তনয়া #পর্ব -১১,১২

0
684

#তনয়া
#পর্ব -১১,১২
#সিফাতী সাদিকা সিতু
#পর্ব -১১

তনয়া সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে চা বানাতে এলো।শায়লা বেগম আয়রা অবাক হয়ে তনুকে দেখছে।তনুকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেই বিকেল থেকে ওর মনে কি ঝড় বয়ে চলছে।

শায়লা ইশারা করায় আয়রা বলল,

তনু তোর খিদে লেগেছে? কিছু বানিয়ে দেব?

না আপা শুধু চা খাব।আমি বানাচ্ছি তুমি খাবে?মা তোমাকেও দেই?

শায়লা বেগম মাথা নাড়ালেন।কেউ বুঝে উঠছে না তনু কি চাইছে?

মাথা ব্যাথা করছে তোর?

হ্যাঁ রে আপা।মাথাটা খুব ধরেছে।একটু তেল লাগিয়ে দেবে?

আচ্ছা, চল ঘরে যাই।

দাঁড়াও বাবাকে চা দিয়ে আসি।

শায়লা যা বোঝার বুঝে গেলেন।তবে মনে মনে খুশিও হলেন।তনু নিজেই কথা গুলো বলতে পারবে এটাই তো আনন্দের। শুধু শুধু কেন গুটিয়ে রাখবে নিজেকে?বিষয়টা তনুর সমস্যা কোনো অপরাধ নয়!

বাবা একটু আগে চা খেয়েছে।তুই চল আমি তেল দিয়ে দেই।

তনু কিছু বলার আগে শায়লা বললেন,চা টা নিয়ে যা।তোর বানানো চা খুব পছন্দ করে।

তনু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। শায়লা বেগমের চোখের কোণ চিকচিক করছে।তনুর সস্তির শ্বাস ফেলে বাবার কাছে এলো।

তনুকে দেখে খুশি হলেন তানভীর সাহেব। ভেবেছেন মেয়েটা হয়ত মন খারাপ করেছে।হুট করেই এমন অভাবনীঅভাবনীয় প্রস্তাব পেয়ে তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করেই মোটামুটি মত দিয়েই ফেলেছেন।না করার তো কারণ নেই।রাফাতকে যদি পছন্দ হয় তাহলে আরাফ কে কেন অপছন্দ হবে?আরাফও ভালো ছেলে।তবু তিনি খোঁজ খবর না নিয়ে এগোবেন না।তাছাড়া রাফাত ভালো জন্য আরাফও ভালো হবে এমনটা নাও হতে পারে।কিন্ত আত্মীয়দের মুখের ওপর না করে দেয়াটা খুব খারাপ হয়ে যেত।

তানভীরের পাশে বসে তনুর নিরবে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

তুমি কি আমায় কিছু বলবে বাবা?

তানভীর এতক্ষণে সুযোগ পেলেন।বললেন,

তুই কি আমার ওপর রেগে আছিস?

উহু, আমি তো কখনো রাগী না।বলতে পারো আমার রাগ খুব কম।যেটুকু আছে তাও অপ্রকাশ্য।

তা অবশ্য ঠিক।তুই তো রেগে থাকিস নীরবে।কিন্তু জানিস কি তোর চাপা রাগটাকে আমি আর তোর মা খুব ভয় পাই।

তনুর মনটা আসলেই ভালো হয়ে গেল।বাবার কাছে কিছুক্ষণ থাকলেই মন ভালো হয় তার।এর আগেও এমন হয়েছে।একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল,

সবকিছু তো আমাদের হাতে থাকে না বাবা।তাহলে অপ্রত্যাশিত কিছু বিষয় নিয়ে রাগ অভিমান করার মতো বোকা আমি নই।তুমি তো জানতে না ওরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে।

আয়রা তো আমাদের সেভাবে কিছু বলে নি।আমি সত্যিই কিছু জানতাম না।

তুমি আরও একটা সত্যি জানো না বাবা! তোমার মেয়ে কোনোদিন “মা” হতে পারবে এই কথাটা এখনও তোমার অজানা।তোমার মেয়ের রিপোর্টে Polycystic Ovarian Syndrome এ সমস্যা লেখা আছে।এটা শোনার পর কি তোমার খারাপ লাগবে বাবা?

