ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত #পর্ব:২৩(দ্বিতীয়াংশ),২৩(শেষাংশ)

0
878

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:২৩(দ্বিতীয়াংশ),২৩(শেষাংশ)
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি
পর্ব:২৩(দ্বিতীয়াংশ)

জানালার গ্রিলে মুখ বাড়িয়ে বসে আছে অরুনিকা। তার দৃষ্টি অত্যন্ত শীতল আর শান্ত। বাইরে ভেজা মাটির ওপর আবর্জনার স্তুপ। বাড়ির পেছন দিক হওয়ায় ততটা পরিষ্কার নয়। চূর্ণবিচূর্ণ করা মোবাইলের অংশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেখানে। সিমসহ মোবাইল ভেঙে তা জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে অরুনিকা। আজকের এই সবকিছুর জন্য তার মোবাইল ফোনই দায়ী।

অরুনিকা বিছানায় এসে বসল। তার হাতে নমিতা বেগমের মোবাইল ফোন। ঝোঁকের বসে নিজের মোবাইল ভেঙে ফেলার পর মা’কে খুব মনে পড়ছে তার। নিজের অশান্ত, অস্থির মনকে শান্ত করার জন্য মৌমিতা বেগমকে ফোন করল সে। মৌমিতা বেগম ফোন রিসিভ করলেন। অরুনিকা চাপা কান্নার স্বরে বলল—

“কেমন আছ আম্মু?”

মৌমিতা বেগম বললেন—

“ভালো। তুই কেমন আছিস?”

“শৈবাল আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না আম্মু। বারবার এড়িয়ে যাচ্ছে আমাকে।”

“তো আমাকে কেন বলছিস?”

মৌমিতা বেগমের কণ্ঠে রাগের ঝড়। অরুনিকা ধ্বসে পড়ে বলল —

“এমন করে বলছ কেন? তোমাকে না বললে কাকে বলব? কে আছে আমার?”

“কেন, তোর ওই শুভাকাঙ্ক্ষী। যে তোকে রোজ ফোন করে ভালো ভালো খবর দেয়, তোকে সাবধান করে, তোর ভালো চায়; তাকে ফোন করে বল।”

অরুনিকা শ্বাস টানতে লাগল। চাপা কষ্টে বুকের ভেতর কেমন অস্থির হয়ে উঠল। চিনচিন করে ব্যাথা করছে।

“তুমি এমন করে কেন বলছ আম্মু। আমি বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস করো, আমার তখন মাথাই কাজ করছিল না।”

“কেন করছিল না? আমি তো তোকে বুদ্ধিমতী ভাবতাম অরুনিকা! আমার বিশ্বাস ছিল, আমার মেয়ে সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে, সঠিক পথ বেছে নিতে পারবে। কিন্তু কী করলি তুই? ভাগ্য ভালো জামাই কিছু করে বসেনি। ছেলেটার মাথাটা আগের চেয়ে ভালো। নাহলে কী করে বসত তুই ভেবেছিস একবার? তোর সব কথা শুনেছি আমরা বসার ঘর থেকে। নিজের স্বামীর ওপর কোনো ভরসা নেই, বিশ্বাস নেই?”

অরুনিকা ঠোঁট কামড়ে ধরল। এতটা জোরে ধরল যে, উষ্ণ লহু তার জিব ছুঁয়ে ফেলল। সে কথা বলল না। মৌমিতা বেগমও আর কোনো কথা বললেন না। তিনি বেশ সময় ধরে নিশ্চুপ রইলেন। এপাশ থেকে যখন অরুনিকার কান্নার স্বর তার কর্ণকুহরে পৌঁছাল, তিনি নিজেকেও ধরে রাখতে পারলেন না। কাঁদতে শুরু করলেন। কিন্তু মেয়েকে জানতে দিলেন না। নিজের মুখে হাত চেপে রাখলেন তিনি। একটাই তো মেয়ে তার! খুব আদরে মানুষ করেছেন। চেয়েছিলেন মেয়েটার সুখ দেখেই বুড়ো-বুড়ি চোখ বুজবেন। কিন্তু তা আর হলো কই? বিয়ের পর থেকে মেয়েটার রঙে ভরা জীবনটা হঠাৎ করেই বিবর্ণ হয়ে গেল। প্রথম সন্তানকে হারিয়ে যেন বাকি প্রাণটুকুও কোথায় মিলিয়ে গেল মেয়েটার। পাথর হয়ে গেল । মৌমিতা বেগম তাই চান, কাঁদুক মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতে বুকের সব কষ্ট ঝরিয়ে ফেলুক। তারপর না হয় আরেকবার বাঁচার চেষ্টা করুক। আরেকবার….।
,
,
,
জানালা দিয়ে উকি দিচ্ছে বিধু। রুমের ভেতর কৃত্রিম বাতির উজ্জ্বল আলো। বিছানায় বসে একটা ফাইলে গভীর মনেযোগে কিছু দেখছে জাফর। দরজায় করাঘাত পড়ল। চকিতে তাকাল জাফর। বিগলিত হাসল শৈবাল। জাফর মোলায়েম হেসে বলল—

