ক্যানভাস-পর্ব : (২৩) অন্তিম পর্ব

0
851

#ক্যানভাস-পর্ব : (২৩) অন্তিম পর্ব
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

৫৯!!
ইরা অনেকক্ষণ ধরে শ্রাবণদের বাসায় বসে আছে। শ্রাবণ এখন পর্যন্ত এসে একবারও দেখা করে যায়নি। শ্রাবণের মা ইরার হাবভাবে অনেকটা কষ্ট পাচ্ছেন। মেঘ যে এইভাবে ওনার দেওয়া চুড়ি ফেরত দিয়ে পাঠাবে সেটা তিনি কখনও ভাবেননি। ইরা চেয়েছিল শ্রাবণের ঘুম ভাঙলে তার সাথে দেখা করে মেঘ সম্পর্কে কিছু কথা জানিয়ে যাবে। কিন্তু শ্রাবণ নিজেকে বাইরে নিয়ে আসার প্রয়োজনবোধ করছে না বলেই একা একা রুমে বসে আছে। ইরা অপেক্ষা করতে করতে শ্রাবণের মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।

শ্রাবণ রুমে বসে মোবাইল নিয়ে অযথাই ঘাটাঘাটি করছে। শ্রাবণের মা রুমে ঢুকে হাতের চুড়ি গুলো শ্রাবণের মুখের উপর ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে কেঁদে উঠেন। ওনার এমন আচরণে শ্রাবণ হতবাক হয়ে যায়। একদম শান্ত গলায় মাকে জিজ্ঞেস করলো,

_এসব আমার এখানে ফেলছো কেন?
_আমার সম্মান, আমার মন বুঝার বয়স তোর এখনও হয়নি। এখন তুই ইচ্ছে করলেই এই চুড়ি গুলো যার হাতে পারিস পরিয়ে দিস। এটা এখন তোর দায়িত্ব।
_এসব আমি পারবো না। কতবার বলবো আমাকে আর এসব নিয়ে বিরক্ত করো না। তোমরা যদি এমন করো আমি বাধ্য হবো এই বাড়ি থেকে চলে যেতে।
_তুই তো মানুষ না শ্রাবণ। কীভাবে বদলে গেলি তুই? একটা মেয়ের মন বুঝার ক্ষমতা যেখানে তোর নেই, সেখানে তুই আনিকাকে ভালোবাসলি কীভাবে? যে ভালোবাসাটা পবিত্র সেটা তোর চোখে পড়লো না। উল্টো মেয়েটাকে অপমান করে এইভাবে শাস্তি দিলি। না পারলি নিজে সুখী হতে আর না পারলি মাকে সুখী করতে।

শ্রাবণের মা কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে যান। শ্রাবণ চুড়ি গুলোর দিকে কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে। তারপর রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

মেঘ আর সামি পার্কে বসে আছে। এত সকাল সকাল মেঘের জরুরি কথা সামিকে অবাক করে দিলেও কাল সন্ধ্যের কথা মনে পড়তেই স্বাভাবিক হয়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরে মেঘ সামিকে অনেক কিছু বলে যাচ্ছে। সামি শুধু নিজের কান দিয়ে সেগুলো শুনে যাচ্ছে। সব কথাবার্তা শেষ হলে সামি মেঘকে বলল,

_আর কোনো উপায় নেই কী?
_থাকলে আমাকে এইভাবে পালাতে হতো না সামি।
_কিন্তু এইভাবে কেন মেঘ?
_সবটাই তো তোমরা জানো। এতকিছুর পরেও আমি পারবো না আর ওর মুখোমুখি হতে। সব থেকে বড় কথা, আমি আর চাই না আমার এই মুখ শ্রাবণ দেখুক।
_তুমি চাইলে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারো।
_ঘুমে, জাগরণে যে মানুষটার স্মৃতি আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয় তাকে ভুলে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাটা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। এখন তুমি যদি পারো এই কয়েক দিনের মধ্যে কিছু করো।
_আচ্ছা। আমি বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবো। তুমি শুধু ইরাকে সামলে নিও।

