ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত #পর্ব:২২,২৩(প্রথমাংশ )

0
901

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:২২,২৩(প্রথমাংশ )
লেখনীতে: তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:২২

শৈবালের এমন উদ্ভ্রান্তের চলে যাওয়া ঠাওর করল জাফর। বসার রুমের কোথাও অরুনিকাকে দেখতে না পেয়ে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বিপদের আভাস দিলো। মুহূর্তে বৈরি আচরণের শৈবালকে সবাই দেখল। কিন্তু দ্রুততার সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া শৈবালকে কেউ কিছু বলতে পারল না। জাফর থমথমে মুখে এসে ঢুকল শৈবালের রুমে। দেখল, বিছানার একপাশে চুপচাপ বসে আছে অরুনিকা। পাথরের প্রাণহীন মুর্তির মতো চাইল জাফরের দিকে। জাফরের আতঙ্কিত অন্তরিন্দ্রিয়। অরুনিকার অস্বাভাবিক চাহনি, আলুথালু চিকুর, ফুলে ওঠা ওষ্ঠাধর।

জাফর ব্যতিব্যস্ত গলায় শঙ্কিত দৃষ্টিতে বলল—

” অরুনিকা, কী হয়েছে তোমার?”

অরুনিকা দৃষ্টি নামিয়ে নিল। তার মসৃণ, ফর্সা বাম পা শাড়ি গলিয়ে বেরিয়ে আছে। সে সেদিকে তাকিয়ে রইল অনিমেষ। জাফর এগিয়ে এলো। তার কণ্ঠনালী কাঁপছে অজানা ভয়ে। সে আবার বলল—

“অরুনিকা, কী হয়েছে বলবে? শৈবাল ওইভাবে চলে গেল কেন? সবটা তো ঠিকই ছিল!”

রুমকি এলো। তার সাথে এলেন তৌফিক সাহেব আর নমিতা বেগম। মৌমিতা বেগম স্বামীর পাশে বসার রুমে বসে রইলেন। তারা অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। শিমুল এলো সবার পরে। সে দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে রইল। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে সে।

রুমকি চোখ পাকিয়ে ঝাঝিয়ে উঠে বলল–

“কথা বলছিস না কেন তুই? কী বলেছিস তুই শৈবালকে। কোথায় গেল ও এত রাতে?”

অরুনিকা এবারও কথা বলল না। তার চোখের পানি গালের ওপর খুবই মন্থর গতিতে গড়িয়ে এসে জমা হচ্ছে চিবুকে। তারপর সেখান থেকে টুপ করে নিচে পড়ছে। জাফর বিরক্ত হলো। তেতো হয়ে উঠল তার মেজাজ। সে অনেকটা রুষ্ট গলায় বলল—

” অরুনিকা! চুপ করে আছ কেন?”

অরুনিকার দেহে নিজের অজান্তেই ঝাকুনি দিয়ে উঠল। একটু সময় নিয়ে সে চাইল জাফরের দিকে। জাফরের চোখ দুটোতে ভীষণ তেষ্টা। সে জানতে চায় কী ঘটেছে। সবাইকে বিভ্রান্ত করে দিয়ে মৃদু হাসল অরুনিকা। আক্ষেপের সাথে বলল—

“আপনারও এক তাই না? সবাই আমাকে বোকা পেয়েছেন? আমার আব্বুর অসুস্থার সুযোগ নিয়ে নিজের দুশ্চরিত্র শালার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।”

জাফর যেন আকাশ থেকে পড়ল। তার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল ওই একটা শব্দে। দুশ্চরিত্র ! শৈবালকে দুশ্চরিত্র বলছে। যে ছেলেটা চোখের আড়ালে যেতে দেয় না এই মেয়েকে, সেই মেয়ে তার স্বামীকে দুশ্চরিত্র বলছে!
জাফর পলেই ক্ষেপে গিয়ে বলল—

“এসব কী ধরনের কথা অরুনিকা? কোন ইস্যুতে তুমি শৈবালের ওপর এত বড়ো আরোপ লাগাচ্ছ?”

