আমার_চন্দ্রাবতী-১৩

0
783

#আমার_চন্দ্রাবতী-১৩
লেখিকা- সালসাবিল সারা

মুষলধারে বৃষ্টির আগমন হলো আচমকা।পাহাড়ে অবস্থানরত মানব মানবী সকলের ঠাঁই মিললো সেই ছোট্ট টঙের দোকানে।টিনের চালে ঝপঝপ বৃষ্টির সুর স্পষ্ট।এইদিকে কয়েকজনের জন্যে এই ছোট্ট দোকান একটু বেশি ছোট হলো আয়তনে। যার দরুণ, ছেলেদের কারো কারো শরীরের অর্ধেক অংশ বৃষ্টিতে ভিজে একাকার।দুআ এবং সকল মেয়েমানুষ চায়ের দোকানে বিদ্যমান মাঝারি সাইজের বেঞ্চে বসে রইলো।ইয়াদ, ইয়াসির দোকানের এক প্রান্তে ঠিক দুআর সম্মুখে দাঁড়ানো অবস্থায় আছে। অপর প্রান্তে ফারসিভ এবং স্পন্দন করলো নিজেদের অবস্থান।ইয়াদ একপাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফলে, তার ডান পাশের হাত এই বর্ষণের শিকার হলো।একদিক বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেলেও ইয়াদের অপর পাশ বৃষ্টির পানিতে স্নানরত।দুআর বিস্ফোরিত দৃষ্টি ইয়াদের পানে।লম্বা মানবটা খুব কষ্ট করেই টঙের দোকানে নিজেকে ঠাঁই দিয়েছে যেনো।পাশে থাকা বন্ধুকে নিজের নিরাপদ জায়গাটুকু দিয়ে নিজেই অর্ধেক ভিজছে সে।দুআর কেমন মায়া হলো। মানবটার উচুঁ মুখখানার এক পাশ দৃশ্যমান।সেই একপাশ দেখে দুআ আন্দাজ করতে পারছে,এই অসময়ে বৃষ্টিটা পছন্দ হচ্ছে না খেলোয়াড় সাহেবের।হঠাৎই দুআ খেয়াল করলো,খেলোয়াড়ের মুখটা অল্প নিচু হয়ে বামে বাঁক ফিরছে। খেলোয়াড়ের চোখের মনি স্থির হলো দুআর আখিঁর মনিতে।অতঃপর দুইজনের চোখাচোখি।ইয়াদ যেনো সন্তর্পনে হাসলো!অদ্ভুত শিহরন জাগলো দুআর তনুখানায়।দৃষ্টি ঝুঁকলো দুআর।খেলোয়াড়, মানবটার তীক্ষ্ম চাহনি দুআকে কেমন অস্থির করে তুলে নিমিষে। দেহখান যেনো এখনই এই আবেশে পুড়ে ছারখার হবে?অদ্ভুত লজ্জার আবরণ দুআর উপর ভর করলো।কিন্তু, দুআ এমনটা চায় না।এমন অপ্রত্যাশিত কিছু দুআর চাওয়ার লিস্টে একেবারে নিষিদ্ধ।তবে দুআ নিরুপায়।ঢাকা থেকে আসার পর নিজেকে সংযত রাখলেও,এই মানবের এখনকার উপস্থিতি পুনরায় তাকে সেই আবেশে মত্ত করে নিচ্ছে গো-গ্রাসে। হাত মুঠ করলো মেয়েটা।নিজের মনের সাথে জোর খাটিয়ে ইয়াদকে নিয়ে সকল কল্পনা পিষে নিলো সে।দুআ কখনোই নিজের মনকে চোট পেতে দিবে না,এটাই যেনো তার জীবনের প্রধান পণ!

