আমার_চন্দ্রাবতী,০৪

0
838

#আমার_চন্দ্রাবতী,০৪
লেখিকা- সালসাবিল সারা

বন্ধু ফারসিভের পাঁচ তারকা রেস্টুরেন্টে বসে অপেক্ষা করছে ইয়াদ তার বাকি বন্ধুগন্দের জন্যে।খানিক পূর্বে ফারসিভ এসে তার সাথে কুশল বিনিময় করে আবারও নিজের অফিস রুমে গেলো।অনুরোধ করলো,ইয়াদ যেনো আর মাত্র বিশ মিনিট অপেক্ষা করে। ইয়াদের হাতে প্রচুর সময়। ছুটি কাটাচ্ছে বলে কথা! ইয়াদ নির্দ্বিধায় বসে রইলো সেফ জোনে।এইখানে ইয়াদের ভক্ত বা যেকোনো সাধারণ মানুষ তাকে বিরক্ত করবে না। ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট এর একটা সুবিধা হলো এইখানে ব্যক্তিগত কেবিন পাওয়া যায়।একটা কেবিন ভাড়া করলে সেখানে আর বিরক্ত করার মতো কেউই থাকে না।ইয়াদ বিনা সংকোচে দুই অধরের ভাঁজে সিগারেট রাখলো।হাতের মোবাইল পর্যবেক্ষণের মাঝে ইয়াদ এই সিগারেটকে নিজের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে।ইয়াদ নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলেও সে জিয়ার কারণে বড্ড চিন্তিত।এই যে কালকে রাতেও জিয়া কি তাণ্ডবটাই না চালিয়েছে বাসায়।ভাগ্যিস! ইয়াদ এসে শেষটা ঠিক করেছে।নাহলে কাল জিয়া একটা অনর্থ সাধনের খুবই নিকটে ছিলো।ইয়াদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে জিয়া এবং জামালের কাহিনীর ইতি ঘটাতে হলে তাকে এই মুহূর্তে জামালকে ফোন দেওয়া প্রয়োজন। যেই ভাবা সেই কাজ।ইয়াদ তার মুঠোফোনের ব্লক লিস্ট থেকে জামালের নাম্বার বের করে,নাম্বারটি আনব্লক করলো।এরপর বিনা দ্বিধায় সে ফোন লাগালো তার অপছন্দের সেই ব্যক্তিটিকে।চারবার রিং হওয়ার পরপরই অপর পাশ থেকে ফোন তুললো জামাল,
–“কে?”
কণ্ঠ তার মাতাল।
–“নেশা কাটেনি এখনো?মেয়ের নেশা করেছিস নাকি মদের?”
ইয়াদের কণ্ঠ জামালের মাতাল মস্তিষ্কে কড়া নাড়লো।জামাল অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো অপর প্রান্তে,
–“আহ্,আমার শালা!নেশা করেছি আপাতত দুইটারই।আমি নেশাগ্রস্ত এইসবের আর তোর বোন নেশাগ্রস্ত আমার।সুযোগ পাচ্ছি না তোর পাগল বোনকে আমার বিছানায় নিয়ে আসার।ইয়াদ!তোর পরাজয় আমি তোর বোনের সাহায্যেই করবো।”
–“তোর মতো বিড়াল করবে বাঘের শিকার?হাহ্?তাও আমার বোনের সাহায্যে?এতো সহজ?ইয়াদের সেই চড় খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিলি মনে পড়ে?এইবার জাস্ট আরেকটা উচুঁ নিচু কারবার করবি তুই,আমার হাতেই মরবি।আর হ্যাঁ,আমার বোনকে নিজের শিকার বানানোর কথা ভুলে যা।আমার সাথে লড়াই তোর,
আমার সামনে এসে লড়াই কর।এরপর মরলে তোর দোষ, আমার না!”
ইয়াদ সোফায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে বললো।
–“তোর মনে কি ভয় নেই, ইয়াদ? আমি যদি তোর দেওয়া আমাকে মেরে ফেলার হুমকি ভাইরাল করে দিই?তাহলে,তোর ক্যারিয়ার তো চান্দে যাবে।”
–“আর এর পূর্বে তোর নোংরামির কথা ফাঁস হলে,
আমার তোকে দেওয়া মেরে ফেলার হুমকিটা সবাই জায়েজ মনে করবে।”
জামালের পিলে চমকে উঠলো ইয়াদের কথায়।ইয়াদ সশব্দে হাসলো আবারও জামালের নিরবতায়,
–“ইয়াদকে ফাঁসানো আর বাঘের সাথে বন্ধুত্ব করা এক।বাদ বাকি,আমার বোন থেকে একশো ফুট দূরত্বে থাকবি।”
জামাল বোকার মতো বসে আছে।ইয়াদের হুমকিতে তার গায়ের ঘাম ছুটলেও,জিয়ার উপর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে জামাল অন্য পন্থা অবলম্বন করার জন্যে ভাবছে।জামাল বুঝেছে যা করার জিয়ার সাথে করতে হবে,নাহলে সামনা সামনি সে কখনো ইয়াদকে টক্কর দিতে পারবে না।