অরুনিকা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল। বিছানা থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তুচ্ছ গলায় বক্রোক্তি করল—

“আরোপ! জানতে চান আপনারা? কী জানতে চান? এটাই যে অরুমিতা বিয়ের আগেই শৈবালের সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করেছিল? আর নিজেদের জঘন্য কাজ লুকাতে আবার সেই সন্তানকে দুনিয়ার আলো পর্যন্ত দেখতে দিলো না তারা। আর আপনারা সব জেনেও চুপ করে ছিলেন। এই আপনাদের ছেলের ভালোবাসা?”

বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগল নমিতা বেগম আর তৌফিক সাহেব। শিমুল একটা বড়ো ঢোক গিলল। তার পা দুটো আচানক কাঁপতে লাগল। দরদর করে ঘামতে লাগল সে। অরুনিকার গলা ফাটা চিৎকার গিয়ে বিঁধল মৌমিতা বেগম আর তার স্বামী হাসান আলীর কর্ণকুহরে। তারা একে অপরের দিকে অবোধ্য নজরে তাকাল। রিম, ঝিম ছুটে এলো মামির এহেন চিৎকারে।

অরুনিকা কথা শেষ হতেই দাপিয়ে উঠল রুমকি। তড়িৎ বেগে সে বলে উঠল—

“কী বলছিস এসব তুই? এত বড়ো নোংরা কথা বলতে তোর মুখে বাঁধল না? আর অরুমিতা! মেয়েটা ম*রে গেছে অরুনিকা। এতবড়ো অপবাদ তো দিস না। শৈবাল শুধু আমার ভাই নয় তোর স্বামী। ওর নামে এই নোংরা কথা বলতে তোর একটুও লজ্জা লাগল না? অবশ্য লজ্জা করবে কেন? কে হয় ও তোর? রাতভোর ওর পাশে শুইয়ে থাকা ছাড়া আর কোন দায়িত্ব পালন করিস তুই?”

জাফর হুংকার দিয়ে বলল—

“রুমকি! চুপ করবে তুমি?”

“কেন চুপ করব? কেন? ও কী বলেছে তুমি শুনেছ?আমার শৈবালকে বলছে দুশ্চরিত্র! ও চিনি আমার শৈবালকে?”

নমিতা বেগম অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তৌফিক সাহেবের দিকে তাকাল জাফর। জাফর চোখের ইশারায় অনুরক্তি প্রকাশ করতেই তিনি নমিতা বেগমকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। সেখান থেকে বের হতেই তাদের নজর গিয়ে পড়ল অরুনিকার বাবা-মায়ের ওপর। তারা ভীষণ লজ্জিত।
জাফর কণ্ঠের নম্রতা ছেড়ে শিমুলকে বলল—

“রিম, ঝিমকে নিয়ে তোর ভাবির ঘরে যা।”

শিমুল ধ্বসে পড়া গলায় বলল–

“জি, জি, ভাইয়া।”

অরুনিকা ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। জাফর চোয়াল শক্ত করে তাকাল রুমকির দিকে। রুমকি ফুঁসে যাচ্ছে। সাপের মতো হিসহিস করছে তার কণ্ঠস্বর। জাফর প্রশস্ত গলায় বলল—

“বললে তো যাবে না। কিন্তু আরেকটা বাজে কথাও বলবে না। যদি বলেছ, ধাক্কা মেরে বের করে দেবো তোমাকে আমি। ভাইয়ের বউ তোমার, রাস্তার মেয়ে নয়, যে যা ইচ্ছে যার সামনে ইচ্ছে বলবে। বউকে ছাড়া একরাত থাকতে পারে না তোমার ভাই। মেয়েটার দম আটকে রাখে তোমার ভাই। ঘরে বাইরে পা রাখতে দেয় না তোমার ভাই। তাই সাবধান!”