দুআর এমন ছটফট অবস্থা ইয়াদের দৃষ্টি কোটরে নিবদ্ধ।খুব কষ্ট করে আড়চোখে মেয়েটাকে উপলব্ধি করছে সে।ইয়াদের ধারণা দুআর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।দুআর মুখমন্ডল দেখে তাই মনে হলো ইয়াদের।কিছু সময় নিরব থেকে ইয়াদ নির্দ্বিধায় দুআকে প্রশ্ন করলো,
–“তোমার কি শরীর খারাপ করছে?”
দুআ চমকে উঠলো।তার আঁতকে উঠা দৃষ্টিদ্বয় ইয়াদের অবয়বকে গ্রাস করে নিচ্ছে নিভৃতে।কালো রঙের জিন্সের পকেটে এক হাত চেপে আছে ইয়াদ। পড়নে সাদা-কালো লম্বা হাতার গেঞ্জির সাদা অংশটা একেবারে ভিজে হাতের পেশীবহুল অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।দুআ পুনরায় নেত্রযুগল ঝুঁকে ফেললো।দম নিয়ে সে আওড়ালো,
–“নাহ।আমি ঠিক আছি।কিন্তু, আপনি এইভাবে বৃষ্টির মাঝে থাকলে আপনার শরীর খারাপ করবে।আপনি বরং ভেতরের দিকে চলে আসুন?”
দুআর এমন কথা উপস্থিত সকলকে নিয়ে গেলো চমকের চূড়ান্ত পর্যায়ে।এমনকি স্বয়ং ইয়াদ দুআর এমন জবাবের আশা করেনি।ইয়াদের মনে আশার বীজ রোপণ হলো গোপনে।সে নির্বিঘ্নে হেসে বললো,
–“বৃষ্টি আমার কিছুই করতে পারবে না।এমন বৃষ্টিতে কতো ভিজেছি!”
–“আচ্ছা।”
দুআ পুনরায় জবাব দিলো।দুআ এবং ইয়াদ বাদে বাকি সকল মানব তাদের এমন কথোপকথন দেখে মনে মনে নিজেদের মন মতো কাহিনী সৃষ্টি করে নিচ্ছে।তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো স্বয়ং দুআ। সে তো ইয়াদের জন্যে চিন্তিত হওয়ার ব্যাপারটা সবাইকে জানাতে চায়নি।কিন্তু,তারপরও মুখ ফস্কে কথাটা কিভাবে প্রকাশ করলো সে?
দুআ দ্বিধায় মত্ত।তার ধারণা ইয়াদ দুআকে গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে ভাবছে।কারণ,এইসব মেয়েরাই তো আগ বাড়িয়ে কথা বলে ছেলেদের কাবু করতে চায়।কিন্তু, দুআ এমন মেয়ে না।স্বপ্নেও এমন কথা ভাবা বারণ।তবে,ইয়াদের কেমন ধারণা হয় দুআকে নিয়ে?বুঝেনা দুআ।এই মুহূর্তে নিজের মনের প্রশ্নে,দুআর অবস্থা বেজার।সে চায় না,ইয়াদ তাকে গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে ভাবুক! তার উপর ইয়াদের বন্ধুরা আছেন এইখানে।তারাও যদি দুআকে একই রকম ভাবে?নাহ,দুআর অস্থির লাগছে দুশ্চিন্তায়। সে আঁখির নোনাজল সংযত রেখে পাশে অবস্থানরত রামিসাকে ফ্যাঁশফ্যাঁশে স্বরে প্রশ্ন করলো,
–“একটু আগে খেলোয়াড়কে বলা কথাটা কি আমাকে বাজে মেয়েতে রূপান্তর করেছে?”
দুআর আঁখি জোড়া টুপ করে দুই বিন্দু অশ্রুজল বিসর্জন করলো।
দুআর চোয়ালে হাত রেখে বিচলিত হলো রামিসা,
–“কি বলছিস এইসব,চাঁদ?কেনো তুই বাজে মেয়ে হবি?পাগলী একটা।”
–“আমার মনে হচ্ছে খেলোয়াড়কে করা প্রশ্নের জন্যে আমাকে উনি গায়ে পড়া মেয়ে মনে করবেন।কিন্তু ,তুই তো সব জানিস।আমি নিজেই বুঝছি না,আমি কিভাবে উনাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম?”
–“আহহা,এইসবের জন্যে কেউ মন খারাপ করে?”
–“আমি বাড়ি যাবো।ভালো লাগছে না আর এইখানে।”
দুআ নিজের গাল মুছলো।
–“আরেকটু থাকতে হবে।বৃষ্টির বেগ কমুক।”
রামিসা সান্ত্বনা দিলো দুআকে।