“ভেতরে এসো।”

শৈবাল ধীরপায়ে ভেতরে এসে জাফরের সামনের দিকটায় বসল। জাফর মৃদু হেসে বলল—

“কিছু বলবে?”

শৈবাল চোখে হেসে —

“রিম, ঝিম বলল, তোমরা নাকি কাল চলে যাচ্ছ?”

জাফর চমৎকার হেসে বলল—

“আর কত? এক সপ্তাহ তো হতে চলল! রিম, ঝিমের পড়ালেখাও হচ্ছে না। এখানে থাকলে সারাদিন হৈ হুল্লোড়ে ব্যস্ত থাকে। শিমুলটাও বেশিদিন আর থাকবে না। ওকে একটু সময় দিতে হবে তো।”

“ঝামেলায় ফেললাম তোমাকে আমি।”

“ঝামেলা কেন হবে? সব ঠিক করে নাও শৈবাল। যা হয়েছে তা একটা দুর্ঘটনা মাত্র। মেয়েটার দিকটাও একটু ভাবো। আজ কতগুলো দিন হলো! তাকাও একটু ভালোভাবে ওর দিকে। অরুনিকা ভালো নেই শৈবাল।”

শৈবাল বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। হাতের আঙুলের ভাঁজে মাথা রাখল। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলল—

” কোন অন্ধক্ষণে
বিজড়িত তন্দ্রা-জাগরণে
রাত্রি যবে সবে হয় ভোর,
মুখ দেখিলাম তোর।
চক্ষু-পরে চক্ষু রাখি শুধালেম, কোথা সংগোপনে
আছ আত্মবিস্মৃতির কোণে।

—-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর( শেষের কবিতা)

জাফর চমকিত গলায় বলল—

“এসব কেন বলছ?”

“ঘোর কেটে গেছে আমার।”

প্রশস্ত হলো জাফরের চোখজোড়ার পল্লব। শৈবাল তার দিকে ঘাড় কাত করে বলল—-

“তোমরা চাইছিলে না আমি ঠিক হয়ে যাই? নাও অাই এম ফিট। নো চিৎকার -চেঁচামেচি, ভাঙচুর, রাগারাগি। শৈবাল আজ সত্যিই শৈবাল। যার কোনো মূল্য নেই। পানিবিহীন যেমন তার অস্তিত্ব নেই, অরুর কাছেও আমি তেমন এক কাগজে সাইনকৃত কর্তব্য মাত্র। ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের। রাতের আঁধার আর দিনের আলোর মতো সম্পর্ক আমাদের। একজনের উপস্থিতিতে আরেকজন অনুপস্থিত।”

“তুমি একটু বেশিই ভাবছ শৈবাল। আর ঠিক যেভাবে ভাবছ সেটাও সঠিক নয়। অরুনিকা ঝোঁকের বশে করেছে সব। ”

“ওর আমার প্রতি একটুও বিশ্বাস নেই? আমার না হয় মাথা ঠিক নেই। ওর তো আছে। তাহলে? কেন একদিনও আমাকে বলল না এসব? কারণ, ওর বিশ্বাস নেই আমার ওপর।”

জাফর ক্লান্ত শ্বাস ফেলে বলল—

“ব্যাপারটা তা নয়। ও তোমাকে টেনশন দিতে চায়নি। ওর বিষয়ে যেকোনো কিছুতেই তুমি ওভার পজেসিভ হয়ে যাও, অল্পতে প্যানিক হয়ে যাও। তাই ও….।”

“তাই ও আমাকে এত বড়ো একটা অপবাদ দিয়ে ফেলল? একবার ভাবারও প্রয়োজন করল না?”