সামিকে পরম বন্ধু ভেবে মেঘ জীবনের কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। মেঘের বিশ্বাস, যেকোনো ভাবে সামি তাকে রক্ষা করবেই। আর এই বিশ্বাসটুকু নিয়েই মেঘ সামির সাথে সব বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে নিতে পারলো।

৬০!!
ক’দিন পর…
মেঘ নিজের মতো করে প্রস্তুতি নিয়ে নিচ্ছে। সবকিছু একদমই ঠিকঠাক এখন শুধু বাবা-মাকে বুঝানো প্রয়োজন। সন্ধ্যেবেলা সামি মেঘের সাথে দেখা করে একটা ছোট ব্যাগে মেঘের জন্য দরকারি জিনিস দিয়ে যায়। ইরা দূর থেকে সেটা লক্ষ্য করলেও বুঝতে পারে না। মেঘ যখন হাতের জিনিসটা নিয়ে নিজের রুমে যায় ইরা সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে সামিকে আলাদা ডেকে নেয়।

সামির চোখেমুখে ভয়ের ছাপ দেখে ইরা বুঝতে পারে কিছু একটা গণ্ডগোল নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সামির চুপচাপ থাকাটা ওর চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবুও ইরা সামিকে জোর করে কথা বের করার চেষ্টা করতে থাকে। সামি কিছুই বলতে রাজি হচ্ছে না দেখে ইরার জোর থেমে যায়। নিজের রাগকে পর্যাপ্ত পরিমাণ কন্ট্রোল করে সামিকে বলল,

_কী লুকাচ্ছো দুজনে আমি জানি না। শুধু এইটুকু জেনে রাখো সামি, যত যাই করো তুমি আমার বোনটার ক্ষতি কোনোভাবেই যেন না হয়। যদি মেঘের কিছু হয় আমি কিন্তু তোমায় ছেড়ে কথা বলবো না।
_কী বলছো পাগলের মতো? মাথা ঠিক আছে তোমার? আরে মেঘের ক্ষতি হোক এমন কাজ এই সামি জীবনে করবে না।
_তাহলে কী লুকাচ্ছো আমার থেকে?
_কিছুই লুকাচ্ছি না ইরা। সময় আসলে সবাই জানবে। এখন শুধু নিজেকে তৈরি করে রাখো, সময় হলে তোমাকেও প্রয়োজন পড়বে।
_আমি তোমাদের কোনো কাজে নেই। আমাকে জোর করো না।
_আমার জন্য কিছু করতে বলবো না তোমাকে। শুধু নিজের বোনের জন্য মেঘের অনুরোধটা একটু রেখো, যদি তুমি আমাকে…
_কীসের অনুরোধ?
_সেটা মেঘ নিজেই তোমাকে বলবে। আমি এখন আসছি। অনেক কাজ বাকি।

সামি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ইরার সামনে থেকে পালিয়ে আসে। রাতে ঘুমোতে গেলে ইরা মেঘকে অনেক প্রশ্ন শুরু করে। মেঘ ছোট ব্যাগের ভেতরে থাকা সব কাগজ ইরার সামনে ফেলে দিয়ে বলল,

_এগুলো দেখ। আর তারপর সিদ্ধান্ত নিবি।
_কীসের সিদ্ধান্ত?
_দু’দিনের মধ্যে তোর সাথে সামির বিয়ে। আর তারপর…
_তারপর?
_কাগজ গুলো দেখ আগে।

ইরা সব গুলো কাগজ বের করে বুঝতে পারে মেঘ পালানোর রাস্তা খুঁজছে। সাথে সামি আর ইরা এই দুজনকে নিয়েই পালাবে। কিন্তু মেঘের এই পালানোর উদ্দেশ্যটা কী সেটা ইরা এখনও বুঝেনি। মেঘকে কিছু বলতে গেলেও লাভ হবে না। মেঘ কোনো উত্তর দিবেই না। মনের মধ্যে হাজারও সংকট নিয়ে ইরা ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়।