দুআ মাথা নাড়ালো ধীরে।

নিজের পিঠ পিছে,ইয়াদ দুআর এমন কান্ড কারখানা দেখে আপনমনে হাসলো।অল্প দূরত্বের কারণে দুআ এবং রামিসার সব কথা ইয়াদের কর্ণকুহরে এসেছে।ইয়াদ ভেবে পায় না,মেয়েটা এমন কেনো!সামান্য একটা প্রশ্ন করে এতো সংশয়ে ভুগছে সে?তবে এমন দুআর জন্যেই তো সে পাগলে রূপান্তরিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।এই সহজ সরল দুআ মেয়েটাই,ইয়াদের সারা সত্ত্বায় জুড়ে গিয়েছে সন্তর্পনে।

ইয়াদের ভাবনার মাঝে ইয়াসির ইয়াদের কানে ফিসফিস করে বললো,
–“তোর দুআ বেশি সহজ সরল না?এমন মেয়েকে সামলাতে পারবি তুই?”
–“অন্যের কথায় কান পাতছিস কেনো?”
ইয়াদ চোখ রাঙালো।
–“আরে বাপ,পিছেই তো কাহিনী হচ্ছে।আমি না শোনার কি?আর তুই কথা প্যাচাঁস কেনো?উত্তর দে।”
–“ইয়াদ তার দুআর জন্যে সব পারবে।”
বৃষ্টির শব্দে ইয়াসির কথাটা স্পষ্ট না শুনলেও ইয়াদের অধরের নড়চড় দেখে আন্দাজ করে নিলো উত্তর।বিনিময়ে ইয়াদের পিঠ চাপড়ালো সে।

বর্ষণ অল্প থামতেই ইয়াদ ফারসিভকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“কটেজের ম্যানেজারকে বল,এইখানে চারটা ছাতা পাঠাতে।”
–“এতো ছাতা তাদের স্টোরেজে থাকবে কি?”
–“এটা বৃষ্টির মৌসুম।এইখানে ট্যুরিস্ট আসলে অবশ্যই তাদের জন্যে ছাতার ব্যবস্থা করা তাদের দায়িত্ব।তুই ফোন লাগা।”
ফারসিভের প্রশ্নে ইয়াদের কড়া কণ্ঠের জবাব।

ইয়াদের কথা অনুযায়ী ফারসিভ ফোন করলো কটেজের ম্যানেজারকে।উনি জানালেন, দশ মিনিটের মধ্যে ছাতা পৌঁছে যাবে।পাঁচ মিনিটের মাথায় বৃষ্টির বেগ একেবারে কমলে ইয়াদ এবং তার বন্ধুগণ বেরিয়ে গেলো টং থেকে।তারা সবাই পাহাড়ের বাম পাশে বিদ্যমান বড় গাছের দিকে ভিড় জমিয়েছে। স্পন্দন এসে দোকান থেকে তাদের জন্যে সিগারেট নিলো। নিচু দৃষ্টিতে দুআ সবটাই নিজের মস্তিষ্কে ধারণ করছে।নজর ঘোরাতেই তার দৃষ্টিতে এলো ইয়াদ বন্ধুগণের সাথে সিগারেট ফুঁকছে।তার ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত।হয়তো কিছু নিয়ে আলোচনা করছে তারা!তবে দুআর কাছে ইয়াদের এই সিগারেটের ব্যাপারটা ভালো ঠেকলো না।দুআর দৃষ্টি এখনো ইয়াদেই আবদ্ধ। সিগারেটের প্রত্যেক টানের পর দক্ষ কায়দায় গাল হাঁ করে ধোয়া নিঃসরণ করছে সে। দুআ নিজের কোলের উপর থাকা ওড়নায় দৃষ্টি জ্ঞাপন করে সেটাতেই মত্ত হলো। সিগারেটে মত্ত মানবটার দিকে তাকানোর দ্বিতীয় ইচ্ছা জাগলো না তার মনে।
–“চল আমরা যায়!”
দুআ বললো।
–“হুম, ছাতা আসুক।আমাদের তো অনেক পথ হাঁটতে হবে।পথিমধ্যে বৃষ্টি এলে আবার সমস্যা।”
মাহি জবাব দিলো।
–“ছাতা? কোথায় পাবো?”
–“ইয়াদ ভাই,ফোন করলো তো।”
মাইশা উত্তর দিলো দুআর প্রশ্নে।
–“উনি হয়তো উনাদের জন্যে আনতে বলেছেন।আমরা কেনো অপেক্ষা করে আছি?চলো যায়।আমার ভালো লাগছে না।”
দুআর জিদের কাছে হার মানলো সকলে। টঙ থেকে বেরিয়ে মাইশা আর রামিসা চললো ইয়াদের সম্মুখে।দুআ এবং মাহি তাদের থেকে একটু দূরেই আছে।দুআ আর এক নজর ফিরলো না সেদিকে।নজর ফেরানোর কোনো কারণ খুঁজে পেলো না দুআ।

