হাই সোসাইটির ললিতা-১৮,১৯

0
618

হাই সোসাইটির ললিতা-১৮,১৯
লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম
১৮

নেশা করা ছাড়িনি তবে অতটাও ভারিক্কি ধরনের নয়, যাতে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে যায়। এপথে কাজের জন্য কিংবা শান্তনুর সাথে বিয়ের পরে নিজের উন্মাদনার স্বকীয়তা প্রকাশ্যে না আনার জন্য হলেও নেশাটা কমিয়ে এনেছি। সেই সুবাদে মাতলামির ব্যাল্যান্স ঠিক থাকে আমার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, নেশা না করেও মাতাল আমি। চোখে ঝাপসা দেখছি। বাড়িতে এসেই এই দৃশ্য আমার মস্তিষ্কের নার্ভ স্থির করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, ভাবনার কুল-কিনারাহীণ অথৈ জলে বোধহয় তলিয়ে যাচ্ছি। সমুখে সোফায় বসা সুব্রত সেটার কারণ। এই তো ছিল অফিসে। এখন বাড়িতে কীভাবে কী? তাও আবার শান্তনুর সাথে গল্পগুজবে মেতে। এখন তাদের সামনে কীভাবে নিজের কার্যসিদ্ধি হাসিল করব? হাতে থাকা ফাইলগুলোর দিকে একবার তাকালাম। আবার সমুখে বসা শান্তনু ও সুব্রতর দিকে তাকালাম। তারা এখনো আমাকে লক্ষ করেনি। করতে কতক্ষণ ভাবান্তরের মাঝেই মনি এসে হাজির হয়ে বলল,

“স্যার! ওই তো ম্যাম এসে পড়ছে।”

মনি কথায় দু’জনে আমার দিকে নজর ফেরালো। শান্তনুকে কেমন যেন গম্ভীরভাব এঁটে থাকতে দেখা গেল। কিন্তু কিছু সম পূর্বে সুব্রতের সাথে তো ভালোই আলাপ-সালাপ করতে দেখা গেল। আমার দিকে ওমন করে তাকানোর মানে কী? আপাতত ওসব বিষয়ে ভাবার চেয়ে হাতে জিনিসগুলো সরিয়ে রাখাটা আমার জরুরি কাজের মধ্যে পড়ে। তাই শান্তনুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

এবার শান্তনুর মুখাবয়ব পরখে না থেকে মনিকে বললাম,

“নাস্তা দেও উনাদের।”

বলে দ্রুত পদক্ষেপে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলাম।
_______

দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে দেখি শান্তনুর সাথে বসে সুব্রত এখনো কথাতেই মগ্ন। সামনের সেন্টার টেবিলে নাস্তার জন্য রাখা নানাননপদের মুখরোচক খাবার। আমি তো পারলে দুটোকেই বিষয় খাওয়াই। ঝামেলা খতম। সুব্রত হঠাৎ কথার মাঝে আমার দিকে তাকালো। তার তাকানোতে শান্তনুও ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখতে পেল দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়।

“ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এখানে এসে বসো।”

আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা সুব্রতর কথা। হাহ্! আমার বাড়িতে আমাকেই বসতে বলা, গেস্ট মনে হচ্ছে নিজেকে। ছেলেটা চাইছে কী আমার বোধগম্য হচ্ছে না। ক্ষতির আশংকাই বেশি মনে হচ্ছে। নাহলে আমার পিছনে এভাবে হাত ধুয়ে পড়ার কথা না, তাও এতবছর পরে। এগিয়ে গিয়ে শান্তনুর বরাবর সিঙ্গেল সোফায় বসলাম। কারণ সে-ও সিঙ্গেল সোফায় বসা। আবারো শান্তনুর থমথমে ভাব দেখতে পেলাম। অবাক লাগছে আমার বেলাই এমন গুমোট মেঘের আবির্ভাব কেন? উত্তর জানা নেই। দেখা যাক সুব্রতর এখানে আগমনের কারণ।

“তা কী ব্যাপার? কী নিয়ে আলাপ হচ্ছে দু’জনের মধ্যে?

