#ক্যানভাস_পর্ব : (৬)
লেখনীতে : তামান্না রাহাত তানু
হাতের ব্যাগটা রেখে আবারও শ্রাবণের পাশে আসে। মেঘের মা শ্রাবণের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। শ্রাবণকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। মেঘের মা শ্রাবণকে বললেন,
_বাবা তোমার কি আনইজি লাগছে?
_না আন্টি তেমন কিছু না, তবে একটু আনইজি লাগছেই। প্রথমবার অপরিচিত কারো বাসায় আসা।
_প্রথম এমন লাগবেই। এরপর থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মেয়েটা কিন্তু খুব জেদি ওকে সামলাতে পারবে তো বাবা?
_জেদি কোনো ব্যাপার না। রাগ না হলেই ভালো। আমার আবার রাগী মানুষে এলার্জি আছে।
_তাহলে তো তোমার খুব বিপদ সামনে।
_কেন?
_সেটা তুমি নিজেই বুঝবে কিছুদিন পর। এই মেয়ে তোমাকে যদি দিনে দিনে বিরক্ত না করে তাহলে দেখ।
_কেউ বিরক্ত করলে সেটা আমি খুশি মনে গ্রহণ করবো। আর সেটা যদি আপনার এই মেয়ের থেকে হয় তাহকে কোনো ব্যাপার না।
_তাই নাকি তাহলে তো ভালো। তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?
_জ্বী আন্টি ওনারা ভালো।
_রাত্রি তুই ওর পাশে থাক আমি ওইদিকটা সামলে আসি।
মেঘের মা শ্রাবণের সামনে মেঘকে রাত্রি বলে ডাকলেন যেন শ্রাবণ সন্দেহ করতে না পারে। মেঘকে শ্রাবণের পাশে বসিয়ে রেখে মেঘের মা চলে যান। শ্রাবণ আর মেঘ বসে বসে গল্প করছে। মেঘ আমতা আমতা করছে শ্রাবণকে কিছু বলার জন্য। কেমন যেন একটা অঅন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে মেঘের মনে। আবার ভয়ও হচ্ছে। মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে শ্রাবণের জীবনে প্রবেশ করতে চাইছে, এই মিথ্যেটা কতদিন স্থায়ী হবে তা মেঘের জানা নেই। শুধু মেঘ এইটুকু জানে, এই মিথ্যে দিয়ে হলেও শ্রাবণের মনে জায়গা করে নিতে হবে। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে মেঘ একসময় শ্রাবণকে জিজ্ঞেস করল,
_আপনি তো সেদিন মেঘের ফেইসবুক একাউন্ট নিয়েছিলেন, কথা হয়েছে মেঘের সাথে?
_হ্যাঁ, অল্প কিছু কথা হয়েছে, তবে এতো বেশি নক দেই না।
_কেন?
_আসলে আমার ওনার ব্যাপার একটা খটকা লাগছে।
_কেমন সেটা?
_ওনি আমাকে না দেখে কীভাবে আমার স্কেচ আঁকলেন?
_ছাড়ুন না এটা, সবার প্রতিভা আলাদা থাকে হয়তো মেঘের ক্ষেত্রেও তাই।
_হুম সেটা ঠিক।
মেঘ কথা ঘুরিয়ে আবারও আড্ডা দিতে মন দেয়।সামান্য চা-নাশতা খেয়ে শ্রাবণ মেঘদের বাসা থেকে বিদায় নেয়।
শ্রাবণ চলে যাওয়ার পর মেঘ আর মেঘের মা বসে বসে গল্প করছেন। মেঘের দুষ্টামি দেখে ওনি মেঘকে বললেন,
_তুই রাত্রি না সাজলেও পারতি।
_আমি কি জানতাম নাকি বেচারা আনিকার শোকে দেবদাস হবে?
