হাই সোসাইটির ললিতা-২০
“ভয় পেয়ো না। আমি আছি তো সাথে।”
সাঁঝনামা বিকেলের হলদেটে আভায় আকাশের গোধূলি মন ভালো করতে পারল না। প্রাণোচ্ছল বাতাসও আমার কাছে মনমরা, বিষণ্ণতায় ছায়া লাগছে। ঋষির কথাতে তার দিকে ফিরেও তাকালাম না। সে হয়তো ভাবছে, মেয়ের চিন্তায় আমি হয়তো চিন্তিত। নাহ, চিন্তা হচ্ছে আমার চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অদৃশ্য শত্রু’দের নিয়ে। রক্ষা বলয় অর্থাৎ পিস্তল একে তো সাথে নেই। উপরন্তু দলিল বাড়িতে। বিশেষ চিন্তা হচ্ছে এটার জন্যই। লকার তো কোড ছাড়া খুলা সহজ না আর না বিভিন্ন যন্ত্র দ্বারা। তবুও কিন্তু একটা থেকে যায়।
_____
বাড়ি ফিরে এলাম। এমনভাব যেন মেয়ে হারানোর খবর আমার কাছে পৌঁছায়ইনি। অথচ এসেই সারপ্রাইজড অবস্থা আমার। গেটের দারেয়ান জখমি। বাড়ির অবস্থা প্রায় তছনছ, বিপর্যস্ত, লন্ডভন্ড। বোধহয় দশ নম্বরে বিপদ সংকেত বাড়ির ওপর দিয়ে গিয়েছে। বাড়িতে মানুষজন এতোটাও না যে, এমন ছারখার করতে হবে সবকিছু। নিশ্চয় কিছু একটার খোঁজে এসেছে আততায়ীরা। সম্ভবত সেটা আমি জানি। তবে কথা হলো, এখনো কোনোকিছুর দাবি-দাওয়া করেনি তারা। কারণ জানা নেই পরে বোঝা যাবে। প্রতিপক্ষ বেশ বিচক্ষণ, বুদ্ধির প্রশংসার দাবীদার বলতে হয়। সাথে সাথে দাবি রাখেনি। আমাকে আগে বাজিয়ে দেখতে চায় বোধহয়। পায়ে পায়ে দ্রুততার সাথে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। শান্তনুর ঘরে আগে উঁকি দিলাম, নাহ নেই। মেয়ের ঘরে গিয়ে পেলাম তাকে সাথে মনিকেও। দু’জনই আহত, অজ্ঞান অবস্থায় এখনো পড়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স কল করলাম।
_______
“কেমন আছে তারা?”
“ওয়েল, বেশি একটা চোট পায়নি জাস্ট জ্ঞানহীন করার উদ্দেশ্যে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। সেটা অতটাও গুরুতর নয়। তাই সুস্থ আছে।”
স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। করিডোরের চেয়ারে বসে আরেকবার ফোনের মেসেজ চ্যাক করলাম। জলপাইগুড়ি যেতে হবে। বুঝলাম না কোনোকিছুর বিনিময় আমি-ই বা কেন? অবশ্য সেখানেও নেশাদ্রব্য আনা-নেওয়া হয়। তবে মন বলছে, কারণ অন্যকিছু। আমার ভয়টা অন্যথায়, তারা তো আর জানে না, মায়াবী চেহারার এই মুখোশের পিছনে মায়াহীন, নির্দয় আমাকে। একজনের প্রতিই সেই মায়ামোহিত হয়ে কাজ করে। একবার তাকে ফোন দিতে মন চাইছে বলে, কোনকিছু না ভেনে এবার দিয়েই ফেললাম। সে আমার মানসিক শান্তি বলে কথা।
“কোথায় তুমি?”
ফোনের ওপাশে ঋষির গলা। বোধহয় কিছু খাচ্ছে।
“ধাবায়। ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে এসেছি খাওয়া-দাওয়ার জন্য। তুমি কোথায়?”
“হসপিটালে।”
“কিহ্!”
“চিন্তার কিছু নেই। আমার কিছু হয়নি।”
অতঃপর বিস্তারিত খুলে বললাম বাড়িতে আসার পরের দৃশ্যমান হওয়া চিত্রের বিষয়ে।
“এখন বলো কী করবে?”
