তবু_ফিরে_আসা,পর্ব : (১০)

0
662

#তবু_ফিরে_আসা,পর্ব : (১০)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

(৩১)
অনেকদিন পর খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে মেঘ। চারপাশে সবুজ গাছপালা আর মানুষের আনাগোনাতে জায়গাটা একদম ভরে গেছে। কতদিন এখানে আসা হয় না তার। সেই এইচ এস সি প্রথম বর্ষে একবার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এখানে আসার সুযোগ হয়েছিল তার। আজ আবার এলো। এর পুরো ক্রেডিটটাই রোশানের। ছেলেটা এতদিন বাইরের দেশে থাকলে কী হবে, মনে প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলাদেশের মানুষকে সে ভীষণ শ্রদ্ধা আর সম্মান করে এটা গত কয়েকদিন ধরে রোশানের আচরণে টের পেয়েছে মেঘ। ভাব হয়েছে দু’জনের মধ্যে। অবসরে মাঝেমধ্যে রোশানই মেঘকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হয়। আগে মেঘ বিরক্ত হলেও এখন মনে হচ্ছে ছেলেটা ওতো খারাপ না। বন্ধুত্ব তো করাই যায়। তাছাড়া মেঘ চাইলেও জীবনে দ্বিতীয়বার কারও সাথে জড়াতে পারবে না। তার সমস্ত অনুভূতি শুধু শ্রাবণকে ঘিরেই। এটা আগেও ছিল, এখনও আছে, আগামীতেও থাকবে। মেঘ সেটা বিশ্বাস করে। আর বিশ্বাস করে বলেই ভুলে যেতে পারে না, ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।

হাঁটতে হাঁটতেই মূল ভবনে এসে দাঁড়ালো মেঘ আর নওরিন। আদনান আর রোশান পিছনে হেঁটে গল্প করতে করতে এগিয়ে আসছে। পুরনো ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই বিশাল ভবনটি আহসান মঞ্জিল যা বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে পরিচিতি দর্শনার্থীদের কাছে। এখানে আসলে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যকে উপভোগ করা যায়। ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে কেন্দ্র কত অজানা গল্প লুকিয়ে আছে এই আহসান মঞ্জিলের মুল ভবনে। একটা সময় মানুষ হারিয়ে যাবে, কিন্তু মানুষের তৈরী কিছু আজব নিদর্শন সবসময় বেঁচে থাকবে। যেসব অনেক দামী সম্পদ। জাদুঘরে বহু আমলের পুরনো জিনিসেরও দর্শন পাওয়া যায়। এই বিংশ শতাব্দীর মানুষগুলো হাজার বছর আগের নিদর্শনও দেখতে পায় এই জাদুঘরের মাধ্যমে। জাদুঘর আছে বলেই মানুষ বিশ্বাস করে পুরনো আমলের অসম্ভব সব ঘটনা, চিত্রকল্প এমনকি অস্ত্র-শস্ত্র সবকিছুরই একটা অস্তিত্ব ছিল এক সময়। এখন দিন বদলেছে, বদলেছে মানুষ। আজকে তৈরী কোনো ইতিহাসের চিত্র একদিন জাদুঘরে বেঁচে থাকবে। আগামী প্রজন্মের জন্য তৈরী হবে নতুন কোনো গল্প। মানুষ জানবে, বুঝবে, শিখবে আর হৃদয়ে ধারণ করবে ইতিহাসকে। ইতিহাস মানুষকে হাসায়, কাঁদায়, বলে যায় পুরনো সব কথা।