ঘুমোতে গিয়ে ইরা অনেক কিছুই ভাবে কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পায় না। কেন মেঘ দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছে? দূর দেশে কীসের আশায় চেনা পরিচিতদের সকল ভালোবাসা চিহ্ন করে এইভাবে পালাবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না ইরা। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায়।

৬১!!
আজ সামি ইরা দুজনের বিয়ে। এতে কারো আপত্তি নেই। সামির বাবা-মা ওমরা হজ্জ্ব পালনের জন্য দেশের বাইরে থাকায় এই মুহূর্তে আসতে পারেননি। ওনারা দুজনকে আশীর্বাদ করেছেন যাতে ওরা দুজন সুখী হতে পারে। মেঘের বাবা-মা, ইরার বাবা-মা, নওরিন আর আদনান, মাত্র এই ক’জন মানুষকে সামনে রেখে এই বিয়ের ছোট আয়োজন। ঝমকালো বাতি নেই, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নেই শুধু হাতে গুনা কয়েকজনকে নিয়ে রেজিষ্ট্রি পেপারে সাইনের মাধ্যমে এই বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেল। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে এক মুহূর্তের জন্যেও আদনান নওরিনের দিকে ফিরে তাকায়নি। নওরিন আড়চোখে অনেকবার আদনানের দিকে তাকিয়ে সেটা আদনানও লক্ষ্য করেছে তবুও মেয়েটাকে এইভাবে অবহেলা করে গেল। এতে যে নওরিন কতটা আঘাত পেয়েছে সেটা আদনানের বুঝতে একটুও বাকি রইলো না।

সাদা বিছানার চাদরে লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা। ঠিক তার মাঝখানে ইরা বসে আছে বধূ ভেসে। রাগে ইরার মাথা জ্বলে যাচ্ছে। মেঘ হুট করে বিয়ে আয়োজন করে বিয়ে দিয়ে দিল। সাথে সামিও নাচতে নাচতে বিয়ে করতে চলে গেল অথচ ইরা নিজে কিছু জানতে পারলো না। সামি সেই তখন থেকে নিজের রুমের সাথে থাকা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। সাহস করে ইরার সামনে পর্যন্ত আসতে পারছে না। অনেকটা সময় ইরা অপেক্ষা করে বিছানা থেকে নেমে সামির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সামি তখনও দু’চোখ দিয়ে ব্যস্ত ঢাকা শহরের রাতের চিত্র দেখতে মনোযোগী হয়ে আছে। ইরা ধুম করে সামির পাঞ্জাবির কলার টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

_এইভাবে বিয়ে করার মানে কী?
_তোমার সাহস তো কম না বিয়ের রাতে নিজের স্বামীর উপর নির্যাতন শুরু করেছো। কই একটু ভালোবাসবে তা না, ওনি ঝগড়া শুরু করেছেন।
_তোমার মতো উল্লুকে ভালোবাসতে যাবো আমি। বয়েই গেছে আমার।
_উল্লু আমি না তুমি।
_কী?
_হ্যাঁ। যে নিজের ভালোবাসাকে নিজের মাঝে চেপে রেখে একা একা কষ্ট পায় সে তো আমার থেকেও আরো বড় বোকা।
_আমি কাকে ভালোবাসি?
_কাকে আবার। যার বউ হয়ে এখন নির্যাতন চালাচ্ছো তাকে।

সামি একটু থেমে ইরার দিকে তাকায়। ইরা ততক্ষণে নিজেকে সামির থেকে দূরে নিয়ে বেলকনির রেলিং ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সামি যত্ন করে ইরার হাত দুটো ধরে ইরাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ইরার গালে হাত রেখে বলল,

