স্নিগ্ধ_চাহনি #সূচনা_পর্ব

0
2201

#স্নিগ্ধ_চাহনি
#সূচনা_পর্ব
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

কাজি অফিসের বাহিরে প্রায় পাঁচঘণ্টা ধরে অপেক্ষারত অবস্থায় বসে আছে মৃন্ময়ী। গায়ে জড়ানো টকটকে লাল রঙের জামদানী শাড়ি। কাজল কালো চোখ দুটোতে হাজারো ভয়, আশংকা আর বিষন্নতার ছড়াছড়ি। সময় চলছে নিজের গতিতে। তবে মৃন্ময়ী মূর্তির ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে পুরনো এই কাঠের বেঞ্চিটাতে। ঠিক যেন এক প্রানহীন মাটির পুতুল বসে আছে। এই প্রানহীন পুতুলটাকে একটু চমকে দিয়ে এখনও উপস্থিত হলো না তার কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার মানুষটি। এখনো পর্যন্ত কেউ এসে বলল না “মৃনু তাড়াতাড়ি চলো আমাদের বিয়ের সময় চলে যাচ্ছে।” দু’দিন আগেই দীঘির পাড়ে তার দু’হাত আঁকড়ে ধরে বেশ আকুতি মিনতি করে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছিল আফনান। ভীষণ ভীষণ ভীষণ আবেগি কন্ঠে বলেছিল-

‘শোন না মৃনু!! চল আমরা এখন বিয়েটা করে ফেলি৷ পরে না হয় সময় বুঝে আমি আম্মুকে জানিয়ে দিবো। তোমাকে নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমার ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। একবার আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলে তোমাকে হারানোর ভয় থাকবে না আমার। প্লিজ মৃনু রাজি হয়ে যাও।’

মৃন্ময়ী এভাবে বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষের জোড়াজুড়িতে বিয়ের জন্য রাজি হতে বাধ্য হয়৷ কিন্তু এখন কেন আসছে না আফনান! তাকে লাল শাড়িতে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আফনানের তাহলে কেন এখনও উপস্থিত হলো না এখানে!
কথা গুলো ভেবেই ঝাপসা হয়ে এলো মৃন্ময়ীর দৃষ্টি। অসহ্য ব্যথায় বুকের ভেতরটা বিষিয়ে উঠলো। সারা গায়ে যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে এই অপেক্ষা নামক বি’ষের য’ন্ত্রণা।।

‘মা গো! সেই কহন থেইক্কা দেখতাছি তুমি এহানো বইসা রইছো। আর কত অপেক্ষা করবা মা? মানুষটা আসার হইলে সে কহন-ই আইসা পরতো। রাত্র হইয়া যাইতাছে এইবার তুমি বাড়ি যাও মা। এতো রাইতে বাইরে থাকা ঠিক হইবো না।’

মৃন্ময়ী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকালো মানুষটার দিকে। বেঞ্চির অপর কোণে বেশখানিকটা দূরত্ব নিয়ে বসে আছেন সফুরা বেগম। খুব সুন্দর, মায়াবী ক্লান্ত একটা মুখ। পাঁক ধরানো উশখুশ চুল। গায়ে জড়ানো ধুলো বালিতে মাখা ময়লা সুতি কাপড়। পায়ের কাছে রাখা বাশের তৈরি একটা খালি ঝুড়ি। মৃন্ময়ী যখন এসেছিলো তখন এই ঝুড়ি ভর্তি ছিল তাজা ফুলের মালা৷ মালা গুলো বিক্রি হয়ে ঝুড়িটা খালি হয়ে গেছে, অথচ মৃন্ময়ীর অপেক্ষার প্রহর গুনা এখনও শেষ হলো না। সফুরা বেগম মৃন্ময়ীর কাছে এসে মাথায় আলতো করে হাত রেখে আবারও বললেন-

“কষ্ট পাইও না মা। ভাগ্যে যা আছিলো তা-ই হইছে। মানুষটা মনে হয় তোমার কপালে আছিলো না।”

মৃন্ময়ী স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। কেন যেন মনে হচ্ছে মহিলাটার মধ্যে মাতৃভাব অন্ত্যত প্রবল৷ কিছু মানুষ থাকে যাদের এক নজর দেখলেই খুব কাছের মনে হয়। এনাকেও তাই মনে হচ্ছে। মৃন্ময়ী কোনো সংকোচ ছাড়াই হুট করে ওনাকে জড়িয়ে ধরলো। সফুরা বেগম প্রচন্ডরকম অবাক হলেন। হয়তো নিজের পেশা আর ধুলোবালিতে মাখা এই ময়লা শরীরটাই হলো তার সংকোচিত হওয়ার কারণ। মৃন্ময়ীর শরীর থেমে থেমে কেঁপে উঠছে। নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সকল কষ্ট চোখের পানিতে বিসর্জিত হচ্ছে। তিনি পরম মমতায় মৃন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। খানিকটা সময় পর মৃন্ময়ী শান্ত হয়। হাতের উল্টো পিঠে চোখেরজল মুছে সোজা হয়ে বসে। অশ্রুসিক্ত চোখে সফুরা বেগমের দিকে চেয়ে একটা নির্মল হাসি দিয়ে বলল-

