হাই সোসাইটির ললিতা-৮,৯

0
446

হাই সোসাইটির ললিতা-৮,৯
লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম
০৮

কয়েকদিন যাবৎ লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা করতে হচ্ছে ঋষির সাথে। হোটেলে সময় কাটানো যাচ্ছে না ঠিকমতো। বেশ চিন্তিত হচ্ছি এ নিয়ে। কারণ মাঝে একদিন শান্তনু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, আমাকে অফিসে টাইম মতো পাওয়া যায় না। আবার না কি কেউ একজন দেখেছে আমাকে স্টার হোটেলের আশেপাশে। কথাগুলো কোনদিকে ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। যদি-ও প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম ভালোভাবেই। তবে শান্তনুর স্বানুভাব আমাকে ভীত করেছিল খানিক। নজরদারিতে পড়তে হবে যে সমুখে’ই টের পাচ্ছিলাম মনে মনে। শান্তনু যে আমাকে একটু হলেও সন্দেহের কাতারে ফেলেছে বোঝা হয়ে গিয়েছিল, তার চিৎকার-চেঁচাম্যাচি না করাতে। সতর্কতার সহিত আপাতত দেখাদেখি বন্ধ রাখতে বললাম ঋষিকে। কিন্তু সে তো নাছোড়বান্দার মতো হয়ে পড়ছে৷ আমাকে না পেলে তার শান্তি নেই যা দেখা যায় তার কাজকর্মের মধ্যে। কারণ হুটহাট ফোন করে হুমকি-ধমকির মাধ্যমে দেখাসাক্ষাৎ করতে বলে। আমার-ও একই হাল তবে বুঝে চলতে হবে তো। ওপেনলি রিলেশন করে চলাফেরা যেত, যদি না আমি মজুমদার পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারের বউ হতাম। আমার সাথে মানসম্মানের বিষয় জড়িত বলেই না এতশত কলাকৌশলে নজরবন্দির প্রয়োগ করা। নাহলে তো কাল সংবাদপত্রের ফ্রন্ট পেজে বড়ো করে ছাপবে, “মজুমদার পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকার শান্তনু মজুমদারের সহধর্মিণীকে হোটেলে অন্য ছেলের হাত ধরে যেতে দেখা গিয়েছে”। সাংবাদিকদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তাঁদের কাজই গরমাগরম মশলা দিয়ে খবর পেশ করা। শেষে আম-ছাল দু’টোই যাবে।
_______

” তুমি আসবে না কি আমি ভেতরে যাব?”

“আবারও, আবারও পাগলামি শুরু করছ?”

“তাহলে কী করব? আজ একসপ্তাহ হচ্ছে, তোমাকে কাছে পাচ্ছি না, তোমার শরীরের ঘ্রাণ নেওয়া হচ্ছে না। কতোটা অভুক্ত করে রেখেছ তুমি আমায়!”

“দেখ ঋষি, আমি কোন ঝামেলায় আছি আমি-ই বুঝি। তুমি বুঝবে কী করে? বোঝালেও তো বুঝতে চাও না। প্রথম প্রথম তো দেখা করতে পারতাম। জানোই তো, এখন শান্তনুর কড়া নজরে বন্দি।”

“জানি বলেই তো নিজেকে একটা সপ্তাহ আঁটকে রেখেছি। নিজেকে কতো কষ্টে কন্ট্রোল করতে হচ্ছে ভেবে দেখেছ? কিছুই জানি না আজ দেখা করবে। শেষ কথা।”

কল কেটে দিলো। ঋষি যে একরোখা, জেদি, ঘাড়ত্যাড়া সেটা আমার জানা। আজ তার সাথে দেখা না করলে নির্ঘাত কোনো ঝামেলা পাকাবে ছেলেটা। উফ মুসিবত! নানাবিধ চিন্তাকুলিত অবস্থার মধ্য দিয়ে দরজায় টোকার শব্দ পেলাম। আজ ছুটির দিন রবিবার। বাড়িতেই আছি। আর এটাই বড়ো জটিলতার কারণ। অফিস থেকে কিছু একটা বাহান দিয়ে যাওয়া যায়। সারা সপ্তাহ একদিন ছুটি থাকে। তাও যদি বাড়িতে সময় না দেই, তাহলে তো আরো তুলকালাম বাঁধবে।

“ম্যাম, ম্যাম আছেন?”

“কী হয়েছে মনি?”

“ম্যাম, আপনার শ্বাশুড়ি মা কেমন জানি করছে!”