_সবই আদনানের হেল্পে হলো।
_ভুলেও এই কথা যেন শ্রাবণ না জানে। জানলে আদনানকে নিয়ে ভুল ভাববে।
_না রে, এতে ভুল ভাবার কিছু নেই। ছেলেটা তোর জন্য শ্রাবণের বাবা-মায়ের কাছে শ্রাবণের চোখের আড়ালে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এমনকি তুই যে শ্রাবণকে পছন্দ করিস সেটাও ওর পরিবারকে জানিয়েছে। আমার মনে হয়না এই সত্যি শ্রাবণ জানলে শ্রাবণ আদনানকে ভুল বুঝবে? এতে দুজনের বন্ধুত্বটা আরো মজবুত হবে। একদিকে শ্রাবণ আনিকাকে ভুলে তোকে নিয়ে বাঁচতে পারবে। অন্যদিকে তুই তোর পছন্দের ছেলেটাকে কাছে পাবি। কিন্তু তুই কতদিন এই মিথ্যে অভিনয় করবি?
_যতদিন না আনিকাকে ওর মন থেকে মুছে সেখানে আমার জন্য ভালোবাসার জন্ম দিতে পারি ততদিন।
_সত্যিটা জানলে ও যদি তোকে ভুল বুঝে?
_সেটা এখনও ফিউচার মা। আমি বর্তমান ছাড়া ফিউচারকে নিয়ে এখন ভাবতে চাই না। যা হবে পরে দেখা যাবে।
_তোদের মাঝে তো দূরত্ব থেকে যাবে।
_আমি সেই দূরত্ব সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করব।
মা মেয়েতে মিলে অনেক আলোচনা করলেন। মেঘ খুব চিন্তায় আছে নিজের আসল পরিচয় শ্রাবণের থেকে আলাদা করার জন্য। ভাবছে এর জন্য ভবিষ্যতে বড় কোনো ঝামেলায় না ঝড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কি বা করার ছিলো মেঘের? শ্রাবণের থেকে মেঘকে আলাদা করতে গিয়ে মেঘ আজ নিজেকেই হারিয়ে যেতে বসেছে। রাত্রি নামের আড়ালে হারিয়ে গেছে মেঘ নামের হাস্যজ্বল মেয়েটি। নিজের রাগটাকে প্রকাশ না করার সেদিন এই একটাই উপায় ছিলো। নয়তো সেদিন শ্রাবণকে যা নয় তা বলে অপমান করতেও দুবার ভাবতোনা মেঘ।
১১!!
রাতে দুই পরিবারের সবাই মিলে ফোনে ওদের এনগেজমেন্টের দিন তারিখ ঠিক করে নেয়। আগামী এক সপ্তাহ পর এনগেজমেন্ট এরপর যেকোনো মাসের ভালো একটা দিন দেখে ওদের বিয়ের তারিখ ফেলা হবে। আপাতত ওদেরকে একটা সম্পর্কে আবদ্ধ করার জন্য এনগেজমেন্ট এর আয়োজন করা। ওদের ইচ্ছামতো একে অপরকে বুঝে নিলে তারপরে বিয়ের আয়োজন হবে।
রাতে মেঘ শুয়ে শুয়ে ভাবছে ওর স্বপ্নের রাজকুমার তাঁর জীবনে বাস্তবে আসতে চলেছে, কিন্তু কতদিন লাগবে মেঘকে সম্পূর্ণরূপে ভালোবাসা পেতে? মেঘ জানে শ্রাবণ এতো সহজে রাত্রিকে ভালোবাসবে না। সবার চাপে পড়ে বিয়েতে মত দিয়েছে ঠিকই কিন্তু মেঘের থেকে কেমন যেন দূরত্ব থাকার একটা ভাব থাকে শ্রাবণের মাঝে। হয়তো এতো তাড়াতাড়ি মেঘকে আপন করা সম্ভব নয় তবে মেঘও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। মেঘ এর শেষ দিক টানবেই টানবে। মেঘের মনে জেদ চেপে বসেছে আর মেঘ জানে সে এই জেদে সফল হবেই। তারপরেও শ্রাবণকে নিয়ে একটা টেনশন থেকেই যায় মেঘের মনের ভেতর। কারণ শ্রাবণ জানে শ্রাবণ রাত্রিকে বিয়ে করছে মেঘকে নয়। ফোনের টিউনে মেঘ ভাবনা থামায়। সামির নাম্বার দেখে ফোন তুলে মেঘ। ওপাশ থেকে সামি বলল,
_কী অবস্থা ম্যাডাম? আমাকে তো ভুলেই গেছো?
_কেন তোমাকে ভুলব কেন? আজ আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম।
_কিসের এতো ব্যস্ততা তোমার?
