ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত #পর্ব:১৪,১৫

0
1000

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:১৪,১৫
লেখনীত: তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:১৪

অরুনিকা আঁততে ওঠে। নিচ্ছিদ্র ভয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল—

“কী করছেন শৈবাল? ওটা ফেলে দিন, প্লিজ ফেলে দিন।”

শৈবাল কুসুমকোমল হেসে বলল—

“তুমি খাও অরু।”

অরুনিকা আস্তব্যস্ত কণ্ঠে বলল—

“প্লিজ ফেলে দিন, শৈবাল। দয়া করে আর কোনো অঘটন ঘটাবেন না। আপনার হাতের ঘা এখনো ভালো করে শুকায়নি।”

অরুনিকা ওঠে এলো। শৈবাল দৃঢ়চিত্তে বলল—

“তুমি ওখানেই বসো, অরু। খেয়ে নাও। না খেলে তোমার শরীর খারাপ করবে।”

অরুনিকা জেদের সাথে অনুভূতির সংমিশ্রন করে অুনরক্তির সাথে বলল—

“শুধু আমার শরীরটাই দেখলেন আপনি! মনে খবর নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না। আমার শরীরটাই আপনার প্রয়োজন, তাই না শৈবাল?”

শৈবাল নিমেষহীন চোখে চেয়ে রইল। কোনো জবাব দিলো না সে। বারবার অসহিষ্ণু চোখের পলক ফেলছে অরুনিকা। ধীর গলায় বলে উঠে শৈবাল—

“তুমি খাবে?”

শৈবাল তার হাতের ভেতর থাকা কাচের টুকরোতে জোরালো চাপ দিতেই চিৎকার করে ওঠে অরুনিকা—

“না, এমন করবেন না। খাচ্ছি আমি, এখনই খাচ্ছি। এই যে দেখুন, এখনই খেয়ে নেব আমি।”

অরুনিকা ত্রস্তে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় বসল। চটজলদি প্লেট হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করল দীর্ঘদিন অভুক্ত থাকা প্রাণীর মতো। চোখের জলের নোনা স্রোত গাল বেয়ে চুইয়ে পড়ছে ভাতের প্লেটে। অরুনিকা চিবুচ্ছে না। গালে খাবার ঠুসেই গিলে নিচ্ছে। শৈবালের নিরবধি স্থির দৃষ্টি। আলতো গলায় বলল—

“ধীরে খাও, অরু। গলায় বেধে যাবে তোমার।”

অরুনিকা শৈবালের দিকে তাকাল। চোখের জলের হেতু ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। অসহায় মুখে চেয়ে ঠোঁট ভেঙে ভেজা গলায় বলল—

“এমন করবেন না, শৈবাল। আমি খেয়ে নিচ্ছি। দেখুন, খাচ্ছি আমি। আপনি ওটা ফেলে দিন।”

শৈবাল অতি স্বাভাবিক হেসে কাচের টুকরোটা ছুড়ে ফেলল। অরুনিকা গূঢ়, অসহায় হাসল। ভাতের লোকমা মুখে পুরে দিয়েই গিলতে লাগল। শৈবাল বদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু আগের পরিপাটি সুন্দরী এক নিমেষে বুভুক্ষু প্রাণীতে পরিণত হয়েছে! দরজায় করাঘাত পড়তেই উঠে দাঁড়াল শৈবাল। অরুনিকা শঙ্কিত চোখে চাইল।

“তুমি খাও অরু। আমি দেখছি।”

দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন নমিতা বেগম। আওয়াজ শুনেই এসেছে তিনি। ঘরের অবস্থা দেখে আত্মা শুকিয়ে এলো তার। দিশেহারা কণ্ঠে বললেন—

“এসব কী করেছিস তুই? ”

শৈবাল রুমের ভেতরে তাকিয়ে পূনরায় মায়ের দিকে তাকাল। শীতল গলায় বলল—

“দেখা শেষ? এখন যান, আম্মা।”

“পাগল হয়েছিস তুই? কী শুরু করেছিস বউমার সাথে?”

“আপনি যান, আম্মা।”

নমিতা বেগম অসহনীয় গলায় বললেন—

“কেন করিস তুই এসব? তোকে কে বলেছিল বউমাকে নিয়ে যেতে? মেয়েটা ঘরেই পড়ে থাকত। তাও শান্তিতে থাকত।”

“আপনি যাবেন না, আম্মা?”