“কী কেমন করছে? বুঝতে পারছি না। আর তুমি সায়ন্তিকাকে রেখে এসেছ কেন?”

“আমি তো বড়ো ম্যাডামকে সকালের খাবারের পরের ওষুধ দিতে গিয়েছিলাম। তখনই দেখি তিনি শ্বাস নেওয়ার জন্য রীতিমতো হাঁসফাঁস শুরু করে দিয়েছেন।”

এরে আবার কোন ফ্যাসাদ শুরু হলো! আমার লাইফটা হেল করে ছাড়ল এই মা-ছেলে মিলে। সায়ন্তিকার জন্য রাখা ন্যানি মনি মাঝেমধ্যে আমার শ্বাশুড়িকে ওষুধ দেয়, খেয়াল রাখে। মেয়েটা বড়োই কাজের, সাথে অকাজেরও। যেমন, আজ-ই শ্বাশুড়ির অসুস্থতার খবর দিতে হলো তাকে!সিরিয়াসলি রিডিকিউলাস! ঋষির সাথে দেখা করার কথা চিন্তাভাবনা করছিলাম। রাগে-দুঃখে ফ্লোরে পা দিয়ে আঘাত করে দেখতে গেলাম শ্বাশুড়ি বেঁচে আছে না কি মরেছে!
______

“দুঃখিত মিসেস মজুমদার। সি ইজ নো মোর।”

“হোয়াট!”

চিৎকারটা সম্ভবত বেশ জোরেসোরে হয়ে গেছে৷ আশেপাশের সবাই আমার দিকে তাক করে আছে তাদের তীক্ষ্ণ নজর।

“আমার মা ছিলেন তিনি। আ..আমি আমার মা হারিয়েছি বুঝলেন। মা…”

কান্নার স্বরে কথায় নাটকীয়তা আনতে বেশ ভালো আমি। নিশ্বাস নেওয়ার প্রচেষ্টায় বাকি শব্দগুলো যোগ না করে বিয়োগান্তে রাখলাম। ডাক্তার যথারীতি আমাকে স্বান্তনার বাণী শুনিয়ে চলে গেলেন। হাহ্! চলে গিয়ে ঝঞ্ঝাট কমিয়ে দিয়ে গেছেন। হিসেবের খাতা থেকে একটা অংকের সমাধান মিটে গেল। মুক্তির ঠিকানায় যোগান্তে আরেক ধাপে এগিয়ে আমি।
______

চলবে…

লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম

হাই সোসাইটির ললিতা |৯|

ভড়কানো দৃষ্টি নিয়ে চমকে-থমকে দাঁড়িয়ে আমি৷ সমুখে রাখা শ্বাশুড়ির ছবি। তাতে মালা পরানো। সদ্য গত হওয়া শ্বাশুড়ির শ্রাদ্ধে উপচে পড়া ভিড় ছিল। যেটা আপাতত ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে তাঁর ছবির সমুখে তিনজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। একপাশে আমি আর শান্তনু, অপরপাশে দু-হাত জড়ো করে ঋষি দাঁড়িয়ে। দিনদুনিয়া আমার দুলতে শুরু করল যখন ঋষি আমার দৃষ্টিতে গোচরীভূত হলো। দূর থেকে ঋষি আমার বিস্ময় নিয়ে আঁতকে হতভম্ব হওয়া ভাব-গতিক পরখ করে বাঁকা হাসল। পরনে তার সাদা ধূতি-পাঞ্জাবি। বলিষ্ঠ দেহের পেশিবহুল বাহুতে আঁটসাঁট করে আঁটকে পোশাকের ওপর দিয়ে সিক্স প্যাক সাদৃশ্যমান। ইশারায় বুঝাচ্ছে, কথা বলার জন্য যেতে। আমি মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে না বোধক বুঝাতে লাগলাম। হঠাৎ করে সেদিক থেকে ধ্যান-খেয়াল সরে গেল অফিসের কাজে জড়িত ক্ল্যায়েন্ট’দের সাথে কথা বলতে গিয়ে। স্বাভাবিক আগত পরিচিতরা অবশ্যই শোকপ্রকাশ করতেই তো এসেছেন। তাঁদের সাথে কথায় ব্যস্ত আমি আর ঋষির কথা শ্রবণে রাখতে পারলাম না। কথাবার্তা শেষে বাড়ির আঙিনা থেকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম শান্তনুকে হুইলচেয়ারে নিয়ে। মেয়ে ন্যানি মনির কোলে ছিল। তাদের বেশিক্ষণ বাইরের জনবহুল পরিবেশে রাখিনি। যার দরুন মনি বাড়ির ভেতরেই ছিল সর্বক্ষণ সায়ন্তিকাকে নিয়ে।

