তনয়া #পর্ব-৭,৮

0
708

#তনয়া
#পর্ব-৭,৮
#সিফাতী সাদিকা সিতু
#পর্ব-৭

বিয়ে বাড়ি জমে উঠেছে।কিছুক্ষণ আগেই বরপক্ষ এসেছে।তনু, আপার পাশেই বসে আছে।আয়রা কিছুতেই তার হাত ছাড়ছে না।আয়রা যে বেশ নার্ভাস হয়ে পরছে তা বুঝতে পেরে তনু সাথেই আছে।লাল শাড়িতে সোনার গয়নায় পুরো রাজকন্যার মতো লাগছে আয়রাকে।তনুর ইচ্ছে করছে না আয়রার থেকে দৃষ্টি সরাতে।বারবার মনে মনে বলছে,ইশ,আমার আপা কি সুন্দর!
সে নিজেও সুন্দর একটা লেহেঙ্গা পরেছে। গোলাপি রঙয়ের লেহেঙ্গায় উজ্জ্বল শ্যামলা তনুকে মিষ্টি দেখাচ্ছে। তনুর মাঝে সবসময় অন্যরকম স্নিগ্ধতা বিরাজ করে।পার্লারের মেয়েদের থেকে চুল গুলো আজ সুন্দর করে খোঁপা করে নিয়েছে।খোঁপায় কাঠগোলাপের গাজরা গেঁথে দিয়েছে।অনেকদিন পর সে বেশকিছু ছবিও তুলেছে।মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেছে।আসলে সকালে মনের কথা গুলো লিখে প্রকাশ করায় নিজেকে একটু হালকা মনে হচ্ছে। যেন ভারী পাথর চেপে ছিলো মনে।তা একটু সরে গেছে।পুরোটা সরাতে পারলে খুব ভালো হতো।তনুর হঠাৎ খাতাটার কথা মনে পরলো।শান্তার থেকে বাঁচার জন্য খাতাটা মায়ের ঘরে লুকিয়ে রেখেছে।একমাত্র মায়ের ঘরটাতে কোনো ঝামেলা নেই।বাবা আর মা ছাড়া কেউ থাকেও না।এত মেহমানদের মধ্যে কেউই বেশি মায়ের ঘরে যায় না।তনু সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে।বিয়ে বিদায় শেষে তবেই খাতাটা মায়ের ঘর থেকে নিয়ে আসবে।

কাজি যখন বিয়ে পরালো আয়রা তখন তনুর হাত জোড়ে আঁকড়ে ধরেছে।আয়রার নখের আঁচড়ে তনুর হাতে জ্বালাপোড়া করছে।তবু তনু মুখে কিছু বলেনি।তাকে সবাই আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় এই ভাবনায় বিভোর ছিল।মিশকাত ভাই ও তনু আঁকড়ে ধরতে চাইছে!কিন্ত সে কি করে বলবে,
তার মতো মেয়েকে আঁকড়ে ধরতে নেই।তনুর পাশে যেই থাকবে তার দিকেই সমাজ বাঁকা চোখে তাকবে।তনুকে ভালোবাসতে হলে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলো ভেঙ্গে চুরে ভালোবাসতে হবে।নিয়মনীতি বিহীন ভালোবাসার প্রয়োজন।যা পৃথিবীতে অসম্ভব। আমাদের এই নিষ্ঠুর সমাজে ভালোবাসাটাও নিয়মের মধ্যে পরে।নিয়ম মেনে,পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে ভালোবাসতে হয়।তাহলেই ভালো ভাবে,সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকা যায়!নিয়মের বাইরে গেলেই সমাজ ছুঁড়ে ফেলবে।একা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

বিয়ে পরানো হলে সে আয়রাকে বলে একটু বের হলো।কারণ ইতিমধ্যে আয়রাকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন ঘিরে বসে পরেছে।সে বোন হয়ে এভাবে আপাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে ব্যাপারটা সবাই ভালো চোখে নাও দেখতে পারে।এসব বাস্তবতা বোঝার মতো মন এখনো আপার তৈরী হয়নি।তনুকে বুঝতে হয়েছে, শিখতে হয়েছে অনেক কম বয়সে।যখন তার ডালা মেলা উড়ে বেড়ানোর সময় ঠিক তখনই ডানা দুটো ভেঙে গেছে।