অরুনিকা মুখের ভাত কোনোরকম গিলে নিয়ে তাড়া দিয়ে বলল—

“আপনি যান, আম্মা। আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।”

সামনে তাকাল অরুনিকা। গলায় ভাত আটকে আছে। তবুও জোর করে গিলে যাচ্ছে সে। নমিতা ভয়চকিত গলায় বললেন—

“তুমি এভাবে খাচ্ছ কেন? ”

তিনি শৈবালের দিকে তীর্যক চোখে চাইলেন। খরখরে গলায় বললেন—

“মেয়েটাকে মে/রে ফেলতে চাইছিস তুই?”

শৈবাল ঠান্ডা গলায় বলল—

“আমি আপনাকে যেতে বলেছি, আম্মা। আপনি শুনতে পাননি আমার কথা?”

নমিতা বেগম চোখের পানি ছাড়লেন। অপরাধবোধ জেকে ধরেছে তাকে। তিনি চাপা স্বরে বললেন—

“তোর ভালোর জন্য মেয়েটাকে এ বাড়িতে এনেছিলাম। কিন্তু তুই যা করছিস তা ঠিক করছিস না শৈবাল। পরে না তোকে পস্তাতে হয়।”

কান্নার দমকে অরুনিকা মুখের ভাত বিছানায় ছিটকে পড়ল। তবুও সে শব্দ করল না। নমিতা বেগম চলে গেলেন। দরজা বন্ধ করে অরুনিকার কাছে এলো শৈবাল। খাওয়া শেষ। অরুনিকা নিশ্চুপ বসে আছে।

সমস্ত রুম নিজের হাতে পরিষ্কার করল শৈবাল। বিছানায় পা উঠিয়ে বসে আছে অরুনিকা। সে শুধু চেয়ে আছে। ঘণ্টা লাগল সবকিছু ঠিক করতে। শৈবাল কাচের টুকরোগুলো ঝাড়ু দিয়ে উঠিয়ে ফেলে দেয়। পানি দিয়ে মুছে দেয় মেঝে। এর মাঝে দুইজনের মধ্যকার আর কোনো বাক্যালাপ হলো না।

অরুনিকা এখনো নিরুত্তেজ ভঙ্গিতে বসে আছে। কৃত্রিম মৃদু আলোর বাতিতে শৈবালের শ্রান্ত মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে শৈবাল। শূন্যে তাকিয়ে আছে সে। এক পা বিছানায় হাঁটু ভেঙে রাখা আর অন্য পা ঝুলিয়ে রেখেছে। সোজা দৃষ্টি ঘুরিয়ে অরুনিকার দিকে চাইল সে। অরুনিকা শান্ত, নির্বিকার। মাথাটা পূনরায় সোজা করল শৈবাল। অনবরত ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ফিকে গলায় বলল—

” তখন অরুর বয়স মাত্র নয়। সেদিন আমার জন্মদিন ছিল। জয়নাল আংকেল ওকে নিয়ে এসেছিলেন। মেয়েটা কিছু বুঝত না। তাই তো আমি কেকে কা/টার আগেই আমার জন্মদিনের জন্য নিয়ে আসা কেকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খাওয়া শুরু করল। ভীষণ রাগ উঠেছিল আমার। রাগ চাপতে না পেরে একটা কষিয়ে থাপ্পড় দিয়ে বসলাম ওর গালে। মেয়েটার সে কী কান্না! অরুর মা ছিল না। আম্মা, ওকে সেদিন আর বাসায় যেতে দিলেন না। রেখে দিলেন নিজের কাছে। ও কতটা নাজুক বুঝো, সেদিন রাতেই গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো অরুর।”

শৈবাল থামল। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে অরুনিকার দিকে তাকাল। মুচকি হেসে বলল—

“ও একদম তোমার মতো নয়।”

অরুনিকা কোনো কথা বলল না। নির্দ্বিধায়, নিঃসংশয় চোখে তাকিয়ে রইল। টিমটিমে আলোতে শৈবালের জল ছলছল চোখ দৃষ্টিগোচর হলো তার। শৈবাল পূনরায় শূন্যে দৃষ্টি রেখে বলল—