ধুম করে নিভে গেল জাফর। শৈবাল বলল—

“এর আগেও ওর সিম বদলে দিয়েছিলাম আমি। নিজেকে কন্ট্রোল করছি। নিয়মিত নিজের কাউন্সেলিং করাচ্ছি। ওর তবুও আমার ওপর বিশ্বাস এলো না? আমার ব্যবহারে ওর একবারো মনে হলো না আমাকে ওর এই ব্যাপারে জানানো উচিত? আর কেউ ফোনে ওকে একটা ছবি পাঠিয়ে দিলো আর ও বিশ্বাস করে নিল?
গত এক সপ্তাহ আমি ওই নাম্বার ট্রেস করার চেষ্টা করেছি। কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। যে এই কাজটা করেছে পুরো প্ল্যানিং এর সাথে করেছে। কখনো কোনো নাম্বার বেশি দিন ইউজ করতই না। কোনো ডকুমেন্ট ছাড়াই কেনা সেসব সিম। এখন তো আর অরুকেও ফোন করতে পারবে না। আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করিনি জাফর ভাই। এমন যদি হয়, এসব কিছু অরুর কোনো পরিচিত করেছে। এমনও তো হতে পারে, অরু সত্যিই মুক্তি চায় আমার কাছ থেকে!”

জাফর ভাসা হারিয়ে ফেলল। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সে। শৈবাল ফিক করে হেসে উঠে বসল। হাসতে হাসতে বলল—

“তোমাকে না বলেছি, বাসায় এসে অফিসের কাজ করবে না।”

জাফর ম্লান হেসে বলল—

“স্যারের আদেশ, কালই ফাইল জমা দিতে হবে তাকে।”

শৈবাল মৃদু হাসল। জাফর সন্দিহান চোখে চেয়ে কৌতূহলী গলায় বলল—

“তুমি কী সত্যিই অরুনিকাকে সন্দেহ করো?”

শৈবাল ঝরেঝরে হেসে বলল—

“অনেক খিদে পেয়েছে আমার। চলো, তুমিও খেয়ে নেবে।”

জাফর আপত্তি করে বলল—

“তুমি যাও। আমি কাজটা শেষ করে আসছি।”

“ওকে।”

শৈবাল যখন ডাইনিং টেবিলে এসে বসল তখন রুমকি রান্নাঘরে। আজকাল সে নিজের হাতেই সব করে। মায়ের একটু সাহায্য তার প্রয়োজন হয়। বাকিটা টুম্পার মা করে। অরুনিকার সাথে তার এখন বিস্তর দূরত্ব। অরুনিকা রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেও ভেতরে ঢোকার সাহস পায় না। তাকে উদ্দেশ্যে করে টুম্পার মাকে অশ্রাব্য ভাষায় কিছু বলে ওঠে রুমকি। অরুনিকা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। শ্বশুর-শাশুড়ির কাছেও সে যেন ছোঁয়াছে কিছু। যেন তার ছায়া পড়তেই সব নস্যাৎ হয়ে যাবে। অরুনিকা অবশ্য সবকিছুর বিপরীতে একটা কাজই করে। দৌড়ে নিজের রুমে ডুকে বিছানায় মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। রোজ আশায় থাকে, শৈবাল ফিরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তার অাশায় সবসময় নিরাশার জল ঢেলে খাওয়া শেষ করেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় শৈবাল। পাশে এক জলজ্যান্ত কন্যার অশ্রুকণা তার অভিমানের উত্তাপ কমাতে পারে না।

“আপা, খিদে পেয়েছে আমার।”

“বস ভাই, আমি আসছি।”

রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল রুমকি। রিম, ঝিম তখন ড্রয়িং রুমে খেলছে। অরুনিকা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিজের ঘরের দরজা থেকে। শৈবাল যতক্ষণ খাবে সে ততক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। রুমকি ভাতের বোল এনে টেবিলে রাখল। শৈবাল বলল—

“চলে যাচ্ছ কাল?”