জামালকে হুমকি দিয়ে ইয়াদের মনে স্বস্তি মিললো।ইয়াদের ধারণা জামালের আজ একটু হলেও আক্কেল হবে।ইয়াদ নিজের মুঠোফোনের কল রেকর্ডিং সেভ করে নিয়েছে।বসা থেকে উঠে ধীর গতিতে হেঁটে সে বড় আকারের কাঁচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালো।বাহারি রকমের গাড়ি পার্কিং এরিয়ায় বিদ্যমান।দলে দলে বা জোড়ায় জোড়ায় কিংবা একা, নানান মানুষের আগমন হচ্ছে।ইয়াদ সিগারেটে আরো দুই টান দিয়ে নির্ধারিত বক্সে সিগারেটের অংশ বিশেষ রেখে দিলো।পুনরায় সে নিজের জায়গা করে নিলো সেই কাঁচের জানালার সামনে। সপ্তম তলা থেকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখছে সে।প্রায় সবটাই বিল্ডিং, তার দৃষ্টির সীমানায় পড়ছে।প্রকৃতির কিছুই এইখানে বিদ্যমান নেই।তবে ইয়াদের পছন্দ প্রকৃতি।তাই সুযোগ পেলেই সে তার বন্ধুদের সাথে ট্যুরে চলে যায়।আপাতত ইয়াদ ব্যতীত সবাই ব্যস্ত কাজে।তাই ট্যুরের চিন্তা ইয়াদ নিমিষেই বাদ দিলো।
দরজা খোলার শব্দে ইয়াদ পেছনে বাঁক ফিরলো।ফারসিভের হাসিমুখ দেখে, বিনিময়ে ইয়াদ হালকা ঠোঁট প্রশস্থ করলো নিজের।
–“কাজ শেষ হয়েছে তোর?”
ইয়াদ প্রশ্ন করলো।
–“হ্যাঁ।মাত্রই কিছু জরুরী কাজ শেষ করলাম।”
ফারসিভ জবাব দিলো।
দুইজনই মুখোমুখি বসে পড়লো।ফারসিভ ফোন করে খাবার অর্ডার করলো ইয়াদের পছন্দ অনুযায়ী।বেশ কিছুক্ষণ পর আগমন ঘটলো ইয়াসির এবং স্পন্দনের।

–“তোরা আজ এসেছিস কেনো?এতো দেরী কি মেনে নেওয়া যায়?”

–“কি করবো বল?আমি এসে নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম স্পন্দনের জন্যে।শালা যেনো আমাকে ছাড়া চলতে পারে না।”
ইয়াসির জবাব দিলো ইয়াদের প্রশ্নের।