অনেক সময় ধরে বসে থাকার জন্য বাম পা টনটন করছে।একবার বাবার কাছে যাওয়া দরকার।মায়ের কাছে যাওয়ার মতো সাহস পাচ্ছে না।মায়ের কাছে ফুফু,খালারা আছে।

আচ্ছা, মিশকাত ভাই কোথায়?একবারও তো দেখতে পায় রাগচটা টা কে।হওয়া হয়ে গেছে নাকি।তনু ভাবলো,একবার আশেপাশে কোথাও খুঁজে দেখবে তারপর আবার ভাবলো,কি দরকার?মিশকাত ভাইকে নিয়ে এত মাথা ঘামানোর দরকার কি?কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো,মিশকাত ভাইকে তো বলতে হবে তার সাথে একফাঁকে দেখা করার জন্য, কিছু দেয়ার আছে!অবশ্য পুরোটা তো লিখতে পারেনি।তবু মনটা মিশকাতের দিকেই ধাবিত হতে চাইছে।তনু মিশকাতকে খুঁজতে পা বাড়ালো।

****

“কিরে বাবা,কাকে যেন দেখাবি বলেছিস?”

আরাফ মায়ের কথায় হেসে বলল,
“দেখাবো তো মা,কিন্তু তাকে তো খুঁজেই পাচ্ছি না।”

“কেন নাম ধাম জানিস না, নাকি?শোন, ভালো পরিবারের মেয়ে না হলে কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হবো না।”

“খুব ভালো পরিবার মা।তুমি আমার পছন্দের ওপর ভরসা রাখতে পারো নিশ্চিন্তে।ওকে দেখার পর তুমি নিজেও খুব পছন্দ করবে।”

“তা বিয়ে বিদায়ের সময় হয়ে আসলো এখনো তো মেয়েটাকে দেখাতে পারলি না।”

“আচ্ছা, তুমি এখানেই থাকো। আমি দেখছি তনয়া কোথায়।”

আরাফ তনয়ার খোঁজে পা বাড়ালো।

মিশকাত একটা ফাঁকা জায়গায় চেয়ার নিয়ে বসে আছে।চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। একটু পরেই চলে যেতে হবে।তনুর সাথে আবার কোথায়, কখন দেখা হবে জানা নেই তার।ভাগ্য তাকে সবসময় তনুর থেকে দূরে রাখছে।কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তার সেটা কি তনু জানে?সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলো তনু তার দিকেই আসছে ধীর পায়ে হেটে।মিশকাত বুঝতে পারলো না সে স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তবেই তনুকে দেখতে পাচ্ছে!

তনু যখন সামনে এসে দাঁড়ালো মিশকাতের ঘোর লেগে গেল।তার হৃদয়রাজ্যের যার সবসময় বসবাস সেই তনু যেন সত্যি রানী সেজে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

তনুকে মিশকাত কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,

“তুমি এখানে কেন মিশকাত ভাই?”

মিশকাত জবাব দিচ্ছে না। তনু সহ্য করতে পাচ্ছে না মিশকাতের মুগ্ধ দৃষ্টি।এই দৃষ্টি যে তার বুকে কাঁপন ধরায়,ভেঙে গুড়িয়ে দেয় তার ভেতরের তনুকে।নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয় খুব!সমস্ত কিছু ভুলে মিশকাতের অনুভূতির আকুতিকে সাদরে জড়িয়ে নিতে।তনু আবার বলল,

“তোমার কি হয়েছে, কথা বলছো না কেন?আর চোখ গুলো এমন লাল হয়ে আছে কেন?”

মিশকাত নিজেকে সামলে নেয়।তবে তনুর থেকে নজর সরায় না।বলে,

“আমার চোখ লাল না সাদা সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।কি বলতে এসেছিস বলে বিদায় হ।”

তনু বুঝলো মিশকাত তার সাথে কখনোই ভালো ভাবে কথা বলবে না।শুধু শুধু আশা করাই বৃথা। সে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

“তুমি কাল একবার আমার সাথে আলাদা কোথাও দেখা করতে পারবে?আসলে তোমায় কিছু দেয়ার আছে!”

