#আমার_চন্দ্রাবতী,৩০
লেখিকা- সালসাবিল সারা
তন্দ্রায় শায়িত দুআ।তার ক্লান্ত আঁখিতে তন্দ্রা ভর করলো ঘণ্টা এক পূর্বে।ইয়াদের আঁখি তন্দ্রাহীন। ভোরের ঝাপসা আলোয় কামরা মুখরিত।ইয়াদের স্থির দৃষ্টি তার প্রেয়সীর পানে।মেয়েটার উন্মুক্ত হাতের ডোরাকাটা দাগে ছেলেটার আঙ্গুল ছুঁয়ে।গলার নিচু অংশে তার দেওয়া ভালোবাসার ছাপ স্পষ্ট।ইয়াদ ঝুঁকলো সেই স্থানের নিকট।পুনরায় নিজের অধর ছোঁয়ালো সেথায়,দুআ কিঞ্চিৎ নড়লো।নিজের অবস্থান আরো গাঢ় করলো ইয়াদ।মেয়েটা উষ্ণতার ছোঁয়া পেয়ে মুচকি হাসলো যেনো।ছেলেটার অধর অর্ধ বাঁকা।ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে ইয়াদ।হাতের উল্টোপিঠে দুআর কপালে ছুঁয়ে জ্বরের তীব্রতা যাচাই করলো।নাহ জ্বর নেই।কম্বল টানলো সে মেয়েটার হাতের উপরিভাগে।সম্পূর্ণ ঢেকে দিলো মেয়েটার তনু।
দুআর বালিশেই শুয়ে পড়লো ইয়াদ।মেয়েটাকে বাহুডোরে আটকে মেয়েটার উন্মুক্ত কোমর চেপে ধরলো।চোখ জোড়া তার এখনো স্থির মেয়েটাতে।থাক না এই দৃষ্টি স্থির!তাকে তো আজই ফিরতে হবে সেই ব্যস্ত দুনিয়ায়।কোচ হতে নির্দেশনা এসেছে।বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সকল টিমমেট যেনো সন্ধ্যা সাতটায় উপস্থিত থাকে “রেডিসন” নামক পাঁচ তারকা হোটেলে।ইতোমধ্যে অনলাইনে টিকিট বুক করেছে ছেলেটা।এই খবর শুনে দুআ কেমন অভিব্যক্তি দিবে,কল্পনায় আসছে না ইয়াদের।মেয়েটা কি খুব কাঁদবে? মেয়েটার কান্নারত মুখশ্রী কল্পনা করতেই ইয়াদের হৃদয় ভারী হয়।আলতো স্পর্শে মেয়েটাকে সম্পূর্ণই তার বক্ষ মাঝারে নিয়ে আসে।মেয়েটার নিঃশ্বাস তার বক্ষ মাঝারে পড়তেই ইয়াদের যতো প্রশান্তি। ধীরে অধর ছোঁয়ালো সে প্রেয়সীর মাথায়।পরম আদরে জড়িয়ে চোখ বুজলো সে।এই মুহূর্তে কিছুতেই অন্য বিষয়ে ভাবতে চাইছে না প্রেমিক পুরুষ।রাতভর সজাগ থাকায়,এমন আয়েশে ইয়াদের আঁখি ভারী হলো।ঝুঁকলো নেত্রপল্লব।
–“দুআ মালকিন,ইয়াদ সাহেবের ব্যাগ রাখলাম এইহানে।”
জেনির চেঁচামেচিতে তন্দ্রা ছুটলো দুআর।দৃষ্টি মেলতেই নিজেকে ইয়াদের হাতের উপরেই শায়িত অবস্থায় পেলো।ইয়াদ তার বাম কাঁধে মুখ গুঁজে ঘুমে।ইয়াদের একহাত দুআর উদরের উপর সীমাবদ্ধ।সর্বাঙ্গে অস্থিরতা মেয়েটার।
জেনি এক নাগাড়ে ডেকে চললো।যেনো ভেতর থেকে উত্তর পাওয়া তার জন্যে বাধ্যতামূলক!দুআ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিল,
–“রেখে যাও।আমি আসছি।”
–“আইচ্ছা মালকিন।”
জেনির আর শব্দ শোনা গেলো না।