–“ছাতা আমাদের জন্যেই ছিলো। পেয়ে যাবো ছাতা পথিমধ্যে।আমরা রওনা দিই চল।”
মাইশার কথায় দুআ মাহির হাত চেপে সিঁড়ির দিকে আগালো।

–“ইয়াসির আগে নাম,এরপর রামু যা।স্পন্দন আর মাহি যাও,মাইশা আর ফারসিভ যা।পিচ্ছিল অবস্থায় একা যাওয়া ঠিক হবে না।একজনের সাথে অন্যজন থাকা বাধ্যতামূলক।আমি সবার শেষে দুআর পেছনেই আছি।”
ইয়াদের এমন কথায় সকলে সায় জানালেও,দুআর মনটা অশান্ত হয়ে উঠলো।তবে কিছু বলতে পারলো না সে।এর পূর্বেই একে একে সকলে নামতে শুরু করলো।বৃষ্টি আসার পূর্বে এই স্থান ত্যাগ করা সবার মুখ্য উদ্দেশ্য।বৃষ্টির কারণে পাহাড়ের সারা সত্ত্বা গাঢ় সবুজ।তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃষ্টি হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সাবধানতার সাথে নামছে সকলে।দুআর মনটা দুরুদুরু।উঠার সময় রামিসা এবং মাহির সাহায্যে তাদের বাঁধনে উঠলেও; নামার সময় একা একা তার শরীরে কম্পন সৃষ্টি করছে।এর উপর পেছনে বিদ্যমান লম্বা মানব তাকে বারংবার সাবধানে পা ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে। যার দরুণ,অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে করতে বাকি সবাই তাদের চেয়ে বেশি দূরত্বে চলে গেলো।পাহাড়ে উঠতে যতো সহজ,নামতে তার চেয়ে বেশি কঠিন।তার উপর বৃষ্টির কারণে জায়গাটা স্যাঁতস্যাঁতে।নিজেকে সামলাতে না পেরে দুআ মাহি এবং রামিসাকে ডাকার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।অশ্রু তার আঁখিতে ভিড় করলো আর দুআর গলার স্বর হলো বন্ধ।