সুব্রতকে না চেনার ভান করলাম না। এতে হীতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আর কথাটা দুজনের দিকে তাকিয়ে বলাতে শান্তনুর চোখে-মুখে অবাক হওয়ার সংকেত পেলাম। তবে সুব্রতর চোখে-মুখে একরাশ অদ্ভুত রহস্য খেলা করতে দেখা গেল।

” তোমার ফ্রেন্ড তোমাকে নিয়েই বলছিল।”

“ওহ্! কী বলল শুনি? ভালো যে বলেনি জানি।”

“তা কেন হবে? কথার সারাটা জুড়ে তোমার প্রশংসাই করতে দেখলাম।”

“তাই না কি? আমি-ও শুনি একটুখানি।”

শান্তনুর আর আমার কথা বলার মাঝে এবার সুব্রত বলল,

“আমাকে নিয়ে তোমার যত আক্ষেপের কথা।”

তার গলায় কত বিষাদ আহা! আস্ত শয়তান একটা। শয়তানি ছাড়বে না কখনো ভালো করে আমার জানা। বিষ ছড়ায় সর্বত্র।

“আচ্ছা, বাদ দাও। সুব্রত তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।”

শান্তুর কথাতে অবাকান্বিত ভাব নিয়ে অভিনয়ে বললাম,

“তাই! তা কী কথা?”

এবার সুব্রত নিজের পক্ষে বলল,

“বছরখানেক হলো দেখা হয় না তোমার সাথে। শুনলাম বিয়ে-শাদি করে সংসার সামলাচ্ছ। তাই দেখতে এলাম, ভার্সিটিতে দাপুটে চলা ললিতা সংসার করছে; অদ্ভুত বিষয়টা দেখার সাধে আরকি আসা।”

সুব্রতর কথায় কান দিয়ে ধোঁয়া ছুটছে রাগে। এত বড়ো মিথ্যাবাদী! আমার চেয়েও জঘন্য সে। ফের সুব্রতের গলা শোনা গেল,

“কিন্তু এসে দেখি, শান্তনুর অবস্থা। পরে শুনি, তুমি অফিসে। সায়ন্তিকার সাথেও দেখা হয়েছে।”

শয়তান ছেলে আমার মেয়েটাকেও নজর নিয়ে ফেলেছে। সবই তার জানা, আমার সাংসারিক সম্পর্কে যে, ভালো করে খোঁজ নিয়ে এসেছে খুব করে বুঝতে পারলাম। আর এখন কি না, না জানার ভান করে কথা বলছে। আমি-ও আপাতত তার কথায় তালে তাল মিলিয়ে গেলাম।

“হুম, আসলে দেখতেই পাচ্ছ শান্তনু অসুস্থ। তাই আরকি সবকিছু দেখে রাখতে হচ্ছে। উপরন্তু কিছুদিন হলো মা মারা গিয়েছেন।”

কথাটা বলেই মন খারাপের রেশ টেনে নিলাম মুখে। যাতে শোক পালন করছি এখনো বোঝা যায়। সুব্রত তখন বলল,

“শান্তনু আমাকে সেটাও বলেছে। গভীরভাবে শোকাহত হলাম কথাটা শুনে। প্রার্থনা করি, তিনি যেন স্বর্গ লাভ করেন।”

শয়তানের মুখে রাম নাম! এদিকে একাধারে অযথা বসে আমাকে শান্তনুর কাছে সন্দেহ করাচ্ছে। অপরদিকে আমার কাজেরও বারোটা বাজাচ্ছে।

“রাত হয়ে এলো ডিনার সময় হচ্ছে। তুমি কি ডিনারে যোগ দিবে? না মানে বাড়িতে যদি ওয়াইফ অপেক্ষায় থাকে, সেজন্যে বললাম।”

আমাকে অবাক করে দিয়ে সুব্রত বলল,

“নাহ, অপেক্ষা করার মতো কেউ নেই।”

শান্তনু মাঝ দিয়ে থমকে গিয়ে চমকানো, ভড়কানো গলায় বলল,

“সিরিয়াসলি ম্যান, এখনও ব্যাচেলর! অবাক না হয়ে পারলাম না।”

বলেই হো হো করে হেসে দিলো। এদিকে আমি ভাবছি অন্য কথা। বিয়ে করবে কেন? তার তো একটা দিয়ে পোষায় না। এমনি এমনি নানান শরীরের ঘ্রাণ পেলে বিয়ের কী দরকার? যত্তসব বিরক্তিকর ঠেকছে। বজ্জাত ছেলেটা যাচ্ছে না কেন। এত চেষ্টা করলাম তাড়ানোর জন্য কিন্তু নাহ, গেঁড়ে বসেছে একদম। ভাবনা-ভাবান্তরের মাঝে শান্তনুর প্রশ্নের উত্তর দিতে দেখলাম,