রুমকি দমে গেল না। দাঁতের সাথে দাঁত চেপে আহত বাঘিনীর ন্যায় চেয়ে আছে অরুনিকার দিকে। অরুনিকা নির্বিকার। জাফর কাছে এগিয়ে গেল তার। হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে তার পাশে নিজেও বসল। অরুনিকা অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। রাগ নাকি অভিমান, ক্ষোভ নাকি অপরাধবোধ; কোনো একটা কিছু তখন তাকে গ্রাস করছে। সে তাকাতে পারল না জাফরের দিকে। জাফর নিজের সেই সাত বাড়িয়ে দিলো, যে হাতে একটু আগে অরুনিকা ঘড়ি পরিয়ে দিয়েছে। অরুনিকা আড় চোখে তাকাল। জাফর বলল—

“ভাই বলেছ না? তাহলে গোপন কেন করছ? বলো কী হয়েছে। মানুষ চিনতে যদি খুব ভুল না করি, তাহলে বলব শৈবালকে তুমি এখনো চিনতে পারোনি। হিরের টুকরো ছেলে। দিনের আলো হোক বা রাতের আঁধার, কারো ক্ষমতা নেই তার চাকচিক্য কেড়ে নেওয়ার।বলো অরুনিকা। তুমি যে এমনি এমনি এত বড়ো কথা বলোনি তা আমি জানি। ভাইয়াকে খুলে বলো।”

অরুনিকা তার মোবাইল জাফরের হাতে দিলো। ওয়াটসঅ্যাপে অপরিচিত নাম্বার থেকে পাঠানো দুটো ছবি দেখাল। রোদনে আচ্ছন্ন গলায় বলল—

“দেখুন, ভালো করে দেখুন। ওই সিগনেচার শৈবালের। শৈবাল নিজে অরুমিতাকে এবোর্শনের জন্য নিয়ে গেছে। নিজে সিগনেচার করেছে। ফ্রমে অরুমিতার নামও লেখা আছে। এর পরেও বলবেন আমি মিথ্যে বলছি?”

রুমকি ঝড়ের বেগে এগিয়ে এলো। মোবাইলটা জাফরের হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে দেখতে থাকল। তার চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। জাফর উঠে দাঁড়িয়ে রুমকির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিল। তারপর সেই সিগনেচার করা কাগজটার ছবিতে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎ বলে উঠল—

“এটা শৈবালের সিগনেচার নয়।”

অরুনিকা অনুপলেই হতভম্ব হয়ে গেল।অবিশ্বাস্য গলায় বলল—

“কী বলছেন?”

“ঠিক বলছি। সারাক্ষণ আমি ওর সিগনেচার করা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করি। এতটুকু বোধ তো আমার আছে।”

অরুনিকার চাহনি এলোমেলো। অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়াল। তিরতির করে কাঁপছে তার ঠোঁট। জাফর সেই ছবিতে দৃষ্টি রেখে বলল—

“ভালো করে দেখো। শৈবাল ‘বি’এর পর ‘এ’ কখনো আলাদা লিখে না। ‘বি’ এর সাথে ‘এ’ একবারে লিখে। কিন্তু যে ওর এই সিগনেচার নকল করেছে, সে বোধহয় তাড়াতাড়ি করছিল। হয়তো সে ভীতিগ্রস্ত ছিল। এল এর মাথাটাও ঠিকভাবে টানেনি।

অরুনিকা বাজপাখির মতো ঠুকরে নিল যেন জাফরের হাত থেকে মোবাইল। অত্যন্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। জাফর বলল—

“বাসায় কোনো ফাইল আছে?”