স্পন্দন কিছু বলার পূর্বেই বাকি তিনজন একসাথে বলে উঠলো,
–“ঢাকা শহরের জ্যাম কেটে এসেছি, এটাই অনেক!”
হাহা করে হাসির রোল পড়লো সেই কক্ষে।স্পন্দনের এই ডায়লগ সবার চেনা।সবাই আড্ডার ছলে খেতে বসেছে।আড্ডার মাঝে তাদের কথা হলো, খাওয়া শেষে সবাই মিলে বেরুবে।আজ তারা শুধু বাইক নিয়েই যাবে।বাকি স্পন্দন আর ইয়াদের গাড়ি এইখানের পার্কিং লটে থাকবে।
বেরুনোর পূর্বে ইয়াদ নিজেকে আয়নার সামনে উপস্থিত করলো।চকলেট রঙের শার্টের নিচের কর্ণ টেনে, মুখে মাস্ক পরিধান করলো সে।মাথায় ক্যাপ চাপার পূর্বে সে নিজের চুলগুলো আলগোছে ঠিক করে নিলো।চোখে কালো রঙের চশমা ব্যবহার করে ইয়াদ সবার উদ্দেশ্যে বললো,
–“চল।”
–“লেটস গো।”
ইয়াসির হেসে বললো।
ইয়াদকে শনাক্ত করার জো নেই।ইয়াদ নির্দ্বিধায় সবার মাঝে হেঁটে যাচ্ছে।কেউ বুঝতেই পারছে না,এই মহাশয় ইয়াদ বিন তেহরান! চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো,ইয়াদ এবং ফারসিভ যাবে ফারসিভের মোটর বাইকে আর স্পন্দন এবং ইয়াসির যাবে ইয়াসিরের মোটর বাইকে।ইয়াদ ফারসিভের সামনে হাত পাতলে তাকে বাইকের চাবি দেয় ফারসিভ,
–“তোর আম্মি থেকে লুকিয়ে বাইক চালাস,এটা কি আন্টি জানে?সেদিন রাতেও তুই বাইক চালিয়েছিস।দেখ ধীরে সুস্থে চালাবি।”
ইয়াদ ক্যাপ,মাস্ক খুললো।হেলমেট পড়া অবস্থায় সে জবাব দিলো,
–“ব্র্যান্ড নিউ বাইক গ্যারাজে পড়ে আছে আম্মির নির্দেশে।আর আমি আম্মিকে বলবো বাইক চালিয়েছি? আম্মি দেখবি আমাকে খোঁজার জন্যে বেরিয়ে পড়েছে, যদি জানে আমি বর্তমানে বাইক চালাবো।”
–“একমাত্র ছেলে তুই, তাই আন্টি বেশি চিন্তা করে।”
–“হু নৌস?স্পিড বাড়ালে চিল্লাবি না।”
–“উম,আচ্ছা।”
ফারসিভ ভীত কণ্ঠে বললো। বাইক হাতে পেলে ইয়াদের হুঁশ থাকে না,এটা চিরন্তন সত্য।কিন্তু, ইয়াদ তার আয়ত্বের মাঝে রেখেই চালায়,আর এই আয়ত্বই সবার কাছে একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়।
ইয়াদের বাইক এর পাশাপাশি ছুটছে ইয়াসিরের বাইক।ব্যস্ত সড়কে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ তার।কোনোদিন রাস্তায় অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হয়নি সে।আজও সে নিজের উপর শতভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে,মানুষের সব দিন তো সমান যায় না।তাই না?
_______________
ঢাকার অভিজাত হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় আছেন রিজোয়ানের মা। কাল সন্ধ্যায় উনার শরীর খারাপ লাগলে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক সেবা দিয়ে রোগীকে দ্রুত ঢাকায় নেওয়ার নির্দেশ দিলো।সেই নির্দেশনা পেয়েই ভোর বেলায় এম্বুলেন্সের মাধ্যমে তারা এই হাসপাতালে পৌঁছায়।সাথে এসেছে দুআ।চট্টগ্রামে চিকিৎসা নেওয়াকালীন কাকীমার শেষ অনুরোধ ছিলো,দুআ যেনো তার পাশে থাকে।তাই রিজোয়ান তাদের সাথে দুআকে নিয়ে আসলো।
নিদ্রাহীন রাত কেটে সকালে তন্দ্রাভাব এসে ভর করলো দুই ভাইবোনের চোখে।দুআ কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে এইবার তার ভাইকে সেই সুযোগ দেওয়ার জন্যে নিজে সজাগ হলো।দুআর প্রথম ঢাকা ভ্রমণ আনন্দের হওয়ার কথা হলেও ব্যাপারটা ঘটলো একেবারে ভিন্নতায়।তবে এখন একটু স্বস্তি অনুভব করছে সে।কারণ,রিজোয়ান বললো; তার কাকীমা আজ সারাদিন অবজারভেশনে থাকলে রাতের দিকে বাড়িতে নেওয়া যাবে।হার্টের কিছু দুর্বলতায় ভুগছেন উনি।যার দরুণ,ঢাকায় না আনলে বড় কোনো ক্ষতি হতে পারতো।চট্টগ্রামের চিকিৎসকের সেই পরামর্শের জন্যেই আজ কাকীমার বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি।

