আমার_চন্দ্রাবতী,২১,২২

0
789

#আমার_চন্দ্রাবতী,২১,২২
লেখিকা- সালসাবিল সারা

গুণগুণ সুরে মুখরিত দুআর কামরা।হাত চালিয়ে রুমের শোভা বর্ধনের কাজে ব্যস্ত থাকা দুআ মিনমিন সুরে গানের পসরা সাজিয়েছে।এই গানের সুর তোলার পাশাপাশি দুআর কল্পনার রাজ্যে শুধু ইয়াদের ছবি আঁকছে মেয়েটা। আঁকবে নাই বা কেনো?মেয়েটার প্রেমিক পুরুষ যে ইয়াদ!এই কয়দিনে যতবার,যতক্ষণ,
যতো প্রহর ইয়াদের সাক্ষাৎ হয়েছিল, ইয়াদ সর্বক্ষণ মেয়েটাকে হারে হারে বুঝিয়ে দিয়েছিলো,ইয়াদের জন্যে “দুআ” হলো একরাশ ভালোবাসার নাম।খেলোয়াড় লোকটার যত্ন,দুআর খুঁটিনাটি ব্যাপারে খেয়াল রাখা,
দুআর প্রতি তার দায়িত্ববোধ,দেখা হলে আগলিয়ে রাখা,ভালোবাসাময় কিছু বাক্য নিবেদন,স্নেহশীল চাহনী, ভরসাময় উক্তি,সব কিছু দুআর মনে স্থায়ী হলো যেনো।
এইসবের জন্যেই তো আজকাল দুআ বড্ড ব্যকুল থাকে,কবে খেলোয়াড় লোকটার এমন পাগলামিতে শামিল করবে নিজেকে!দুআর ধারণা,দুআর রাজ ভাগ্য বলেই মেয়েটা এমন একজন প্রেমিক পুরুষ পেয়েছে।যে তার সবকিছুকেই ভালোবাসে।হোক সেটা দুআর নজর কাড়া রূপ বা দাগযুক্ত চামড়া!মেয়েটা ইয়াদের এমন ভালোবাসা দেখেই এখন মরিয়া হয়ে থাকে,কবে আবারও সাক্ষাৎ পাবে সে প্রেমিক পুরুষের?এমন প্রেমিক পুরুষের আহ্লাদী কর্মকাণ্ড কার’ই বা খারাপ লাগে?দুআ হেসে উঠলো আনমনে।লোকটা যখন চুপি চুপি সকলের আড়ালে তার হাতটা নিজের মুঠোয় নেয়,
তখনকার অনুভুতি দুআর সবচেয়ে প্রিয়,অতিপ্রিয়।সেই স্পর্শে থাকে না কোনো কামুকতা,থাকে শুধুই প্রেয়সীকে একটিবার ভালোবাসার ছোঁয়ায়,স্পর্শ করার আকাঙ্খা।
লোকটাকে মাঝে মাঝে দুআর পাগল বলেই মনে হয়।নাহলে, নিশিরাতের বেলায়ও লোকটা দূরের ল্যাম্প-পোস্টের নিচে এসেও হাজির হয়,একনজর তাকে দর্শনের সুবাদে। যদিও তখন ইয়াদের চারদিকে তার কাজিন মহল উপস্থিত থাকে,তবে ইয়াদের নজর স্থির থাকে ঠিক জমিদার বাড়ির পূর্ব দিকেই।
ইয়াদের কড়া মেসেজের সম্মুখীন হয়ে মেয়েটা রাতের নিদ্রাকে বিদায় দিয়ে প্রেমিক পুরুষের জন্যে খোলা জানালায় উকি ঝুঁকি দেয় সঙ্গে সঙ্গে।নিদ্রা কাটতেই, দুআর নজরে তার খেলোয়াড়ের অবয়ব দৃশ্যমান হয়।লোকটার অবয়বের সাথে তার হাতের ধোঁয়া নিঃসরণ করা সিগারেটও দুআর নজর থেকে বাদ যায় না।

লোকটা যেনো আস্ত বিড়িখোর। কিন্তু,লোকটা সরাসরি কখনোই দুআর সম্মুখে, অধরে সিগারেটের আনাগোনা রাখে না।