“এর দুই বছর পর, অরুর বাবা ওকে আমার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমরা একই প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়তাম। জয়নাল আংকেল আমাদের বাড়ির পাশেই বাসা ভাড়া নিলেন। আব্বা আর আংকেল কোনো একসময় একই কোম্পানিতে জব করতেন। সেই থেকে তাদের বন্ধুত্ব। ”

শৈবাল শ্বাস নিল। অনুপল পর আবার বলল—

“তখন অরু ক্লাস সিক্সে পড়ে। সেদিন ওর জন্মদিন ছিল। ও কাউকে বলেনি। শুধু আমি আর অরু। রাত তখন বারোটার ওসপার। ও ভীষণ সাজতে পছন্দ করত। সেদিন প্রথমবার আমি ওকে শাড়ি পরা দেখেছি। আমার যে কী হলো! বুঝতে পারিনি। একসাথে বসে প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়া, রাস্তায় দৌড়ে কে আগে বাসায় পৌঁছাতে পারে তা নিয়ে ঝগড়া করা, একে অপরকে যেকোনো কম্পিটিশনে হারানোর প্রয়াসে চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ি মাথায় তোলা এই আমি সেদিন অন্যকিছু ভাবতে লাগলাম। এক শরতের বিকেলের শুভ্র কাশফুলের মতো আমার হৃৎপ্রকোষ্ঠে নীলাভ আকাশে তখন অরু উড়তে লাগল। আমরা বুঝে নিলাম, বন্ধুত্বের বাইরেও আমাদে মাঝে অন্য সম্পর্ক আছে। যার নাম আমরা জানি না।
কিন্তু আম্মা বুঝে গেলেন। অরুকে তখন আমার কাছে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মনে হতো। আগের মতো ওর সাথে ঝগড়া করা হতো না, খাবার নিয়ে টানাটানিও নয়।
কিন্তু…।”

শৈবাল দম ফেলল। একনাগাড়ে কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। অরুনিকা আসন পেতে বসল। তার চোখ স্থির, নিষ্কম্প। শৈবাল বলল—

“কখন যে এত বড়ো হয়ে গেলাম! বুঝতেই পারিনি। ইন্টার কমপ্লিট হতেই আব্বা আমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। তার শখ, ছেলে বিদেশে লেখাপড়া করবে। অরুকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয়নি আমার। তবুও গিয়েছিলাম। সব কিছু অসহ্য লাগছিল। আম্মার আঁচল ধরে রাখা এই আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আব্বা তাড়াতাড়ি করে আমাকে আবার দেশের আনার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু সুস্থ হতেই…। নিজেকে শক্ত করে নিলাম। ঠিক তখন বুঝতে পারলাম, অরুকে কতটা চাই আমি। ওর থেকে দূরে থেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি আমি। আমাদের সেই নামহীন সম্পর্ক তখন নাম পেল।
তারপর…একদিন ফিরেও এলাম। আমাদের সম্পর্ক পূর্ণাঙ্গ। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, বাকিটা জীবন আমরা একসাথেই কাটাব। কিন্তু বিয়ের দিন…।”

শৈবাল থমকে যায়। তার কণ্ঠনালী থরথর করে কাঁপছে। নিঃশ্বাস ভার হচ্ছে। অরুনিকা ঠোঁট চেপে রেখেছে নিজের। এক অদ্ভুত আত্মস্পর্শী অনুভূতির গহন মৃ/ত্যুর আভাস পাচ্ছে সে। শৈবাল অনুরাগভরা কণ্ঠে বলল—

“সব আমার দোষ। আমিই আমার অ/রুকে মে/রে ফেলেছি। আমিই ওর দোষী। নিজের হাতে আমি আমার অরুকে খু/ন করেছি। ও চেয়েছিল বাঁচতে। আমিই ওকে বাঁচতে দিইনি।”

শৈবালের নাসিকার ডগা ফুলে ফুলে উঠছে। তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনতা, শীতল প্রস্রবণ। অরুনিকার বুক সংকুচিত-প্রসারিত হচ্ছে। তাতে করে বুকের ভেতর চাপা ব্যাথা হচ্ছে। চোখের পানি টপটপ করে পড়ছে। শৈবাল নির্মল গলায় বলল–