দুআ নিঃশব্দ।যতক্ষণ কাল এম্বুলেন্সে ছিলো ততক্ষণ তার কাকীমাকে দেখেছিল সে।এইখানে আসার পর আর একবারও দেখার সুযোগ পায়নি দুআ।বুকটা এখনোও ধুকধুক করছে তার। কাল কি থেকে কি হয়ে গেলো,এখনো যেনো দুআর কাছে সবটাই ধোঁয়াশা।তবে দুআ খুব করে দোয়া করছে,তার কাকীমার সুস্থতার জন্যে।চারিদিকে বড় বড় স্ক্রিনে হাসপাতালের নানান ভালো দিক উল্লেখ করছে।দুআ আপাতত সেইসবে দৃষ্টি জ্ঞাপন করছে নিভৃতে।
হঠাৎ এমন বড় দূরত্বের ভ্রমণের দরুণ,দুআর শরীর নেতিয়ে আসছে।কিন্তু,সে এই দুর্বলতার আভাস পেতে দিলো না রিজোয়ানকে।ভাইয়ের চিন্তা আর বাড়ানোর ইচ্ছে নেই তার।তবে,শরীরটা তার ঢুলুঢুলু।মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাবে!

রিজোয়ানের তন্দ্রা ছুটলো।ডাক্তারের সাথে দেখা করা শেষে রিজোয়ান দুআর সামনে এসে বললো,
–“চল,কিছু খেয়ে আসি।”
দুআর মাথা ধরেছে।মুখে হাসি ফুটিয়ে তাও সে জবাব দিলো,
–“আচ্ছা।”
বসা থেকে উঠতেই দুআর জগৎ ঘুরে উঠলো।সে নিজেকে ধরে রাখলো বেশ সতর্কতায়।এই যেনো দুআর দুনিয়ায় টিকে থাকার জোর প্রচেষ্টা!

হাসপাতাল থেকে বেরুতেই রিজোয়ান কড়া নির্দেশ দিলো দুআকে,
–“মাস্ক পড়ে রাখ। ঢাকায় ধুলাবালি প্রচুর।”
দুআ মাথা নেড়ে ব্যাগ থেকে মাস্ক নিয়ে সেটা পড়লো।দুআর শরীর টলছে।দুআ কিছু বলার পূর্বে ফোন এলো রিজোয়ানের।কথা বলতে বলতে সামনে এগুচ্ছে তারা।হাসপাতালের উল্টোদিকে এক রেস্টুরেন্ট তাদের গন্তব্য।ব্যস্ত সড়ক পার হলো দুআ রিজোয়ানের সাহায্যে।নিজেকে ব্যস্ত রাখতে দুআ রিজোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,
–“মাইশা আপু ফোন করেছিল?”
–“হ্যাঁ,ওর আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে বললো।”
–“যাবে কি?”
–“নাহ,আমরা রাতেই ব্যাক করবো।চেনা নেই,জানা নেই ওর আত্মীয় স্বজনদের বাসায় আমরা কেনো যাবো?”
–“এইভাবে বলছো কেনো?আপু সৌজন্যতার খাতিরে বলেছে।”
–“আমার এইসব পছন্দ না।”
–“এমন পাথর ছেলেকে মাইশা আপু কিভাবে ভালোবাসে আল্লাহ্ জানেন!”
দুআ দুষ্টুমির ছলে বললো।
–“দুআ!মাইর খাবি কিন্তু।”
রিজোয়ানের কথায় দুআ হাসলো বৈকি কিছু বললো না।গলা যে তার ধরে আসছে!

রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনে উবুত রয়ে রইলো দুআ।মাথায় পানি দিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টায় রইলো সে।
অল্প কিছু খেয়ে নিজের কিছু শক্তি সঞ্চয় করার প্রচেষ্টা করছে দুআ।কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে,তার শরীরটা এখনই ভেঙে পড়বে।তার বাবা হয়তো,তার এই অবস্থার কথা ভেবেই ঢাকায় আসার জন্যে বারণ করেছিল।বাবার বুঝি সব জানেন!