দুআর নড়চড় না দেখে ইয়াদ একটু ঘবড়ালো।
–“দুআ!”
ইয়াদের কণ্ঠ দুআর বোধগম্য হলো না।সে মনে মনে ধারণ করলো,তার নামতে দেরী হওয়াতে ইয়াদের মেজাজ বিগড়েছে।দুআর অশ্রু বাঁধ মানছে না। সিঁড়ির একপাশের হাতল ধরে চেপে গেলো সে। ধাধস্ত কণ্ঠে সে ইয়াদকে জবাব দিলো,
–“আপনি চলে যান।আমার জন্যে আপনি আটকে আছেন।দুঃখিত।প্লিজ,মাহি আর রামিসাকে ডেকে দিবেন?ওদের ছাড়া আমি নামতে পারবো না।”
দুআর কান্নারত অবস্থার বেগ পেয়ে ইয়াদ দুআকে টপকে সামনে এলো।মেয়েটা কেঁদে একাকার।তার আঁখিতে ভয় আর অনুশোচনা দুইটাই লক্ষ্য করলো ইয়াদ।সে দুআকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করলো,
–“হেই,শান্ত হও।আমি মোটেও আটকে নেই।তুমি আস্তে ধীরে নামতে পারো।আমি তোমার পিছেই আছি।”
দুআ দুদিকে মাথা নাড়ালো,
–“আমি পারবো না।সত্যি পারবো না।উপরে উঠতে আমাকে ওরা দুইজনই সাহায্য করেছিল।নিচে নামাটা আমার জন্যে সত্যি কষ্টদায়ক।তাও একা!আমি এটা ভাবতে পারছি না।ওরাও এখন সামনে নেই।আমার মনে হচ্ছে আমি পড়ে যাবো।”
ইয়াদ বুঝলো না দুআর কথার ধাজ।মেয়েটা কেঁদে কুটে গড়গড় করে সব বলছে এখন। উপরে এই ব্যাপারে একটুও মুখ খুললো না দুআ।ইয়াদ মিনিট দুয়েক দুআকে বিশ্লেষণ করলো।দুআর ব্যাপারটা এখন যেনো ইয়াদের বোধগম্য হলো কিন্ঞ্চিৎ।
কিছু চাপা স্বভাবের মানুষ থাকে,যারা স্বাভাবিক অবস্থায় নিজের মনের কথা প্রকাশ না করলেও; কান্নারত বা চিন্তিত অবস্থায় ভাষণ দিয়ে মনের কথাটা জানিয়ে দেয় মুহূর্তেই।দুআর এমন অবস্থা দেখে ইয়াদের মন খারাপের পাশাপাশি অন্য কথা ভেবে বেশ আনন্দ ছুঁয়ে গেলো হৃদয়ে।
দুআর দুই আঁখি আর নাক টকটকে লাল রং ধারণ করেছে।নেত্রপল্লব নোনাজলে ভিজে আছে তার।কুঞ্চিত ভ্রুজোড়া আর ঝুঁকানো নজরে আবারও দুআ ইয়াদের মনে দাগ কাটলো।নিজের মনের বাসনা আর দুআর প্রতি ভালোবাসার তাগিদে সুন্দর একটা পরিকল্পনা করলো ইয়াদ। দুআর সামনে দুই হাত নাড়িয়ে সে তাকে বুঝিয়ে বলতে আরম্ভ করলো,
–“দেখো,তোমার বান্ধবীরা অনেক দূরত্বে চলে গেলো।এই মুহূর্তে তারা তোমার জন্যে ফিরবে না।কারণ,আমি তাদের বিশ্বস্ত মানুষ।তারা আমার ভরসায় তোমাকে ছেড়ে আগেই প্রস্থান করেছে।এখন তুমি কি চাও ওরা আবারও ফিরে আসুক?তাছাড়া তুমি বলার সাথে সাথেই আমি ফোন বের করেছিলাম কিন্তু নেটওয়ার্ক জিরো। পাহাড়ের চূড়ায় নেটওয়ার্ক থাকলেও এইখানে এক দাগও নেই।এখন বলো কি করবে?”
দুআ নাক টেনে যাচ্ছে।উত্তর পাচ্ছে না খুঁজে।
–“আমি তোমার সামনে হাঁটবো।তাই ভয় পাওয়ার দরকার নেই।পড়লে আমাকে নিয়ে পড়বে।আর আমার মনে হয়,তোমার ছোট্ট সত্তা আমাকে টপকিয়ে নিচে ভেসে যাবে না।আমি আছি।নামবে এখন?”
দুআ উপর নিচ মাথা নাড়ালো।মনে মনে সে ইয়াদের কথাকে গুরুত্ব দিলেও তার বন্ধুবীগণকে এক গাদা গালি ছুঁড়ছে।তারা এই লম্বা মানবের ভরসায় রেখে কিভাবে চলে গেলো?তারা কি জানেনা,দুআ কতোটা ইন্ট্রোভার্ট অন্য মানুষের সামনে!

