে পাস না?”
আরেক কাজিন মারুফ বলল,
“তোর মন কোথায় রে?এত উসখুস কেন করছিস?”
তনু পরলো মহা বিপাকে।তার ভাই বোন গুলো সব বিচ্চুরদল।
মিশকাত শুধু ভাবছে তার পাশে বসতেও তনুর এত অসুবিধা হয় তাহলে বোঝাই যায় সে শুধু শুধু নিজের সম্মান নিচে নামিয়ে ফেলে।কিন্তু সে যে তনুর চোখের ভাষা পড়তে পারে।কখনো ভুল হয়নি সে ভাষা বুঝতে।একমাত্র সেটাকেই অবলম্বন করে সে এক বুক আশা নিয়ে দিন গুনতে থাকে।
মিশকাত তার মুখটা একটু এগিয়ে এনে ফিসফিসিয়ে বলল,
তোর এতো অহংকার কেন?নিজেকে মিস ইউনিভার্স মনে করিস?
তনু অসহায় চোখে তাকালো মিশকাতের পানে।বলল,
“নিজেকে আমি কিছুই মনে করিনা। তোমার অনেক কিছুই মনে হতেই পারে সেজন্য আমার করার কিছু নেই।তুমি তোমার ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো না সেটা তোমার সমস্যা।আমি আমার মতোই আছি।”
মিশকাত চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলো। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“কেন তুই এতো আঘাত করতে জানিস তনু।যেদিন তোর আঘাতে আমি শেষ হয়ে যাব সেদিন ঠিক বুঝবি!”
তনুর কানে এসে লাগে কথা গুলো।বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে।কান্না গুলো গলার কাছে এসে দলা পাকিয়েছে।
***
“শায়লা গহনা গুলো ব্যাংক থেকে নিয়ে এসেছ?”
“নাহ্,তুমি আনবে তো সেগুলো?”
“সেটা আগে বলবে তো?আমি কতবার বাইরে যাচ্ছি এক ফাঁকে নিয়ে আসতে পারতাম।”
“কাল যেও বড় ভাইজানকেও নিয়ে।তোমার একা যাওয়া তো ঠিক হবে না।”
“তা না হয় যাওয়া যাবে।” তা শুনলাম ছেলে মেয়ে গুলো নাকি ছাঁদে হলুদের আয়োজন করতে চাচ্ছে? ”
“হ্যাঁ, ওরা তো তাই বলল।অনেক ফুল লাগবে।লিষ্টটা আমার হাতে দিয়েছে।”
“ঠিক আছে আমায় দিও অর্ডার দিয়ে আসবো।” আমার আয়রার মায়ের জন্য কোনো কিছুর কমতি আমি রাখবো না।”
শায়লা বেগমের চোখ জোড়া ভিজে এলো।তার আদরের মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাতে মন সায় দেয়া না।তবুও সমাজের,ধর্মের নিয়ম মানতে হবে।যখন তখন মেয়েটার মুখটা দেখতে পারবেন আর এটা ভাবলেই বুকটা ফেটে যায়।আয়রার তার প্রথম সন্তান। মাতৃত্বের অনুভূতি আয়রাকে দিয়েই পেয়েছেন।খুব যত্নে,স্নেহে বড় করেছেন।এখন বিয়ে দিচ্ছেন। এর মাঝে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে! অথচ মনে হয় এই তো সেদিন কোল আলো করে এসেছে মেয়েটা।
“আরে কাঁদছ কেন আবার?আয়রা এসে দেখুক শুধু। মেয়ের জন্য তুমি তো নিজেই দেখে শুনে পাত্র ঠিক করলে তাহলে এত চিন্তা কেন করছো?”
“মানুষের ভেরতটা তো পড়তে পারা যায় না।কার মনে কি থাকে বোঝা যায় কখনো!”