মিশকাত চমকে উঠলো। তিন বছরের বেশি সময় হয়ে গেল ঠিক একই কথা সে একদিন তনুকে বলেছিল!তনু তার কথা শোনে নি।সেদিনের পর থেকে দুরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।কিন্তু কি জানে মিশকাতও এবার তনুর কথা রাখতে পারবে না।তাকে চলে যেতে হবে।আচ্ছা, কি এমন দেবে তনু যা আজ দেয়া যায় না?

সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরাফ এসে তনুর হাতে ধরে ফেললো। তনু চমকে উঠলো আরাফের এমন কান্ডে। আরাফ খুশে মনে বলল

“এতক্ষণ তোমায় পেলাম।কোথায় ছিলে বলোতো?ভাবীর কাছেও নেই তুমি?”

তনু অপ্রস্তুত হয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। বলল,

“আমায় খুঁজছিলেন কেন?”

“উমম,একটা প্রয়োজন। চল আমার সাথে তাহলেই বুঝতে পারবে।”

“কোথায় যাব? ”

“সেটা তে গেলেই দেখতে পারবে।” আরাফ দেরী করলো না সেটা তনু প্রায় টেনে নিয়ে গেল।

তনু যদি একবার পেছন ফিরে তাকাতো তাহলে আঁতকে উঠতো মিশকাতকে দেখে।

আরাফকে কিছুতেই আর সহ্য করতে পারছে না।তার কাছ থেকে তারই তনুকে টেনে নিয়ে গেল? কতবড় সাহস ছেলেটার ভাবা যায়?মিশকাতের মাথা কাজ করছে না।শুধু ইচ্ছে হচ্ছে শক্ত কিছু দিয়ে আরাফের মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে।এই ছেলেটা তনুকে নিয়ে এত টানাটানি করার অধিকার টা পেল কি করে?রাগে মিশকাত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে যাবে না,কোথাও যাবে না।তার পক্ষে তনুকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়।আরাফের কিছু একটা ব্যবস্থা না করে তো আরও নয়।এই মুহূর্তে তার বাবাকে খুব প্রয়োজন। মাকে সামলাতে বাবাই তাকে সাহায্য করতে পারবে!মিশকাত ছুটলো বাবার কাছে।

আরাফের মায়ের প্রশ্নের জবাবে হাপিয়ে উঠেছে তনু।বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আছে। আরাফ তাকে হুড়মুড় করে টেনে এনে এই মহিলার সামনে কেন এনে বসিয়েছে বুঝতে পারছে না।ওইদিকে আপার কাছে যাওয়া প্রয়োজন।বাবার কাছেও যেতে হবে। কনের বোনকে এত প্রশ্ন করার কি আছে সে সত্যি বুঝতে পারছে না।

আরাফ ও কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।সে নিজেও বুঝতে পারেনি তার মা প্রথম দেখাতেই তনু এতসব প্রশ্ন করতে শুরু করে দেবে।সে তো শুধু এক নজর দেখাতে এনেছে।মায়ের কারনে না আবার তনু সবটা বুঝে যায়।তনুকে সে নিজে প্রপোজ করার কিছুই বুঝতে দেবে না।সারপ্রাইজ দিয়ে তনুকে চমকে দেবে।তনু না করতে পারবে না!সে তো না করার মতো ছেলে নয়।দেখতে সুন্দর, ভালো চাকরি করে,সমাজে একটা ভালো অবস্থানে আছে।তনুকে সে একদম বিয়ের প্রপোজাল দেবে।প্রেম করার মতো ইচ্ছে বয়স কোনোটাই নেই।সোজা বিয়ে করে ঘরে তুলবে।শুধু তনুর মত পেলেই হলো।

“আন্টি আপনার কথা শেষ হলে আমি একটু আপার কাছে যাই।বোঝেনিই তো বিয়ের বাড়ি অনেক ঝামেলা।”

“আচ্ছা মা, যাও।আগামিকাল তো আমাদের আবার দেখা হচ্ছে তখন না হয় জমিয়ে গল্প করা যাবে।আরাফের মা হেসে বলল।