“মনের মতো কাউকে পাইনি বলে।”

কথাটা বলছে তো বলছে আমার দিকে নজর এলিয়ে বলার প্রয়োজন কী বুঝলাম না। শান্তনুর দিকে ভয় ভয়ে তাকিয়ে কারণটা বুঝতে পারলাম। বাঘের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সে। রাগ উঠল এবার খুবই। শান্তনুর কাছে আমাকে বাজে প্রেজেন্ট করার ধান্দা খুঁজছে সুব্রত। নিজের সাফাই এখন গাইলেও লাভ নেই। নিরবে, নিভৃতে শান্তনুকে ধরে হাত করতে হবে। এত এতবপেইন আর নিতে পারছি না। এমনিতেই পেপারসে সাইন নিতে হবে। আবার নতুন মাল ভর্তি ট্রাক জলপাইগুড়ি যাবে সেখানের খবরা-খবর নিতে হবে। এখন উটকো ঝামেলা। মাথা রিলাক্স করার ওষুধের খবর নাই এরমধ্যে। প্রয়োজনের সময়ই ঋষিকে পাওয়া যায় না। এই ছেলেটা যে কী করছে না বিন্দু পরিমাণ জানায় না। এমনিও কন্ডিশন হিসেবে ছিল, নিজেরা নিজেদের লাইফে ইন্টারফেয়ার করব না। কন্ডিশনটা দিয়ে দেখি আমি-ই এখন পস্তাচ্ছি।

“কী হলো কোথায় হারিয়ে গেলে ললিতা?”

“নাহ, কোথাও না। আচ্ছা, ডিনারে চলো সবাই। মনি সম্ভবত সব রেডি করে ফেলেছে।”

আমি ওঠে গিয়ে শান্তনুকে সোফা থেকে ওঠাতে গেলে আমার হাত ধরে ফেলে সুব্রত। হকচকিয়ে গিয়ে বিস্মাপন দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তার পানে। তখন সে হাত ছেড়ে দিয়ে শান্ত ও ভাবলেশহীন গলায় বলল,

“আমি উঠিয়ে দিচ্ছি।”

অতঃপর শান্তনুকে হুইলচেয়ার বসাতে সাহায্য করল সুব্রত। এদিকে হাত ধরায় শান্তনুর জ্বলজ্বলে আগ্নেয় দৃষ্টির মাঝে আমাকে জ্বলতে হলো।
______

ডিনার টেবিলে বসে খুব একটা কথা হয়নি। সারাটাক্ষন আমি চুপটি করে ছিলাম। আসলে চিন্তায় কথাও আসছিলা না মুখ দিয়ে। আর শান্তনু-ও এবার চুপ করে ছিল। সেসব দেখে যে সুব্রত মনে মনে দেওয়া হাসিটা ঠোঁটের কোণে ধরে রেখেছিল, বুঝাই যাচ্ছিল। কারণ হাসিটা আমাকে লক্ষ করেই দেওয়া হচ্ছিল। ভগবান নাম জপ ছিলাম মনে মনে। এরকম বারবার আমার ওপর দৃষ্টি ফালানো শান্তনুর নজর এড়ায়নি। নিহাত ভদ্রলোক বলে কাউকে কিছু বলছে না। কিন্তু আমাকে পাছে জবাবদিহি করতে হবে ভেবেই গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। আজ যদি কৈফিয়ত দিতে হয়, তাহলেই সেরেছে। আমার ফাইল সাইন নেওয়ার সময় পিছিয়ে যাবে, যা দেখতে পাচ্ছি। একপর্যায়ে খাওয়াদাওয়া শেষে ফের ড্রয়িংরুমে এগিয়ে গেল সকলে, তাদের পিছু পিছু আমি-ও গেলাম। যাওয়ার আগে মনিকে সবকওছু গুছিয়ে রাখতে বললাম।

“আসি কেমন?”