“হ্যাঁ। দেখছিস না, পাজি দুটো সারাক্ষণ খেলাধুলায় ব্যস্ত। কেউ তো নেই যে ধরে বেঁধে ওদের পড়াবে। আর শোন, আমি না থাকলেএ তোকে রোজ ফোন করব। ঠিকমতো খেয়ে নিবি। ঔষধও খেয়ে নিবি। আমি জাফরকে বলে দিয়েছি, তোর যেদিন ডাঃ সাবিনার কাছে এপয়েন্টমেন্ট আছে ও যাবে তোর সাথে। একদিনও মিস দিবি না। যেভাবে বলবে সেভাবে করবি সব।”

শৈবাল আলতো হেসে বলল—

“করব। চিন্তা করো না এত। আর পাগল নই আমি এখন। সবাই তো এটাই চেয়েছিলে। যেন আমি নিজের ভালো বুঝি? বুঝে নিচ্ছি।”

অরুনিকা ভালো করেই জানে কথাগুলো তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে শৈবাল। জাফর বের হলো তার রুম থেকে। অরুনিকাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুমকিকে উদ্দেশ্যে করে বলল—

“রুমকি, এসো তো একটু। আমি একটা কাগজ খুঁজে পাচ্ছি না।”

রুমকি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল—

“তুমি যাও, ওকে খাবার বেড়ে দিয়ে আমি আসছি।”

“আগে এসো। ওকে খাবার অরুনিকা বেড়ে দেবে। তুমি আমাকে কাগজটা দিয়ে যাও। রিম, ঝিম মামার সাথে খেয়ে নাও।”

দুই বোন একসাথে বলে উঠল—

“আচ্ছা আব্বু।”

রুমকি যেতেই আকাশের চাঁদ হাতে পেল অরুনিকা। তার বদ্ধ হৃৎপ্রকোষ্ঠের হিমেল হাওয়া বইতে লাগল। ঝটপট করে টেবিলের কাছে এলো সে। বোলে রাখা ভাতের চামচে হাত দিতেই তার হাত ধরে ফেলল শৈবাল। নিষ্কম্প চোখে চেয়ে অনমনীয় গলায় বলল—

“আমি নিজে নিতে পারব। আল্লাহ্ হাত দিয়েছেন আমায়।”

অরুনিকার হাত থেকে চামচ নিয়ে নিল শৈবাল। অরুনিকা অসহিষ্ণু গলায় বলল—

” এমন করে কথা বলছেন কেন আপনি?”

শৈবাল বোল থেকে প্লেটে ভাত বেড়ে নিতে নিতে বলল—

“কেমন করে কথা বলছি? ”

“আপনি আমার সাথে ঠিক করে কথা বলছেন না।”

“ঠিক করে কীভাবে কথা বলে অরু?”

“যদি এতটাই অসহ্য লাগে আমাকে আপনার, তাহলে বের করে দিন আমাকে এই বাড়ি থেকে।”

“তুমি চলে যেতে পারো। আমি তোমাকে আটকাব না। ভালোবেসে বার বার আমাকেই কেন অপদস্ত হতে হয় অরু?”

“বলেছি তো ভুল করে ফেলেছি। তবুও কেন মানছেন না আপনি? কেন আমার সাথে কথা বলছেন না?”

“কথা তো বলছি। এর বেশি আর সম্ভব নয়।”

শৈবাল রিমের প্লেটে ভাত দেওয়ার জন্য চামচ তুলতে গেলেই ভাতের বোল ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় অরুনিকা। চট করে অরুনিকার দিকে চাইল শৈবাল। জলস্রোতে হুটোপুটি খাওয়া নেত্রযুগলের পানে অনিমেষলোচনে তাকিয়ে রইল শৈবাল। তার হৃদয় পুড়ছে। তবে তা দগ্ধ হলেও ধোঁয়া হয় না। শুধু ঝাপসা হয় চোখের কোটর।

” এই দহন দিনের শেষ, ওই কাদম্বিনীর রেশ
জলে ভেজা পদ্মআঁখি আমায় করেছে নিঃশেষ।”

ঝনঝন আওয়াজে কেঁপে উঠল রিম, ঝিম। ছুটে এলো ঘরের ভেতরে থাকা মানুষগুলো। অরুনিকার দেহ কাঁপছে। যেন অশরীরী ভর করেছে তার ওপর। রুমকি ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল—-

“কীরে? এসব হলো কী করে?”

ঝিম জড়ানো সুরে বলল—

“মা….।”

“আমি ফেলেছি। ”

কঠোর কণ্ঠে বলল শৈবাল। সকলের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি অরুনিকার দিকে। অরুনিকার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। শৈবালের এহেন নির্লিপ্ততা তার সহ্য হচ্ছে না। সে ছুটে গেল রুমের দিকে। শৈবাল নম্র গলায় বলল—

“তুমি রান্না বসাও আবার। আমি রিম, ঝিমকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি। ওদের আইসক্রিম নাকি শেষ হয়ে গেছে।”