তানভীর স্থীর হয়ে বসে আছে।বোঝার চেষ্টা করতে চাইছে তনু কি বলছে!সব কথা গুলো জট পাকিয়ে উঠছে।

তনু আবার বলল,

আমি জানি তোমার খারাপ লাগবে।রাগও হবে প্রচুর এতদিন এই বিষয়টা গোপন রাখার জন্য।সবথেকে যেটা বেশি হবে সেটা হলো কষ্ট!তোমার মনে আছে বাবা,অফিস থেকে ফিরে আগে আমার হাতে চকলেট তুলে দিতে এরপর আয়রা আপাকে দিতে।ছুটির দিন গুলোতে তুমি আমায় বেশি সময় দিতে।সবসময় ছায়ার মতোন ছিলে আমার পাশে।মা বাবার কাছে সব সন্তান এক হলেও আয়রা আপাকে যেভাবে মা আঁকড়ে রেখেছে তুমিও সে ভাবেই আমায় স্নেহের চাদরে জড়িয়ে রেখেছ।তুমি পারবে না বাবা তোমার তনয়াকে এভাবেই আগলে রাখতে?

তনু বাবাকে প্রশ্ন করলো কিন্তু উত্তর শুনতে চাইলো।কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হয় না।প্রশ্নটাই উত্তর হয়ে যায়।তনু উঠে দাঁড়াল। তানভীর সাহেবের সামন থেকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে চলে গেল।

***
মিশকাত ইন্টারভিউ শেষ করে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়াল।প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সে।আজ দুটো ইন্টারভিউ ছিল।একটা খুব খারাপ হয়েছে অন্যটা বেশ ভালো হয়েছে। ঠিক তনু যেরকম।বেশি খারাপ আবার খুব ভালো।টক ঝাল মিষ্টির সংমিশ্রণ। মিশকাতের ফাইনাল পরিক্ষার মাসখানেক বাকি।এরই মাঝে সে চাকরির পেছনে ছুটছে।পরিক্ষা নিয়ে ভাবছে না।তার এখন অন্যকিছু ভাবনা!শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ নয় সেটা বাস্তবায়নেও নেমে পরেছে।এখান থেকে সোজা সে বাস টার্মিনালে যাবে।দুদিনের জন্য বাড়ি যাবে সে।রাস্তায় দাঁড়িয়ে মারুফের অপেক্ষা করছে।মারুফ এইদিকেই কাজে এসেছিল।দুজনে একসাথে বাড়ি ফিরবে।বাড়িতে থাকবে একদিন এরপর মারুফের কাছে যাবে।ওখানে সমস্ত কাজকর্ম সেরে আবার হলে ফিরবে।

পকেট থেকে টিস্যু বের করে গলায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে নিলো।

কয়েক মিনিটের মধ্যে মারুফ এলো।দুজনেই রিকশা নিলো।

কিছু জানিস ওই দিকের খবর?

তুই বললেই জানতে পারব।

আরাফ বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।ফুপা বোধহয় মত জানিয়ে দিয়েছে।

মিশকাত হাসলো দুপা ছাড়িয়ে আরাম করে বসলো।

এতসব কবে হলো?

গতকালই হয়েছে।আয়রার শ্বশুর বাড়ির কথা ভেবেই বোধহয় ফুপা এত দ্রুত রাজি হয়েছেন।তা না হলে দেখিস নি রাফাতের সময় কতদিন ধরে খোঁজ খবর চালিয়েছেন।

এবার খোঁজ নিয়ে কি করবে বিয়ে টাই তো হবে না!

কি বলছিস?কেন হবে না?তুই কি এখন বিয়ে ভেঙে দিবি তনুর?মারুফ অবাক হয়েছে ভীষণ।

মিশকাত এত সামান্য কিছু করে না।যা হবে তা এমনিই হয়ে যাবে।দুদিন পর শুনিস বিয়ের প্রস্তাব যেভাবে এসেছে সেভাবে ফিরে গেছে।

এত নিশ্চিত হচ্ছিস কিভাবে?তোর ধারনা তো ভুলও হতে পারে।

তনুর ব্যাপারে আমার কখনো ভুল হয়েছে?

মারুফ একটু ভেবে বলল,তা হয়নি।তুই বলেছিলি তনু তোর মাকে নালিশ করতেই পারে না!যদি করেও থাকে এর মধ্যে অন্য কোনো কারণ আছে।

আমার বিশ্বাসটা ঠিক মিলে গেছে।এখন দেখবি এটাও মিলে যাবে।কি বলতো,কাউকে ভালোবাসলে নিজের মাঝে সুপারন্যাচারাল পাওয়ার চলে আসে।তবে আমার দেরিতে এসেছে।তা না হলে অনেক আগেই বুঝে যেতাম তনু সেদিন রাতে দেখা করতে আসবে না!