মধুর স্মৃতি আজ দুআর মস্তিষ্কে টগবগ করছে।কিছুতেই যেনো তারা বিদায় জানাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলো।
তবে, তার স্বপ্নরাজ্য ব্যাঘাত হলো মায়ের ডাকে,
–“চাঁদ,জলদি তৈরি হয়ে আয়।”

এমন কথা শুনে দুআর স্বপ্নরাজ্য ভেঙে চুরচুর।

মস্তিষ্কের গভীর থেকে উঁকি দিচ্ছে একটাই কথা,
–“মাইশার হলুদে,তোমার কাছে কিছু চাইবো আমি।সেটা কিন্তু মানা করা দুষ্কর তোমার জন্যে।নিশ্চয়,ভালো কিছু চাইবো না।তাই আগে থেকে নিজেকে প্রস্তুত করে রেখো,চন্দ্র।”
শেষবার ইয়াদের সাথে দেখা হলে উপরোক্ত কথাটি দুআর কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিল ইয়াদ।ছেলেটা সেদিনও প্রেয়সীর কপালে অধর ছোঁয়াতে গিয়েও পিছু হটেছিল।কারণ একটাই,দুআ।ইয়াদের মতে,ইয়াদ হুট করে যদি এই কাজ করে তবে দুআ কিছুতেই তার সামনে ধরা দিবে না,প্রাণ গেলেও না।তাই আগে থেকেই সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছে সে মেয়েটাকে।
কল্পনার রাজ্যে এতটাই বুদ ছিলো দুআ,সে ভুলতেই বসেছে আজ সন্ধ্যায় মাইশার হলুদ। অথচ সকালেই কাকিমা তাকে সুন্দর কলাপাতা রঙের জামদানি শাড়িটা পড়ে যেতে বলেছে।দুআ নির্দ্বিধায় তখন রাজি হলেও,পূর্বরক্তি ইয়াদের কথা ভেবে মেয়েটা তখনও লজ্জায় বুদ হয়েছিল।কিন্তু,হঠাৎ’ই প্রেমিক পুরুষের শক্ত বুলি কিভাবে যেনো ছুটে গিয়েছিল তার মস্তিষ্কের গহীন থেকে।
দুআর তনুতে তিরতির ভাব।তার ভাবলেশহীন ভাবভঙ্গি দেখে আহেলী পুনরায় বললো,
–“এই মেয়ে,কি হলো তোর! জেনি আসবে এখনই। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে।ফটফাট তৈরি হ।তমাল আর জুঁই আসলে ওদের গাড়িতে উঠবি।আমাদের বাকি আত্মীয় যাবে নিজেদের গাড়ি করে।”
সংশয়ে ডুবন্ত দুআ মায়ের পানে তাকালো।প্রেমিক পুরুষের স্পর্শ পেতে তার মনটাও আনচান করে,কিন্তু এর পরবর্তীতে লজ্জার দরুণ দুআর হুঁশ খোয়াবে কিনা, এই নিয়েই মেয়েটার যতো দ্বিধা।মেয়েটার লাজের পরিমাণ গগণ স্পর্শী।

–“আম… আম্মা,আমি না যায় আজ?”
দুআর ভীত কণ্ঠ।

বাঘিনীর ন্যায় গর্জন শোনা গেলো আহেলীর দুআর কথার প্রত্যুত্তরে,
–“রিজোয়ান শুনলে কেলেঙ্কারি বাজিয়ে দিবে।ছেলেটা তার বিশ্বস্ত ভাইদের তোকে নেওয়ার জন্যেই উল্টোপথে আসতে বলেছে।কোনো কথা নয়।জলদি তৈরি হতে শুরু কর।”

–“মালকিন,আমি আইসা পড়ছি।”
জেনি কামরায় প্রবেশ করলো হাসিমুখে।

–“এইতো,ভালো করেছিস জেনি একেবারে তৈরি তুই।এইবার এই মেয়েকে শাড়ি পড়িয়ে চুলটা পরিপাটি করতে সাহায্য কর।”
আহেলী দুআর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে কামরা ত্যাগ করলো।
মনে শত লজ্জার আবরণ দমিয়ে রেখে দুআ চললো ওয়াশরুমে।ভেতরে একটাই প্রশ্ন পুনরাবৃত্তি করছে,
আজ খেলোয়াড় সাহেবের সম্মুখে লজ্জার ভারে জ্ঞান খোয়াবে সে?