তারা জানলেও,দুআ জানেনা কেনো রামিসা এবং মাহি দুআর সাথে এই কাজটা করলো!কারণ তারা তো জানে,এই মুহূর্তটা দুআ এবং ইয়াদের একাকী সময় কাটানোর সুযোগ।নিজের সইয়ের প্রেমের সূচনা করতেই তাদের এমন উধাও হয়ে যাওয়া।সত্যিটা যদি দুআ জানে,তাহলে নিশ্চয় তার দুই সইয়ের দেহ থেকে ধর আলাদা করবে!
.
অর্ধেক পথেই কটেজের লোকের দেখা পেলো ইয়াসির।তাদের ইশারায় কাছে ডেকে ছাতা নিয়ে নিলো সে।তারা উপরের দিকে উঠতে চাইলে তাদের বাঁধা দিলো মাইশা।কারণ,সবাই যেহুতু চলে এসেছে ইয়াদ এবং দুআ চলে আসবে।এমনটাই তার ধারণা।মাইশা এইও জানে,দুআ ভীতু হওয়ায় তার একটু সময় লাগবে।এটাই স্বাভাবিক।যেহুতু এখন বৃষ্টি একেবারে থেমে আছে।তাই ছাতার প্রয়োজনটা ফিঁকে।অগত্য নিচে নেমে সকলে পাহাড়ের ভূমিতে অবস্থিত বেঞ্চে বসে অপেক্ষায় রইলো দুআ এবং ইয়াদের।

–“দুআ আর ইয়াদ কই হাওয়া হলো?”
ইয়াসির প্রশ্ন করলো রামিসাকে।
–“ইয়াদ ভাই দুআকে সামলাচ্ছে নিশ্চয়।দুআ এই মুহূর্তে ভীতুর ডিম হয়ে আছে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
–“আর ইয়াদ আমাদের ভাবীকে সুন্দর করেই কন্ট্রোল করবে,এটা আমার বিশ্বাস।”
রামিসা ইয়াসিরের পেটে গুতা দিলো,
–“ভাই আস্তে।আমার আপু জানেনা ইয়াদ ভাইয়ের মনের কথাটা।আগে ওদের দুইজনের মধ্যে কিছু হউক!এরপর আপনি চিল্লাবেন।”
ইয়াসির আঙ্গুল ঠোঁটে রাখলো,
–“ওকে ওকে।”
রামিসা চোখ রাঙালো ইয়াসিরের এমন ভাবভঙ্গি দেখে।

এইদিকে দুআ এক কদম দিয়ে দুই মিনিট বিরতি নিচ্ছে।এই অবস্থায় ইয়াদের মনে হলো আজ সারারাত তাদের এইখানেই কাটাতে হবে! দুআর ভীত চেহারা দেখে কিছুই বললো না সে।চুপ করে রইলো। নিচে ওরা কি করছে ইয়াদের জানা নেই।চিন্তিত অবস্থায় দুআর খোঁজে নিচ থেকে কেউ আসলে,তাদের একান্ত সময়ে ব্যাঘাত ঘটবে ।তাদের একান্ত সময়ে কারো আগমন ইয়াদের হজম হবে না।তাই সে পুনরায় দুআকে অনুরোধ করলো,
–“একটা কথা বলতে চাই।যদি আমাকে তুমি খারাপ ছেলে মনে না করো!”
–“বলুন।”
দুআর ভীত কণ্ঠ।
–“তুমি আমার কাঁধে এক হাত রাখো।অন্য হাতে হাতলটা চেপে ধরো। এতে আমরা দ্রুত নামতে পারবো, সাথে তোমার পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না।”
–“আপনার কাঁধে হাত রাখলে কি আপনি আমাকে বাজে মেয়ে ভাববেন?আপনি যদি মনে করেন,আপনি খেলোয়াড় হওয়ার সুবাদে আমি আপনার কাছাকাছি থাকতে চাইছি!বিশ্বাস করুন আমি এমন মেয়ে না।আমার সত্যি ভয় করছে।”
দুআ নিজের পাতলা অধর চেপে অসহায় ভঙ্গিতে অপর পাশে চেয়ে রইলো।
পুনরায় ভয়ের কারণে দুআ মনের বুলি সব প্রকাশ করছে,এটা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হলো না ইয়াদের।সে মলিন হেসে জবাব দিলো,
–“আমি কাঁধে হাত রাখতে বলেছি নিজ থেকেই।তুমি বাজে মেয়ে হবে কেনো?তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো,দুআ।জলদি চলো,প্লিজ।”
ইয়াদ দাঁড়ালো সম্মুখে মুখ দিয়ে।দুআ ইতস্ততবোধ করতে করতে কাঁধে হাত রাখার পূর্বে পুনরায় বললো,
–“হাত রাখছি।আমি কিন্তু সত্যি বাজে মেয়ে না।”
–“আই নো,দুআ।”
ইয়াদ হাসলো নির্বিঘ্নে।এমন সহজ সরল মেয়ে আজকাল খুঁজে পাওয়া যেনো বড্ড দায়।এই সহজ সরল মেয়েটার ছোঁয়াতে ইয়াদের তনু ঝনঝন করছে।অতঃপর তারা দ্রুত সক্ষম হচ্ছে নিচু নামতে।প্রথম প্রথম দুআর পা ফেলতে গরমিল হলে দুআ শক্ত করে কাঁধ স্পর্শ করে।আর এতেই ইয়াদের মনে সুপ্ত অনুভূতির আগমন হয়।দুআর এমন স্পর্শে ইয়াদ দহনে পুড়েছে সর্বক্ষণ।কিছুদূর আগাতেই দুআর মধ্যে এখন ভয় কাজ করছে না।