তুই যে পথে হাঁটছিস তাতে কি মনে হয়?

মিশকাত সে কথা জবাব না দিয়ে বলল,

খোঁজ নে তো।তনু এ দুদিন ভার্সিটিতে আসবে কিনা?

তনুর সাথে দেখা করবি?

নাহ।ঠিক দেখা করবো না অন্যকিছু করবো!

ভালোভাবে বলতো কি চাইছিস তুই?

বলব,আগে কিছু খেয়ে নেই।বাসে উঠে তোকে সবটা বলছি।সকালে কিছু খেয়ে বেরোই নি আজ।

মারুফ রিকশাওয়ালা কে বলল,মামা সামনে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ায়েন তো।

আইচ্ছা মামা।

আরাফ মায়ের ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে।তার মা সমানে বকাঝকা করে চলেছে।কারণ,একটু আগেই তনুর বাবা জানিয়েছেন সবকিছু।তানভীর সাহেবে বলেছেন,

ওনার মেয়ের এই সমস্যাটা মানতে রাজি হলে হলে তবেই ওরা বিয়ের বিষয়ে ভাববে।তনুর সবটা ওনারা খোলামেলাই জানিয়েছেন।আরাফকেও বলে দিয়েছিলেন, তুমি বাবা বিয়ে করতে না চাইলে আমরা কিছু মনে করবো না।তবুও আগেই সব ভেবে চিন্তে নিও।বিয়ের পর আমার মেয়েকে অসুখী দেখতে পারব না।

তনুর বাবার এমন ব্যবহার ভালো লেগেছে আরাফের মায়ের।সত্যি লুকোনো হয় তাদের কাছে।আয়ারার পরিবার যে সত্যি ভালো পরিবার তা বুঝতে পেরেছেন।কিন্তু ছেলের কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেছেন।

আরাফ বলছে,সে তনয়াকেই বিয়ে করবে।বাচ্চা লাগবে না তার।যদি প্রয়োজন হয় দত্তক দেবে।কত নিষ্পাপ শিশু এতিমখানায় বড় হচ্ছে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা দরকার।নিজের ঔরসজাত সন্তান হতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই।এরকম সমস্যা তো তার নিজেরও হতে পারতো।

ছেলের এমন আবেগী ভাষণে গলে না গিয়ে বরং রেগেমেগে চড় বসিয়ে দিয়েছেন।একমাত্র ছেলের গায়ে হাত তুলেছেন অনেকদিন পর।এই যে এতবড় কথা বলছে ঠিক একদিন বলবে তার নিজের সন্তান চাই।তনুর সমস্যাকে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে দেবে।যতই হোক তিনি একজন নারী।নিজেকে দিয়েই তো বোঝেন।আরাফ তার বিয়ের পাঁচ বছর পর এসেছে।এরপর তো অপারেশন করতে হলো।আরাফের বাবা প্রথম প্রথম ঠিক এমন কথাই বলেছিল।অথচ পাঁচটা বছরে কতশত ডাক্তার দেখিয়েছেন,কত মান অভিমান,অপমানের পালা চলেছে সেটা শুধু তিনিই জানেন।আরাফ একমাত্র ছেলে এখন যদি ছেলের বউও সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয় তাহলে কি করে হবে?

***
তনু ভার্সিটির থেকে বেরিয়ে মারুফকে দেখতে পেল।হেসে এগিয়ে এসে বলল,

কেমন আছো ভাইয়া?

ভালো আছি, তোর খবর কি?

এইতো ভালোই।কাজে আসছিলে?

উহু,তোর কাছে এসেছি?

তনু একটু অবাক হয়ে বলল,

আমার কাছে কেন?

প্রয়োজন আছে।চল আমার সাথে একটা জায়গায় তোকে নিয়ে যাব।

কোথায় যাবো?

গেলেই দেখতে পাবি।

তনুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেনে নিয়ে গেল মারুফ।

চলবে..

#তনয়া
#পর্ব -১২

“তোমার জন্যই মারুফ ভাইয়া আমায় কিছু না বলে এখানে নিয়ে এসেছে, তাই না?”