যথারীতি সময়ে দুআ তৈরি হলো।দীঘল কালো কেশ পিঠের উপরেই সুন্দর করে ছড়িয়ে আছে।জেনি আবার কৃত্রিম ফুলের সুন্দর একখান গাজরা আটকে দিলো দুআর পেছনের চুলের ডান প্রান্ত থেকে বাম প্রান্ত পর্যন্ত। এতেই যেনো পরিপূর্ণতা পেলো দুআর সাজ।ব্লাউজের হাতার ডিজাইন আজ লম্বা হলেও বেশ বড় ঘের বিশিষ্ট। যার দরুণ,দুআ নিজের হাত উপরে না তোলার শত চেষ্টায় ব্যস্ত।ব্লাউজের এই ডিজাইন দুআর কম পছন্দ হলেও, মুখ খুললো না মেয়েটা।এই কথা শুনলে আহেলী নিশ্চয় আবারও তুলকালাম কান্ড ঘটাবে।নিজেকে সংযত করে সে সিদ্ধান্ত নিলো,খুব বেশি প্রয়োজনে দুআ হাত উপরে উঠাবে।নিজেকে পুনরায় আয়নায় পরখ করে নিলো সে।শাড়িতে তার রূপটাই যেনো বদলিয়ে ধারণ করলো এক পূর্ণ যুবতীর রূপ।দুআর স্বয়ং, নিজের এই রূপ কল্পনার চেয়েও বেশি পছন্দ হলো।স্বরূপ বিবেচনা মেয়েটা হাসলো খুবই চমৎকার ভঙ্গিতে।

গাড়ি এখনো পৌঁছায়নি।দুআ রিজোয়ানের হাত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো আঙিনায়।গাড়ি আসলে দুই ফটক আপনাআপনি খুলে যাবে।দুইজন সচেতন দারোয়ান যে দরজার কিনারায় অবস্থান করছে।

–“কোনো সমস্যা হলে,ভাইকে ফোন দিবি। জেনি দুআর যেনো কোনো সমস্যা না হয়,খেয়াল রাখবেন তার।”
জেনি মাথা নাড়ালো নিশ্চুপ।দুআ তার ভাইয়ের পানে তাকালো,
–“আমি ছোট বাচ্চা না ভাইয়া।আর আমার কি বা সমস্যা হবে?”

–“সমস্যা হলে,মাইশা বা ইয়াদকে বলবি।ছেলেটা তোর অনেক খেয়াল রাখে।আমার চোখে সব আসে।আমি ছোট বাচ্চা না।”
রিজোয়ানের সোজাসাপ্টা উত্তর শুনে দুআর মনে আতঙ্ক ভর করলো।তার ভাই,অনেকবার দুআকে একা ছেড়েছে ইয়াদের সাথে।এর মানে,তার ভাই কি ইয়াদের ব্যাপারটা জানে?অবশ্য জানবে নাই বা কেনো,মাইশা হয়তো সুরসুর করে সবটা বলেছে রিজোয়ানকে ইয়াদের ব্যাপারে।তাই তার ভাই হয়তো,পরীক্ষা সুলভ দুআকে একা ছাড়তো ইয়াদের নিকট।কম স্থানে তো ভ্রমণে যায়নি তারা একসাথে!তখন হুটহাট সময়ের পূর্বে রিজোয়ানের আগমন না ভাবালেও, এখন দুআ বুঝতে পারছে,কেনো তার ভাই সময়ের পূর্বে তার কাছে ফিরে আসতো!
ভাই তলে তলে সবটা উম্মেচন করেছে,পর্যবেক্ষণ করেছে।অথচ অবুঝ দুআর তখন কিছুই বোধগম্য হয়নি।

দুআ নিশ্চুপ থাকলেও,মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে জেনি।দুআ পুনরায় ভাইয়ের পানে তাকালে রিজোয়ান দুআর মাথায় হাত রাখলো সন্তর্পনে,
–“আমি জানি সব।ইয়াদ আমাকে বলেছে।”

কুঁকড়ে উঠলো দুআ।এই মুহূর্তে ভাইয়ের দৃষ্টি মেলানো তার জন্যে এভারেস্ট জয়ের মতোই।মৃদু কম্পিত ডান হাত চেপে ধরলো বাম হাত দিয়ে।ইয়াদের সাহসিকতা ঠিক কতটা প্রখর, তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না দুআকে।তার সিংহের লাহান সাহসী ভাইকে কিভাবে তাদের প্রেমের সম্পর্কে জানিয়ে দিলো?দুআ ভাবনায় মশগুল।দুআর বলা হলো না কিছু।