ঘড়ির কাঁ’টায় চোখ বুলিয়ে সময় দেখলো দুআ।নয়টার কাছাকাছি ঘড়ির মধ্যখানে অবস্থিত ছোট কাঁ’টাটা।
ঘুমন্ত ইয়াদের মুখশ্রী দুআর নজর কাড়লো আরেক দফায়।লোকটা কাল দুইজনের সত্তাকে এক করলো পরম ভালোবাসায়।গাল রঙা হলো মেয়েটার।পুনরায় লাজে সজ্জিত হচ্ছে মেয়েটার গাল।গতকাল ইয়াদের সামনেই তার লজ্জার দফারফা হলো আর আজ সে একাই লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছে।
পায়ের তলায় শাড়ির অস্তিত্ব পেতেই তা সম্পূর্ণভাবে পেঁচিয়ে নিলো মেয়েটা।দরজা খুলে ব্যাগটা নিয়ে রুমের মাঝামাঝি অবস্থায় রাখলো।আলমারির উপরের সারি হতে সবুজ রঙ্গা জামদানি শাড়িটা নিলো সে।আহেলীর তরফ হতে এটাই ছিল তার গত বছরের জন্মদিনের উপহার।অবিবাহিত থাকায় মেয়েটা এই শাড়ি পড়েনি।এইভাবে শাড়িটা তার গায়ে জড়াবে,এমন উপলক্ষে; এমনটাও সে ভাবেনি।ড্রায়ার খুলে তাওয়াল নিয়ে ঢুকে পড়লো গোসলে।
সবে মাত্র শরীরে পানির আস্তরণ ভর হলো।এরমাঝে দরজায় খটখট শব্দ। ঝর্ণা বন্ধ করলো দুআ,
–“কে?”
–“এই,খুলো তো।জরুরি কাজ আছে।”
ইয়াদের কণ্ঠ শুনে দুআ খানিক ভড়কালো,
–“কি কাজ? বলুন।”
–“দরজা খুলো,তবেই না বলবো?”
ইয়াদের কণ্ঠে অস্থিরতা।
দুআ ভেজানো শাড়ি ঠিক করলো।দরজা হালকা খুলতেই তার দৃষ্টিতে এলো,ইয়াদ ঘাড়ে তাওয়াল ঝুলিয়ে,হাতে নিজের পড়নের কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ভ্রু কুঁচকে এলো দুআর।প্রশ্ন করার পূর্বেই,ইয়াদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।দুআ স্থব্দ।কথা বলার শক্তিটুকু পাচ্ছে না অভ্যন্তরে।
ইয়াদ দুআর অবয়বে উপর নিচ দৃষ্টি বুলিয়ে কাছে টানলো তাকে।গভীরভাবে হাতের স্পর্শ ছুঁয়ে দিয়ে আকর্ষণীয় কণ্ঠে বললো,
–“একেক রূপে তুমি একেকরকম।ভয়ংকর সুন্দর তুমি,চন্দ্র।”
______________
গোসল সেরে ইয়াদ আগেই বেরিয়েছে।ইতিমধ্যে তৈরি সে।টিকিটে তার ফ্লাইটের সময় দেওয়া আছে দুপুর দুইটা ঘটিকায়। কাল ঝুম বৃষ্টি হলেও আজ আকাশ একেবারে পরিষ্কার।সাথে গরমের প্রকোপ বাড়লো ঢের।দুআর কক্ষে এয়ার কন্ডিশনার নেই। ফ্যান চলছে তীব্র গতিতে। তাও ছেলেটার শার্ট ঘেমে যাচ্ছে।ব্যালকনির দরজা সটান করে খুললো ইয়াদ।প্রাকৃতিক বাতাসের আগমন হলো মুহূর্তেই।বিছানায় দুই হাত ঠেকে বসলো সে।প্রাকৃতিক বাতাস এবং ফ্যানের বাতাসে এখন গরমের উষ্ণতা কিছুটা কমছে।
ভেজা কাপড় বালতিতে রাখলো দুআ।দুইজনের কাপড় ভর্তি বালতি বের করে বাথরুমের দরজার সামনে রাখতেই ইয়াদ চেঁচালো,
–“তুমি এত কাপড় ধুতে গেলে কেনো?কাজের মেয়ের অভাব আছে?”