উপর থেকে তারা দেখতে পাচ্ছে বাকি মানব মানবীদের।তাদের কাছাকাছি যাওয়ার পূর্বে ইয়াদের পা থামলে দুআর কদমও থেমে যায়।
দুআ কিছু না বলে অবাক ভঙ্গিতে ইয়াদের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।পেছনে বাঁক ফিরে ইয়াদ নরম সুরে দুআকে বলে উঠলো,
–“টঙে আমাকে করা প্রশ্নটার জন্যে আমি তোমাকে মোটেও বাজে মেয়ে মনে করিনি।বরং তোমার সহজ সরল ব্যবহার আর চিন্তাধারায় আমি মুগ্ধ।তুমি ভালো মেয়ে।অ্যান্ড তোমার বিহেভিয়ার,আই রিয়েলি লাইক ইট।”
দুয়ার হাত সরে এলো ইয়াদের কাঁধ থেকে।তার বলা প্রত্যেকটা বুলি দুআর কর্ণগহ্বরে বারবার প্রতিফলিত হচ্ছে।শেষে বলা ইয়াদের বুলি দুআর কাছে মনে হচ্ছে এটা কেবলই স্বপ্ন।গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পুনরায় ধরণীতে আগমন ঘটলে ইয়াদ তারা লাগালো দুআকে,
–“চলে আসো,চন্দ্রা…দুআ।বৃষ্টি আসছে পুনরায়।”
ইয়াদের তীব্র কণ্ঠ শুনে মাহি নিচ থেকে দ্রুত পায়ে তাদের কাছে চলে এলো।দুআর হাত চেপে তাকে নিয়ে যাচ্ছে সে।ইয়াদ তাদের পিছু পিছু নামছে।বৃষ্টি নামার ভয় থাকায় দুআরা সিদ্ধান্ত নিলো সিএনজি ঠিক করবে বাড়ি ফেরার জন্যে।তিতলি কটেজের রাস্তা থেকে বেরুনোর পূর্বে না চাওয়া সত্ত্বেও নিজের মাথার উপর থাকা তিতলি কটেজের ছাতা সরিয়ে দুআর নজর ইয়াদের পানে ছুটে গেলো।যার দরুণ ইয়াদের মুখ ভঙ্গি এবং দৃষ্টিতে দুআর জন্যে বিদ্যমান মুগ্ধতা দুটোই উপলব্ধি করলো দুআ।ইয়াদের এমন মুখভঙ্গি যেনো একদম কাঁচের মতো স্বচ্ছ আর পবিত্র।
দুআ আর কিছু ভাবতে পারছে না।চোখ বুঁজলেই পুনরায় ইয়াদের সেই ভাবভঙ্গি আর তার বলা শেষ কথাটুকু দুআর কানে বাজছে।দুআ নিজেকে প্রশ্ন করলো,
–“আমার কানে কি ঠিক শুনেছি?নাকি সবটাই আমার ভ্রম?”
দুআর মন এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলো না।আফসোসের নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here