গাড়ির হর্ন বাজতেই বিশাল ফটকের দুই দ্বার খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।রিজোয়ান সহসাই এগিয়ে যাচ্ছে।স্ফীত কণ্ঠে সে দুআকে বলে উঠলো,
–“ছেলেটাকে আমি ভালো করেই উপলব্ধি করেছি।আগের অভ্যাসের মাত্রার ছিটেফোঁটাও, তার মাঝে নেই এখন।খারাপ অতীতকে ভুলে সম্মুখে এগিয়ে চলা মানুষটার ব্যক্তিত্ব বজ্রের ন্যায়।ঢাকায় খোঁজ নিয়েছিলাম ইয়াদের,ছেলেটা বড্ড পরিবর্তন এনেছে নিজের বিগত কয় বছরে।এমন শক্ত ব্যাক্তিক্তের মানুষের চোখে তোর জন্যে প্রখর দায়িত্ববোধ দেখে আমি নাকচ করতে পারলাম না ছেলেটার প্রস্তাব।আমার ছোট দুআর জন্যে এই শক্ত পার্সোনালিটির মানুষটাই দরকার।সাবধানে থাকবি সেখানে।”
দুআকে আলিঙ্গন করলো রিজোয়ান।ছলছল আঁখিতে ভাইয়ের পানে দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো সে।ভাইটা তার ব্যাপারে বাকিদের সতর্ক করতে ব্যস্ত।রিজোয়ান নামের ছেলেটা তার জন্যে আশীর্বাদ স্বরূপ।এমন ভাই সবার ভাগ্যে জুটে না।নিশ্চয়ই দুআর কপাল চাঁদ কপাল।তাই তো এমন একজন ভাই পেয়েছে সে,যে দুআর অগোচরে সবটা খেয়াল রাখে।

গাড়ি মাত্রই সামনে এগুচ্ছে।পেছনে বাক ফিরে দুআ দেখলো,জমিদার বাড়িতে কয়েকখানা বড় ট্রাক প্রবেশ করছে।এখন থেকেই বুঝি আগামীকাল রিজোয়ানের হলুদের অনুষ্ঠানের জন্যে কাজের ঢল নামবে।

ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে ঝলমলে জমিদার বাড়ি।
——————————-
দক্ষ হাতের সাজে এই বাড়ির রূপ বদলেছে।উঠানের নকশা আন্দাজ করা বড্ড দায় এখন।কৃত্রিম গাছপালা,লাইটিং,ডেকোরেশন সবকিছুর জন্যেই এই চেনা জায়গা দুআর অচেনা ঠেকছে।চারিদিকে মানুষের হট্টগোল।জেনি দুআর পিছু পিছু আসছে সর্বক্ষণের ন্যায়।
দু’কদম সামনে এগোতেই ইয়াদের দেখা মিললো।আচমকা দুআর সামনে এসে দাঁড়ালো ইয়াদ।এতে খানিকটা বিচলিত হলো মেয়েটা।চেহারা এখনো দেখা হয়নি ইয়াদের।কিন্তু, দেহের অবয়ব দেখে দুআ বুঝে নিল,এই লোকটা তার খেলোয়াড় সাহেব,তার প্রেমিক পুরুষ।লোকটা সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে,যেখানে অন্যসব ছেলেরা বাহারি রঙের পাঞ্জাবিতে করেছে নিজেদের আবৃত।ইয়াদ না কিছু আওড়ালো,না পিছু হটছে।সটান দাঁড়িয়ে রইলো ছেলেটা।পাশের দুই গার্ডকে আড়চোখে পরখ করে নিলো দুআ।