তনু মনে মনে বলল,

“আপনার এসব গল্প না পুলিশি জেরা সে নিয়ে সন্দেহ আছে।” মুখে বলল,

“ঠিক আছে আন্টি। ভালো থাকবেন।”

তনু আর দাঁড়ালো না।দ্রুত আয়রার কাছে আসলো।রাফাত আয়রাকে এক সাথে বসানো হয়েছে।আয়না দেখার পালা চলছে।তনুকে দেখে শান্তা বলল,

“কিরে কোথায় ছিলি? ”

“পরে বলব।এখন আপার যাই চল।”

“ধুর যাব কিভাবে?দেখিস না ওরা কেমন আপাকে ঘিরে ধরে আছে।আমাদের তো কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না।কবুল পরানোর সাথে সাথেই আপাকে ওরা নিজেদের ভেবে নিয়েছে।মেয়ে গুলা এমন ভাব করছে ওরা যেন কতো আপন আর আমরাই পর,হু!”

তনু হেসে ফেললো। বলল,
“আস্তে কথা বল, কেউ শুনে ফেললে খুব খারাপ হবে।”

“শুনলে ভালোই হবে।”

“আয় তো আমার সাথে।আপা নিশ্চয়ই আমাদের কাছে না পেয়ে খুব নার্ভাস হয়ে পরেছে।”

তনু একটু একটু করে এগিয়ে এসে আপার পাশে দাঁড়াল। আয়রা তনুকে দেখে একটু সাহস পেল।সবাই বারবার বলছে,

“ভাবী আয়নায় কি দেখতে পাচ্ছেন, বলেন তো?উত্তর কিন্তু রোমান্টিক হওয়া চাই!”

আয়রা লজ্জায় কাবু হয়ে পরেছে।এভাবে কি বলা যায়! মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না।আয়রার অবস্থা দেখে রাফাত মুচকি মুচকি হাসছে।এই লজ্জবতীকে নারীকে সে অন্তকাল ধরে পাশে চায় সবসময়ের জন্য!

চলবে..

#তনয়া
#পর্ব -৮

“সেদিন রাতে তোমার সাথে দেখা করতে যাইনি আমি।জানতাম অপেক্ষায় ছিলে।নিশ্চয়ই ছটফট করেছিলে খুব!যাইহোক তোমার অনুভূতি গুলো তোমার মধ্যেই থাকুক। আমি চাইলেও সেই অনুভূতির যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারব না কখনো।তবে কি জানত,তোমার আমার মনের ভেতর কি চলছে সেটা বড়মামি খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন।মায়েরা সবটা বুঝতে পারে! হয়ত তোমার আমার না হওয়া সম্পর্কের কারণ এটাই!কি ভাবছ, বড়মামিকে দোষারোপ করছি?উহু,মোটেও না।নিজের এত দোষের ভীড়ে অন্যকে কি দোষ দেব।ভুল বলো,অন্যায় বলো যদি কিছু হয়েই থাকে সেটা আমার হয়েছে।তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না কি বলতে চাইছি, তাইনা?

আচ্ছা বলছি,
তুমি তো জানো বড়মামা বড়মামির কত আদরের ছিলাম আমি।সেদিন সন্ধ্যা বেলা বড়মামি আমায় ডেকে তার কাছে বসিয়ে বললেন,

“আয় তোর চুল গুলো ভালো ভাবে বেঁধে দেই।সারাদিন খুলে রেখেছিস জট লেগে গেছে।”

আমি খুশি মনে বসেছিলাম চুল বাঁধতে ।মামি প্রথমেই বললেন,

“এই যে এত সুন্দর চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াস আমার ছেলের মাথাটা নষ্ট করতে বুঝি?”কি সুন্দর ভাবে হেসে বলেছিল কথাটা!প্রথমে আমি সত্যি বুঝতে পারিনি মামির কথা।সদ্য কলেজে পা দেয়া আমি তখনও এই কথাটার গাম্ভীর্য বুঝে উঠেনি।

