#তবু_ফিরে_আসা,পর্ব : (৪)
লেখনীতে ; তামান্না আক্তার তানু
(১২)
গ্রীণ রিসোর্ট থেকে পিয়াইন নদীর দূরত্বটা খুব বেশি না। সকাল সকাল ঘুম ভাঙার পরেই আজকের দিনের পুরো প্রোগ্রাম ঠিক করে নিয়েছে শ্রাবণ। দু’দিন হয়ে গেছে এখানে এসেছে অথচ কোথাও ঘুরতে যেতে পারেনি। একটা ব্যাগপ্যাকে নদীতে নামার জন্য লাইফ জ্যাকেট, অল্প শুকনো খাবার আর নিজের আরও দরকারি জিনিসপত্র গোছগাছ করে নেয়। রুম লক করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। এত সকালে রিসোর্টের সবাই হয়তো ঘুমোচ্ছে। রিসেপশনে বলে যাওয়া দরকার এইভেবে রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেল শ্রাবণ। ওখানে তখন জয় বসেছিল, নীলাশার বাড়ি এখান থেকে খুব দূরে না, সেজন্য তাকে রাতে এখানে থাকতে হয় না। শ্রাবণের জন্মদিন পালন করে রাত এগারোটার দিকে সে বাসায় পৌঁছে গিয়েছে। আজকের শিফটে আসবে দুপুরে। এখনও তার অনেক সময় বাকি। শ্রাবণ জয়ের কাছাকাছি গিয়ে বলল,
“যাবে সঙ্গে?”
“এখানে কেউ থাকলে ভালো হতো। আচ্ছা ওয়েট বাবাকে ডেকে আনি।”
জয় তার বাবাকে ডেকে আনার জন্য এগোতেই আহ্সান চৌধুরী নিজেই তখন রিসেপশনে আসলেন। জয় চমকে একবার সামনের দিকে তাকালো ততক্ষণে শ্রাবণের দৃষ্টিও স্থির! মেঘ নিজেই আহ্সান সাহেবের হাত ধরে ওনার রুম থেকে রিসেপশনে আসছিল। এতক্ষণ চাকরি ছাড়া নিয়েই আলোচনা চলছিল দু’জনের মাঝে। মেঘ সামনে না তাকিয়েই বলল,
“জয়, আংকেলকে ম্যানেজ করা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তুই একটু বুঝিয়ে বল না, এই চাকরিটা করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়!”
আহ্সান চৌধুরীর হাত ছেড়ে সামনে তাকিয়ে মেঘ নিজেও স্তব্ধ হয়ে যায়। দ্রুত পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। শ্রাবণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গাতেই। এখনও তার দু’চোখকে যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে, যার অপেক্ষায় দুটো বছর ধরে প্রহর গুণে বসেছিল সেই মানুষটা আজ তার সামনে। এটা কোনো ভ্রম নয়তো! মেঘ এখানে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো শ্রাবণ। চমকে উঠলো আহ্সান সাহেবের কণ্ঠস্বর শোনে। তিনি জয়কে বলছেন,
“এই মেয়েটার হঠাৎ হলোটা কি দেখতো, এভাবে হুট করে কেউ চাকরি ছাড়ে? তুই একটু বুঝা তো ওকে, এখন টুরিস্ট সিজন। এইসময় এখানে পর্যটকদের ভিড় হয় প্রচুর। এভাবে আমার উপর সব চাপিয়ে কীভাবে চলে যেতে পারে ও?”