চলবে,,,

#ভালোবাসার_লাল_বৃত্ত
#পর্ব:২৩(শেষাংশ)
লেখনীতে:তাজরিয়ান খান তানভি

ঝিলের টলমলে পানির দিকে উদাসচিত্তে তাকিয়ে আছে শৈবাল। ওপারের উঁচু উঁচু দালানগুলো থেকে ঠিকরে আসা আলো পড়ছে ঝিলের পানিতে। মিহি, বাধহীন বাতাস বইছে। শৈবাল যে বেঞ্চিতে বসেছে তার সামনেই ঝিলের পাড় ঘেঁষে ছোটো ছোটো গাছের সারি। হাওয়াতে দোল খেলছে তারা। অল্পস্বল্প মানুষের চলাচল। সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সোডিয়াম বাতি আলো ছড়াচ্ছে। বেশ সময় পরপর জোরালো আওয়াজে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। রিম, ঝিম চকিতে সেই আওয়াজে পেছন ফিরে। চকচক করে ওঠে তাদের চোখ। তারা আনন্দ পায়। ঘন আঁধার অনেকটাই হালকা এখানে।

শৈবালের পাশেই বসে আছে রিম, ঝিম। কাপ আইসক্রিম খাচ্ছে দুই বোন। রিম প্রশ্ন করল–

“মামা, তুমি কী মামিমা’কে বকেছ?

বেঞ্চিতে হেলান দেওয়া গ্রীবাদেশ দৃঢ় করল শৈবাল। চোখে হেসে বলল—

“হ্যাঁ।”

ঝিম মুখের ভেতর পাতলা চামচটা রেখে বলল—

“কেন বকেছ?”

“তোমাদের আম্মু কেন বকে তোমাদের?”

রিম বলল—

“আমরা যে দুষ্টমি করি, গাড়ি ভেঙে ফেলি, পুতুল ভেঙে ফেলি। তাই আম্মু বকা দেয়।”

শৈবাল ফ্যাকাশে গলায় বলল—

“তোমার মামিমাও আমার সব ভেঙে ফেলেছে। আমার স্বপ্ন, আমার বিশ্বাস, আমার মন।”

“মন কী মামা?”

রিমের গলায় উৎসুকতা। শৈবাল ম্লান হেসে বলল—

“আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস।”

“ও তোমার পুতুল! তোমারও পুতুল আছে মামা?”

শৈবাল মায়াময় হাসল। বলল—

“হ্যাঁ, আমার মনপুতুল। যা তোমাদের মামিমা ভেঙে ফেলেছে।”

শৈবালের নয়নযুগল পানিতে টলটল করছে। রিমের ঠোঁটের কোণে আইসক্রিম লেগে আছে। সে মামার দিকে আস্ত নজর রেখে বলল—

“তুমি কী কাঁদছ মামা? মামিমা তোমার মনপুতুল ভেঙে ফেলেছে বলে?”

“না তো মা। কাঁদছি না মামা।”

শৈবাল দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। ঝিম চট করে প্রশ্ন করল—

“মনপুতুল কোথায় পাওয়া যায় মামা? আমরা তোমাকে আরেকটা মনপুতুল কিনে দেবো। তুমি মন খারাপ করো না। আমাদের পুতুল ভেঙে গেলে আব্বু আবার কিনে দেয়। তোমাকেও কিনে দিতে বলব।”

চোখের স্রোত আটকে নিল শৈবাল। বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে কপট হেসে বলল—

“মনপুতুল তো কিনতে পাওয়া যায় না মা। এটা সবার মনে একটা করেই থাকে। এই যে এখানে।”

শৈবাল তার হৃৎপিণ্ডের ওপর হাত রেখে বলে। রিম, ঝিম আকাশসম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না, মানুষের বুকের ভেতর কী করে পুতুল থাকে!
রিম অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে বলল—

“আমাদেরও আছে মামা? এখানে, এখানে আমাদেরও মন পুতুল আছে?”