_হাসপাতালের নার্স সেজে যাওয়া, ফেইসবুকে সব সময় ফলো করা। আমাকে বিরক্ত করা। এসব কিছুই তো তুমি করেছো। কীভাবে পারলে সবকিছু আমার থেকে আড়াল করে যেতে? তুমি কী ভেবেছিলে, আমি এসব কিছুই জানতে পারবো না। ইরা যেদিন হাসপাতালে তুমি আমাকে স্পর্শ করেছিলে সেদিনই আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। তোমাকে চিনতে পেরেছিলাম বলেই বার বার তোমার চেহারা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি নিজেকে আড়ালে রাখলে। তারপর তোমাদের বাড়িতে নিজেই আমার সেবা-যত্ন করলে। হাসপাতালের তুমি আর বাড়ির তুমি কখনওই আমার কাছে আলাদা মনে হয়নি। আমার ভাবনা শিওর তখনই হয়, যখন হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর সেদিন বাবা-মা আমাকে দেখতে এসেছিল। হুট করেই বলে ফেলে তোমাদের নিচে দেখেছে। মোবাইল রিচার্জ যে একটা মিথ্যে বাহানা ছিল, সেটা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। এরপরেও কী বলবে তুমি আমাকে ভালোবাসো না?

ইরা শুধু সামির কথার মাঝে ডুবে থাকে। এই মুহূর্তে ঠিক কী বলা প্রয়োজন তার জানা নেই। শুধু এই মুহূর্তটাকে স্মৃতিতে মিশিয়ে নিতে চাইছে। বিন্দু বিন্দু সুখের জল চোখে নিয়ে সামির বুকে মাথা রাখে ইরা। সামি আবারও বলল,

_আমি ভুল করেছি ইরা। আগেই সব কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু নিজের মনের সংকোচটা কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। প্রথম দেখায় যে ভালোবাসা হয় না সেটা তোমাকে না দেখলে অনুভব কর‍তে পারতাম না। ভালোবাসার জন্য অনুভূতির দরকার হয়। দরকার হয় নিজেকে শপে দেওয়ার জন্য বিশ্বাস যোগ্য দুটো হাত। যে হাতের স্পর্শ আমি সেদিনই পেয়েছিলাম ইরা।

দুজনের চোখে আজ সুখের অশ্রু। তাদের এই সুখের সাক্ষী দূর আকাশের ওই রূপালী চাঁদসহ লক্ষ-কোটি তারকা। আজ দুটি জীবন আবদ্ধ হলো একে-অপরকে ভালোবেসে সারা জীবন কাটানোর।

৬২!!
এক মাস পর…
মেঘ সবকিছু ঠিকমতো লাগেজে ঢুকিয়ে নিয়েছে। বাবা-মা দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে যাচ্ছে। মেঘের বাবা-মা দুজনের চোখেই জল। একমাত্র মেয়েকে এইভাবে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে কারোরই মন সায় দিচ্ছে না। তবুও মেঘের জেদটাকে জিতিয়ে দিতে এই মুহূর্তে তারা তাকে বাধা দিতে চান না। যেভাবে সে নিজেকে সুখী রাখতে চায় সেভাবেই থাকুক। অন্তত এই নরক যন্ত্রণা থেকে তো মুক্তি পাবে, তাতেই তারা খুশি।

মেঘকে বিদায় দিতে আদনান, নওরিন দুজনেই এয়ারপোর্টে উপস্থিত। সাথে ইরা আর সামি দুজনেই। ইরা মেঘের দিকে তাকিয়ে মেঘকে বলল,

_আমাকে মাঝখানে এত ভয় দেখালে দুজন। যাই হোক, সবকিছু পিছনে ফেলে আবারও নতুন কিছু ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা। ভিন দেশের মাটিতে আপনজন তোর কেউ না থাকলে এই দুই বান্দা সব সময় তোর সাথে থাকবে।

মেঘ শুধু ইরার কথায় মুচকি হাসে। তারপর আদনান আর নওরিনের দুটো হাত এক করে দিয়ে বলল,

_যখন আবারও ফিরে আসবো তখন তোদের মাঝখানে একটা পুচকোকে দেখতে চাই। সব অভিমান ভুলে, রাগ ভুলে, এবার অন্তত দুজনে নতুন জীবন শুরু কর। আমি সব সময় তোদের জন্য দোয়া করবো।