জয় কিছু বলার সাহস পেল না। নিজেই বোকা বনে গেছে এই মুহূর্তে। কী করবে কিছুই মাথায় আসছে না। মেঘ এভাবে হুট করে কেন বাইরে আসলো! এখন তো না আসলেও হতো। দুচ্ছাই বলে একবার দাঁতে দাঁত চেপে ফুস করে দম ছাড়লো জয়। ঠিক তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেঘ নিজেই ঘুরে দাঁড়ালো। আহ্সান চৌধুরীর ডানহাত নিজের হাতে চেপে ভাঙা গলায় বলল,
“আমার চাকরির কোনো প্রয়োজন ছিল না আংকেল। আমি আমার অতীত ভুলতে এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি অপয়া অতীতটা আজও আমার পিছনে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে এখান থেকে চলে যেতে হচ্ছে। আ…আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ।”
রিসেপশনের লকারগুলোর মধ্যে নিজের পার্টস আর দরকারি কিছু কাগজ ছিল। দ্রুত সেখানে গিয়ে লক খুলে একটা ফাইল আর পার্টসটা বের করে লক লাগিয়ে চাবিটা তুলে দিল জয়ের হাতে। বের হওয়ার আগে জয়কে বলল,
“ভালো থাকিস তোরা। নীলাশার সাথে পরে আলাপ করে নিব। আসছি।”
(১৩)
ঝড়ের বেগে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে বাগানের সেই চিরচেনা রাস্তা দিয়ে মেইন গেটের কাছাকাছি এগিয়ে গেল মেঘ। শ্রাবণ তখনও বোকার মতো নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে তার ঠিক করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না। জয় তখন বলল,
“এখনও বুঝে উঠতে পারেননি ভাইয়া? আপনার কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নিন। এক বছর আগে আর গতদিন রাতে অচেনা নাম্বার থেকে জন্মদিনের যে দুটো ম্যাসেজ গেছে, সেই অচেনা নাম্বারের মেয়েটা এই মেঘ। যে কল্পনার মাধ্যমে আপনাকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছিল অথচ বাস্তবে ফিরে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছিল। গতদিন ইন্টারকমে যে মেয়ের কণ্ঠস্বর শোনেছেন সেটাও এই মেঘ। গতকাল জন্মদিনে যে কেক আপনি কেটেছেন, সেটাও এই মেঘের হাতেই বানানো। এরপরেও কি আর কিছু বাকি থাকে বুঝার যে, কেন মেঘ চাকরি ছাড়ছে?”
জয়ের কথাগুলো শোনে শ্রাবণের বুঝতে দেরী হলো না যে, মেঘ সিডনীতে নয় সিলেটেই ছিল এতদিন। আর এখানেই এতদিন ধরে চাকরি করছে। শ্রাবণ যতবার এখানে এসেছে মেঘ নিজেকে আড়াল করেছে। দু’হাতে মুখ মুছে দ্রুত ছুটলো মেঘের পিছনে। দু’বছর আগে যে ভুল হয়েছে সেটা শোধরানোর সময় এসেছে। মেঘকে ফিরে পাওয়ার সবরকম চেষ্টা থাকে চালিয়ে যেতে হবে। যেভাবেই হোক, মেঘকে তার লাগবেই। এখনও অনেক কথা জানা বাকি আছে তার।
মেইন গেট থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল মেঘ। শ্রাবণকে দেখে আবারও সেখান থেকে চলে যেতে শুরু করলো মেঘ। শ্রাবণ দ্রুত ছুটে গেল মেঘকে ডাকতে ডাকতে। শ্রাবণের ডাক যেন মেঘ শুনতেই পাচ্ছে না, এমনভাবে কানে তুলো গুঁজে দ্রুত হাঁটছে সে নিজে। কোনোভাবেই যখন মেঘকে থামানো যাচ্ছিল না তখন বাধ্য হয়ে মেঘের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ঠাস করে একটা চড় দিল শ্রাবণ। মেঘ গালে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। ঠিক সেই মুহূর্তেই মেঘকে অবাক করে দিয়ে চট করে শ্রাবণ তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এতক্ষণ ধরে ডাকছি, অথচ সাড়া দিচ্ছো না। এই দু’বছরে এত ঘৃণা জন্মেছে আমার প্রতি যে, আমার থেকে দূরে থাকাতে সুখ খুঁজে নিলে? বলো না মেঘ, কেন এভাবে পর করে দিলে? কী ভুল ছিল আমার?”