“তবুও ছেলে খুব ভালো।একদম আমাদের আয়রার মতই।”
“সে জন্যই তো আমি ছেলেটাকে এত পছন্দ করেছি।মেয়েটা আমার দুনিয়ার প্যাচগোজ কিছু বোঝে না।ওর জন্য রাফাত ঠিক আছে।”
“এখন চোখ মুছে ফেলো দেখি,তোমার তো এখন সুখের সময়।বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। দুদিন পর আমার তনয়ার বিয়েও হয়ে যাবে।তনয়ার জন্যও আমি ঠিক ভালো ছেলে খুঁজে পাব।”
শায়লা বেগমের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। তনুর কথা ভাবতেই কষ্টটা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
মিশকাত যে ঘরেই যাচ্ছে সে ঘরেই কেউ না কেউ আছেই।কোনো ওয়াশরুম ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না।বিরক্ত লাগছে তার।সারা শরীর ঘেমে গেছে।এখন গোসল করতে না পারলে শান্তি পাবে না।আজ সন্ধ্যার পর মেহেন্দি অনুষ্ঠান।সকাল থেকে তাই নিয়ে ব্যস্ত।ছাঁদটাকে ওরা সবাই মিলে খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়েছে। এত কাজ করে সকলে হাপিয়ে উঠেছে। এখন গোসল সেড়ে খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে একটু বিশ্রাম করবে সবাই।এরপর বিকেলে রেডি হতে হবে।আজ সারারাত মজা করবে ওরা। নাচ গান আড্ডায় মেতে থাকবে।
তনু সদ্য গোসল সেড়ে বেরিয়েছে।মাথায় এখনো তোয়ালে পেঁচানো।তার খুব খিদে পেয়েছে তাই আগে খেতে যাবে। খেয়ে একটা ঘুম দেবে।কারন আজ রাতে যে ঘুমোনোর উপায় নেই তা বুঝে গেছে।হলুদের দিন সারারাত জাগলে বিয়ের দিন অনেকের সমস্যা হতে পারে ভেবেই আজকে এই ব্যবস্থা করা হলো।এতে মজা করাও হলো সবকিছু ঠিকঠাক থাকলো।তনু মিশকাত কে খেয়াল করে নি।সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে মিশকাতের সাথে মুখোমুখি হয়ে গেল।তনু একটু হকচকিয়ে গেল। মিশকাত সারা মুখ ঘামে চিকচিক করছে। টিশার্টের বুকের কাছের বোতাম গুলো খোলা।লোমশ বুকেও ঘামের ফোঁটার অস্তিত্ব। মিশকাত স্থির চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে জন্য সে তাড়াতাড়ি নেমে গেল।
“তনু!”
মিশকাতের আচমকা এই ডাকে থেমে যেতে হলো।নিচ থেকে ওপরে তাকিয়ে দেখলো সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে মিশকাত একি ভাবে তার দিকে আছে।
“কিছু বলবে?”
“আমায় একটু গোসল করার ব্যবস্থা করে দিবি?কোনো ওয়াশরুমে ফাঁকা পাচ্ছি না।”
তনু একটু থমকালো।এই জন্যই কি তাকে থামালো মিশকাত ভাই।সে তো অন্য কিছু ভেবেছে।একটু আগে মিশকাত ভাইয়ের চোখে সে তার প্রতি মুগ্ধতা দেখেছে।ভেবেছে কিছু হয়ত বলবে।তনু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আবার ওপরে উঠে আসলো।মিশকাত বলল,
“আমার সাথে এসো।আমার ঘরের ওয়াশরুম ফাঁকা আছে।”
মিশকাত মুচকি হেসে তনুর সাথে পা বাড়ালো। তনুকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে।মিশকাতের ইচ্ছে করছে শুধু তাকিয়ে থাকতে।বলতে ইচ্ছে করছে,তোর দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকার অনুমতি দিবি? কিন্তু পারলো না বলতে।
চলবে..