আষাঢ় নামে সন্ধ্যে খামে-১

0
1191

আষাঢ় নামে সন্ধ্যে খামে-১
ইলমা বেহরোজ

আমিরাহ টেবিল ক্লিন করে রুমে আসে।বিছানার দিকে তাকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।নিজের জীবনটাকে তাঁর ব্যর্থ সাদা খাতা মনে হচ্ছে।যে খাতার নিষ্প্রাণ পাতা হৃদয়।হৃদয়টা যদি কেটে কুচিকুচি করা যেতো তবে সে তাই করতো।রাত এগারোটা বাজে এখনো রওশান বাড়ি ফেরেনি।নিস্তব্ধতায় চারপাশ হাহাকার করছে যেন!এমন নিস্তব্ধতা কখনো তাঁর সংসারে আসবে সে ভাবেনি।রাজিয়া সুলতানা রুম থেকে আওয়াজ করে, রাণী, রাণী ডাক পাড়াতে আমিরাহর চারপাশের নিস্তব্ধতা মুহূর্তে ভেঙ্গে যায়।রাণী বলে যখন রাজিয়া প্রথম ডাকতেন আমিরাহ বেশ বিরক্ত হতো।এরপর অবশ্য ভালো লেগেছিল।কিন্তু কাল থেকে কী আর এই সংসারের রাণী সে থাকবে?আমিরাহ ধীর পায়ে রাজিয়ার রুমে আসে।রাজিয়া আমিরাহকে রুমে ঢুকতে দেখে বলেন,
— “পোলায় এখনো ফিরে নাই?”
শ্বশুর শফিউল্লাহ দু’হাত বুকে ভাঁজ করে রেখে ঘুমাচ্ছেন।আমিরাহ শফিউল্লাহর গায়ে কাঁথা টেনে দিতে দিতে রাজিয়ার জবাব দেয় শান্তকন্ঠে,
— “আসলে তোমার কাছেই আগে আসবে আম্মা।”
রাজিয়া আমিরাহর থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকান।বুক ছিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ছয় মাসে সংসারটা কেমন পাল্টে গেছে। তিনি মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করেন,
— “তোদের মধ্যে কি সমস্যা হইছে জানি না। যা ই হোক, আমার অনুরোধ রইলো দুজন মিলেমিশে সমস্যা মিটমাট করে নে।ডিভোর্সের কি প্রয়োজন?”
আমিরাহ রাজিয়ার কথা অগ্রাহ্য করে বললো,
— “রাত বারোটা বাজে। ঘুমিয়ে পড়ো।ফজরে নামায পড়তে উঠতে হবে।বাতি নিভিয়ে দিয়ে যাবো?”
রাজিয়া অসন্তুষ্ট হোন।তিনি বুঝতে পারেন আমিরাহ আর এইসব নিয়ে কথা বলতে চাইছে না। তাই তিনি আর কথা বাড়ান না। চুপচাপ শুয়ে পড়েন।আমিরাহ বাতি নিভিয়ে বেরিয়ে যায়।রাজিয়ার চোখের কার্ণিশ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। তখনি কেউ একজন এসে জড়িয়ে ধরে।রাজিয়া স্পর্শটা চিনতে পারেন।আমিরাহ! আমিরাহ ধরা গলায় বললো,
— “ডিভোর্স হলেও তোমার সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে আম্মা।আমাদের সম্পর্কটা যে আত্মার।”
রাজিয়া টের পান, বুকের ভারটা ম্যাজিকের মতো নাই হয়ে গেছে।স্বস্তির হাওয়া ঢুকে গেছে বুকের ফাঁক ফোঁকর গেলে।তবুও অভিমান নিয়ে বলেন,
— “তুই ছাড়া এই সংসার মৃত্যুপুরী। থাকবো না এখানে।সাথে নিয়ে চল।পোলা একাই থাকুক।”
— ” ও তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবে না। ছেলেটা তো তোমার। থাকো না।আমি কয়দিন পর পর তোমার সাথে কোথাও একটা দেখা করবো।”
রাজিয়া বিপন্ন গলায় বলেন,
— “তবুও….
— ” আর কথা না আম্মা।আল্লাহ যা লিখেছেন তাই হবে।”
রাজিয়া আমিরাহর কপালে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলেন,
— “রাত জাগিস না।ঘুমাবি কিন্তু।”
— “আচ্ছা আম্মা।”