দু’হাতে শ্রাবণকে ধাক্কা মেরে দূরে সরে গেল মেঘ। চিৎকার করে বলল,
“কেউ হোন না আপনি আমার। কেউ না। আমার হৃদয়ের ক্যানভাসে যে মুখ আমি ফুটিয়ে তুলেছিলাম সে মানুষটা দু’বছর আগেই মারা গেছে। এই দু’হাতে যত্ন করে সাজানো সব ক্যানভাস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছি। দাফন করেছি নিজের ভালোবাসার। ভেঙে ফেলেছি নিজের স্বপ্ন। সব শেষ হয়ে গেছে শ্রাবণ, সব শেষ হয়ে গেছে। কিচ্ছু বাকি নেই আর। ওই ক্যানভাস আর আমার ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের মতো, এই দু’বছরে আমিও মরেছি। বার বার মরেছি, তবুও নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি।”
“আস্তে কথা বলো, এটা রাস্তা। মানুষজন কী ভাববে?”
রাগটা কন্ট্রোল করতে গেল মেঘ। মাথা নিচু রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। রাগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে নিঃশ্বাসের ওঠানামার গতি তীব্র হচ্ছে। মেঘের এই এত রাগী মুখ আগে কখনও লক্ষ্য করেনি শ্রাবণ। যত কষ্টই পেত, কখনও এভাবে রাগ দেখায়নি। মেঘকে পর্যবেক্ষণ করে ধীরস্থিরভাবে বলল,
“একঘণ্টা সময় দিবে? কোথাও বসে কথা বলতাম।”
(১৪)
“বলুন কী জানতে চান?”
সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো মেঘ। শ্রাবণ বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছে এখন পর্যন্ত মেঘ তার দিকে তাকায়নি আর তুমিতেও নামেনি। কেমন অপরিচিতদের মতো আচরণ করছে। কষ্ট পেলেও সেটাকে চেপে রাখলো শ্রাবণ। মেঘের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে বলল,
“দু’বছরে খুব পর করে দিলে! তুমি থেকে আপনি। ভালো, খুব ভালো।”
“আপনি আমার আপন ছিলেন কখনও?”
মেঘের চোখ এখন শ্রাবণের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে মেঘ। তার চোখেমুখে দৃঢ়তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। যেন অনেক বেদনার গল্প লুকিয়ে আছে ওই দু’চোখে। অথচ শ্রাবণ এত কাছাকাছি থেকেও সেটা ধরতে পারছে না। মেঘ আবারও বলল,
“আমার স্পর্শে কখনও আপনি আমাকে খুঁজেছিলেন? খুঁজেননি। মানুষ আপনজনের স্পর্শ অনুভব করতে পারে। খুব কাছে থেকে সেটা অনুভব করে। আপনি আমার কাছে থাকলেও সবসময় আমার স্পর্শে আনিকাকে খুঁজে নিয়েছেন। এতেই কি প্রমাণ হয় না, আমি আপনার আপন হতেই পারিনি কোনোদিন?”