দুআ চুল মুছতে ব্যস্ত,
–“আমার ইচ্ছে হলো,তাই ধুয়েছি।”
–“জ্বর যদি আরেকবার উঠে,এরপর তোমার খবর করবো আমি।”
ইয়াদের কণ্ঠে দুআ তার নিকট তাকালো।ছেলেটা উবুত হয়ে জুতার ফিতা বাঁধছে।দুআ চুলে তাওয়াল ঘষা অবস্থায় ইয়াদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো,
–“এতো ফিটফাট যে? ক্যাজুয়াল কাপড় পড়ে বসে থাকা লাগবে না এইখানে।ভুলে যাবেন না এটা আপনার শশুরবাড়ি এখন।”
ইয়াদ মাথা তুলে তাকালো।সদ্য গোসল করা বউয়ের সর্বাঙ্গ যেনো চকচক করছে।দুআর হাফ হাতা ব্লাউজের কিনারা ভেদ করে ডোরাকাটা দাগ দৃশ্যমান।অন্য রকমের মা’তাল রূপের অধিকারী এই মেয়ে।
কোমরে হাত ঠেকে হালকা ধাক্কা দিতেই মেয়েটা তার নিকট চলে এলো। শাড়ির উপরে নাক ছোঁয়ালো ইয়াদ।দুআ ইয়াদের কাঁধ ঠেললো,তবে লাভ হলো না।এইবার দুআ চিমটি কা’টলো ইয়াদের গলার পাশে,
–“ছাড়ুন।”
–“জ্বলছে,বউ।”
ইয়াদ তার কাজে মগ্ন।
–“কেনো জ্বলছে?”
দুআ প্রশ্ন করলো সন্দেহজনক দৃষ্টিতে।
–“পিঠে।তোমার নখের মাঝে আমার মাংসের অবশিষ্ট অংশ আছে।চেক করো।”
দুআ নিজের নখ দেখলো। মিথ্যা বলছে ছেলেটা।তার নখ পরিষ্কার।
–“মিথ্যুক।”
–“গোসলের সময় আমার পিঠে লাল আঁচড় দেখে কার চোখে পানি এসেছিল?”
দুআ এতক্ষণে বুঝলো ইয়াদ কি বুঝাতে চেয়েছে।লজ্জার আভাস এলেও প্রকাশ করলো না সে।ইয়াদের ঘাড়ের উপরিভাগের ছোট চুলে হাত রেখে জবাব দিল,
–“এতো বাজে কেনো?”
মুখ তুলে হাসলো ইয়াদ,
–“চলে যাচ্ছি আজ।এই বাজে লোক কবে আসবে আবার,জানে না।”
আঁখির আয়তন বড় হলো দুআর।বিশ্বাস হচ্ছেনা নিজ কানে,
–“আপনি কিছুই বলেননি কাল।আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম না?”
কথা শেষ করার পূর্বেই নেত্রযুগল অশ্রুশিক্ত হলো দুআর।
ইয়াদ উঠে দাঁড়ালো।সন্তর্পনে জড়িয়ে ধরলো অর্ধাঙ্গিনীকে,
–“মন খারাপ করে না,চন্দ্র।তুমি এখন সাধারণ মেয়ে নও।ইয়াদ বিন তেহরানের অর্ধাঙ্গিনী।তোমার জন্যে এইসব সহ্য করার ক্ষমতা রাখাটা মুখ্য।অপেক্ষা করবে আমার জন্যে।আমি আসবো।”
–“কয়েকদিন থেকে যেতেন?”
নাক টানলো মেয়েটা।
–“এইভাবে দিনের পর দিন থেকে গেলে আমার আর যাওয়াই হবে না।এরপর আর কি?সবাই বলবে ইয়াদ বিন তেহরান দেশদ্রো’হী,ক্রিকেট বি’রোধী।”
দুআ ইয়াদের পানে তাকালো।ছেলেটার মুখে হাসি,তবে চোখ বলছে অন্যকথা।দুআকে এভাবে ছেড়ে যেতে ইয়াদের মনটাও বুঝি ব্যথিত?প্রিয়তমার মন খারাপ হবে বলে সেই ব্যথিত অনুভূতি প্রকাশ করছে না সে!
–“আপনি সবাইকে বলে দিবেন,আপনি এখন বিবাহিত।”
কপালে ভালোবাসার স্পর্শ অনুভব করলো মেয়েটা।
–“এয়ারপোর্টে যাওয়ার রাস্তায় জেনে যাবে সবাই।ডোন্ট ওয়ারি,চন্দ্র।”
–“কখন বেরুবেন?”