অরুনিকা আবিষ্ট গলায় বলল—

“না।”

“আচ্ছা। আমি শিমুলকে আমার বাসায় পাঠাচ্ছি। একটা নতুন প্রজেক্টের ফাইল আছে বাসায়। শৈবালের সিগনেচারও আছে সেখানে।”

অরুনিকা জবাব দিলো না। সে কী যেন ভাবছে। তারপর শশব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল আলমিরার কাছে। আলমিরা খুলল চটজলদি। কিছু সময় পরে খুঁজে বের করল তাদের বিয়ের কাবিননামা। সেখানে শৈবালের সিগনেচার আছে। তা মোবাইলের ছবির সাথে মিলিয়ে দেখল। ধুক করে উঠল অরুনিকার বুক। জাফর সত্য বলেছে। এ সিগনেচার শৈবালের নয়। তার নেত্রযুগল থৈ থৈ করে উঠল নোনা জলে। জাফরের দিকে তাকাল। জাফর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—

“একটু তো বুঝে শুনে নিতে।”

চকিতে মেঘ ডেকে উঠল। দমকা হাওয়া বইতে শুরু করল। মিনিট ব্যয় হতেই রুম জুড়ে ঠাণ্ডা একটা আবহ তৈরি হলো। অরুনিকা ব্যস্ত গলায় বলল—

“শৈবাল কোথায়?”

“ও তো বাইরে চলে গেছে।”

“ও আল্লাহ! এখন কী হবে?”

রুমকি জ্বলে উঠল। এতসময় যে সে চুপ করে রইল, সব আ*গুন যেন একবারে উগরে দেবে বলে! সে বলল—

“আর কী হবে? ভালোই তো হবে। ওর কিছু হয়ে গেলেই তো শান্তি পাস তুই।”

“আপা!”

কাতর শোনালো অরুনিকার কণ্ঠ। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে। মাথাটা নামিয়ে নিল। জাফর ক্রোধিত চোখে তাকাল রুমকির দিকে। রুমকি তেজী গলায় বলল—

“এভাবে কেন তাকাচ্ছ? আমার ভাইটা কী খেলার পুতুল। যখন যেভাবে ইচ্ছে খেলবে, খেলা শেষে ছুড়ে ফেলে দেবে! কে কী বলল, কী পাঠালো তা দেখেই নিজের স্বামীকে অবিশ্বাস করে ফেলল। এই ওর ভালোবাসা? ওর তো কিছু হবে না। পাগল তো আমার ভাই। নিজের গলায় ছু*রি বসিয়ে দেবে তাও এই মেয়েকে একটা আচড় লাগতে দেবে না। আর সে কিনা…।”

“তুমি চুপ করবে? বাইরে ওর বাবা-মা আছে।”

“শুনুক তারা। শুনে যাক মেয়ের কীর্তি।”

অরুনিকা বলে উঠল—

“জাফর ভাই, দেখুন না একটু গিয়ে, শৈবাল কোথায় গেছে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হবে।”

“দেখছি আমি।”

জাফর বেরোলো শিমুলকে নিয়ে। সে কল করল অনেকবার। শৈবালের মোবাইল সুইচ অফ।ঝড় এসেছে। রাস্তায় ধুলো উড়ছে। খানিক সময় পরপর বিজলী চমকাচ্ছে। আশেপাশের অনেকটা জায়গা জুড়ে দৌড়ে দৌড়ে শৈবালকে খুঁজে বেড়াল তারা দুইজন। তবে পেল না।

ঝমঝম করে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলো। তদ্দণ্ডে ঘরে ঢুকল জাফর আর শিমুল। তাদের নরম, নিরুত্তেজ চাহনি। ভয়ে কুকড়ে এলো অরুনিকার অন্তঃকরণ। রুমকি চিৎকার করে বলে উঠল—

“এবার খুশি হ তুই। খুশি হ। তোর আপদ বিদেয় হয়েছে।”