‘আমি তোমাকে মা ডাকি! আমি আমার মা’কে কখনো দেখিনি। উনি থাকলেও হয়তো আমাকে এভাবে তোমার মতো আগলে রাখতেন৷’

মৃন্ময়ীর আবদার শুনে তার দুচোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠলো। যেন খুব সাধনার পর কিছু একটা পেয়েছেন। তিনি জড়ানো কন্ঠে বললেন-

‘খুব শখ আছিলো একটা সন্তানের কিন্তু কি করার আল্লাহ হয়তো চায় না আমগো পোলাপান। আইজ তোমার মতো এমন পবিত্র একটা মাইয়া দিয়া আল্লাহ আমার শখ পূরণ কইরা দিছে।’

মৃন্ময়ী ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো৷ ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া ভগ্নহৃদয়ের ব্যথা খানিকটা সময়ের জন্য ভুলে এখন মায়ের মমতা আর ভালোবাসায় সিক্ত হলো মৃন্ময়ী।

রাত প্রায় সাড়ে আটটা। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট এই সময় ভীষণ ব্যস্ত থাকে। মুগ্ধ তপ্ত শ্বাস ফেলে। বা হাত উঁচু করে ঘড়িতে টাইম দেখলো৷ প্রায় দশ মিনিট ধরে গাড়িটা ঠিক এই জায়গাতেই সুপার গ্লু’র মতো আটকে আছে। চরম বিরক্তিতে ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুঞ্চিত করে বাহিরে তাকালো। চারপাশের হর্নের তীব্র আওয়াজে মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে মগজ গুলো লাফালাফি করছে। আচমকাই তার অস্থির, ক্লান্ত চোখ দুটো ডান পাশের খানিকটা দূরের একটা রিকশায় স্থির হলো। সোডিয়ামের আলোয় রিকশায় বসে থাকা এক তরুণীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুগ্ধর দৃষ্টি মায়া কাড়া সেই মায়াবিনীর চেহারাতেই আটকে আছে। লাল শাড়ি পড়া, হাত খোপা করা এলোমেলো চুল। অদ্ভুত কারণে তার গাল দুটো চিকচিক করছে। খুব সম্ভবত চোখের পানি। সোডিয়ামের উজ্জ্বল আলোয় চোখের পানি গুলো যেন মুক্তোর মতো ঝলঝল করে জ্বলে উঠেছে।

মৃন্ময়ী রিকশা থেকে নেমে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট রিকশাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিল। বৃদ্ধলোক টাকা হাতে না নিয়ে বিনয়ের ভঙ্গিতে বললেন-

‘আপা আরেকটু অপেক্ষা করতেন! এহনি মনে হয় জাম ছুইট্টা যাইবো।’

‘অনেক দেরি হয়ে গেছে দাদু। তুমি টাকাটা রাখো।’

বৃদ্ধলোকটা টাকা হাতে নিলেন। বাড়তি টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পকেট থেকে টাকা বের করতেই মৃন্ময়ী বলল-

‘টাকা দিতে হবে না, তুমি রাখো পুরোটা। অনেকক্ষন ধরেই তো জ্যামে বসে আছো। ওটা তোমার পাওনা।’

বৃদ্ধলোক মৃন্ময়ীর কথা বলার ভঙ্গিতে মোহিত হলেন। আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন-

‘একলা যাইতে পারবা তো দাদুমনি! ওইদিকের রাস্তাটা কিন্তু নির্জন।’

মৃন্ময়ী অদ্ভুত রকমের এক হাসি দিয়ে বলল-

‘পৃথিবীতে সবাইকে একাই চলতে হয় দাদু। ভালো থেকো।’

মৃন্ময়ী চলে গেল। মুগ্ধ এতক্ষণ যাবত পুরো বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। হর্নের শব্দে কথা গুলো শুনতে না পারলেও মৃন্ময়ীর কথা বলার ভঙ্গিতে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। মৃন্ময়ী চলে যেতেই খানিকটা অস্থির হয়ে পরে সে। গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল-

‘জ্যামে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। আমি হেঁটেই যাচ্ছি।’

মুগ্ধ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করল। উদ্দেশ্য সেই মায়াবতী তরুণীকে দেখা। অজানা কারণেই মেয়েটার চোখেরজল দেখে মুগ্ধ’র মাঝে বেশ কৌতুহল জেগেছে। কিন্তু মেয়েটার দেখা পাওয়া গেল না। হয়তো অন্য কোনো গলিতে ডুকে পরেছে।

নির্জন পিচঢালা রাস্তা৷ খানিকটা দূর দূর ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলছে। রাত বাতির নিয়ন আলোয় রাস্তাটা পুরোপুরি আলোকিত না হলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আশপাশ। এই নির্জন গলি দিয়ে মৃন্ময়ী আগে কখনও রাতেরবেলা আসেনি। সব সময় মেইন রাস্তা দিয়েই আসা-যাওয়া করেছে। কিন্তু আজ হেঁটে আসার জন্য এই শর্টকাট রাস্তা দিয়ে আসা। কিছুটা পথ যেতেই এক লোক মৃন্ময়ীর পথ আটকে দাঁড়ালো। দেখতে পেটুক টাইপের। খাটো করে মধ্যবয়সী লোক। কুচকুচে কালো বর্নের চেহারায় বিদঘুটে বিশ্রী হাসি।

‘এক রাতের জন্য নিবা সুন্দরী?’