মামি আবার বললেন,”আমি জানি মিশকাতের মনে কি চলছে তোকে নিয়ে।তবে তোকে সাবধান করে দেই তনু, ভুলেও মিশকাতের দিকে পা বাড়াস না!এরবেশি কিছু আমি বলতে চাইনা।”

আমি অবাক হয়ে মামির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।ধীরে ধীরে সবটা বোঝার পর লজ্জা সেই সাথে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম।আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মামি বলেছেন,

“খুব অবাক হচ্ছিস তাই না?ভাবছিস আমি কিভাবে জানলাম তোদের দুজনের মনের খবর?জেনেছি জন্যই চেপে যেতে বলছি তোকে।ভুলেও মিশকাতের কাছাকাছি যাবি না।যে সম্পর্কটা তোদের শুরু হবার কথা তা যেন কখনোই না হয়।”

আমার বুকের ভেতর তখন তোলপাড় চলছে। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।লজ্জা দূরে রেখে মামির পায়ের কাছে বসে বললাম,

“কেন এমন বলছ বড়মামি?মিশকাত ভাইয়ের কাছে যেতে কেন বাঁধা দিচ্ছো?মিশকাত ভাই আমায় পছন্দ করে!”

“পছন্দ যখন করে তখন একদিন অপছন্দও করবে।তোকে যেটা বলেছি সেটা মাথায় রাখিস।”

আমি মামির পা দুটো আঁকড়ে ধরে বলেছি,

“তোমার আদরের তনু তোমার ছেলের বউ হোক তা চাও না কেন?”

“কারণ,তুই কখনো আমার মিশকাতের জীবনে সুখ এনে দিতে পারবি না তাই।”

“কি বলছ,কেন পারব না?আমি মিশকাত ভাইকে ভালোবাসি। ”

“ভালোবাসা আর সুখের পার্থক্য বোঝার মতো বয়স,জ্ঞান তোর কোনটাই হয়নি তনু!জীবনে ভালোবাসা না থাকলেও চলে কিন্তু সুখ, সেটা লাগে রে।আমি আমার সংসারে সুখ চেয়ে এসেছি, আমার ছেলের জীবনেও তাই চাইবো।”

“কিসের সুখ আমায় বলো, দেখবে আমি ঠিক পারব।”

“পারবি না তুই?”

আমি নাছড়বান্দার মতোর বলেছিলাম,

“পারব,তুমি বলে দেখ আমি ঠিক পারব।”

মামি কিছুক্ষণ কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।এরপর বলেছিলেন,

“তুই কখনো মা হতে পারবি না তনু!তোর সাথে বিয়ে হলে আমাদের সংসারটা শেষ হয়ে যাবে।”

আমি তখন বজ্রাহত হয়ে বসেই রয়েছি।মামির কথা আসলেই কিছু বুঝতে পারছি না।”মা “হতে পারব না কেন?বিয়ের পর তো সব মেয়েরাই মা হয়।আমি তখন এতটাও ছোট নই যে বিয়ে, নারী পুরুষের সম্পর্ক, সন্তান এসব বিষয়ে বুঝবো না।

“কি বলছ মামি?”মা “কেন পারবো না?আমার বিয়ে হলেই তো মা হতে পারব।তুমি আগেই কেন এসব বলছ?

আমি জানি তাই বলছি।তোর আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোর মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। তোর মনে নেই কিছুদিন আগে পেট ব্যাথা নিয়ে হসপিটালের ভর্তি ছিলি দুইদিন।আমিও তো ছিলাম।দুলাভাই বাইরে থাকায় তোর মামা তোকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল।তখন রিপোর্টে এসেছিল তুই কখনো মা হতে পারবি না।এ জন্যই তোর পিরিয়ডের সমস্যা হতো।আজ তোর মিশকাতের সাথে সম্পর্ক হলে কাল আমি ছেলের সুখের কথা ভেবে তোদের বিয়ে দিয়ে দিলাম। বিয়ের পর যখন তুই মা হতে পারবি না, তখন মিশকাতকে কি জবাব দিবি?”