অরুনিকার বিবশ চাহনি তখন দরজায়। বৃষ্টির ঝুপঝুপ শব্দ। সে আর অন্যদিকে তাকাল না। সবাই বসে রইল বসার রুমে। চেয়ারে বসে ডাইনিং টেবিলে হাত ঠেকিয়ে মাথা দিয়ে রেখেছে তাতে রুমকি। আর বিলাপ করে যাচ্ছে। নানা -নানীর মাঝে কাউচে হেলান দিয়ে বসে আছে রিম,ঝিম। তারা বুঝেও কিছু বুঝল না। অরুনিকার বাবা-মাও নিরুত্তাপ। তাদের দৃষ্টিও ওই দরজার দিকে। জাফর বসেছে ডাইনিং অন্য পাশটায়। শিমুল দাঁড়িয়ে আছে কাউচের এক কোণায়।

দৌড়ে ঘরে ঢুকল শৈবাল। সে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকাল ভেতরের দিকে। নিস্তরঙ্গ বসে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে চঞ্চলতা এলো। কাকভেজা শৈবালকে দেখে তারা হতচকিত। শৈবাল শীতল গলায় বলল—

“সবাই এখানে কেন?”

সবাই নিজ স্থান থেকে উঠে দাঁড়াল। কয়েক কদম এগিয়েও গেল। রুমকি গিয়ে দাঁড়াল একদম ভাইয়ের কাছে। বলল—

“কোথায় গিয়েছিলি তুই? এত ভিজে গেলি কী করে? তোর দুলাভাই তো খুঁজতে বেরিয়েছিল।”

শৈবালের খরা দৃষ্টি তখন অরুনিকার দিকে। অরুনিকা একটুও নড়ল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শৈবাল চোখ সরিয়ে এনে তাকাল বাকিদের দিকে। সবার মধ্যে চাপা উৎকণ্ঠা। সে বলল—

“সামনে মনির ভাইয়ের হোটেলে। ঝড় শুরু হয়েছিল। তাই ভেবেছি, ঝড় থামলে ফিরব। এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ফোনের ব্যাটারিও ডাউন ছিল।”

সবাই শ্বাস নিল। শৈবালের নরম ব্যবহারে সবাই একটু অবাকও হলো। তবে স্বস্তি পেল এই ভেবে যে, ডঃ সাবিনার ট্রিটমেন্টে শৈবাল আগের চেয়ে ভদ্র ব্যবহার করছে। তার ক্ষোভ, উগ্রতা কমে এসেছে।

ভেজা পা নিয়েই নিজের রুমে ঢুকল শৈবাল। গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ঝুড়িতে রাখল। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকল। অরুনিকা রুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইল। শৈবাল বের হলো মিনিট পাঁচেক পর। বের হয়েও সে অত্যন্ত স্বাভাবিক। যা আরও বেশি অস্বাভাবিক লাগছে অরুনিকার কাছে। শৈবাল কাপড় বদলালো। একটা ট্রাজারের সাথে টিশার্ট পরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সবকিছু এমনভাবে ঘটল যেন, সেখানে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায়নি শৈবাল।

খাবার টেবিলে বসল সে। হাসি হাসি মুখে সে বোনকে বলল—

“তোমরা কী খেয়ে ফেলেছ?”

রুমকি বলল—

“তোকে ছাড়া কেউ খাবে তুই ভাবলি কী করে?”

“ভাবিনি তো। তাই জিজ্ঞেস করলাম। আম্মু-আব্বু আপনারাও আসুন। আর আজকের রাতটা এখানেই থেকে যান। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। কাল সকালে যাবেন। ”

অরুনিকা গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। টেবিল থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। শৈবাল আবার বলল—

“জাফর ভাই আসুন। আম্মা-আব্বা আপনারা বসে আছেন কেন? আয় শিমুল। রিম, ঝিম এসো।”

অরুনিকার বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। শৈবাল সবাইকেই দেখল, শুধু তাকেই দেখল না?
শৈবাল খেলও নিজের মতো করে। একটিবারের জন্যও সে ওই তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো চেয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকাল না।