“মেয়ে আমার উইক পয়েন্ট না তুমি তো জানোই। তবে চিন্তা হচ্ছে, টাকার বিনিময় না চেয়ে আমাকে যেতে বলছে কারণ বুঝতে পারছি না।”
“আমার-ও একই অবস্থা। হিসেব মিলছে না। তবে ওয়েট করো, দেখো কী চায় পরবর্তীতে।”
“যতোই হোক, শান্তনুর মায়া কাজ করে মেয়ের প্রতি, আমার চেয়েও বেশি। সে যদি পুলিশ কল করে?”
“তুমি আটকানোর চেষ্টা করে দেখবে। কেন পুলিশ কল করতে না বলেছে আততায়ীরা?”
“নাহ, বলেনি।”
“তাহলে তো কেস আরো জটিল।”
“হুম। দেখছি কী করা যায়। তুমি সাবধানে থেকো।”
“পাগল তুমি, আমার কিছু হবে না।”
“তারা যদি জেনে যায়, আমার উইক পয়েন্ট তুমি?”
অস্পষ্ট ও মিনমিনে বললাম, যেন আশেপাশেও কেউ না শুনতে পারে। কিন্তু ওপাশে হাসতে হাসতে কাশি ওঠে গেছে ঋষির। ফোনের এপাশ থেকেই চোখ রাঙিয়ে ধমকে গলায় ফের বললাম,
“হাসছো কেন এভাবে?”
“আমাকে বাচ্চা ভাবো। আসবে আর তুলে নেবে। এতোই সহজ?”
ফের হাসতে শুরু করল। জানি না তার কী হয়েছে, এত হাসছে বাতাসে কি লাফিং গ্যাস ছেড়েছে না কি জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। পাগল করা ভালোবাসা চলছে আমাদের মাঝে এখন থেকেই। কিন্তু এ-সময়টা সেসবের নয়। বিপদের কড়া সংকেত পাচ্ছি মনে মনে।
“আচ্ছা, তুমি কি তোমার বন্ধুদের সামনেই কথা বলছ আমার সাথে?”
“হ্যাঁ, তাতে কী?”
“ঋষিই! তারা কী ভাববে বলো তো?”
“কিছুই ভাববে না। তাদেরও তো গার্লফ্রেন্ড আছে।”
“আ..আমি রাখলাম।”
“উহুম, কথা বলবে সারারাত আমার সাথে।”
“ফ্রেন্ডদের সাথে এনজয় করো। রাখি।”
“প্লিজ না। রিকোয়েস্ট ইউ।”
আমার অসময়েও হাসি পাচ্ছে। ছেলেটা তো প্রেমে মহারথী হবে। অথচ না কি তাকে তার গফ ডাম্ব করেছে। ডোন্ট নো হোয়াই!
______
সকালে আলো ফোটার সময় একটু ছাড়া পেয়ে কেবিন নিয়ে সেখানেই ঘুমে ঢলে পড়ি। ঋষির সাথে সারারাত কথাতে মন খারাপের রেশ চলে গেলেও, সারাদিন দৌড়াদৌড়ি ও রাতের আলাপচারিতায় শরীরে ক্লান্তি জেঁকে বসেছিল। তাই ঘুমে ঢলে যাই কয়েকপলেই। দুপুরের দিকে শান্তনু আর মনিকে রিলিজ করে নিয়ে আসি বাড়িতে। শান্তনু তার নামের মতোই শান্ত হয়ে আছে। কারণ পাচ্ছি না। মেয়ে কিডন্যাপড হওয়ার পরেও কীভাবে ঠান্ডা হয়ে থাকতে পারে সে! প্রশ্নের চেয়ে অবাক হলাম বেশি। সারাদিন কথা হলো না শান্তনুর সাথে। মনিকে বাড়িতে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে জখমির চেয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। তাই সে নিজের বাড়িতে রয়ে যায়। এদিকে শান্তনু রাতে ডেকে পাঠায় আমায় ফোন করে। ভয় পেয়ে যাই তাতে। কারণ জরুরিতলব সেটা বুঝতেই পারি।
“মেয়েটা যে কিডন্যাপড জানো নিশ্চয়ই?”
মাথা নেড়ে মুখে বিষণ্ণতা, কাঁদো কাঁদো ভান করার মুখোশ টেনে নেই। কিন্তু শান্তনুর পরবর্তী কথাতে স্তব্ধ, বিমূঢ় হই। মুখোশ সরে যায় আতংকে।
“কারণ কী জানো? তুমি।”
“আ..আমি?”