মামির এই কথাটাই আমায় প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল।সত্যি তো, কে না চায় নিজের সন্তান। তোমায় আমি কি জবাব দিতাম?এখন যতটা কষ্ট হচ্ছে তখন তো আরও বেশি কষ্ট হবে।সেই কষ্টের সীমানা থেকে বের হতে পারব না।

আমি ছুটে মায়ের কাছে গিয়েছিলাম।প্রশ্ন করেছিলাম আমায় এই কথা কেন জানানো হয়নি?পরে এই নিয়ে বড়মামির সাথে মায়ের কথা কাটাকাটি হয়। সেই থেকে বড়মামির সাথে মায়ের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।তার পরেরদিন সকালেই মা আমায় নিয়ে চলে আসে।তোমায় কিছুই জানাতে পারিনি।তোমার সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকুও সেসময় আমার ছিল না।সদ্য পাওয়া আঘাতটা সামলিয়ে ওঠার মতো মানসিক দৃঢ়তা ছিল না।তবে একটা কাজ আমি করেছিলাম,

মামিকে বলে গিয়েছিলাম তোমায় এমন কিছু বলতে যাতে আমার মতো তুমিও নিরবে সরে যাও।না হওয়া সম্পর্কের রেশ টেনে নিয়ে না চলো।

আমি জানতাম না মামি তোমায় কি বলেছিল।নতুন বাড়িতে ওঠার সময় মারুফ ভাই এসেছিল।তার কাছ থেকেই জানতে পারি,

মামি তোমায় বলেছিল,আমি নাকি তার কাছে তোমার নামে নালিশ করেছি।তুমি আমায় বিরক্ত করো খুব,আমি তোমায় নিজের ভাইয়ের চোখে দেখি অথচ তুমি নাকি আমায় অন্য চোখে দেখ।এমন ধরনের অনেক কিছুই বলেছিল হয়ত।তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছিলে!কষ্ট পেয়েছিলে কিনা সেটা না হয় নাই বা জানতে চাইলাম।অবশ্য ভালোই হয়েছে তুমি অনেকটা সরে গেছ আমার কাছ থেকে।এরপর কোথাও দেখা হলেই আমি তোমায় এড়িয়ে চলেছি তোমার প্রশ্নবাণে জর্জড়িত হবার ভয়ে।

মারুফ ভাই বলেছিল,আমি নাকি ছোট ছিলাম তাই তুমি আমায় মাফ করে দিয়েছ?কেন দিয়েছ মিশকাত ভাই?তুমি বোধহয় বিশ্বাস করতে পারোনি আমি মামিকে তোমার নামে নালিশ করেছিলাম, তাই তো?

আমার বাবাও আজ পর্যন্ত জানে না এই ব্যাপারটা।হয়ত জানবে একদিন। আমার সবচেয়ে বড় দোষের কথা একদিন পুরো পৃথিবী জানবে।সবচেয়ে বড় দোষই তো,এই কারনেই তো ভালোবাসা হারাতে হয়েছে।সেদিনের পর অনেকটা সময় লেগেছিল নিজেকে স্বাভাবিক করতে।দুটো মাস ঘরবন্দী হয়েছিলাম।কলেজ যেতাম না,বাইরে বের হতাম না,পড়াশোনা করতে পারতাম না।শুধু মনে হত আমি “মা” নামক পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর অনুভূতির সাথে কখনো পরিচিত হতে পারব না।নারীর সার্থকতা যে অনুভূতিতে তা থেকে আমি বঞ্চিত।

তুমি বলতো আমায় মিশকাত ভাই,আমার কি করা উচিত?ভালোবাসলেই কি ঘর বাঁধতে হয়?তুমি হয়ত বলবে এটা কোনো সমস্যা নয়, ভালোবাসায় বাঁধা হতে পারে না। তোমার ভাবনায় সমাজ,পরিস্থিতি কখনো থেমে থাকবে না।কখনো না কখনো তুমি নিজের সন্তানের আশা করবে!হয়ত আমায় বুঝতে দেবে না কখনোই তবু দুজনের মধ্যে যোজন বিয়োজন থাকবে।প্লিজ মিশকাত ভাই আমি আর তোমায় ভাষায় বোঝাতে পারছি না।আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।সম্পর্কের জটিলতা কেউ পছন্দ করে না। তোমার জীবন তুমি সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলো।কেন পেছন ফিরে চাও বারবার?অতিত কখনো ভবিষ্যৎ হয়?সবটা জানার পর আশা করি তুমি নতুন কোনো ঝামেলা করবে না।সবার আগে তোমার মায়ের কথাটা ভেব।নিজের সুখের চিন্তা করার আগে সবার সুখের কথাটা একবার ভেবে নিও।”

