ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত #পর্বঃ১

0
2344

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্বঃ১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছে শৈবাল। তার চোখের কোটর পরিপূর্ণ নোনতা জলে। দীর্ঘ আঁখিপল্লব বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় নামছে জল। অরুনিকা ভয়ে তটস্থ। মানুষটা আবারও অঘটন ঘটাবে!

শৈবাল পা ভাঁজ করে অপলক চেয়ে আছে অরুনিকার দিকে। তার কব্জি হতে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই শৈবালের। নিজের রোদনস্ফীত চক্ষুর চাহনিতে আবদ্ধ করে রেখেছে অরুনিকাকে। অরুনিকা বিভ্রান্ত। সে কথা বলবে না। কথা বললেই ক্ষেপে যাবে শৈবাল।

প্রায় মিনিট খানেক সেভাবেই বসে রইল শৈবাল। অরুনিকা নড়ল না। শৈবালের রক্তের স্রোত মন্থর হয়ে এসেছে। শুভ্র মেঝের বুকে সে এঁকে ফেলল তার প্রিয় চিত্র। শোণিতের রক্তিম সাজে অঙ্কিত হলো এক বৃত্ত। তার মাঝে একটি নারীমুখ। শৈবাল বিধুনিত কণ্ঠে শুধাল—

“তুমি আমাকে কেন ছেড়ে গেলে অরু? তোমার মতো কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারে না। কেউ না।”

অরুনিকা ক্ষীণ শ্বাস ফেলল। নিজের স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের নাম শুনে অন্তঃকরণে তীক্ষ্ম ফলার ঘা লাগে তার। কিন্তু সে নিরুপায়। অরুনিকা নিজেকে সামলে নিল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ধীরগতিতে শৈবালের কাছে এসে মেঝেতে বসে। অরুনিকার কাছ ঘেঁষা উপস্থিতিতে বিরক্ত হয় শৈবাল। উচ্চ গলায় বলে উঠে—

“কেন এসেছ এখানে? চলে যাও, চলে যাও এখান থেকে।”

অরুনিকা ধাতস্থ হয়ে ঢোগ গিলল। ডান হাত রাখল শৈবালের কাঁধে। শৈবাল চটে যায়। ঝাঁড়া মেরে সরিয়ে দেয় অরুনিকার হাত। বিধ্বস্ত গলায় বলল—

“ছোঁবে না তুমি আমাকে। ভালোবাসো না তুমি আমায়। তুমি আমার অরু নও। একদম ছোঁবে না তুমি আমাকে। চলে যাও এখান থেকে, চলে যাও।”

অরুনিকা শক্ত ঢোগ গিলে বলল—

“আমি আপনার অরু নই। আমি অরুনিকা। আপনার স্ত্রী। ভালোবাসি আপনাকে আমি।”

চোখের পাল্লা প্রশস্ত করল শৈবাল। বিচলিত গলায় বলল—

“তুমি আমার অরু নও? তাহলে কেন এসেছ এখানে? চলে যাও এখান থেকে। আর কখনো আসবে না।”

“আপনি আমার কথাতো শুনুন।”

“একদম হাত লাগাবে না আমাকে।”

তেতে উঠল অরুনিকা। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। দাপিয়ে উঠে বলল—

“কোথায় যাব আমি? বলুন কোথায় যাব? আমার যাওয়ার সব জায়গা তো বন্ধ করে দিয়েছেন আপনি। যদি আমার কোনো প্রয়োজনই নেই তাহলে কেন বিয়ে করেছেন আমায়? কেন পাগলের মতো রাতের পর রাত, দিনের পর দিন আমাকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন? কেন একবারও বুঝতে চাননি আমি আপনার অরু নই। অরু নই আমি শৈবাল। আপনার অরু নই আমি। ”

কথা শেষ হতেই প্লাবনের বাঁধ ছুটল অরুনিকার। তার চোখ হতে ঝরে পড়া জল হাতের তালুতে নিয়ে নিল শৈবাল। অরুনিকা যখন বুঝতে পারল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘকায় পুরুষটি, সে নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। শৈবালের বক্ষ ভিটাতে আছড়ে পড়ল। খামচি মেরে ধরল তার গেঞ্জি। জমাট গলায় বলল—

“আমি আপনার অরু নই শৈবাল। কেন বুঝতে পারছেন না আপনি?”

শৈবাল দম ফেলল। দুর্বোধ্য হাতে জড়িয়ে নিল অরুনিকাকে। বিনীত গলায় বলল—

“তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? সত্যি করে বলো অরু, যাবে নাতো আমাকে ছেড়ে?”

অরুনিকা রোদনঝরা কণ্ঠে বলল—

“আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই শৈবাল। কোথাও না। আপনার ভালোবাসার লাল বৃত্ত আমার সব পথ রোধ করে দিয়েছে। কী করে মুক্তি পাবো আমি?”

শৈবালের চোয়াল শক্ত হলো অচিরেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন অরুনিকাকে বিছানায় পেল না, তখন সে গুটি গুটি পায়ে ঘরময় বিচরণ করে। দরজার কাছে এসে পৌঁছাতেই শুনতে পায় অরুনিকার কলহাস্য। আর সহ্য হলো না শৈবালের। বাইরে গিয়ে দেখল, পাশের বাড়ির জব্বর আলী তার আট মাসের নাতিকে কোলে নিয়ে সূর্যের মৃদু রোদে দাঁড়িয়ে আছেন। তার নাতিকে আদর করতে গিয়ে কথার ছলে হেসে কুটিকুটি হয় অরুনিকা। আর তাই কর্ণগোচর হলো শৈবালের। শৈবাল উদ্ভ্রান্তের মতো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো অরুনিকাকে। শৈবালের পরিবারের সবাই যে, যে অবস্থানে ছিল সেখানেই থমকে যায়।

রুমের ভেতর নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দেয় শৈবাল। কিছু সময় আড়ষ্ট নজরে চেয়ে রইল অরুনিকার দিকে। অরুনিকা অনুভূতিশূন্য! সে জানে এখন শৈবাল কী করবে।
ঝনঝন করে শব্দ হতে লাগল। কাচের টুকরোগুলো বিক্ষিপ্ত হতে লাগল একের পর এক। অরুনিকা নিরুত্তাপ। নিজের রাগের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া শৈবাল যখন একটু শান্ত হলো, তখন সেই ভাঙা কাচের টুকরো দিয়ে নিজের হাত কে/টে ফেলল। দ্রুততার সাথে করায়, শুধু ওপরের চামড়াটুকুই কে/টে যায়। রক্তের বান ছুটে তাতেই। শৈবাল বসে পড়ে মেঝেতে। দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে অরুনিকা। শৈবালের পাগলামিতে সে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। বিয়ের রাত থেকে এই সত্যের সম্মুখীন সে।

শৈবাল বুকে জড়িয়ে রাখল অরুনিকাকে। মেঝেতে এঁকে রাখা রক্তের বৃত্তটির দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়াল—-

” আমার ভালোবাসার লাল বৃত্তই তোমার শ্বাসের পরিধি। তুমি এই বৃত্ততেই আবদ্ধ। আমার দেহে একবিন্দু রক্ত থাকতে এই বৃত্তের একটা অংশও আমি মুছে যেতে দেবো না। আমার ভালোবাসাও ততদিন স্থায়ী থাকবে, যতদিন এই বৃত্তের লাল রং থাকবে।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here