–“আমার সাথে আসো।”
ইয়াদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ।

দুআ মাথা উচুঁ করলো এইবার।মুহূর্তেই প্রশান্তিতে ভরে উঠলো হৃদয়।সাদা রঙের পাঞ্জাবিটা ইয়াদের অবয়বে বড্ড শুভ্র দেখাচ্ছে। দুইপাশের চুলটাও আগের তুলনায় ছোট করেছে সে,তবে মাথার তালুর উপর ঠিক একগোছা চুল বিদ্যমান।বাম হাত তুলে ঘড়ি পরখ করে বিরক্তির সুরে ইয়াদ পুনরায় দুআকে বলে উঠলো,
–“পা চলছে না কেনো?সবার সামনে তোমার হাত ধরলে তো আবার সমস্যা তোমার।ভেতরে চলো।বাড়ির ভেতরে।”

প্রেমিক পুরুষের এমন তুখর মেজাজ আয়ত্বে এলো না ইয়াদের প্রেয়সীর।খুবই ধীর কণ্ঠে দুআ বলে উঠলো,
–“অনুষ্ঠান এইখানে হচ্ছে।আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি এইখানে।আমি আন্টি আর মারিয়ার কাছে যাচ্ছি।”

–“ওরাও ভেতরে যাবে।”
ইয়াদ নিজের কথা ব্যক্ত করে একজন গার্ডের কানে ফিসফিস করে কিছু বললো।গার্ড মাথা নাড়িয়ে চললো মারিয়া এবং বাকি সবাইকে ইয়াদের নির্দেশনা জানাতে।
এইদিকে গানের তীব্রতা কম হলেও অপরপাশ থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে প্রচুর।

দুজনের নজর মিলতেই দুআ,ইয়াদের তীক্ষ্ণ চোখজোড়ার পেছনকার রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করছে।

মারিয়া, রামিসা,মাহি দৌড়ে এলো দুআর নিকট।

–“চাঁদ আপু,তোমাকে আজকে এতো সুন্দর লাগছে।শাড়িতে তোমাকে একদম বড় মেয়ের মতো মনে হচ্ছে।পারফেক্ট ভাবী আমার।”
উচ্ছ্বাসিত হলো মারিয়া।
–“তোমাকেও সুন্দর লাগছে, মারু।”

–“ভেতরে যাও।”
ইয়াদের নির্দেশনা শুনে ইয়াদের দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে দুআও সেদিকে তাকালো।বনেদি পরিবারের মালকিন সার্জা আর তার ছেলেকে নজরে এলো দুআর।
মারিয়ার পেছন পেছন দুআ হাঁটতে আরম্ভ করলো।প্রশ্ন করলো না কোনো।ইয়াদের মেজাজ আজ ভালো না,এটা দুআ বেশ বুঝতে পারছে।
রামিসা,মাহি অনুষ্ঠানে থেকে গেলো।মারিয়া দুআকে নিয়ে পৌঁছালো রামিসার রুমে।জেনি আপাতত দুআ এবং মারিয়ার জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করতে ছুটলো নিচে।
বাড়ির ভেতরকার দৃশ্যটাও দুআর বেশ লাগছে।ছোট ছোট দিয়া দিয়ে সুন্দর করে সাজানো ভেতরের ঘর।রামিসার রুমেও কিছু কৃত্রিম দিয়া এবং কিছু সত্যিকারের দিয়া জ্বলজ্বল করছে।দুআ একমনে সেদিকে চেয়ে রইলো নিভৃতে।মনে তার ভেবে চলেছে অন্য কথা।আজ তার খেলোয়াড় এতো রেগে কেনো?

–“জানো চাঁদ আপু,ভাইয়া আজ অনেক রেগে আছে।”
মারিয়া দুআর হাতের আংটি নাড়াচাড়া করতে করতে বললো।
–“ফুফুর কাছে প্রস্তাব এসেছে তোমার জন্যে।এইখানকার বনেদি পরিবারের পক্ষ থেকে।তবে ফুফু নাকচ করে দেওয়াতে ঐখানকার মহিলা ফুফুকে তোমার নামে বাজে কথা কথা বললে,ভাইয়া শুনে ফেলে।এরপর ভাইয়া মহিলাটাকে বেশ ঝেড়েছে।তাই তো নিচে সেই মহিলার সামনে তোমাকে দেখতেই ভাইয়া এতটা রিয়েক্ট করে ফেললো।ভয় নেই তোমার,ভাইয়া ঐ মহিলাকে বলে দিয়েছে তোমার নামে আর যদি কথা রটায় উনি,তবে মানহানির মামলা দিবেন উনার বিরুদ্ধে।তুমি কি জানো,আজকে অনেকেই তোমার আর ভাইয়ার কথা জেনেছে।যদিও সবাই ভাবছে,আমার ভাই একা তোমাকে পছন্দ করে।”
অবাক হয়ে সবটা শুনলো দুআ।সটান ভ্রু কুঁচকে এলো তার,
–“তোমার ভাইয়াকে খারাপ কিছু বলেছে কেউ?”
–“নাহ।আমার ভাইয়াকে কমবেশি ভয় পায় সবাই।বাড়ির সকলে তো জানে,ভাইয়া চুপ থাকলে শান্ত তবে চিল্লিয়ে উঠলে আর কথা নেই।”
মারিয়া হেসে বললো।