চলবে,,,

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:২৩(প্রথমাংশ )
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি

জমাট আঁধারের বুকে মিহি আলোর ছড়াছড়ি। মিষ্টি, স্নিগ্ধ, তন্দ্রালু দ্যুতির এক থমথমে পরিবেশে বসে আছে অরুনিকা। বিছানার একপাশে তার উপস্থিতি। অন্য পাশটাতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে শৈবাল। চোখের ওপর আড়াআড়ি করে হাত রাখা।

অরুনিকা অনিমেষ লোচনে চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। শৈবালের মধ্যে হেলদোল নেই। কিয়ৎপল পরপর সমীরণে দোলা বাড়তেই জানালার পর্দা উড়ে যায়। আর তখনই চাঁদের আলোর সাথে হুরহুর করে ডুকে পড়ে শীতল বাতাস। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক সময় হয়েছে। তবুও তার রেশ বাহ্যজগতে মিশে আছে। অরুনিকা কম্পিত গলায় বলল—

“শৈবাল, প্লিজ, এবারের মতো মাফ করে দিন।”

শৈবাল চুপ করে রইল। তার ঠোঁটের দিকে ক্ষীণপ্রভাতে চেয়ে রইল অরুনিকা। অবিচল গলায় বলে উঠে শৈবাল—

“ঘুমাও অরু। অনেক রাত হয়েছে।

“প্লিজ শৈবাল।”

“আমি কী তোমাকে কিছু বলেছি? ক্ষমা কেন চাইছ তুমি? এমন অনেক ভুল তো আমিও করি। তুমি কী আমাকে ক্ষমা করে দাও না? তাহলে আমি কেন দেবো না? তোমার কোনো দোষ নেই অরু।”

অরুনিকার অন্তঃকরণ ব্যথিত হয়। সে জানে শৈবাল এখনো তার ওপর অভিমান করে আছে। সে আবার বলল—

“প্লিজ শৈবাল। আমার ভুল হয়ে গেছে।”

শৈবাল চোখের ওপর থেকে হাত সরালো। মাথাটা বাকিয়ে তাকাল অরুনিকার দিকে। আলোর বিপরীতে মুখ হওয়ায় সে স্পষ্ট অরুনিকার মুখ দেখতে পেল না। শৈবাল উঠে বসল। বিছানার উচু জায়গাটার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বলল—

“তুমি বারবার একই কথা কেন বলছ? আমি তোমার কথায় কিছু মনে করিনি। তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসনি অরু। যা করেছে শুধু দায়িত্বের খাতিরে করেছ। আমি আজ তোমাকে সেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিলাম।”

অরুনিকার বুক কাঁপছে। উষর গলা। তিরতির করে কাঁপছে ওষ্ঠাধর। ঝিমুনি দিয়ে উঠছে মাথা। সংকুচিত হচ্ছে দেহ। এসব কী বলছে শৈবাল? কীসের দায়িত্ব? কীসের মুক্তি? অরুনিকা আর পারল না। তার চোখ দিয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। তাতে কোনো শব্দ হলো। শৈবাল দেখল কিনা কে জানে?

শৈবাল সোজা মাথা রেখে শূন্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল—

“আমি যখন সেকেণ্ড ইয়ারে, তখন আমাদের ডিপার্টমেন্ট হেড আমাদেরকে একটা অ্যাসাইমেন্ট করতে বললেন। তাই তিনি ক্লাসের সবাইকে চারজনের এক একটা গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। আমাদের গ্রুপে আমি, কুনাল, এন্ড্রো আর লুসি ছিলাম। কুনাল ইন্ডিয়া থেকে এসেছিল। এন্ড্রো আর লুসি সেখানকারই।
সারাদিন ক্লাস শেষে আমাদের আড্ডা হতো পাবে। লুসি প্রচুর ড্রিংস করত। ওর মম সিঙ্গেল মাদার ছিল। তার একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল এলিস নামে।
সেদিন লুসি অন্য দিনের চেয়ে বেশিই করে ফেলে। ওকে সামলানো যাচ্ছিল না। সেদিন ও আমাকে কী বলেছিল জানো?”