“এই তো এলে, আবার মাত্রই খেলে। রেস্ট নাও, নাহয় থেকে যাও যেহেতু অপেক্ষা করার মতো কেউ নেই।”

শান্তনু শেষোক্তি আমার দিকে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে সুব্রতকে বলল। সেটা দেখে সুব্রত হাসি দিয়ে বলল,

“অনেক তো রইলমা। আজ আসি। আবারো তো আসা পড়বে, তাই না? আসি হ্যাঁ।”

বলেই বেরিয়ে গেল সুব্রত। মাঝে দিয়ে আমাকে ফাঁসিয়ে গেল। আবার তো আসতে হবে কথার মানে যা আমি বুঝেছি সেটা অন্য আর শান্তনুকে যা বুঝাতে চেয়েছে সেটা অন্য। এদিকে শান্তনুর কপালের ভাজ পড়ার হাবভাবে বুঝা যাচ্ছে, সুব্রত যা বুঝাতে চেয়েছ সে তা বুঝতে পেরেছে। বাস্টার্ড কোথাকার! মুখে গালি দেওয়া আর হলো না। হিম শীতল কণ্ঠে যেভাবে শান্তনু বলল,

“রুমে আসো।”

এই দু’টো শব্দ আমাকে ভেতরেই ভেতরে তীব্রভাবে ভঙ্গুর করতে সক্ষম। শান্তি নামক শব্দটাকে খুঁজে পাচ্ছি না এখন আর। পাবই বা কী করে, যেসব খেলায় মেতে ওঠেছি, তাতে কণ্টকাকীর্ণ পথও বেশ পাথুরের আঘাতের মতো।

চলবে…

লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম

হাই সোসাইটির ললিতা |১৯|

“বন্ধু?”

“তাহলে কী বুঝাতে চাচ্ছ? তাকেই জিজ্ঞেস করতে পারতে। আমার ওপর না চিল্লিয়ে।”

“সে-তো তোমার মতো একই গান গাইল।”

থেমে কয়েকপল ফের শান্তনু গভীর নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,

“বন্ধুত্বের চোখ আমার জানা আছে ললিতা।”

“তুমি কী বলতে চাইছ? আমার সাথে তার কেবল ট্যুরে দেখা, তাও বহুকাল আগের কথা। এছাড়া আর কোন সম্পর্ক তো নেই।”

সত্য! সত্য বলা কখনোই সম্ভব নয়। কিছু সত্য আগুনের মতো। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অলি-গলি জ্বালিয়ে দেয়। শেষে নিজ অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।

“ললিতা, আমাকে কি বোকা পেয়েছ? যে কি না ব্যবসা করে শহর চড়িয়ে খায়।”

“আমি ক্লান্ত শান্তনু, তোমাকে বোঝাতে বোঝাতে। আর পারছি না। তারচেয়ে এটাই ব্যাটার তুমি যা ইচ্ছা ভেবে নেও।”

বলেই নিজ রুমে চলে এলাম। হায় আফসোস! এই সুব্রতকে সামনে পেলে খু*ন করতাম। ছেলেটা আমার লক্ষ্যচ্ছেদ করছে। মূল লক্ষ আরেকটুর জন্য ফসকে গেলাম হতচ্ছাড়া! সেই রাত কাটালো তুখোড় দো-মনদশা চিন্তাতে।
______

চিড়বিড়ে, উত্তপ্ত মেজাজ সকাল হতে। শান্তনুর নাস্তা প্রতিবারের মতো রুমেই দেওয়া হলো। আমি ডাইনিংয়ে সারলাম। এরপরে রুমে গিয়ে ছক কষলাম। চারপাল্লার আলমারি খুলে একদম নিচে থাকা সিন্দুক হতে ফাইল বের করলাম, পাশেই লাইসেন্স করা পিস্তলটা পড়ে। একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে ফাইল নিয়ে ওঠে দাঁড়ালাম। অতঃপর শান্তনুর রুমে যাওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রস্তুতি নিলাম। কারণ রাগান্বিত অবস্থায় শান্তনু তৎক্ষনাৎ স্বাক্ষর করে দিবে পেপারসে খেয়াল করবে না আর না পড়বে। যেই ভাবা সেই কাজ। শান্তনুর নাস্তা খাওয়া শেষ। নাস্তা যদিওবা মনি দিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো নেওয়ার বাহানায় ভেতরে গেলাম। মুড কেমন সেটা দেখার আশায়। খাওয়ার শেষে খালি ট্রে আনতে গেলে শান্তনুর অবাকান্বিত হওয়া মুখ দেখা গেল। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলল না। আমি-ও চুপচাপ চলে এলাম ট্রে হাতে। বেশ কিছু সময় পর আবহাওয়ার শান্ত ও ঠান্ডা পরিবেশ দেখে শান্তনুর রুমে হন্তদন্ত হয়ে গেলাম। এবারও অবাক হলো সে। হন্তদন্ত হয়ে তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন আছে।