“আছে, সবার আছে।”

বেঞ্চি থেকে নামল রিম। শৈবালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রিমের দেখাদেখি ঝিমও বেঞ্চি থেকে নেমে শৈবালের সামনে দাঁড়াল। শেষ হওয়া আইসক্রিমের বাটি ছুড়ে ফেলে রিম বলল—

“তুমি মন খারাপ করো না মামা। আমরা আমাদের মনপুতুল তোমাকে দিয়ে দেবো। তখন তোমার দুটো মনপুতুল হবে। আমাদের তো বারবি ডল আছে, কারও আছে। বিগ, বিগ। আব্বুকে বলব আমাদের আরেকটা টেডিবিয়ার কিনে দিতে।”

ঝিমও বোনের সাথে তাল মিলিয়ে বলল—

“হ্যাঁ, মামা। আমরা তোমাকে মনপুতুল দিয়ে দেবো। আর মামিমা’কেও বকে দেবো। তাহলে মামিমা আর কখনো তোমার মনপুতুল ভাঙবে না।”

শৈবাল ক্রন্দনরত হাসে। তার খুশি যেন কান্না ফুড়ে বেরিয়ে আসছে। তার চোখে-মুখের হাস্যোজ্জ্বলতায় আনন্দিত হলো রিম, ঝিম। শৈবাল তাদের দুজনকে তার দুই উরুর ওপর বসিয়ে দুই হাতে আঁকড়ে রাখল। দুই বোনের কপালে চুমু বসিয়ে বলল—

“না মা। মামিমা’কে বকবে না। তোমরা তো মামিমা’কে ভালোবাসো। কাউকে ভালোবাসলে তাকে বকতে নেই।”

ঝিম আদুরে গলায় বলল—

“তাহলে তুমি কেন মামিমা’কে বকেছ? মামিমা রোজ কাঁদে। আমাদের সাথে খেলেও না। হাসেও না।”

ঝিমের কথা টেনে নিল রিম।

“হা, মামিমা খেলে না আমাদের সাথে। শুধু জানালার পাশে বসে কাঁদে। কেউ কথা বলে না মামিমার সাথে। আম্মুও বকে।”

শৈবালের গলা বুজে আসে। সে নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। রিম টগবগে গলায় বলে উঠল—

“তুমি মামিমা’কে ভালোবাস না? তাহলে বকো কেন?”

“বাসি তো। ভালোবাসি বলেই তো কষ্ট হয়। তোমাদের বকার পর আম্মু আবার কাঁদে তাই না?”

রিম, ঝিম একসাথে বলে উঠল—

“হ্যাঁ।”

রিম টুকটুক করে বলল—

“ওইদিন আম্মু ঝিমকে লাঠি দিয়ে মেরেছিল। তারপর নিজেও কেঁদেছে। আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। আর বলেছে, আম্মুর কষ্ট হয় আমাদের মা*রলে। তোমারও তেমন কষ্ট হয় মামা?”

শৈবাল নির্বিকার গলায় বলল—

“হয় তো। খুব কষ্ট হয়।”

রিম শৈবালের বুকের সাথে হাত লাগিয়ে ঝরা গলায় বলল—

“তোমার কী এখনো কষ্ট হচ্ছে মামা?”

“হচ্ছে।”

“তাহলে তোমাকে চুমু দিয়ে দিই? তোমার সব কষ্ট চলে যাবে। মামিমা’কে বলে দেবো, যেন সে তোমার মনপুতুল আর না ভাঙে। ঠিক আছে মামা?”

শৈবাল কথা বলল না। মাথা নাড়িয়ে দুটো তুলোর বস্তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। দূর আকাশের ভরাট চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়াল—

” তুমি মুক্তি চেয়েছিলে না অরু? তোমাকে আমি আমার এই ভালোবাসার দুর্ভেদ্য পরিধি থেকে মুক্তি দিয়ে দিলাম। এখন থেকে তুমি ওই আকাশের চাঁদ হয়ে থাকবে। স্বচ্ছ, শুভ্র চাঁদ। আমার এই রক্তক্ষরণ ভালোবাসার বৃত্ত থেকে তুমি মুক্ত। আমি তোমাকে দূর থেকেই দেখব। ছোঁব না কখনো। আমার ছোঁয়ায় কখনো তোমার আর কষ্ট হবে না।
একটু একটু করে ভালো বাসতে বাসতে কখন যে পুরো তুমিটাকে ভালোবেসে ফেললাম, নিজেই বুঝতে পারিনি। এক বিধ্বংসী ঝড় থেকে বাঁচতে তোমায় আঁকড়ে ধরেছিলাম। সেই তুমিই মহাপ্রলয় হয়ে আমাকে ধ্বং*সস্তুপ বানিয়েদিলে। তুমি সুখে থাকো অরু। সুখে থাকো। আমি দূর থেকে তোমায় ভালোবাসব, এই হৃদয়ে রাখব। আমার খরা হৃদয়ে আর কখনো কেউ প্রেমের বর্ষণ করতে পারবে না। কেউ না।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here