“সেদিন আমি কেন বেঁচে গেলাম বলোতো? আমারও তো ম/রে যাওয়া উচিত ছিল! ম/রে গেলেই আমি আমার অরুর কাছে চলে যেতাম। ওকে হারিয়ে আমি ভালো নেই। তোমাকেও কষ্ট দিচ্ছি। তিনমাস…তিনমাস রোজ ও আমার কাছে বাঁচার আকুতি করেছে। আমাকে ঘুমাতে দেয়নি। সেদিন তোমাকে দেখে কেন আমার এমন হলো আমি জানি না। ওই নামেই আমি, আমার অসুস্থ মস্তিষ্ক, আমার ভগ্ন হৃদয়, এই প্রাণ আটকে গেল। অনেক দেরি হয়ে গেল বুঝতে যে, তুমি আমার অরু নও। ততদিনে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি অরু।”

শৈবাল ঘাড় ঘুরিয়ে অরুনিকার দিকে তাকাল। অরুনিকা অঝোরে শব্দহীন অশ্রুকণা বিসর্জন দিচ্ছে।

“আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি অরু। ওকে হারিয়ে আমি বুঝে গেছি, তোমাকে হারালে আমি বাঁচব না। অনেকটা সময় ওকে নিজের কাছ থেকে দূরে রেখেছিলাম আমি। তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যও পারব না। তোমার আশেপাশেও কাউকে সহ্য হয় না। আমি ছাড়া আমার ছায়াকেও নয়।
তুমি ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারো। আমি তোমাকে আটকাব না। অরুকেও আটকাতে পারিনি আমি।”

শৈবাল আর একটা কথাও বলল না। দৃষ্টি সোজা করে চাইল ওপরে। তারপর চোখ বুজে নিল। কিন্তু তার চোখের কোণ ঘেঁষে পড়া লবণাক্ত স্রোতোস্বিনীর ধারা বন্ধ হওয়ার নাম নিল না। অরনিকার অপলক চাহনি ওই নিমীলিত আঁখিযুগলের থৈ থৈ সমুদ্রতটে।

চলবে,,,

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:১৫
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি

মোলায়েম প্রভাতের মনোহর দৃশ্য! রাস্তার দুই পাশে যুবক ছেলেদের শারীরিক কসরত চলছে। তৌফিক সাহেব ব্যাগভর্তি মাছ নিয়ে হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছেন। মিহি, স্নিগ্ধ মলয়ে তার দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সজীবতা খেলছে।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেই গলা ছেড়ে ডাকলেন—

“বউমা!”

অরুনিকা সকালের নাশতা তৈরি করছিল। তৌফিক সাহেবের কণ্ঠে দৌড়ে এলো সে। শ্বশুরের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে কিশোরীসুলভ হেসে বলল—

“এত ঘেমে গেছেন কেন বাবা? বাইরে কী খুব রোদ?”

তৌফিক সাহেব ধীরস্থির গলায় বললেন—

“তেমন নয়। অনেকদিন ধরে হাঁটা হয় না। ছেলেপুলেদের দেখে একটু জোস এলো। তাই একটু জোরে হাঁটলাম। আর তাতেই ঘেমে নেয়ে একাকার!”

অরুনিকা মিষ্টি রাগ দেখিয়ে বলল—

“কী দরকার ছিল আপনার! শুধু শুধু।”

কোমল হাসলেন তৌফিক সাহেব। জিজ্ঞাসু গলায় বললেন–

“শৈবাল উঠেছে?”

“উহু। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে নিন। আমি চা দিচ্ছি। এই ফাহিমটাকেও দু ঘা দেবো এলে। এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে, এখনো ফেরার নাম নেই। আর এজন্য সকাল সকাল আপনাকে কষ্ট করতে হলো।”

তৌফিক সাহেব হাসলেন। অরুনিকা বাজারের ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। নমিতা বেগম চুলা থেকে চায়ের পাত্র নামিয়ে নিলেন। থমথমে মুখ তার। অরুনিকা আলতো হেসে বলল—

“আপনি যান আম্মা। আমি চা নিয়ে আসছি।”

নমিতা বেগমের গম্ভীর চেহারার পরিবর্তন হলো না। তিনি চোখ সরিয়ে হাঁটা ধরলেন। অরুনিকা তার হাত ধরে অনুনয় করে প্রশ্ন করল—

“আম্মা, কথা বলছেন না কেন আপনি? সকাল হতেই চুপ করে আছেন।”

নমিতা বেগম আচমকা উন্মাদগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। চোখের পল্লব প্রশস্ত করে বললেন—

“তুমি চলে যাও, চলে যাও এখান থেকে। শৈবাল আর কখনো ভালো হবে না। অরুমিতার মতো তোমাকেও না মে/রে ফেলে!”