তাও,দুআ আসবেই আসবে পরবর্তীতে ঢাকায় রিজোয়ানের সাথে।শরীর খারাপ হলে হোক,এই তথ্য বাবা থেকে তার লুকাতে হবে।এইসব নানান কথা ভাবছে সে।
–“চাঁদ,উঠে পড়।”
দুআ উঠে দাঁড়ালো মুখে মাস্ক লাগিয়ে।একে তার দুর্বল লাগছে তার উপর রাস্তায় বেজায় ধুলবালি।অতিষ্ট লাগছে দুআর।দুর্বলতা তার সারা সত্ত্বায় ছড়িয়ে পড়লো যেনো।নিভৃতে সে হাঁটছে ভাইয়ের হাত ধরে।
হঠাৎ থমকে গেলো রিজোয়ান।আবারও ফোন বাজছে তার। ব্যস্ত সড়কের কোলাহলের শব্দে ফোনের কিছুই যেনো শুনছে না রিজোয়ান।
–“চাচী ফোন করেছে।এইখানে কাছাকছি এসেছে বললো।বাকি কথা বুঝলাম না। কর্ণারে চল।”
রিজোয়ান হাঁটা আরম্ভ করলো।দুআ সামনে পা দিতেই নিজের পায়ের ধারে একটা কুকুর ছানা আবিষ্কার করলো।দুআ সন্তপর্নে বসে পড়লো কুকুর ছানাকে কোলে নিয়ে।এইযে রিজোয়ান পিলারের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ফোনে আর আলগোছে তাকাচ্ছে দুআর দিকে।হাতের ইশারায় দুআকে সেখানেই থাকতে বললো সে।

–“এই কুকুর ছানা,তোমার মা কোথায়?”
কুকুর ছানা শুধু লেজ নড়ালো। অপর প্রান্তে অন্য বড় কুকুর দেখে দুআ তার কোল থেকে কুকুর ছানা নামিয়ে দিলো আর অমনি মা কুকুর ঘেউ ঘেউ শব্দ করতেই ছানাটা দৌড় লাগালো।হতবম্ব দুআ কুকুর ছানাকে ব্যস্ত সড়কের গাড়ির আঘাত থেকে বাঁচাতে নিজেই সেদিকে পা বাড়ালো। উদ্দেশ্য তার কুকুর ছানাকে বাঁচানো!কিন্তু দেরী হয়ে গেলো।দুআ এরমধ্যেই মাঝ রাস্তায়।কুকুর ছানার নাগাল পেলে, দুআ কুকুর ছানা সমেত রাস্তায় বসে পড়লো।সামনে থামলো তার দ্রুতগামী এক মোটর বাইক।দুআর সারা দুনিয়া টলমল করছে।হাত থেকে কুকুর ছানা ছুটে দৌড় দিলো তার মায়ের কাছে।