বেখেয়ালি দুআর প্রশ্ন।
–“ব্রেকফাস্ট শেষে।”
–“সবাই যাবে?”
দুআ পুনরায় প্রশ্ন করলো।
–“আমি, ফারসিভরা ফ্লাইটে যাবো।বাকিদের কথা জানিনা।”
–“ওহ।”
দুআর অস্ফুট স্বর।
গায়ের উপর শাড়ি পেঁচিয়ে হাতের দাগ ঢাকলো দুআ।ইয়াদের কড়া নির্দেশ,গরমের দিনে দাগ ঢাকতে যেনো ফুলহাতা কোনো পোশাক গায়ে না চড়ায় সে।ইয়াদের যেহুতু তার দাগ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই,তাই দুআ আর আগ বাড়িয়ে কিছু বললো না।বিদায়বেলায় এই লোকের মেজাজ খারাপ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার।
দরজার কিনারায় যেতেই ইয়াদ আষ্টেপিষ্টে বাহুডোরে আবদ্ধ করলো তার প্রেয়সীকে। দীর্ঘক্ষণ প্রেয়সীর সমেত রোমাঞ্চকর বোঝাপড়া শেষে ইয়াদ দুআর ললাটে নিজের ললাট ঠেকে বললো,
–“নিজ খেয়াল রাখবে।আমি যখনই ফোন দিবো,ফোন ধরবে মাস্ট।কলেজেও সাবধানে যেও।”
–“আপনিও সাবধানে থাকবেন।”
প্রেয়সীর অধরে পুনরায় অধর ছুঁয়ে শান্ত হলো ছেলেটা,
–“লাভ ইউ,দুআ।”
.
ইশফাকের মন ছটফট করছে।দুআকে সে চেয়েও ভুলতে পারছে না।যদিও জানে,ইয়াদ তার এইসব ব্যাপার জানলে নিশ্চিত তার অবস্থা দু’রবস্থা করে ছাড়বে।তারপরও মন ব্যাকুল লোকটার।উপস্থিত হলো কলেজের গেইটে।আড়ালে।কিয়ৎ পূর্বে ছুটি হলো কলেজ। দলে দলে ছেলে মেয়ে বেরিয়ে আসছে।এরমাঝে মাহিকে দেখে সজাগ হলো সে।পরপর দৃষ্টি ঘোরাতেই দুআর অবয়ব স্পষ্ট হলো তার নজরে।মেয়েটাকে হঠাৎ অদ্ভুত রকমের মোহনীয় লাগছে। ঘোর লেগে যায় ইশফাকের।মেয়েটার মাঝে শারীরিক পরিবর্তনের কিছুটা আভাস লক্ষণীয়।ইয়াদের সাথে তার সংক্ষিপ্ত পরিসরের বিয়ের খবর জানে সে। শুধু সে না,পুরো দেশের কাছে এই খবর এখন সাধারণ ব্যাপার।তবে,দুআর এমন পরিবর্তনে ইশফাকের ভেতরকার সত্তায় দহন হয়।ভুলে যাওয়া প্রতিশোধ পুনরায় আঘাত হানে নিজ মস্তিষ্কে।ইতিমধ্যে ইয়াদ, দুআর ঘটা করে রিসিপশনের গুজব শোনা যাচ্ছে চারিদিকে।যদিও ইশফাক এর সত্যতা জানে না।তবে মনে মনে সে আওড়ালো,
–“অনুষ্ঠান?মাই ফুট!যখনই হোক অনুষ্ঠান,সেই অনুষ্ঠানকে শোকবার্তায় পরিবর্তন করতে যা দরকার হয় আমি তাই করবো।আমি জামালের মতো জেইলে বসে থাকার লোক না।দুআকে কাছে না পেলেও তার সবচেয়ে বড় দিনকে আমি শোকের দিন বানিয়ে ছাড়বো।হোক না সে দুআর প্রিয়জন?নিজের চেয়ে আপনজনের কষ্ট অসহ্যকর।”
জ্বলন্ত কুন্ডলীর নয় জ্বলে উঠলো ইশফাকের আখিদ্বয়।
চলবে…..