_জীবনের সবচাইতে ইম্পর্ট্যান্ট মানুষটাকে সঙ্গ দিতে গিয়েছিলাম। একটা গুড নিউজ শুনবা?
_আমি নিজেই তোমাকে একটা কথা বলব বলে ফোন দিলাম।
_ওহ তাই নাকি, আচ্ছা তাহলে তুমি বপো।
_না ম্যাডাম। আগে আমার নিউজ ইম্পর্ট্যান্ট হলে বলতাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমার কথাটা আগে শুনতে হবে নয়তো মনে তেজ আসবে না। যেহেতু তোমার কথাটা গুড নিউজ তাই।
_আগামী সপ্তাহে আমাদের বাসায় তোমার দাওয়াত রইলো।
_ওয়াও! সো সুইট! বাট কীসের দাওয়াত? মানে হুট করে কেন?
_আগামী সপ্তাহে আমার এনগেজমেন্ট।
_ক ক কার সাথে?
_আমার স্কেচে আঁকা মানুষটার সাথে।
_ম মানে!
_মানে শ্রাবণ মাহমুদের সাথে। যে আমার স্বপ্নে এসে বিরক্ত করে সে এবার সত্যি সত্যি আমার জীবনে আসতে চলেছে।
_ওহ, কনগ্রেচুলেশন!
_থেংক ইউ, আসবে তো।
_হুম, তোমার এনগেজমেন্ট আর আমি আসবো না সেটা হয় নাকি।
_আমার নিউজ তো বললাম এবার তোমার নিউজ বলো।
_কী বলবো বলো তো, তোমার কথা শুনে আমি এতোটাই খুশি হয়েছে যে আমার নিউজটার কথা ভুলেই গেছি।
_ইয়ার্কি মারছো।
_সিরিয়াসলি! আচ্ছা আজ রাখছি। তোমার এনগেজমেন্টের দিন দেখা হবে। বাই, টেইক কেয়ার।
সামি তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিল। আর একটু হলেই সামির ফুঁপানির আওয়াজ মেঘের কানে পৌঁছে যেত। সামি ফোনটা বুকে চেপে ধরে নিরব কান্না কেঁদে যাচ্ছে। এ কান্না দেখার ক্ষমতা কারো নেই, শুধু ওই উপরওয়ালা ছাড়া। তিনি একমাত্র সর্বশ্রোতা যাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হয় না তার আগেই তিনি সবটা বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবটাই তাঁর হাতে। আমরা চাইলেই তা বদলাতে পারব না। ভাগ্য আমাদের হাতে নেই ঠিকই কিন্তু আমাদের কর্মে ভাগ্য নিয়োজিত। যা ওই সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির আগেই প্রস্তুত করে রেখেছেন। সামি, মেঘ আর শ্রাবণের ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। কার ভালোবাসা কখন কোন দিকে মোড় নেয় সেটা এরা কেউ-ই জানে না।
১২!!
এক সপ্তাহ পর…
আজ মেঘ আর শ্রাবণের এনগেজমেন্ট। মেঘ যতটা খুশি শ্রাবণ ঠিক ততটাই আপসেট। সারাবাড়িতে মেহমানদের অনেক আনাগোনা। চারিদিকে সিম্পল আলোকসজ্জা। যদিও শুধু এনগেজমেন্ট তবুও কাছের আত্মীয়স্বজন কয়েকজনকে ইনভাইট করা হয়েছে। আজ মেঘ খুব সুন্দর করে সেজেছে। মেঘ যাদের ইনভাইট করেছে তাঁদের মধ্যে সামিও আছে। সামি জানতোই না মেঘ শ্রাবণকে ভালোবেসে ফেলেছে। অথচ সামি এতদিন মেঘকে নিয়ে নিজের ভাবনা গুলো সাজিয়ে গেছে।