দুআ ভাবনায় মশগুল।সামনের দিনে আরো কি কি পরিবেশের সম্মুখীন হতে হবে এই নিয়ে দুআর ভাবনা।
মারিয়ার মোবাইল টুং শব্দের পাশাপাশি জ্বলজ্বল করে উঠলো।মারিয়ার মুখে হাসির ঝিলিক। জেনি নাস্তা নিয়ে প্রবেশ করলো ঠিক তখনই।মুঠোফোনের কিবোর্ডে হাত চালিয়ে মেসেজের বিপরীতে অন্য মেসেজ পাঠালো মারিয়া।

শরবত টুকু খেলো মেয়েটা।আর কিছুই দুআ মুখে তুললো না।
জেনি পুনরায় নিচে চললো হাতের ট্রে রাখতে।

–“চাঁদ আপু,ভাইয়ার রুমে ড্রেসিং টেবিলের উপরেই মেহেদী রাখা আছে।নিয়ে আসবে তুমি?”
মারিয়ার নিবেদনে দুআ হাসিমুখেই রুমের বাহিরে পা রাখলো।

ভিড়ানো দরজাটা হাল্কা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো নিমিষেই।দুআ নির্দ্বিধায় ভেতরে প্রবেশ করলো।এই মুহুর্তে ইয়াদ রুমে নেই,এটা দুআ একেবারে নিশ্চিত।ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতেই সে লক্ষ্য করলো ড্রেসিং টেবিলের উপরিভাগ একেবারে ফাঁকা।বড় আয়নায় পর্দা দেওয়া।
আনমনে মেয়েটা মেহেদী খুঁজতে আরম্ভ করলো।এইদিকে তাকে যে একজন মানব ভালোবাসার নজরে আয়েশ করে উপলব্ধি করছে, সেইদিকে দুআর হুঁশই নেই।মেয়েটা মেহেদীর খোঁজে বাঁকা হয়ে ড্রায়ার খোলার চেষ্টা করছে।তার এমন ভঙ্গিতে বেশামাল হচ্ছে প্রেমিক পুরুষ।দৃষ্টি ঘোরালো।কোমর থেকে দৃষ্টি সরে দৃষ্টি স্থায়ী হলো প্রেয়সীর লম্বা চুলে।
হুট করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দুআ চমকে উঠলো।পিঠ ঠেকলো সুঠামদেহী মানুষটার সাথে।ভীত হয়ে পেছনে ফিরতেই প্রেমিক পুরুষের অবয়ব দেখে শান্ত হলো অশান্ত মন।ইয়াদ সম্মুখে এগিয়ে আসতেই দুআ পিছিয়ে আটকে গেলো ড্রেসিং টেবিলের সাথে।ইয়াদের দৃষ্টি ভালোবাসায় সিক্ত।প্রেয়সীকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে সামলানোর বিফল চেষ্টা করছে সে।এইদিকে তিরতির করে কাঁপতে থাকা প্রেয়সীর অধরজোড়া বেকাবু করে ফেললো ইয়াদকে মুহূর্তেই।দুআর আঁখি কোণে দেখা মিললো এক ফোঁটা জলের আভাস।ইয়াদ নিজেকে সামলে নিলো বিনা সংকোচে।তার এই নিষ্ফল আবেদনের চেয়ে দুআর পবিত্রতা তার কাছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।বুড়ো আঙুলের সাহায্যে ছুঁয়ে দিলো মেয়েটার টানা আঁখি।অশ্রু কণা প্রেমিক পুরুষের আঙ্গুলে এসে শান্তি পেলো যেনো।