মৃন্ময়ী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। তার মস্তিষ্ক এই কথাটা বুঝতে কিছুটা সময় নিচ্ছে। এমন বিশ্রী কথাটার মানে বুঝতেই তার গাঁ গুলিয়ে আসলো। ঘৃণার চোখে লোকটার দিকে চেয়ে আছে। মুখ ফুটে কিছু তিক্ত কথা বলার আগে-ই পেছন থেকে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসল।

‘শরীরের তৃষ্ণা মেটাতে চাইলে নি’ষিদ্ধ পল্লিতে যান। কিন্তু দয়া করে রাস্তাঘাটে ঘুরবেন না। এখানে সবাই আপনার মতো ক্ষুধার্ত অবস্থায় আসে না।’

লোকটা ভড়কে উঠল-

‘আপনে আপনের রাস্তায় যান। এত জ্ঞান দিতে আহেন কে?’

মুগ্ধ লোকটার কথা গাঁয়ে মাখালো না। মৃন্ময়ীর দিকে চেয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল-

‘বউ! তুমি একা একাই এসে পরলে কেন? রিকশা ভাড়া দিতে দেরি হচ্ছিল তাই বলে একটু অপেক্ষা করতে পারলে আমার জন্য!’

মৃন্ময়ী অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ সেই চাহনিকে উপেক্ষা করে লোকটার দিকে হাসি মুখে তাকালো। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ধরে রেখেই কঠিন গলায় বলল-

‘যাবেন না-কি পুলিশকে ফোন করতে হবে! আর হ্যাঁ এই রাস্তায় যেন নেক্সট টাইম আপনাকে না দেখি।’

লোকটা ভয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল পাশের চিপা গলিতে। মুগ্ধ তাকালো মৃন্ময়ীর দিকে। স্বাভাবিক লাগছে মেয়েটাকে। এই মুহূর্তে অন্য কোনো মেয়ে হলে ভীষণ উত্তেজিত দেখাতো। কিন্তু এই মেয়েটার ভাবভঙ্গিতে তেমন কোনো কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। মৃন্ময়ী দৃষ্টি নামিয়ে রেখেই কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে ছোট করে বলল-

‘থ্যাঙ্কিউ।’

মৃন্ময়ী পেছনের রাস্তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে মুগ্ধ নিজেও পেছনে তাকাল। কোনো কিছু দেখতে না পেয়ে সামনে তাকাতেই দেখল মৃন্ময়ী হাঁটা শুরু করেছে। মুগ্ধ ভীষণ অবাক হলো। অচেনা একটা ছেলে তাকে বাঁচিয়েছে এমনকি বউ বলে পরিচয়ও দিয়েছে। অথচ মেয়েটার মধ্যে বিন্দুমাত্র কৌতুহল কিংবা বিস্ময় দেখা যাচ্ছে না!! অদ্ভুত, ভীষণ অদ্ভুত। মুগ্ধ কিছুক্ষন অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে পেছন পেছন হাঁটা শুরু করল। এক পর্যায়ে তারা দু’জন পাশাপাশি চলে আসে। দুজনেই চুপচাপ হাঁটছে। কিছুটা পথ হাঁটার পর মুগ্ধ আপনমনেই বিড়বিড় করে বলে উঠে-

‘সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত এই অন্ধকার শহরের আলোর আভা পড়ছে তোমার গায়,
শূন্য মনের অনুভূতি গুলো ভাসছে তোমার ওই সিক্তচোক্ষু দুটায়।’

‘জ্বি! কি বললেন?’

মৃন্ময়ী কপাল কুচকে সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করে। মুগ্ধ অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে মাথা চুলকে বলল-

‘তেমন কিছু না। আসলে আইস ব্রেক করার চেষ্টা করছি।’

‘ওহহ..’

মৃন্ময়ীর মধ্যে কথা বলার কোনো আগ্রহ না দেখে মুগ্ধ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। ভদ্রতার সঙ্গে প্রশ্ন করে-

‘আপনার নাম কি মিস?’

‘মৃন্ময়ী’

মৃন্ময়ী সামনের দিকে তাকিয়েই নির্লিপ্ত কণ্ঠে নিজের নাম বলল। মৃন্ময়ী দেখতে পায়নি তার সাথের মানুষটার চমকে ওঠা। হঠাৎ করেই মুগ্ধর থমকে যাওয়া। বিস্ময়ে ঝলঝল করে ওঠা মুগ্ধ’র চোখ দুটো। দেখতে পায়নি কোনো কিছুই।

চলবে..??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here