নমিতা বেগম লম্বা লম্বা পা ফেলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অরুনিকা হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
,
,
,
একটা ফাইল খুঁজতে খুঁজতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল শৈবাল।
বিতৃষ্ণা উগরে ডেকে উঠল—

“অরু!
এদিকে এসো।”

অরুনিকা একটু সময় নিল। ড্রয়ার খুলে চিরুনি তল্লাশি করেও ফাইলের হদিস পেল না শৈবাল। সে আবার ডেকে উঠল—

“অরু! শুনতে পাচ্ছ না?”

“আসছি।”

জবাব এলো রান্নাঘর থেকে। তবে খুবই ছোট্ট আওয়াজে। গুটিগুটি পায়ে রুমে ঢুকল অরুনিকা। কোমরে বাধা আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে বলল–

“কেন ডেকেছেন?”

শৈবাল স্থির হলো। অধৈর্য চোখে চেয়ে বলল–

“দু’দিন আগে একটা ফাইল দিয়েছিলাম তোমায়। কোথায় রেখেছ? পাচ্ছি না তো।”

অরুনিকা জবাব দিলো না। শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে এসে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফাইলটা নিয়ে দিলো। তখনই ড্রেসিং টেবিলে চোখ পড়ল শৈবালের। নিজেকে দেখতে পাচ্ছে সে। আয়না তার জায়গায় থাকলেও দুই পাশের পাল্লা দুটোর কাচ ভেঙে ফেলেছে সে। শৈবাল শ্বাস ফেলে বলল—

“টুম্পার মা এসেছে? ”

“না।”

“সে আসলে তাকে এটা নিয়ে যেতে বলো। আব্বাকে বলো গ্লাস লাগানোর জন্য টাকা দিয়ে দিতে। নতুন ড্রেসিং টেবিল নিয়ে আসব তোমার জন্য।”

“আপাতত দরকার নেই। আমার প্রয়োজন হলে আমি নিজেই বলব।”

শৈবাল সংকীর্ণ চোখে তাকাল। অরুনিকার কণ্ঠ অদ্ভুত, করুণাহীন। তদ্দণ্ডে মোবাইল ফোন বাজল অরুনিকার। বিছানার পাশ টেবিল থেকে মোবাইল নিয়েও কল রিসিভ করল না সে। অপলকে চেয়ে রইল। শৈবাল ফাইল উলটে দেখতে লাগল। জড় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা অরুনিকাকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো সে। ধীরগতিতে তার কাছে এসে বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলল—

“কে ফোন করেছে?”

অরুনিকা থতমত খেয়ে গেলে। শব্দহীন শ্বাস ফেলছে সে। হাতের মুঠোয় মোবাইল ফোন চেপে রেখে সোজা হয়ে আছে। শৈবাল অরুনিকার উদরে আবদ্ধ রাখা বন্ধন মজবুত করল। তার কানে অধরের ছোঁয়া লাগিয়ে বলল—

“কথা বলছ না কেন?”

অরুনিকা জবাব দেওয়ার মতো কোনো বাক্য খুঁজে পেল না। শৈবাল চট করে অরুনিকার মোবাইল নিয়ে নিল। অরুনিকা ভড়কে যায়। শৈবাল তেমন কিছু বলল না। মোবাইল ফোনের পাওয়ার বাটন অফ করে তা খুলে সিম বের করে নিল। আঙুলের চাপে সিম ভেঙে ছুড়ে ফেলে বলল—

“রং নাম্বার নিয়ে এত চিন্তার কী আছে? নাও। আসার সময় নতুন সিম নিয়ে আসবো।”

অরুনিকাকে তার মোবাইল ফিরিয়ে দিলো শৈবাল। অরুনিকা স্বস্তির প্রশ্বাস নিল। শৈবাল প্রবল ভাবাবেগের সাথে অরুনিকার কপালে চুমু খেয়ে বলল—

“আসি আমি। আর কালকের জন্য সরি।”