“এতদিন আদনান বলতো আমি তোমার কেউ হই না, কেউ হতে পারিনি, বাবা-মা বলেছেন, তোমার বাবা-মা ওনারাও বাকি রাখেননি। আর আজ তুমি বললে। আসলেই আমি তোমার কেউ না। আমি শুধু তোমার ক্যানভাসের একটা অচেনা চেহারাতেই সীমাবদ্ধ ছিলাম, আজও আছি, হয়তো চিরকাল তাই থাকবো। যাক সেসব কথা, সিডনী থেকে ফেরার কারণ জানতে চাইবো না। আমাকে কেন মিথ্যে পরিচয় দিলে সেটা অন্তত বলো। কে সেই আবির যার মাধ্যমে জানতে হলো, তুমি রাত্রি নও চিত্রশিল্পী কাশফিয়া হাসান মেঘ। কেন সে তোমাকে আমাদের বিয়ের দিনই কিডন্যাপ করলো? কেন তুমি নিজে আমাকে এই সত্যিটা জানালে না মেঘ? আজ সব উত্তর দিয়ে তবেই এখান থেকে যাবে। যদি চাও, আমার জীবন থেকেও চলে যাওয়ার অনুমতি পাবে। কিন্তু তার আগে আমার অপরাধটা কী সেটা ক্লিয়ার করে যাবে।”
এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে থামলো শ্রাবণ। বুড়ো আঙুলে চোখ মুছে মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ এক দৃষ্টিতে তখন শ্রাবণকেই দেখছে। কী অদ্ভুত, তখন মেঘের চোখে এক অজানা বিস্ময় লুকানো!
২০১৪ সাল। মেঘ ওর মায়ের সাথে নারায়ণগঞ্জ জেলার একটা গ্রামে থাকতো। মেঘের বাবা তখন ঢাকায় ব্যবসা সামলাতে ব্যস্ত। তখনও পুরো পরিবার নিয়ে ঢাকায় আসতে পারেননি তিনি। গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে মেঘ তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী। পড়াশোনা, বন্ধু-বান্ধব, হাসি-আনন্দ এসবেই দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছিল মেঘের। তখন থেকেই পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে মেঘের আঁকিবুঁকি শুরু হয়। আর্টসকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয়েই বেশ সুনাম অর্জিত হয় তার। তার সেই মেধা দেখে শিক্ষকরা গর্ব করতেন মেঘকে নিয়ে। এক সময় বিদ্যালয়ের ট্যালেন্টেড স্টুডেন্ট হিসেবে পরিচিতি পায় তার।
সেই একই বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে পড়াশোনা করতো আবির আর রেহান। দু’জনে একে-অপরের জানের দোস্ত। বিপদে-আপদে একে-অপরকে সাহায্য করা, অসুস্থ হলে এগিয়ে যাওয়া এভাবেই চলছিল তাদের দিন। কিন্তু বিপত্তি বাধে মেঘ। মেঘের ট্যালেন্ট নিয়ে পুরো বিদ্যালয় যখন আলোচনায় মশগুল তখন রেহান নিজে থেকেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় মেঘের দিকে। সিনিয়র ভাই দেখে মেঘ যথেষ্ট সম্মান করতো তাকে।
রেহান ছাত্র হিসেবে খুব একটা ভালো না থাকলেও মেঘের সংস্পর্শে এসে অনেককিছু ধারণা করতে শিখে যায়। পড়াশোনার প্রতিও বেশ মনোনিবেশ করে। জানের দোস্তের হঠাৎ এই পরিবর্তন আবিরের চোখে পড়ে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে রেহান নবম শ্রেণীর কাশফিয়া হাসান মেঘ নামে একটা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করেছে। ক্লাসটাইম শেষ হলেই ওরা আশেপাশে চক্কর দেয়। আড্ডা দেয়। আবার কখনও বই নিয়ে পড়াশোনা করে।
হঠাৎ করেই আবির কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠে। কারণ অনেকদিন ধরেই সে মেঘের পিছনে প্রেমপত্র নিয়ে ঘুরঘুর করেছে অথচ মেঘ তাকে পাত্তা দেয়নি। আবিরের তুলনায় রেহান অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। অথচ মেঘের মতো মেয়ে কিনা সেই দরিদ্র, ছোটোলোক ছেলেটার সাথেই বন্ধুত্ব করলো। ব্যাপারটা সহজে হজম করতে পারলো না আবির। বন্ধু যখন শত্রু হয়, তখন এর শেষটাও হয় ভয়াবহ! খুব গোপনে ভয়ানক এক ফন্দি আটলো আবির, যেটা রেহান টের পেল না কভু!
চলবে…
(ভুল ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।)