“শেয়ার বিক্রি করে ফেলতে চাচ্ছি। যেগুলোর দাম কম। বাড়বে বলে মনে হচ্ছে না।”

শান্তনুর পাশে বিছানায় বসতে বসতে বললাম। সে অবশ্য এখনো চুপটি করে। টুঁ-শব্দটিও করছে না। হয়তো আমার বলা কথাতে সায় দেওয়ার লক্ষ্মণ এটা। স্বাভাবিকও ব্যবসার অবস্থা ভালো না আর না শান্তনুর সুস্থ হওয়ার চান্স রয়েছে। আমি-ও হাতে থাকা ফাইল এগিয়ে দিলাম স্বাক্ষরের জন্য। পড়ল না কিছুই পাতা উলটে উলটে স্বাক্ষর দিয়ে গেল। তবে সই দেওয়ার আগে দেখলাম উদাসীন তার দু’জোড়া চোখ। মায়া লাগল, এটা ভালোবাসা নয়। একসাথে থাকতে থাকতে লিগ্যালি অনুভূতিতে হয়ে ওঠা মায়া-মমতা। আমার জীবনে ভালোবাসা নামক অধ্যায় অতীতেই গুঁড়ো হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। এসবে এখন আর মন গলে না আর না অনুভূতি আসে।

ফাইলপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম শান্তনুকে ওভাবেই রেখে। এখন সে কিছুটা সময় একা কাটাবে। সিন্দুকে দলিলপত্র রেখে ফাইল নিয়ে ফ্ল্যাটে যাব, যেখানে ঋষির সাথে থাকা হয়। ঋষি প্রায় লাপাত্তা। আমার প্রতি তার এই অনীহা কেন জানি ভালো লাগছে না। আমার এমনতর ভালো না লাগা, তবে এটা কি তবে ভালোবাসা? ভাবতে ভাবতে গাড়ি ড্রাইভ করে ফ্ল্যাটের সামনে এসে পৌঁছে গেলাম। অন্যসময় হলে ঋষিকে খবর দিয়ে আসি। এবার আর দিলাম না। সে এখানে থাকলে তো। একাকী কিছু সময় কাটানোর উদ্দেশ্যেই আসা এখানে।
_____

“মেয়েটাকে এখানে এনেছ যে আমাকে জিজ্ঞেস করেছ?”

“করার প্রয়োজন বোধই করিনি।”

“কেন?”

“কেন আবার কী? এখানে আমরা প্রয়োজনের তাগিদে আসি। তুমি তো ব্যস্ত তাই অন্য কাউকে আনলাম। সেজন্য রাগান্বিত হওয়ার কী আছে?”

কিছুক্ষণ আগেই ফ্ল্যাটের রুমে এসে পৌঁছালাম। আমার কাছে আর ঋষির কাছে আলাদা চাবি থাকে। তাই নিজেরটা দিয়ে লক খুলে ভেতরে গিয়ে যেটা দেখলাম, প্রচণ্ড শকড হয়েছিলাম। ঋষিকে অন্য মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে শায়িতাবস্থায় দেখতে আমার খারাপ লাগার কারণ খুঁজে পেলাম না। আমরা তো কন্ডিশনে, যে কাউকে নিয়ে লিভ করতে পারি। তাহলে কেন বারবার ঋষির প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছি? ভালোবাসা? এই বয়সে টিনএজের এক ছেলের প্রতি ভালোবাসা হওয়াটা কতটুকু যুক্তিগত ভাবনায় এলো না। তার আগেই দেখলাম মেয়েটা পোশাক-আশাক পরে বেরিয়ে গেল। ঋষি সেভাবেই শুয়ে, আমাকে দেখে তাকে ঘাবড়াতে দেখা গেল না। ডোর লক করে এগিয়ে গিয়ে টি টেবিলে হ্যান্ডব্যাগ রাখতে রাখতে প্রশ্নগুলো ছুঁড়লাম ঋষির কাছে।

“তোমার ফিয়ন্সে?”