মেঘের কথায় নওরিন হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

_সবাইকে সুখী করে তুই নিজেকে কোন সুখের আশায় দূরে নিয়ে যাচ্ছিস মেঘ?
_অচেনা শহরে আমার জন্য সুখ আছে কী না জানি না নওরিন। শুধু এটা বলতে, এই চেনা শহরে ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা খারাপ মানুষের ভীড়ে আর থাকা সম্ভব না। বাবা-মাকে দেখার জন্য এখানে কেউ নেই। ইরা আর সামি দুজনেই আমার সাথে যাচ্ছে। এখানে শুধু তোরা আছিস। আমি ফিরে আসা পর্যন্ত বাবা-মায়ের দিকে খেয়াল রাখিস।

একরাশ অভিমান নিয়ে মেঘ নিজের কথাগুলো শেষ করে দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে ইরা আর সামিকে সাথে নিয়ে অচেনা গন্তব্যের দিকে পা এগিয়ে দেয়। চোখের কোণে যে জল জমে রয়েছে তা এই দেশের মাটিতেই মুছে দিয়ে যায় মেঘ। নতুন ঠিকানায় যেন নতুনভাবে নিজের জীবনটা সাজাতে পারে সেইজন্য এই চেনা শহর থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে অজানায় পাড়ি দিল সে।

সীটবেল্ট বেঁধে বিমানে অন্যান্য যাত্রীদের পাশে জানালার পাশাপাশি সীটে বসে আছে মেঘ। জানালার বাইরে চোখ পড়তেই মেঘের ভেতরটা ধুক করে কেঁপে উঠে। কীসের জন্য আবারও মেঘের বুকে এক তীব্র ব্যথার অনুভব করে সে। সবকিছুই তো ফেলে যাচ্ছে এখানে। সব স্মৃতি মুছে যাচ্ছে হৃদয় থেকে। ভালোবাসা, ভালোবাসার মানুষ কেউ-ই আর এই হৃদয়ে নাড়া দিচ্ছে না, তবুও কীসের এত যন্ত্রণা এই বুকের মাঝখানটায় লুকিয়ে আছে তা মেঘ নিজেও জানে না।

প্ল্যান তখন নীল আকাশের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছে। এখন শুধু মরিচীকার মতো ভয়ঙ্কর মিথ্যে কিছু স্বপ্ন ওই আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে। যাকে নিয়ে মেঘের স্বপ্নের শুরু সেই মানুষটাকে ফেলে এইভাবে একাকী জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিতে কতটা কষ্ট হয়েছে তার সেটা শুধু সেই জানে। সব ভালোবাসাকে এইভাবে যে মিথ্যে বলে অস্বীকার করে গেল তার জন্য আর নিজের চোখের পানি ফেলাটাও বৃথা। এখন শুধু নিজেকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই।

মেঘ চলে গেছে অনেক দূরে। কিন্তু এই দেশের কোনো এক কোণে সে, একটা মানুষ দিনের পর দিন অনুতাপের অনলে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে খবর জানতেও পারলো না মেঘ। যার ভেতরে যন্ত্রণাটুকু লুকিয়ে রয়েছে সে নিজেও জানলো না, কেউ একজন তার অবহেলার স্বীকার হয়ে আজ অজানায় হারিয়ে গেল। শত চাইলেও আর সে ফিরে আসবে না। মানুষটা চলে যাওয়ার সাথে সাথে সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেল। অনুভূতির আড়ালে যে ভালোবাসাটুকু ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছিল, হঠাৎ তা তুমুল ঝড়ে হারিয়ে গেল। সাদা কাগজের ক্যানভাসে লেপটে থাকা অনুভূতিটাও আজ বেদনার নীল জলে মিশে গেল। সেই হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা, ক্যানভাসে ছড়িয়ে দেওয়া রঙিন রঙের অনুভূতি, এইসব আর কেউ কোনোদিন কাউকে খুঁজতে আসবে কী না তা এদের দুজনের মাঝে কেউ-ই জানে না। জানার আগ্রহও নেই কারো। শুধু আছে লুকানো কিছু স্মৃতি, কিছু কষ্টের মূহুর্ত যা চিরকাল অম্লান হয়ে থেকে প্রত্যেকের মনের মণিকোঠায়।

সমাপ্ত…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here