শৈবাল অরুনিকার দিকে তাকাল। অরুনিকা চোখের জলের চাকচিক্য একটুও বিভ্রান্ত করল না শৈবালকে। না সে দেখতেই পেল না! সে অনুদ্বেগ গলায় আবার বলল—

“ও আমাকে ভালোবাসে।”

শৈবাল হেসে ফেলল। অরুনিকা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিন্তু কোনো কথা বলল না। শৈবাল মাথা সোজা করল। ফের বলতে শুরু করল—

“ওর ওটা ভালোবাসা ছিল না। ছিল ইনফেচুয়েশন। মোহ। আমার প্রতি ওর একটা মোহ তৈরি হয়েছিল। কেন জানো? কারণ, দুর্লভ বস্তুর প্রতি আমাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু যখন আমরা তা পেয়ে যাই, তখন আমাদের সেই মোহ কেটে যায়। কুনাল আর এন্ড্রো ওরা দুইজনই লুসিকে যথেষ্ট কেয়ার করত। কিন্তু আমি তখনো আমার অরুতে আবদ্ধ। এরপরেও আমরা অনেকবার কাছে এসেছি। তবে তা কখনো সীমা লঙ্ঘন করেনি। বন্ধুত্বের বাইরে এক কদমও রাখিনি আমি। অ্যাসাইমেন্ট শেষ হওয়ার পর আমরা আবার আলাদা হয়ে যাই। একদিন রাতে লুসি আমাদের ফ্ল্যাটে চলে আসে। এটা তেমন কিছু নয়। কুনাল সেদিন ওর গার্লফ্রেন্ড সুজানকে নিয়ে এসেছিল। কুনাল আর এন্ড্রো প্রায়ই ওদের গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে ফ্ল্যাটে আসত। ব্যাপারটা জঘন্য ছিল! সেদিন রাতে আর বাকিদের ঘুম হতো না। আমরা বসে গান বাজিয়ে তখন গেমস খেলতাম। সবকিছুই স্বাভাবিক ওখানে। লুসিও সেদিন আমাদের সাথে ছিল। ইভেন ও আমার কাছে এসেছিল সেদিন। তখন আমি ওকে ক্লিয়ার করে জানিয়ে দিই। সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

শৈবাল থামল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা শ্বাস ফেলল। বলল—

” অরুকে আমার তখন অনেক বেশিই মনে পড়ত। আফটার অল আমিও পুরুষ মানুষ। কতদিন নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়! ওই বয়সটাতো নতুন জিনিসকে এক্সপ্লোর করার, নতুনকে নিজের মতো করে জানার। তবুও আমি সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি, কারণ, আমি অরুকে ভালোবাসতাম। অনেক বেশি ভালোবাসতাম। খুব বেশি হয়তো। তাই ও আর আমার হলো না। আর যে আমার হলো সে আমাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসার সবচেয়ে বড়ো ভিত্তি বিশ্বাস। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না অরু। তাই এই ভালোবাসা মূল্যহীন।”

শৈবাল মাথাটা ঠেকিয়ে রাখল বিছানার হেডবোর্ডে। হালকা ঘুরিয়ে বলল—

“লুসি এখনো বিয়ে করেনি। ও জনসন নামে একটা ছেলের সাথে লিভ ইন এ থাকে। জনসনের আগেও অনেক গার্লফ্রেন্ড ছিল। লুসি সব জানে। ওদের কাছে নিজের ইচ্ছেই বড়ো বাকিসব ঠুনকো। কখন, কাকে, কীভাবে ভালো লেগে যায় বোঝা বড়ো দায়। তারচেয়ে বড়ো কষ্টকর কাউকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবেসে ফেলা। সেই কষ্ট না বাঁচতে দেয় না ম*রতে। জাস্ট লাইক মি।”