সন্ধ্যে সন্ধ্যে আবহাওয়া বিরাজমান। খালি খালি লাগছে ঘরদোর৷ অবশ্য আমার কি খালি-ভরতি ঘর দিয়ে, থাকেই বা কে এসব নিয়ে পড়ে? ট্রিপিক্যাল বউদের মতো নই যে এসব নিয়ে পড়ে পড়ে জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ মাটি দিব। শ্রাদ্ধ শেষ করে, ঘরে ফিরে শান্তনুকে খাইয়ে দিয়ে তার রুমে রেখে আসতে আসতে সন্ধ্যার প্রহর চলে এলো। অন্ধকার দূরীকরণে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করতে এগিয়ে গেলাম। সারাদিনের ঘামে চটচটে ভাব যেন গা গুলানোর অবস্থা। এত মানুষজনের ভিড়ে কি আর স্বতস্ফুর্তভাবে থাকা যায় না কি। রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। শরীরে থাকা কাজ করা স্টোনের সাদা শাড়ি খুলে ফেললাম। স্লিভলেস কালো মখমলি ব্লাউজের দিকে তাকাতেই হাসি পেল। ব্লাউজটার পিঠটা বেশ বড়ো আর ফিতে লাগানো। যার কারণে ধবধবে ফর্সা পিঠ স্পষ্টমান। আজ কতজন পুরুষ ছুতোনাতা মার্কা কথায় যে পিঠে তাদের হাতের স্পর্শ করেছে বলার বাহিরে। সকলেরই একই কথা, “ইয়াং লেডি। অফিস একা হাতে সামলাও স্বামী ছাড়া। কিন্তু কতদিন? জীবনটাকে অসুস্থ লোকের পিছনে না খুইয়ে এগিয়ে যাও, নতুন করে শুরু করো।”

যদি-ও মনে মনে বলি, এগিয়েই তো যাচ্ছি। কিন্তু সমুখে তো আর বলার মতো জো নেই। তাই সকল নিম্নমানের অসুস্থ মস্তিষ্কের পুরুষদের স্পর্শ অস্পষ্টভাবে হজম করে যাই। আর পিঞ্চ করা মহিলাদের কথাকে উপেক্ষা না করে সুযোগ ও সাক্ষী হিসেবে মধু মেখে আবেগী গলায় বলি, “স্বামী তো ভালোবাসি। জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্কে ছেড়ে দেই কীভাবে বলুন? আপনার স্বামী হলে কি এভাবে ছেড়ে দিতেন? হয়তো দিতেন কারণ মায়া পড়েনি। আমার তো মায়া-ভালোবাসা দু’টোই পড়েছে।” আহা! দেখার মতো মুখমণ্ডল ছিল তাদের। চটপটে ভাব নিয়ে অন্যকে সুঁই লাগানো ভালো জানেন তারা। ছেড়ে দেবার পাত্রী নই, তবে সময়ের ফেরে ছাড় দেই তবে চপেটাঘাত করে।

ভাবনার অতলান্ত থেকে ফিরে এলাম কারো চেনা ও গম্ভীর গলার স্বরে। প্রত্যেক রুমের সাথে এডজাস্ট করা বারান্দা রয়েছে। পরিচিত কণ্ঠস্বর সেখান থেকেই এলো। আমি আরেকটু শিওর হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। সত্যি না কি? সত্যি যেন না হয়। কাঁদা ভরা জুতো বাইরে থাকাই শ্রেয়। এখন সেটা যদি ভেতরেও ছাপ ফেলে তাহলে পরিস্থিতি মুঠোর বাইরে চলে যাবে। এমনিই শত-শত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। এখন নতুন ঝামেলায় লুডু খেলার মতো সাপের মুখে পড়ে একদম শূন্যের ঘরে নামতে হবে। কিন্তু আমার আশাকে নিরাশায় পরিণত করে, সেই পরিচিত কণ্ঠের মানুষটা এবার সমুখে এগিয়ে এসে দণ্ডায়মান হলো। রক্তাভাব চক্ষু নিয়ে আমার গণ্ডদেশ চেপে ধরল। আতংকিত হয়ে আঁতকে ওঠা কণ্ঠে বললাম,

“ঋষি!”

চলবে…

লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here