নার্ভাসনেসে তোতলিয়ে যাচ্ছি। ভগবানকে ডাকছি অশনী সংকেত থেকে রেহায় পেতে। কিন্তু নাহ৷ কপালে শনির দশা লেগেই আছে।
“হ্যাঁ, তারা তোমাকে অপহরণ করতে এসেছিল। না পেয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে যায়। জানি না মেয়েটা আমার কী হালতে আছে।”
“আমাকেই বা কেন? বলেছে কিছু? আ..মি তো কারো ক্ষতি করিনি।”
বলার মূহুর্তেই শান্তনু বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার তাকানোর ভঙ্গিমা ছিল অদ্ভুত, অন্যরকম। তীক্ষ্ণ তীরের ফলার মতো এফোঁড়ওফোঁড় করে দেওয়ার ক্ষমতা, এই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম। বিষয়টা আমাকে আরো বেশি ভীতু করে তুলল। সময়ের পরিক্রমা শেষে বিছানার পাশের ড্রয়ার খুলতে বলল আমাকে। কাঁপা কাঁপা হাতে ভেতরে থাকা জিনিসপত্র দেখে আমার চক্ষু চড়ক গাছ। শুধু কিড়মিড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষ্ট উচ্চারণ করলাম,
“সুব্রত!”
রাগে আমার মুখমণ্ডল থমথমে লালাভ বর্ণ ধারণ করল। ছবিগুলো হাতে তোলার সাহস পেলাম না। বুঝলাম না বহুবছর আগের ছবিগুলো দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছে সে? পরক্ষণেই শুনলাম শান্তনুর ধীরস্থির হওয়া ঠান্ডা গলার স্বর,
“তোমার কারণে চাই না আমার মেয়ের কোন ক্ষতি হোক। তুমি যে কতটুকু সন্তানের প্রতি আসক্ত জানা আছে আমার। তাই তারা যা বলে, মেনে আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়ে চলে যাও তোমার পুরোনো প্রেমিকের সাথে। বাঁধা দেব না উলটো ডিভোর্স সাইন করে দেব।”
মাথা আমার কত ডিগ্রী কোণ দিকে ঘুরছে বলা মুশকিল। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, সুব্রতর চাওয়াটা কী পরিষ্কার নয়। শান্তনুকে তো আমি এমনি-ও ডিভোর্স দিয়ে দেব। গতকাল রাতে সেই নিয়েও আলোচনা হয়েছে ঋষির সাথে। শান্তনুর জায়গা-সম্পত্তি সবকিছু যে বাগিয়ে নিয়েছি, সেটাও জানিয়েছি তাকে। অতঃপর দু’জনই সিধান্ত নিয়েছি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগামী পাঁচ মাসেই। এখন দেখা যায় আরো দ্রুত দেশ ছাড়তে হবে আমাদের।
_______
সায়ন্তিকার ভিডিয়ো পাঠিয়েছে সুব্রত। কিন্তু সেদিন ফোনে কথা বলেছিল তার ভাড়াটে গুন্ডারা। ভিডিয়োটা আমার ফোনে পাঠায়নি, পাঠিয়েছে শান্তনুর ফোনে। এখন শান্তনু আমার ওপর চোটপাট শুরু করে দিয়েছে। মুখে দুশ্চরিত্রাও বলতে বাঁধছে না তার। কারণ সুব্রতর বন্ধুদের হাতে আমার সাথে হওয়া তাদের ওয়াইল্ড সেক্সের ছবিগুলোই। এদিকে অবশ্য টলানোর খুব ভালো অপশন সুব্রত ব্যবহার করেছে। তবে চক্ষুলজ্জার বিষয়টা গা সওয়া হয়ে গেছে। বর্তমানে ভিডিয়োতে দেখাচ্ছে, সায়ন্তিকাকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রেখে মারার দৃশ্য। সেসব দেখে কিঞ্চিৎ হলেও মনটা আমার টলেছে, খারাপলাগা কাজ করছে, মেয়েটার কান্নামাখা মুখে মায়া জড়ানো কণ্ঠে ‘মা,মা’ শব্দ শুনে। মেয়েটাকে কখনো সময়-ই দেইনি। ফিডিং করানো আর নিজের রক্তের ছাড়া কোন বন্ধন তৈরি হয়নি তার সাথে। এতটাই নিষ্ঠুর নারী হয়ে গেছি আমি? কখন কীভাবে? উত্তর আমার মাঝেই। অর্থলোভের নেশা, বড়ত্বের নেশা, স্বাধীনচেতা হওয়ার নেশা আমাকে ক্রুর, পাষণ্ড হৃদয়ে তৈরি করেছে।
চলবে…
লেখাঃ Mannat Mim – মান্নাত মিম