নওরিন মেঘকে অনেক সুন্দর সাজিয়ে করে দিল। গলায় নেকলেস, হাতে চুড়ি, কানে দুল, কপালে টিকলি, চোখ ভর্তি কাজল দেখতে একদম রাজকন্যার মতো লাগছে।
শ্রাবণের পরিবারের সবাই এসে উপস্থিত। সামি, শ্রাবণ, সাকিব, আদনানসহ শ্রাবণের আরো অনেক ফ্রেন্ড এসেছে ওদের এনগেজমেন্টে। শ্রাবণ ব্ল্যাক কোর্ট প্যান্ট, ব্ল্যাক স্যু, আর ভেতরে ব্ল্যাক শার্ট আর সাথে ব্ল্যাক টাই, হাতে ব্ল্যাক ঘড়ি, একেবারে কালোর মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে। যদিও শ্রাবণ মনেমনে বিয়েতে আপত্তি, তারপরেও আনিকার কথা ভেবে একরকম জোর করে আদনান আর সাকিব শ্রাবণকে এই বিয়েতে রাজী করায়। শ্রাবণের বন্ধুরা চায় শ্রাবণ সুখী হোক আনিকাকে ছাড়া। শ্রাবণ কেমন যেন মনমরা হয়ে বসে আছে সোফায় এক কোণে। শ্রাবণের বাবা-মা অলরেডি মেঘের বাবা-মায়ের সাথে আড্ডা জমিয়ে ফেলেছেন। শ্রাবণের সব বন্ধুরা মিউজিকের সাথে ডান্স করতে রেডি। মেঘকে নিচে নিয়ে আসলে পর এনগেজমেন্ট আগে হবে তারপর ছেলেমেয়ে জুটি হয়ে ডান্স করবে এরকমই প্লেন সবার। শ্রাবণের মুড অফ দেখে শ্রাবণের বন্ধু সাকিব শ্রাবণকে বলল,
_শ্রাবণ আজকের দিনে এটলিস্ট আনিকার জন্য মন খারাপ করিস না।
_আমি মোটেও মন খারাপ করছি না সাকিব।
_তাহলে এইভাবে বসে আছিস কেন? যে মানুষটা তোকে ছেড়ে অন্যকারো হাত ধরে তোর এতদিনের ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে দিল, তারজন্য তুই শুধু শুধু মন খারাপ করছিস।
_সে কোনোদিন আমার ছিল না। যদি আমার থাকতো এইভাবে ছেড়ে যেত না। আর আজ আমার জীবনেও অন্যকাউকে আসতে হতো না।
_বাদ দে এসব। পুরোনো কথা ভুলে নতুন ভাবে বাঁচতে শুরু কর।
_আমি আনিকার সব স্মৃতি মুছবো কীভাবে?
_পারতে হবে তোকে। একবার তোর হবু বউটাকে দেখ। কী মিষ্টি মেয়ে! এই মেয়ে তোকে সুখ এনে দিবে শ্রাবণ যা আনিকা পারেনি। এই নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকালে তুই আনিকাকে ভুলতে পারবি।
শ্রাবণ সাকিবের কথায় মাথা তুলে সিঁড়ির দিকে তাকায়। নওরিন তখন মেঘকে হাত ধরিয়ে ধরিয়ে নিচে নামছিল। শ্রাবণ মেঘের দিকে অপলক ভাবে তাকাচ্ছে। আজ মেঘের পরনেও কালো লেহেঙ্গা। সম্পূর্ণ কালোর সাজ মনে হয় সবাই প্ল্যান করে ওদের এই সাজ দিয়েছে যাতে দুটো মানুষকে পারফেক্ট দেখতে লাগে। মেঘের দিক থেকে চোখ ফেরাচ্ছে না দেখে সাকিব শ্রাবণকে আলতো করে বাহুকে ধাক্কা মারে। শ্রাবণ একটু ঘাবড়ে উঠে। সাকিব তখন শ্রাবণকে বলল,
_বিয়ের বাকি এখনও অনেক দিন। আজকে মাত্র তারিখ ফিক্সড হবে। যা দেখার বিয়ের পর দেখিস আজ আর না ওকে।
_তোর কি মনে হচ্ছে আমি রাত্রিকে দেখছি?
_তা নয়তো কি?