মোটর বাইক থেকে দ্রুত নামলো ইয়াদ এবং ফারসিভ।দুআর কাছে গিয়ে হেলমেটের কালো কাঁচ উঠিয়ে ইয়াদ তাকে প্রশ্ন করলো,
–“ঠিক আছো?”
মাথার অর্ধভাগে শুভ্র রঙের ওড়না,কালো কেশ ছড়িয়ে আছে চারদিকে,নিস্তব্দ বসে থাকা এক রমণীকে দেখতে পেলো ইয়াদ। মেয়েটা কেনো মাথা নিচু করে রেখেছে এটাই সে বুঝতে পারলো না।
লম্বা জ্যামের সৃষ্টি হলো মুহূর্তেই।ট্রাফিক পুলিশ এসে ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করছে।
–“হেই!তুমি ঠিক আছো?”
ফারসিভ বললো।
ভয়ে এবং দুর্বলতায় দুআর মুখের ভাষা নেই।রিজোয়ান উপস্থিত হতেই ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিলো।
দুআর বাহু চেপে তাকে উঠতে সাহায্য করে, ক্রোধে রিজোয়ান ধাক্কা দিলো ইয়াদকে,
–“বাইক চালানোর সময় মানুষ চোখে দেখেন না?”
–“এই এই কি করছেন?”
ফারসিভ ইতস্ত হয়ে বললো।ফারসিভ তো জানে ভুল মানুষের গায়ে ধাক্কা দিলো রিজোয়ান।ইয়াদ এরমধ্যে চেপে ধরলো রিজোয়ানের কলার,
–“আমি ছাড়া অন্য কেউ হলে এই মেয়ের কন্ডিশন এই অবস্থায় থাকতো না।আরো খারাপ হতো।”
ইয়াদ এর নজর গেলো এইবার দুআর দিকে।দুআর নেত্রযুগল ক্লান্ত এবং ভীত কিন্তু অসম্ভব সুন্দর দেখতে!
কিন্তু, পলকেই ইয়াদ আবার রিজোয়ানের দিকে দৃষ্টি দিলো।
দুআর সেই ভারী চোখে ইয়াদের দিকে তাকালে দেখলো রিজোয়ান থেকেও লম্বা উচ্চতার এক ছেলেকে।চোখাচোখি হওয়ার পূর্বে দুআ নিজের দৃষ্টি সংযত করলো।
রিজোয়ান কিছু বলার চেষ্টা করতেই দুআ ছোট্ট কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“ভাইয়া,আমার দোষ।আমি না বুঝেই দৌড় দিয়েছি কুকুর ছানার পিছে।”
ইয়াদ রিজোয়ানের কলার ছাড়লো।রিজোয়ান এখনো ফোঁসফোঁস করছে রাগে।ইয়াসির এর বাইক এসে পৌঁছালো জ্যাম এড়িয়ে।তারা নির্বাক এইখানের ঘটনা দেখে।
–“চাঁদ,ঠিক আছিস তো?ভাইয়াকে বল?”
–“আরে আপনারা সাইডে আসুন।ট্রাফিকের সমস্যা হচ্ছে।”
ট্র্যাফিক পুলিশের কথায় তারা সবাই একসাথে এক কিনারায় আসলো। ট্র্যাফিক পুলিশের সাথে রিজোয়ান,ইয়াদ এবং বাকি সবাই কথা বলে নিচ্ছে।কিন্তু, পাশে দাঁড়ানো দুআ,চাপ সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়লো।পড়ে যাওয়ার পূর্বে ইয়াদ দুআর হাত চেপে রিজোয়ানের কাছে ফিরিয়ে দিলো তাকে।
ইয়াদ ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“আপনার বোনের চিকিৎসার দরকার হয়তো।”
–“জ্বী দেখছি।”
তম্মধ্যে এসে হাজির হলো দুআর মা।গাড়ি থেকে নেমে রিজোয়ানকে দেখতে পেলো তার কাঙ্খিত ঠিকানায়।কিন্তু দুআর এমন অবস্থা দেখে দুআর মা আহেলি বেগম চিল্লিয়ে উঠলো দূর থেকেই,
–“দুআ!কি হয়েছে আমার মেয়ের?”
দুআ!নামটা আবারও ইয়াদ এর কাছে ছুটে এসেছে।তবে ইয়াদ জানে না এই দুআ কোন দুআ! দুআকে ছবির সাথে মেলানোর চেষ্টা করলো ইয়াদ।তবে মুখের নকশা বুঝতে পারলো না তার মুখের উপর থাকা এলোকেশ এবং মাস্কের জন্যে।পরক্ষণে ইয়াদ এক নজর তাকালো রিজোয়ানের দিকে।
কিন্তু না!রিজোয়ানের মুখে মাস্ক আর চোখে খয়েরী রঙের চশমা থাকায় ইয়াদ চিনলো না তাকে।আর না চেনার চেষ্টা করলো।নিভৃতে সে হেলমেটের কাঁচ লাগিয়ে উঠে পড়লো মোটর বাইকে।কি বুঝে যেনো ইয়াদ আবারও বাইকের লুকিং গ্লাসের দিকে তাকালো।দুআর মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে তার মা এবং ভাই।দুআর চুল চারিদিকে ছড়িয়ে তাকে আপাতত ঢেকে রেখেছে।দূরে যেতেই দৃশ্যটা বিলীন হয়ে গেলো লুকিং গ্লাস থেকে।
–“আমি ভাবিনি এতো জলদি মামলা মিটে যাবে।মেয়েটার ভাই বেশ রাগী মনে হলো।ভেবেছি আজ ক্রিকেটার সাহেবের মারপিট দেখা লাগবে।কিন্তু মেয়েটা অনেক ভালো মনের হয়তো।মেয়েটা কিভাবে নিজের দোষ স্বীকার করে নিলো!”
–“হ্যাঁ,ঢাকার অভিজাত এলাকার মেয়ে এতো শান্ত আমার জানা ছিলো না।যাক,ভালই হলো।খামোখা ঘোরার মুড নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলাম।মেয়েটা সামলে নিয়েছিলো,নাহলে আজ সত্যি একটা কিছু করে ফেলতাম আমি।”
ইয়াদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো।