হাতের আঙুল দেখিয়ে বলল,

“ভেঙে গেছে।”

হেসে দিয়ে তার পাশে বসে পোশাক খুলতে খুলতে বললাম,

“কেন? তাকে ভালো করে এনজয় করাতে পারোনি?”

এনজয় বলতে কোন আনন্দের কথা বলেছি সেটা ধরতে ঋষির বেগ পেতে হলো না। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার কম্বলের ভেতর আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,

“তুমি কি আমার সাথে কমফোর্টেবল নও?”

“হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”

“তোমাকে কাছে পাই না যে?”

“তুমি-ই তো ক’দিন ধরে লাপাত্তা ছিলে। আমি তো খোঁজ নিতাম।”

আমার দিকে নেশাক্ত, কামাক্ত দৃষ্টি নিয়ে গালে আঙুলের সাহায্যে স্লাইড করতে করতে জিজ্ঞেস করল,

“কেন? ভালোবাসো?”

উত্তর তো আছে তবে মনে মনে। শিওর নই, এটা কি ভালোবাসা? ভাবলাম, ঋষিকেই অনুভূতির কথা জিজ্ঞেস করে বিষয়টা ক্লিয়ার করা উচিত। তার অভিব্যক্তিও জানা যাবে এ-বিষয়ে।

“জানি না। তবে তোমার সঙ্গ ভালো লাগে। তোমার আশেপাশে থাকতে ভালো লাগে। তোমাকে অন্যের সাথে দেখলে জেলাসি ফিল হয়। ইজন্ট ইট লভ?”

আমার উন্মুক্ত বক্ষদেশে ভেজা স্পর্শে এতক্ষণ মাতিয়ে রাখলেও আমার কথা শুনে ঋষি মাথা উঁচিয়ে বলল,

“অবশ্যই এটা ভালোবাসা। আমাকে নিয়ে ইনসিকিউরড ফিল হওয়া, আমাকে ভালোলাগা। এগুলোই ভালোবাসা। ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসার তৈরি।”

ঋষির চোখে চোখ রেখে বললাম,

“আমি বাসলে কী হবে? তুমি তো বাসো না?”

ভ্রু কুঁচকে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা রেখে ঋষি বলল,

“কে বলল, বাসি না? তোমার মতো অনুভূতি আমার আরো আগে হয়েছে। তাই সেটা ভুলতেই তো এনগেজমেন্ট করলাম। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? ভেঙে গেল। এতদিন সেটা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। তারপর অন্য মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়ালাম সেটা ভুলতে। অতঃপর তাকে বিছানাতে এনেও সেই তোমাকে স্মরণ করেই মিলিত হই। লাভের লাভ কিছুই তো হচ্ছে না। উলটো তুমি আমার মস্তিষ্কে দখল করে জেঁকে বসে রয়েছ।”

বিষণ্ণ কণ্ঠে একনাগাড়ে বলে দম ফেলল ঋষি। এদিকে আমার ভেতরে একপ্রকার উত্তেজনা কাজ করছে আনন্দের জোয়ারে বোধহয় ভেসে বেড়াচ্ছি। এত খুশি একদিনে পেলাম যে বলা ভার। অতি আবেশিত হয়ে জড়িয়ে নিলাম ঋষিকে৷ উন্মত্ত হয়ে গেলাম সমুদ্রের নোনাজলে পা ভেজাতে। যেখানে পূর্ণ মিলন ভালোবাসার, সেখানে আজ না ছিল কাম-বাসনার স্থান।
______

“আপনি তো প্রায় ভুলে বসেছেন যে, আপনার একটা বাচ্চা-ও আছে।”

আসলেই কথা সত্য। একটাই তো সন্তান, যার প্রতি তীব্র অবহেলা আমার। নিতে চাইনি বাচ্চাটা, একমাত্র শান্তনুর জোরাজোরিতে নেওয়া। এখন আবার এর জন্য না আমার এত কষ্টে অর্জন করা সবকিছু বিফলে যায়! সেই আশঙ্কায় সত্যি হলো আগন্তুকের পরের বাক্যে।

“যতই হোক মেয়ে তো আপনার, ফেলনা না তো অবশ্যই? চাইলে মেসেজ করা ঠিকানাতে এসে পড়ুন।”

চলবে…

যারা যারা পড়বেন প্লিজ রেসপন্স করবেন।

লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here