_একদমই না, আমি তো একটা কালো বিড়ালকে দেখছিলাম।
_হা হা হা। তাহলে তুইও সেই কালো বিড়ালের কালো জামাই।
সাকিবের কথা শুনে শ্রাবণের সব বন্ধু হেসে উঠে। মেঘকে সবার সামনে আনার পর শ্রাবণকে শ্রাবণের বন্ধুরা সোফা থেকে উঠিয়ে মেঘের পাশে নিয়ে দাঁড় করায়। শ্রাবণ মেঘের পাশে দাঁড়াতে একটু অস্বস্তি বোধ করছে দেখে মেঘ নিজে থেকে শ্রাবণের থেকে চার আঙুল পরিমাণ দূরে সরে যায়। শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে চোখের পাতা উপর থেকে নিচে ফেলে বুঝায় “সমস্যা নেই, এই দূরত্ব বেশি দূরত্ব না, এটা তোমার আনইজি ভাবটা কাটাবে।” শ্রাবণ মেঘের ইশারা বুঝে মুচকি হেসে সবার কথা শোনার জন্য মনোযোগ দিল।
এনাউন্সমেন্ট শুরু হয় ওদের দু’জনকে কেন্দ্র করে। শ্রাবণের বাবা-মা, মেঘের বাবা-মা মিলে দু’জনের হাতে দুটো আংটি তুলে দেন। প্রথমে শ্রাবণকে বলা হয় মেঘের হাতে আংটি পরিয়ে দেওয়ার জন্য৷ তারপর মেঘ পরাবে। শ্রাবণ আংটিটা হাতে নিতেই ফিরে যায় অতীতে…
মাত্র কয়েকমাস আগেই আনিকাকে নিয়ে একটা শপিংমলে আনিকার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিল দুজনে। আনিকা একটা ডায়মন্ডের ফিঙ্গার রিং পছন্দ করেছিল। শ্রাবণ অনেক দাম দিয়ে সেটা আনিকার জন্য কিনে আনিকার বার্থডেতে গিফট করে। নিজেই আনিকার হাতে আংটিটা পরিয়ে দেয় শ্রাবণ। শ্রাবণের দেওয়া গিফটটা এখনও আছে কি না সেটা শ্রাবণ জানেনা? চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে রোজ রোজ আনিকার বায়না পূরণ করতে শ্রাবণের একাউন্টের অনেক টাকা তুলতে হতো। আজ রিং, কাল দুল, পরশু শাড়ি, দামী গয়নাগাটি আরো নানারকম জুয়েলারি।
আনিকার এতো এতো বায়না পূরণ করা ছিল শ্রাবণের নিত্যদিনের রুটিন। আনিকা যাওয়ার পর থেকে শ্রাবণ এই রুটিনটা বড্ড মিস করে। আনিকার বায়না পূরণ করতে শ্রাবণের খুব ভালো লাগতো। তাই আনিকার ইচ্ছের মূল্য দিতে শ্রাবণ অনেক কিছু করত। অথচ আনিকা সব ভুলে আজ দূরে সরে গেল। ভাবতে ভাবতে শ্রাবণ কখন যে মেঘের আঙুলে আংটি পরিয়ে দিল নিজেই খেয়াল করল না। হাততালির আওয়াজে শ্রাবণের ঘোর কাটে। মেঘের দিকে তাকাতেই শ্রাবণ কেমন অদ্ভুত একটা চাহনি দেখতে পেল। যে চোখের চাহনি শ্রাবণের চোখের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম। শ্রাবণ তাড়াতাড়ি মেঘের থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। মেঘ শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বলল,
_একদিন এই দু’টো চোখে তুমি নিজেই চোখ রাখবে। আর বুঝতে পারবে এই দু’চোখের মায়া তুমি কোনোদিনও কাটাতে পারবে না। ততদিনে আমি তোমার মনের ঠিক সেইখানে প্রবেশ করব যেখানে আজ শুধু আনিকার অস্তিত্ব। তুমি বুঝতে পারবে না তুমি আনিকার জায়গায় আমাকে রাখতে শুরু হবে। আর ঠিক সেইদিনই তুমি জানতে পারবে তোমার ওই মায়াজড়ানো দু’টো চোখ আর্টের চিত্রশিল্পী কাশফিয়া হাসান মেঘ, যে আজ রাত্রি নামে পরিচিত।
মেঘের মা মেঘকে ডাকতেই ভাবনা থামিয়ে মেঘ মায়ের দিকে তাকায়। মেঘকে আংটি পরিয়ে দিতে বলেন শ্রাবণের হাতে। মেঘ মাথা নাড়িয়ে হাতের আংটিটা নিয়ে শ্রাবণের মুখোমুখি দাঁড়ায়। শ্রাবণ মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ শ্রাবণের কানের কাছে মুখ নিয়ে শ্রাবণকে ফিসফিসিয়ে বলল,
_একবার এনগেজড্ হয়ে যাও তারপর দেখব কতটা দূরে থাকতে পারো?