“চ্যাটাং চ্যাটাং কথা না বলে চুপচাপ বসে থাক।তোর মতন নবাবজাদীকে এভাবেই আনতে হয়।”

তনু মিশকাতের কথার পিঠে কথা না বলে চুপ করেই বসে থাকলো।হঠাৎ মিশকাত কই থেকে উদয় হলো কে জানে?এখন মিশকাতের সাথে ঠিক মতন কথা বলাই যায় না।সব কথা ত্যাড়া ভাবে বলবে।বিশেষ করে তার সাথে।আজ মিশকাতের সাথে দেখা হবে জানলে চিঠিটা সাথে করে আনতো।এখন মনে হচ্ছে ইহজনমে মিশকাতকে জানানো হবে না। অবশ্য ধীরে ধীরে অনেকেই জানতে পারবে এখন।মিশকাত ভাই ঠিক এক সময় জানবে।দেখা যাবে মামি বলে বসবে।তার আর কষ্ট করতে হবে না।মা বাবা দুজনেই খুব সুন্দর ভাবে তাকে সামলাচ্ছে। তানভীর সাহেব খুব কষ্ট পেয়েছেন।তনুর একদিক থেকে কপাল খুব ভালো সে তানভীর সাহেবের মতো বাবা শায়লা বেগমের মতো মা পেয়েছে।পরিবারকে খুব প্রয়োজন হয় এমন পরিস্থিতিতে।পরিবার পাশে থাকলে সব সীমাবদ্ধতা জয় করা যায়।

“তোর সাথে এনআইডি কার্ড আছে নিশ্চয়ই? একটু দে তো।”

“কেন? ”

মিশকাত নিজেই ব্যাগটা টেনে নিলো।কাগজটা খুঁজে নিয়ে আবার চলে গেল।তনু কিছুই বুঝতে পারছে না।ভার্সিটি থেকে একটু দূরের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে মারুফ। এখানে এসে দেখলো মিশকাত বসে আছে।তনুকে দেখে মিশকাত একটা লম্বা হাই তুলে বলল,

“মহারানীকে কোথায় খুঁজে পেলি মারুফ?তা মহারানী আপনি কি এখানে রাজভোগ খেতে এসেছেন?এসেছেন যখন বসে পরেন।আপনার সাথে আমরা গরীব প্রজারাও একটু খেতে পারবো।”

এরপর তনুকে বসিয়ে রেখে মারুফ কে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।এবার এসে এনআইডি কার্ড নিয়ে আবার চলে গেল।কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠছে না। ইতিমধ্যে ওয়েটার ফ্রাইড রাইস চিলি চিকেন দিয়ে গেছে।তনুর বিরক্ত লাগছে।দিন দিন মিশকাত খুব বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষটার অনুপস্থিতিও তাকে বিরক্ত করে।ভালোই হয়েছে সম্পর্কটা হয়নি।এমন মাথা পাগলা ছেলের সাথে কেনো সম্পর্ক না হওয়াই উচিত ,হু।

দশ মিনিটের মধ্যে দুজনেই ফিরে এলো।মিশকাত বসতে বসতে বলল,

“খাচ্ছিস না কেন?সারাদিন এখানে বসে থাকার ইচ্ছে আছে?এরপর একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল খেয়ে দেয়ে এখানে একটা সই দিয়ে চলে যা।”

“কিসের কাগজ?আমি কি এখানে বসে আছি নাকি বসিয়ে রাখা হয়েছে?”

মিশকাত কথা বলল না।সে খাওয়ায় মনযোগী হয়ে গেছে।এমন ভাব তার সামনে খাবার ছাড়া কিছু নেই।সামনের নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত মেয়েটার কোনো অস্তিত্বই নেই।

তনু মিশকাতের এমন ভাব দেখে জ্বলে উঠল।

“মারুফ ভাই তুমি আমায় বলবে কি হচ্ছে এসব?তুমি আমায় কেন নিয়ে এলে।”

মারুফ পরলো বিপদে।এদের দুজনের ঝাঁঝে এসির বাতাসও তার কাছে গরম লাগছে।

“তুই শুধু সিগনেচার করে দে।আমি তোকে রেখে আসব বাড়িতে।”

আমি বাড়ির রাস্তা জানি।তোমরা আমায় বলো কি হচ্ছে এসব?