–“সুন্দর লাগছে অনেক।আমি তো হ’ত্যা হচ্ছি তোমার রূপের তীব্রতায়।এতো আসক্তি কেনো তোমাতে?”
ইয়াদের হাস্যোজ্বল জবাব।
দুআর অস্থিরতা কমছে ধীরে ধীরে।এই পুরুষের কাছে সে নিরাপদ,এটা চিরন্তন সত্যি।প্রথমে ভয় পেয়েছে বিধায়,মেয়েটার চোখে অশ্রু এসেছিল।তবে,অস্থিরতা কমে এখন লাজের আভাস মিলছে।

–“মেহেদী খুঁজতে এসেছি।”
দুআর কথায় হাসলো ইয়াদ।চকচক করে উঠলো প্রেয়সীর দৃষ্টি।অবাক আঁখিতে প্রেমিক পুরুষের সৌন্দর্য উপলব্ধি করছে মেয়েটা।দুআর হাতের মুঠোয় নিজের হাতের আগমন ঘটালো।ড্রেসিং টেবিলের উপর বসতে নির্দেশনা দিতেই দুআ বসে পড়লো সেথায়। ভেতর থেকে একখান বড় বাক্স বের করে দুআর কোলের উপর রাখলো সে।
–“এক হাত খালি কেনো? চুড়ি পড়লে আরো ভালো হতো।দুই হাতের ঝনঝন শব্দে আমি আরো বেকাবু হতাম ”
–“ইচ্ছা করেনি পড়তে।”

–“এখন পড়বে।মারিয়া আর তোমার হাতের সাইজ একই।ভেবে দেখেছো!বাচ্চা মেয়ের সমতুল্য তুমি।খাবার খাবে নিয়ম মতো।”
ইয়াদ সন্তর্পনে এক ডজন চুড়ি বাহির করলো বাক্স থেকে।ব্লাউজের হাতা অল্প উঠিয়ে চুড়ি পড়িয়ে দিলো তার প্রেয়সীকে।অতঃপর চুড়ি সমেত হাতের দাগের উপর বেশামাল অধর ছুয়ে দিলো তার।দুআ হাসলো কেবল।এক রাশ ভালোলাগা আর লজ্জা দুইটাই সমানতালে উপভোগ করলো সে।
–“হয়েছে।আর এইভাবে লাজুক হাসবে না।কতটা আবেদনময়ী তোমার এই হাসি,জানা নেই তোমার।আমি আবার বেশামাল হলে তুমিই বিপদে পড়বে।কথা ছিলো তোমার কাছে আজ কিছু চাওয়ার,কপালে একটা ভালোবাসার পরশ দেওয়ার।কিন্তু, কপালে পরশ দিলে,লোভ তখন মুখের নি’ষিদ্ধ স্থানে পরশ দেওয়ার জানান দিবে।”
দুআ বুঝলো ইয়াদ ঠিক কি বুঝানোর চেষ্টা করলো।অগত্য নিচের ঠোঁট মুখে পুরে ঠোঁট লুকানোর চেষ্টা করলো মেয়েটা।
–“একদম এমন করবে না,চন্দ্র।আমি নিয়ন্ত্রণ..”

–“বোনের সুখ দেখতে পারিস না।আর নিজে এইসব কীর্তি করছিস?”
ইয়াদ সোজা হয়ে দাঁড়ালো।দুআ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো জিয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।চোখমুখ জ্বলন্ত তার।
–“আপু,প্লিজ বাজে বকিস না।তোর ব্যাপার আর আমার ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা।ভাই হিসেবে তোমার ভালো খারাপ সবটা আমি যাচাই করবো।”
ইয়াদের মুখের রং পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে।

–“বাজে বকবি না।আগেই তোদের এইসব কাজ লক্ষ্য করেছি আমি।এই মেয়ের দোষ দিয়ে লাভ নেই।মেয়েটা ভালো।তাই এমন ভালো মেয়েকে নিজের কাছে আটকে নিলি!অতীত সম্পর্কে জানলে ঠিকই তোকে ছেড়ে পালাবে।আমার জীবনে আর যেনো নাক না গলাস তুই।”
জিয়া হনহন করে বেরিয়ে পড়লো।