মেঘের কথা শুনে শ্রাবণ মুখে হাত দিয়ে কাশি দিয়ে উঠে। মেঘ আদনানের দিকে তাকাতেই আদনান মুচকি হাসে। আদনান মেঘকে ইশারায় হাত উঠিয়ে ‘বেষ্ট অফ লাক’ জানায়। মেঘ চোখ নেড়ে সম্মতি দিয়ে শ্রাবণের হাত ধরে রিং ফিংগার আঙুলটা বের করে ধীরেধীরে আংটিটা পরিয়ে দেয় শ্রাবণের হাতে। আংটি পড়ে মেঘ আস্তে করে একটা চুমু খায় শ্রাবণের আঙুলে। শ্রাবণ সাথে সাথে চোখ দু’টো বন্ধ করে নেয়। সবাই করতালি দিচ্ছে একসাথে। আংটি বদল শেষ হলে আদনান আর সামি মিলে এনাউন্সমেন্ট শুরু করে। সামি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল,
_আজ দুজন কাপলদের একসাথে হওয়ার আনন্দে আমরা সব বন্ধুরা মিলে একটা নৃত্যের আয়োজন করেছি। যেখানে নৃত্যের সাথে তাল মিলাবে প্রিয় জুটি। প্রথমেই আমাদের সবার মাঝে জুটি হিসেবে ডান্স করবে আমাদের এই অনুষ্ঠানে আসা সকলের মধ্যে যেকোনো দু’জন। আর সেই দু’জন হলো।
সামি একটু থামে। আদনান মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল,
_সামি আর ইরা।
_ওহ নো, আদনান ইট’স নট পসিবল।
_ইয়েস ব্রো! ইট’স পসিবল। তাড়াতাড়ি পার্টনার আনো।
_দূর আমি এই ইরাকে চিনি না৷ কি ডান্স করব তাঁর সাথে?
_চিনো না তাতে কী? ডান্সে তো সমস্যা নেই। ইরা তো আর রিয়েল লাইফে তোমার পার্টনার না।
_এইভাবে ঝামেলায় না ফেললেও পারতে।
_তোমার প্রবলেম হলে বাদ দিয়ে দেই।
_না থাক আমি ডান্স করব। ইরাকে ডাকো।
_শিওর!
_ইয়াহ! আমি প্রেস্টিজ লস করতে চাই না।
আদনান ইরাকে ডাক দেয়। ইরা সবার মাঝখানে ছিল। ইরা হচ্ছে মেঘের কাজিন। ইরা মা-বাবার সাথে গ্রামে থাকে। মেঘের এনগেজমেন্ট থেকে শুরু করে বিয়ের দিন পর্যন্ত ইরা এখানেই থাকবে। এটা মেঘের হুকুম। আর ইরা কখনও মেঘের কথা ফেলে না। ইরা মেঘের দু’বছরের ছোট হলেও দেখতে ওরা একই বয়সী। দু’জনের হাইট সেইম তাই দেখলেই বুঝা যায় এরা সমবয়সী। ইরা সবার ভেতরে থেকে বেরিয়ে এসে সামির পাশে দাঁড়ায়। মেঘ ইরাকে ‘অল দ্যা বেষ্ট’ বলে।
আদনান স্টেজে ওদের দুজনকে রেখে নওরিনের পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর মিউজিক অন করা হয়। মিউজিক বাজার সাথে সাথে সামি নিজের বা’হাতটা বাড়িয়ে দেয়। যদিও সামির একটু নার্ভাস লাগছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। সবার সামনে এটলিস্ট নিজেকে হাসির পাত্র বানাতে পারবে না। তাই ইরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ইরা কাঁপা কাঁপা হাতে সামির বা’হাতের তালুতে নিজের ডানহাতটা রাখল। বাজলো মিউজিক তার সাথে শুরু হলো ডান্স।
“এই মন পড়েছে আমার বড় দু’টানায়।
প্রেম বয়ে আনলো হঠাৎ ধমকা হাওয়ায়।।
এই আশিকী, আশিকী, করলো কী জাদু হায়!”