“মারুফ এত কথা না বলে কাগজটা পড়ে দেখতে বল।এইজন্যই মেয়ে মানুষের সাহায্য নিতে নেই?” মিশকাত খেতে খেতে বলল।তার মনোযোগ এখনও খাবারে।আশেপাশে তাকানোর প্রয়োজন মনে করছে না।

তনু কাগজটা পড়ে কিছুই বুঝল না।কিসব জায়গা কেনার কথা লেখা।এই কাগজে তনুর কেন সিগনেচার লাগবে সেটাই বুঝল না।

মিশকাত ইশারায় মারুফকে বলতে বলল।

“মিশকাতের এনআইডি হারিয়ে গেছে।এই কাজটা না হলে সমস্যা হয়ে যাবে।আজকেই করতে হবে তাই তোকে ভার্সিটিতে পেয়ে নিয়ে এসেছি আমি।মিশকাত জানত না।ও তো আমার এনআইডি কার্ড নেয়ার জন্য এসেছে।আমি আনতে ভুলে গেছি।এত না ভেবে সিগনেচারটা করে দে।”

তনুর এবার সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কি সব কথা? এনআইডি কার্ড হারিয়ে ফেলেছে তাই তনুকে লাগবে।কেমন জোড়াতালি কথাবার্তা!
সে আবার পরলো ভালো ভাবে কাগজটা।তাই দেখে মিশকাত বলল,

“কি ভাবছিস তোর থেকে সম্পত্তির দলিলের সই করিয়ে নিচ্ছি?”

“আজব তো ,কখন বললাম সে কথা?মিশকাত ভাই তুমি একটু সুন্দর করে কথা বলতে শেখো তা না পারলে আবার স্কুলে ভর্তি হও।”

তনু রেগে ব্যাগ থেকে কলম বের করে দ্রুত সাইন করে দিলো।মিশকাত মারুফ দুজনেই লুকিয়ে হাসলো।তনু টেবিলে কাগজটা রেখে কড়া চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। মারুফ খাবার রেখে দৌড়ে পিছু নিলো।

***
“আয়রা তনয়ার বিষয়ে যা শুনলাম সেটা সত্যি? ”

“আমরা মিথ্যা বলব কেন?”

“আরে বাবা,রেগে যাচ্ছ কেন?আমি শুধু জানতে চাইলাম।আমার তনয়ারর জন্য খুব খারাপ লাগছে।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ”

আয়রা চুপ করে রইলো।তনুর জন্য সবসময় খারাপ লাগে।তার বিয়ের পর থেকে একবারই যা এসেছে তনু।এখন নিশ্চয়ই আসতে চাইবে না?
রাফাত আয়রাকে দুহাত মেলে আগলে ধরে বলল,

“পাগলি,মন খারাপ কেন করছো?এই সাধারণ ব্যপারটা তোমরা এতো অস্বাভাবিক করে কেন তুলছো বলতো?”

“মানে? ”

“দেখ ,এটা খুব সাধারণ বিষয়।মানুষের হাতে তো কিছু নেই।সৃষ্টিকর্তা কখন কাকে সন্তান দান করেন সেটা কি কেউ বলতে পারে?তাই আমার কাছে এটা খুব সাধারণ বিষয় মনে হয়।”মা” হতে পারবে না এভাবে কথাটা বলা ঠিক না।জন্ম দিলেই কি মা হওয়া যায়, বলো?আমরা শুধু বুঝি সন্তান জন্ম দিলাম তো মা হলাম।এমনটা নয়,এটা শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যপার।আমরা গভীর ভাবে ভেবে দেখি না।যা আমাদের সমাজে প্রচলিত তাই আমরা নির্দ্বিধায় মেনে চলি।সেটা কতটুকু সঠিক এটা ভাবতে চাই না।ধরো,হসপিটালে তোমার জন্ম দেয়া সন্তানটা কোনো ভাবে পাল্টে গেল!তুমি বুঝতেই পারলে না।অন্যের সন্তানকে তোমার নিজের সন্তান ভেবে অজান্তেই তাকে লালন পালন করলে,মমতা দিলে,ভালোবাসলে।তুমি ভেবেছ সেটা তোমার নিজের সন্তান অথচ সে তোমার রক্তের নয়!”

রাফাত থামলো।আয়রার দিকে তাকিয়ে দেখলো আয়রা উৎসুক হয়ে শুনছে।সে আবার বলল,

“কখনো যদি জানতে পারো তোমার সে সন্তান ছিল না তাহলে কি তুমি সেই সন্তানকে ভুলে যাবে, ভালোবাসবে না?”