অরুনিকা চোখে হাসল। হালকা করে মাথা ঝাঁকাল।

প্রায় একঘণ্টা পর গৃহকর্মী ফারিনা এলো। সে রান্নাঘরে ঢুকেই বলল—

“ভাবীজান মাফ কইরা দেন। আইতে একটু দেরি অইয়া গেছে। মাইয়াডার আইজ পরীক্ষা আছিল।”

অরুনিকা ভাতের পাতিল নামিয়ে মাড় ঝরার জন্য রাখল। ফারিনার দিকে তাকিয়ে বলল—

“আজ আর তোমাকে কিছু করতে হবে না। তোমার স্বামীকে ফোন করে আসতে বলো। আমাদের ড্রেসিং টেবিলটা নিয়ে যেতে। কাচ লাগিয়ে নিয়ো। বাবা ভ্যান ভাড়া আর কাচ লাগানোর টাকা দিয়ে দিবেন। ও, আরেকটা কাজ করো। রান্নাঘরের দেয়ালের সাথে যে শো-কেসটা আছে ওটাও নিয়ে যাও।”

ফারিনা উদ্বিগ্ন গলায় বলল—

“ভাইজান কী কাইলও ভাঙচুর করছে নাকি?”

অরুনিকা শান্ত ভঙ্গিতে বলল—

“হুম।”

ফারিনা বিস্ময় নিয়ে বলল—

“কন কী ভাবীজান! ভাইজানের রাগ এহনো কমে নাই? কাইলও কী হাত-পা কাইট্টা ফালাইছে?”

“উহু। তুমি আর প্রশ্ন করো না তো । মাথা ধরেছে আমার। তুমি টুম্পার বাবাকে আসতে বলো। ”

“জে ভাবীজান। তয় এখ্খান কথা কই। মনে কিছু কইরেন না। আমার কী মনে হয় জানেন, ভাইজানরে অরুমিতা আফার ভূতে ধরছে। নাইলে আপনে কন, এত বড়ো বড়ো ডাক্তার হেরে ভালা করতে পারে না কেন?”

অরুনিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল—-

“কী সব বাজে কথা বলছ! ”

“আমি হাছা কইতাছি ভাবীজান। আমাগো বাসায়ও এমন একটা বেডা আছিল। তার প্রথ্থম বউ ম/ইরা যাওনের পর বেডা আরও দুইডা বিয়া করছে। দুই বউই বিয়ার একমাস পরেই গলায় ফাঁস দিছে। মাইনসে কয় বেডায় নাকি প্রথ্থম বউডারে বহুত মারত। আবার কেউ কয় বেডায় নাকি নিজেই বউরে মা/ইরা পাঙ্খার লগে ঝুলাইয়া দিছিল। হের পতিশোধ নেওনের লাইগা তার বউয়ের ভূত এডি করতাছে।”

অরুনিকার সরু ভ্রূ জোড়া অচিরেই বক্র হয়ে এলো। এমনকি হয়! সত্যিই কী শৈবালের এমন উদ্ভট আচরণের জন্য অরুমিতা দায়ী?
,
,
,
কেবিনে ঢুকতেই হলকে উঠল শৈবাল। কেবিনের একপাশে রাখা কাউচে বসে আছে শিমুল। শৈবালকে দেখেই তার হাসি চওড়া হলো। সে উঠে দাঁড়াল। শৈবাল বুনো ষাড়ের মতো তেড়ে গিয়ে কলার চেপে ধরল শিমুলের। ক্যাটক্যাটে গলায় বলল—

“কেন এসেছিস তুই এখানে?”

শিমুল স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল—

“তুই প্রমান করেছিস, কারো উপকার করতে নেই। তুই সেই প্রথম দিন থেকে যা তা ব্যবহার করছিস আমার সাথে। তোকে সত্য বলে কী আমি ভুল করেছি?

শৈবাল ক্ষেপা বাঘের মতো বলল—

“আমার অরুর কাছ থেকে দূরে থাকবি। তোর ছায়াও যেন না দেখি আমি ওর আশেপাশে।”

“বিয়ের আগে ঠিকঠাক খোঁজ নিয়েছিস তো? না কী দ্বিতীয়বারও সেই একই ভুল করেছিস?”

ধুম করে শিমুলের চোয়ালে এক ঘু/ষি বসাল শৈবাল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here