ইরা নিজের পিট ঠেকিয়ে দেয় সামির বুকে। সামির আনইজি ভাব আরো বেড়ে বুকের ভেতরের ধুকপুকানির আওয়াজটা বাড়তেই থাকে। ইরা যত নিজের অনিচ্ছাতে সামির শরীরের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে সামি ততই নিজেকে অশান্তির মাঝে অনুভব করছে। সামি ইরাকে বুক থেকে সরিয়ে হাত দিয়ে চারিদিকে ঘুরাতে থাকে। মিউজিকের সাথে সুর মিলায় সামি।
“পুড়তে বসেছি, প্রেমে পুড়তে বসেছি,
কখনও আগে হয়নি এমন আমার সাথে?
খুঁজতে চেয়েছি, তোকে খুঁজতে চেয়েছি,
লেখা আছে সে সবই কারণ আমার হাতে।।
এই আশিকী, আশিকী, করলো কী জাদু হায়!”
সামি ইরার দুহাত নিজের দুহাতে ধরে ইরাকে কাছে টানে। এই মুহূর্তে সামি ঠিক নিজেও জানেনা এটা কি করল? ইরা টাল সামলাতে না পেরে সোজা সামির বুকের সাথে ধাক্কা খায়। পিট খামছে জড়িয়ে ধরে সামিকে। ইরা সামির বুকে মাথা রাখতেই সামি নিজের অজান্তেই সুখের দেশে পাড়ি দিতে থাকে৷ সামি ভুলে যাচ্ছিল ওরা ডান্স করছে। সামি আবারও ইরার থেকে দূরে যায়। সামি হাঁটু গেড়ে বসলে ইরা সামির এক পায়ের হাঁটুতে বসে। সামির কপালের সাথে কপাল ঠেকায় ইরা। গালে হাত রাখে সামির। ইরার হাতের প্রত্যেকটা স্পর্শে সামি নিজেকে হারিয়ে নিয়ে যেতে থাকে অজানাতে। ইরা গলা ছেড়ে মিউজিকের তালে তালে ঠোঁট মিলায়…
“আজকে দুজনে, চল বলতে শিখে নেই,
চোখে চোখে চলার ভাষা কি করে হয়?
আজকে জেনে নেই, এই শর্ত মেনে নেই,
তুই যদি না চাস তো এসব, আমারও নয়।
এই আশিকী, আশিকী, করলো কী জাদু হায়!”
দুজনে উঠে দাঁড়ায়। সামি আর ইরা দুজনেই দুজনের উল্টো পিট দুজনের পিটে ঠেকিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। সাথে সাথে মিউজিক অফ হয়। সবাই হাততালি দিতে শুরু করে। মিউজিক অফ হতেই সামি তাড়াতাড়ি করে স্টেজ থেকে নেমে পালিয়ে যায়।
১৩!!
ইরা চারিদিকে সামিকে খুঁজতে থাকে। স্টেজে কোথাও সামিকে দেখতে না পেয়ে ইরা চলে আসে মেঘের কাছে। মেঘ ইরার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
_খুব তো আমার বন্ধুটাকে জড়িয়ে ধরলি। তুই আবার ওর প্রেমে পড়িস না ইরা।
_ছাড় তো এসব। তোর বন্ধু হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল কীভাবে?
_কী জানি। এখানেই তো ছিল। বাদ দে, তোদের ডান্সটা কিন্তু সুপার হয়েছে। মনে হচ্ছিল দুজন বাস্তবেই কাপল। খুব মানিয়েছে দুজনকে তাই না শ্রাবণ?
_তুইও না পারিসও বটে। জিজুকে এখানে টানিস না। দেখছিস না বেচারা তোর সাথে নাচতে না পেরে চেহারাটা কেমন আমলকীর মতো করে রেখেছে?
ইরা হাসতে হাসতে কথাটা বলে একছুটে পালিয়ে যায়। শ্রাবণ চেহারায় রাগের ভাব এনে ইরার যাওয়ার পানে তাকায়। ইরা আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়ে সামিকে খুঁজতে।
চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।