অরুনিকা বিবশ চোখ চেয়ে রইল। শৈবাল ফিক করে হেসে বলল—

“ঘুমাও অরু। এত ভেবো না। তোমার ওপর কোনো রাগ নেই আমার। তুমি মুক্ত। এমন জীবন চেয়েছিলে না তুমি? দিলাম আমি তোমাকে। আজ থেকে তুমি তোমার মতো থাকবে। যেখানে যাওয়ার যাবে। কেউ বাঁধা দেবে না তোমায়। শুধু একটা কথা মনে রেখো, আমি সত্যিই তোমায় ভালোবেসেছি।”

শৈবাল শুয়ে পড়ল। অরুনিকার কী হলো সে জানে না। তার মাথায় দুই পাশে ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হলো। হাত -পা অবশ হয়ে আসছে। কান্নারা গলায় পেচিয়ে যাচ্ছে। ঝাপসা চোখজোড়া কী নিদারুণভাবে জ্বলে যাচ্ছে!
,
,
,
সকালের প্রথম প্রহর। মিষ্টি সুরে ডাকছে অজানা পাখি। কুসুম রঙের রোদের ঝলকে হাসছে ধরণী। সেই আলোয় চিকচিক করছে কচি পাতারা।

সময় যেতে যেতে সকাল নয়টা। অপ্রকৃতিস্থের মতো শুয়ে থাকা অরুনিকার চোখ ছুটল। ঘুমো ঘুমো আলসে চোখ। সারারাত কান্নার তোড়ে ঘুমাতে পারেনি সে। শেষ রাতে চোখ বুজে আসে। তাই সময়টাও চপল পায়ে এগিয়ে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে আলস্য নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল অরুনিকা। ধড়ফড় করে উঠে বসল সে। ন’টা বেজে গেছে! বুকের কাপড় টেনেটুনে নিজেকে ঠিক করে অরুনিকা। শৈবালকে কোথাও দেখতে পেল না। অধৈর্য পায়ে বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। শৈবাল টেবিলে বসে আছে। তার পিঠ দেখতে পাচ্ছে অরুনিকা।

রুমকি সাবধানে ভাইকে খাবার এনে দিচ্ছে। তার প্লাস্টার খুলে ফেলা হলেও ডাক্তার বলেছে সাবধানে থাকতে। ওই হাতে ভারী কিছু না উঁচু করতে। শৈবালের দুই পাশে রিম, ঝিম। চেয়ারে দুই পা উঠিয়ে টেবিলে একসাথে দুই হাত রেখে তাতে ভর দিয়ে রেখেছে। বুকের ভরও ঢেলে রেখেছে হাতের ওপর। দুই বোনের মুখে পরোটার টুকরো ছিঁড়ে দিচ্ছে শৈবাল। রিম অরুনিকাকে দেখল। আদুরে স্বরে বলল—

“মামা, মামিমা কাঁদছে।”

শৈবাল সেকেণ্ডের জন্য থমকে গেল। পেছন ফিরতেই অরুনিকা দরজার চৌকাঠ থেকে সরে ভেতরে চলে গেল। উলটো হয়ে সেদিকে তাকাল ঝিমও। শৈবাল সামনে ফিরল। রিমকে বলল—

“মামিমা কাঁদছে?”

নরম অভিব্যক্তিতে মাথা ওপর -নিচ করে সম্মতি দিলো রিম। শৈবাল বলল—

“মামিমা’কে বলবে আর কাঁদতে না। মামা মামিমাকে ভালোবাসে। বলবে তো?”

“বলব।

“ওকে। মামা অফিসে যাচ্ছি। আসার সময় আইসক্রিম নিয়ে আসবো।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here