অতি মাত্রায় রাগ ভর করলো ইয়াদের।দ্রুত পায়ে এগিয়ে “ধপ” করেই ঘুষি দিলো আলমারির শক্ত স্থানে।মনটা কেঁপে উঠলো দুআর।ইতিমধ্যে ইয়াদের গর্জন তার কর্ণগহ্বরে প্রবেশ করছে,
–“অতীত,অতীত,অতীত!এই অতীত নিয়ে আর কতো?নিজের বোন যখন এইসব বলে তখন সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় মনে।এছাড়া অতীত নিয়ে অন্য কেউ কি ভাবছে আমার কিছুই যায় আসে না।দুআ,তুমি কি আমাকে এখনো অবিশ্বাস করো?”
দুআর গাল অশ্রুতে মাখামাখি।ইয়াদের কণ্ঠের তেজ প্রখর।চোখজোড়া সাদা-লাল রঙের সংমিশ্রণ।দুআর উত্তর না পেয়ে ছেলেটা আবারও ঘুষি দিলো আলমারিতে। কেঁপে উঠলো দুআ পুনরায়।এই বুঝি ইয়াদের হাড় মড়মড় করে ভাঙলো!
–“আই লাভ ইউ, চন্দ্র।তুমি চেয়েও আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবে না।তোমার ভাইও রাজি।আমি তোমাকে আমার থেকে কখনো দূরে যেতে দিবো না।”
দুআর মন চঞ্চল।সাত পাঁচ না ভেবে লোকটার নিকট গিয়ে হাতটা তুলে দেখতে লাগলো।শুভ্র হাতে লালচে ছাপ স্পষ্ট।
–“আমি বিশ্বাস করি আপনাকে।আপনি কেনো আপুর কথায় নিজেকে আঘাত দিচ্ছেন!একবার বলেছি তো বিশ্বাস করি আপনাকে,তার মানে এই বিশ্বাস কখনো ভাঙবে না আপনার প্রতি।আপনার অতীতকে নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই।এখন যেমন আপনি আমাকে ভালোবাসেন,আমাকে নিজের নিকট চান,সারাজীবন এইভাবেই আমাকে আপনার কাছে রাখবেন,আমি তাতেই সন্তুষ্ট।এইভাবে নিজেকে আঘাত করবেন না আর।”

দুআ শাড়ির আঁচল দিয়ে চেপে ধরলো ইয়াদের আঘাতপ্রাপ্ত স্থান। বেশামাল প্রেমিক,নিজের প্রতি প্রেমিকার এমন বিশ্বাস দেখে চমকালো না বরং মেয়েটার প্রতি তার ভালোবাসা বাড়লো শতগুণ।ভালোবাসার এই মাপকাঠি কমতে দিবে না কখনো প্রেমিক পুরুষ।বরং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মেয়েটাকে ভালোবাসার মাত্রা বাড়বে হাজার গুণ বা তার চেয়েও বেশি।হয়তো সে মাপকাঠির কোনো মাত্রায় নেই।

দুআ চক্ষু মেলে লোকটার দিকে তাকাতেই লোকটা এক অদ্ভুত কাজ করলো।নিজের অবয়বের সাথে মিশিয়ে নিলো তার অবয়ব।যাকে বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা।লোকটা শক্ত করে দুআর কোমর একহাতে চেপে ধরে অন্য হাতে দুআর মাথাটা তার বক্ষস্থলে চেপে ধরলো।দুআর হাত দুইজনের শরীরের মাঝে পিষ্ট অবস্থায় আছে।অথচ লোকটার খবর নেই। জোরে শ্বাস নিচ্ছে মানবটা।হুট করে এমন হওয়াতে দুআর নিঃশ্বাসের চালচলনও কেমন চঞ্চল হলো!

লোকটা আরো একটু শক্তি প্রয়োগ করে স্ফীত কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“এই মুহুর্তে তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমি ম’রে যেতাম,চন্দ্র।ভয় নেই,এই একজনই তোমাকে সারাজীবন স্পর্শ করবে।আমার কাছে শুধু তোমার অস্তিত্বের ঠাই আছে।আমার প্রতি তোমার এই বিশ্বাস কোনো দিন ভাঙবে না।এই ইয়াদের নিকট তুমিই একমাত্র চিরস্থায়ী প্রেয়সী।তোমায় আমার কাছে আগলিয়ে রাখবো আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।ভালোবাসি,চন্দ্র। এই ভালোবাসার মাত্রা কমবে না কখনো,ওয়াদা দিলাম।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here