আমিরাহ রুমে এসে বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে।চাপা কান্না।ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে, রাত একটার।বিছানায় শুয়ে আমিরাহ বুঝতে পারলো তার মাথাটা ধরেছে।চোখ দুটিও জ্বলছে ভীষন, ভীষণ ভাবে। জ্বর আসতে পারে।বুকের ভেতর দলা পাকানো কষ্ট পাথরের মতো ভারী হয়ে চেপে বসে আছে। পাথরটার ওজন কত হবে? পরিমাপ করা যাবেনা বোধহয়। অনেক…..অনেক ওজন।
বাচ্চা বয়স থেকে প্রেম দুজনের।তেরো বছরের প্রেম!তিন বছরের সংসার।ষোল বছর পর দুজনের মনে হলো কেউ কারোর নয়!দুজন দু’টি আলাদা আলাদা ব্যক্তি। যাদের পথ আলাদা, চয়েজ আলাদা। সত্যিই কি সব আলাদা ছিল? নাকি হুট করে হলো।নাহ,আমিরাহর একদম ইচ্ছে করেনা এসব প্রশ্নের উত্তর হন্ন হয়ে খুঁজতে।

সে স্টাডি রুমে চলে আসে উপন্যাস লিখার জন্য। বইমেলা আসার বাকি আর মাত্র পাঁচ মাস।এখনো উপন্যাসটির এক অংশ ও শেষ হয়নি।কত-শত পাঠক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমিরাহ সিদ্দিকার নতুন উপন্যাস পড়ার জন্য। এতো মানুষের মন ভাঙ্গার সাহস তার নেই। জনপ্রিয় একজন লেখিকা হিসেবে লেখালেখি তাকে চালিয়ে যেতেই হবে।ব্যক্তিগত জীবনে যাই হয়ে যাক। ল্যাপটপ নিয়ে বসতেই কলিং বেল বেজে উঠলো।রওশান এসেছে! আমিরাহর ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে দরজা খুলে মানুষটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।এতদিন তো তাই হয়ে এসেছে।কিন্তু জেদ, ইগো আটকে দিলো।আরো বার কয়েক কলিং বেল বাজে।আমিরাহ চুপ করে শুধু শুনে।

ঘুমু ঘুমু চোখ নিয়ে দুলে দুলে আসে চুমকি।কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়াতে কপালে তার বিরক্তির ছাপ।দরজা খুলে রওশানকে দেখে বিরক্তির ছাপ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে।
— “ভাইজান আপনের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছেনা।খুইলা ঢুইকা পড়তেন।হুদাই ঘুমডা ভাঙ্গাইলেন।”

রওশান জবাবে মৃদু হাসে।অবাধ্য চোখ দু’টি এদিক-ওদিক তাকিয়ে কেউ একজনকে খুঁজে।এতোবার কলিং বেল বাজানোর কারণটা কি মেয়েটা ধরতে পারেনি?রওশান দরজা লাগিয়ে রুমে আসে।রুমেও নেই!সে সেকেন্ড কয়েক দাঁড়িয়ে থাকে ঝিম মেরে।কিছু একটা ভাবে।এরপর ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে।ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়।ঘুমে চোখ দু’টি জ্বালা করছে।পাঁচ মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে পড়ে।হারিয়ে যায় অন্য এক জগতে।সেই মুহূর্তে রুমে ঢুকে আমিরাহ।রওশান কে ঘুমাতে দেখে ঠোঁটে ফুটে উঠে ম্লান হাসি। বিয়ের পর তোমাকে বুকে না নিয়ে একদিন ও ঘুমাবোনা, বলা মানুষটা তার মুখ অব্দি দর্শন না করেই কত আরামে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মানুষ কত কথাই বলে!করে কয়টা?

আমিরাহ ঘুরে দাঁড়ায় রুম থেকে বেরিয়ে যেতে।আবার ফিরে তাকায়।অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাঁথাটা টেনে দেয় রওশনের গায়ে।এরপর বাতি নিভিয়ে স্থান ত্যাগ করে।আজ সারারাত সে জাগবে।বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াবে।আগামীকাল তার বিদায়!তার জায়গাটা দখল করবে অন্য কেউ।আমিরাহ বিড়বিড় করে,
— “অন্যকেউ!”
অন্যকেউ শব্দটা মস্তিষ্কে আসতেই মন পাহাড়ে বজ্রপাত শুরু হয়।
অসহনীয় কষ্ট অনুভব হয়।আমিরাহ ব্যস্ত পায়ে দ্রুত ছাদে আসে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here