“সেটা সম্ভব নয়।এতদিন ধরে যাকে নিজের সন্তান ভেবে মানুষ করেছি তাকে কি করে ভুলব?”

“ঠিক এটাই হলো কথা।সেটা যদি হয় তবেই তুমি “মা”।আমাদের মানসিকতাই এমন হয়ে গেছে যে নিজের বলতে আমরা শুধু আপনজনদের বুঝি?অথচ সেই সন্তান একসময় বৃদ্ধ বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। তবু আমরা নিজেদের পরিবর্তন করতে পারি না।নিজের ঔরসজাত সন্তানই চাই।অথচ কত এতিম বাচ্চাদের কি নির্মম পরিনতি রাস্তাঘাটে কত টোকাই!এসব কি থাকতো?পৃথিবীর সব সন্তানই যার কাছে সন্তান সেই তো”মা”।

আয়রার চোখে পানি এসে গেছে।সবটাই সত্যি কথা কিন্তু সমাজ তো পরিবর্তন হতে চায় না?কখনো কি কেউ দেখেছে একজন মা তার ধর্ষক ছেলেকে নিজে আইনের হাতে তুলে দিয়েছে?সে মা হবার আগে একজন নারী এটা নিজের সন্তানের জন্য ভুলে যায়।মাতৃস্নেহ হবে নির্মল কোমল পবিত্র! সেটা অন্ধস্নেহ কেন হবে?

আয়রা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাফাতকে।এই মানুষটা এত ভালো কেন?

বিকেল বেলা আয়রাকে অবাক করে দিয়ে তনু এসেছে। সাথে মায়ের বানিয়ে দেয়া কয়েক ধরণের পিঠে নিয়ে।আয়রার খুশি দেখে কে?সন্ধ্যায় রাফাত অফিস থেকে ফিরে ওদের নিয়ে ডিনারে গেল।রাতে খেয়ে একটু ঘোরাঘুরি করে ফিরে এসে দেখল আরাফ এসেছে।তনু এসেছে জানতে পেরেছে আয়রার শ্বাশুড়ির থেকে।

তনু আরাফকে দেখে খুব বিরক্ত হলেও হাসি মুখে বলল,কেমন আছেন আপনি?

“ভালো আর রাখলে কই?”

“আরাফ ভাইয়া আমি আপার শ্বশুর বাড়ি এসেছি।নিজের কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসিনি।প্লিজ ওসব বিষয়ে কথা বলতে আসবেন না?আপনি আমার বোনের আত্মীয় তাই আমি সৌজন্যতার খাতিরে জানতে চাইলাম কেমন আছেন।আর আপনি কি উত্তর দিলেন?”

আরাফ লজ্জা পেল সত্যি সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে নাই।হুটহাট কি বলে ফেলল।নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

আ’ম স্যরি, তনয়া।আমি তোমার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই?

তনয়া একবার রাফাতের দিকে তাকালো।রাফাত ইশরায় তনুকে আশ্বস্ত করে বলল,

“আরাফ তনুর বাবা স্পষ্ট সবকিছু বলেছেন।খালাও তার মতামত জানিয়ে দিয়েছে।এ নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো।তোর যদি কথা বলতে হয় সেটা তনয়াদের বাড়িতে গিয়ে বলিস।ও বোনের কাছে এসেছে এসব কথা বলে ওর মনটা নষ্ট করে দিস না।”

রাফাতের কথা শুনে অবাক হলো আরাফ।রাফাত এভাবে বলতে পারলো?সে ভেবেছিল সবার সাহায্য নিয়ে তনুকে বোঝাবে তাই তো এখানে আসা।উল্টো রাফাত খালা সবাই মানা করছে!তনয়াকে যে সে কতটা ভালোবেসেছে তা কেউ বুঝতেই চাইছে না?

আরাফ উঠে দাঁড়ালো। এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।কিন্ত তনু বাঁধা দিয়ে বলল,আপনি চলে গেলে আমার সত্যি আরও বেশি খারাপ লাগবে।মনে হবে আমার জন্যই আপনি চলে গেলেন। এসেছেন যখন সাবই মিলেই থাকি।গল্প করবো আড্ডা দেয়া যাবে রাতে।

আরাফ তো অবাক।খুশিতে পারলে লাফিয়ে উঠে।রাফাত শুধু হাসলো।তনয়াকে এই জন্যই খুব ভালো লাগে।তনয়া অন্য রকম।এদের দুবোনই যেন দুটো কোহিনূর!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here