তনু খাতাটা বন্ধ করে বুকে চেঁপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বুকের ভেরতটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই আয়রাকে বিদায় দিয়ে পুরো পরিবারে বিষাদের ছায়া ভর করেছে।শায়লা বেগম নিজের ঘরে কাঁদছেন। চাচী ফুফু সবার মনই খারাপ।সবাই শায়লা বেগমকে সবাই শান্তনা দিচ্ছে। তনু আয়রাকে বিদায় দিয়ে এসে খাতাটা নিয়ে বসেছে লিখতে।তনুর কান্নার শব্দে শান্তা এসে জড়িয়ে ধরলো।সবাই ভাবছে বোনের জন্য কাঁদছে তনু।শুধু তনুই জানলো, সে কেন কাঁদছে! কোথায় তার কষ্ট হচ্ছে!

“আচ্ছা, তনুর মনের এই হাহাকার কি মিশকাত অব্দি পৌঁছেছে?”

***

রাত অনেকটাই গভীর।সবাই ক্লান্ত হওয়ার দরুন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।ঘুম শুধু নেই তনুর চোখে।জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর।বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে।শুয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বাধ্য হয়ে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলো।সময় নিয়ে মাথায় পানি ঢাললো।শরীর দূবল হয়ে গেছে।ঘুম আসবে না তাই সে পা বাড়ালো ছাঁদের উদ্দেশ্যে।ঘরের গুমোট ভাবে মাথা ধরে যাচ্ছে। ছাঁদের খোলা পরিবেশে এসে দাঁড়াল তনু।মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।

মিশকাত আজ শুতে যায়নি।মায়ের সাথে রাগারাগি হয়েছে বেশ।আজ মাকে নিয়ে না যাওয়ায় অনেকটা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। মা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।উপায় না পেয়ে মিশকাত বাধ্য হয়েছে আগামিকাল চলে যাওয়ার জন্য।মনটা প্রচন্ড ভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।দুচোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। বিয়ে বিদায়ের পর সে আর ঘরে যায়নি।সোজা ছাঁদে উঠে এসেছিল।সেই থেকেই ছাঁদেই সময়টা পার করে দিচ্ছে আর তনুর কথাই ভাবছে।হঠাৎ ছাঁদের একপাশে ছায়ামূর্তি দেখে একটু অবাক হলো।উঠে দাঁড়াল সে।ধীরে ধীরে এগোতেই অবাক হলো।ছায়ামূর্তিকে চিনতে পরেছে।তনু দাঁড়িয়ে আছে! রাত দুটোর সময় তনুকে মোটেও ছাঁদে আশা করেনি সে।

আচ্ছা, তারই মতো কি তনুর চোখেও ঘুম নামেনি আজ?

“কি করছিস এখানে?তোর দেখছি ভুতের ভয় নেই?”

তনু কেঁপে উঠে।মিশকাতকে দেখে অবাক হয়।একটু এগিয়ে আসতে চাইলে মাথাটা ঘুরে যায়।তনু টলছে দেখে মিশকাত এগিয়ে আসে ধরতে।তনু হাত নেড়ে মানা করে।মিশকাত থমকে দাঁড়ায়।তনুকে দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ।

কাঁপা গলায় তনু বলে উঠে,

তুমি চলে যাও মিশকাত ভাই,যত তাড়াতাড়ি পারো আমার থেকে দ্রুত চলে যাও!

রাতের গাঢ় আধার ভেদ করে তনুর বলা কথা গুলো মিশকাতের কানে এসে ডানা ঝাপটায়।অভিমানে টলমল করে ওঠে চোখের কোণ।মিশকাত ঘুরে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য।তার আগেই তনুর শরীরটা লুটিয়ে পরে যায় নিচে।

চলবে…

P.c- Aysha siddika

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here