বাসায় ফিরে নিজের ফোনের রেকর্ডিং চালু করে শোনালো ইয়াদ জিয়াকে।কিন্তু জিয়া বিনিময়ে হেসে উঠলো,
–“তুই এইসব কিছু শুনিয়ে আমাকে ভোলানোর চেষ্টা করছিস ইয়াদ?আমি জামালকে বিশ্বাস করি।জামাল এইসব কাজ করতেই পারে না।জামাল বলতো,তুই ভালো ছেলে।কিন্তু তুই কেনো ওকে দেখতে পারিস না?”
–“ওহ, বিড়ালটা তোকে সব পড়িয়ে দিয়েছে?সমস্যা নেই আপু,আমি যেদিন ওকে পাবো তোমার সাথে ফাইজলামি করার সময়;সেদিন তাকে তোমার সামনেই মারবো আমি।”
ইয়াদ ক্ষিপ্ত সুরে জবাব দিলো।
–“তুই আমার মন থেকে কখনোই পারবি না তাকে মুছে দিতে!আমার ভালোবাসা এতো সস্তা না।”
–“এইসব ভালোবাসা পালাবে,দেখে নিও।সেদিন তুমি তোমার ভাইয়ের হিংস্র রূপ দেখবে।বাদ বাকি তোমার ভালোবাসা সস্তা না।জামাল লোকটাই সস্তা।”
–“ইয়াদ,তুই কিভাবে…”
ইয়াদ রাগের মাথায় দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লো জিয়ার রুম থেকে।কোমরে হাত রেখে দুইবার নিজের চুলের উপর হাত বুলিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো সে।দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে তার মায়ের পাশে বসে পড়লো সোফায়।তার মা মাত্রই কান থেকে ফোন রাখলো।হেসে ডালিয়া নিজের ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
–“ঠিক আছো, আব্বা?”
–“হুম, আম্মি।”
ইয়াদ চোখ বুঁজে থেকে জবাব দিলো।
–“আরো কয়েকদিন কি আছো বাসায়?”
–“মাস খানেক আছি।কেনো?”
–“ভালো হলো।তোমার ছোট ফুফু ফোন দিয়েছিল।মাইশার শশুর বাড়ির লোকেরা কিছুদিন পরে আসবে বলে জানালো।রিজোয়ানের মাকে আজ ভোরে ঢাকায় এনেছিলো চিকিৎসার জন্যে।”
ইয়াদের মাথায় হঠাৎ চলে এলো আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা।কেনো যেনো তার দুআর সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হলো।সে সরাসরি তার মাকে।প্রশ্নে করলো,
–“উনারা দুইজন এসেছেন শুধু?”
–“নাহ,ছেলেটার বোন দুআ মেয়েটাও এসেছে বললো।কিন্তু,আজ মেয়েটাও অসুস্থ হয়ে গিয়েছে।রাস্তায় এক্সিডেন্ট এর হাত থেকে বাঁচলো মেয়েটা।শুনলাম ছেলেটার নাকি দোষ নেই,মেয়েটা কুকুর ছানাকে বাঁচাতে রাস্তায় দৌড় দিলো।আহারে মেয়েটা।ছোট্ট মন হয়তো বুঝেনি, উনিশ বিশ হলেই বড় কিছু হয়ে যেত!”
ইয়াদ থমকে রইলো।তার মনের কথাটা এইভাবে সত্যি হয়ে যাবে সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।শুভ্র রঙের ওড়না পরিহিত ভীত মনোরম নেত্রযুগলের দুআর আজকের বাস্তব ছবিটা যেনো তই তই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইয়াদের সারা মস্তিষ্কে।দুআ মেয়েটা কেনো এইভাবে ইয়াদের মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে এটাই ইয়াদের মাথায় আসছে না।তবে ইয়াদ জানে,পূর্বের মতো আজকের স্মৃতিও নানান ব্যস্ততায় ভুলে বসবে সে।
পরক্ষণে ইয়াদের মনে এলো,কখনোই সে দুআর ব্যাপারটা পুরোপুরি ভুলেনি।তার মস্তিষ্কের বা মনের কোনো এক অংশে আছে “দুআ” নাম এবং মেয়ে দুটোই।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here