পুরো দিনটা বেশ ভালোই কাটিয়েছে ওরা। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় মেঘকে নামিয়ে দিয়ে রোশান নিজের বাসার দিকে রওনা দেয়। ভেতরে ঢুকেই মেঘ চমকে যায়। ড্রয়িংরুমে শ্রাবণ তার বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে দিব্যি গল্প করছে রেদোয়ান হাসানের সঙ্গে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে শ্রাবণের বাবা-মাকে সালাম করে দ্রুত নিজের রুমে চলে আসে সে। বিছানায় ফোনটা ফেলে রেখে আগে ওয়াশরুমে ঢুকে। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দ্বিগুণ অবাক হলো মেঘ। শ্রাবণ তার রুমে এসে বিছানায় বসে আছে তাও বিনা অনুমতিতে। রেগে গেলেও চুপ থাকলো মেঘ। টাওয়াল এনে হাত-মুখ মুছতে মুছতে বলল,
“কী সমস্যা তোমার? অনুমতি ছাড়া রুমে প্রবেশ করলে কেন? কারও ঘরে ঢুকার আগে পারমিশন নিতে হয়, এই সেন্সটুকু তোমার নেই?”
“বারে, কেউ ঘরে না থাকলে বুঝি ভূতের থেকে অনুমতি নিব? আজ এই রুমে দ্বিতীয়বার আসলাম। একটু যত্ন তো করতেই পারো।”
“নিচে যাও। বড়োরা খারাপ ভাববে।”
“এতদিন ফোন ধরোনি কেন মেঘ? ম্যাসেজের রিপ্লে দিলে না, ফোন রিসিভ করো না, নিজে থেকে যেচে কখনও ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করো না, আগে তো এমন ছিলে না তুমি। এখন অনেক পালটে গেছো!”

মেঘ কোনো জবাব দিল না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো শ্রাবণ। রুমের চারপাশ ভালো করে তাকিয়ে কোনো ক্যানভাস, স্কেচ কিছুই পেল না। এই রুমটা একসময় রঙিন ক্যানভাস আর শ্রাবণের স্কেচে ভরপুর ছিল। আজ সেসব কিছুই নেই। সেদিন নওরিনদের বাড়িতে যে স্কেচ এঁকেছিল সেটাও তো নেই। তবে কি সেই স্কেচ ওখানেই রয়ে গেছে? মেঘ সঙ্গে আনেনি? একা একাই ভাবলো শ্রাবণ। মেঘ তখন বলল,
“ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই, এখানে আর কোনো ক্যানভাস, স্কেচের জায়গা হয় না। যেগুলো পুড়িয়েছিলাম সেসব তো ছাই হয়ে গেছে বহু আগে। সেদিন একটা এঁকেছিলাম কিন্তু, তবে ওটা এখন স্টোর রুমের পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের সাথেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। রুমে আনলে, এই রুমের অমর্যাদা হবে তো, তাই ফেলে রেখেছি। কষ্ট পেয়েছো?”

তাচ্ছিল্যের সুর মেঘের কণ্ঠে। কঠিন একটা ধাক্কা খেল শ্রাবণ। একটা নর্দমার কীটের সাথেও মানুষ এত বাজে ব্যবহার করে না, যতটা বাজে ব্যবহার মেঘ তার সাথে করছে। শ্রাবণ আস্তো একটা বোকা। বোকা না হলে এত কথা শোনার পরেও কেউ যেচে আসে নাকি? ভাবতে ভাবতেই উঠে দাঁড়ালো সে। বাইরে বের হওয়ার আগে পিছু ঘুরে বলল,
“রোশানের সঙ্গে ভালোই ভাব জমেছে তাহলে। বিয়ে করতে পারো তাকে। আমাদের মাঝে দূরত্বের যে দেয়াল তুমি টেনেছিলে, সেই দেয়াল ভাঙার ক্ষমতা আমি আজও অর্জন করতে পারিনি। তোমায় ভালোবেসে আবারও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছি, এতগুলো দিন তোমার অপেক্ষায় আমার অনুভূতিকে বাঁচিয়ে রেখেছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সব অনুভূতিরা চাপা পড়তে যাচ্ছে। এই ক’দিনে তুমি বুঝিয়ে দিলে, আমার দেখা পুরনো সেই মেঘ হারিয়ে গেছে। যেদিন থেকে হারিয়ে গেছে রাত্রি নামের মেয়েটা সেদিন থেকে তুমিও হারিয়ে গেছো মেঘ। তুমিও হারিয়ে গেছো!”

এক মিনিটও আর দাঁড়ায়নি শ্রাবণ। ড্রয়িংরুমে এসে বাবা-মাকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেছে। এসেছিল মেঘের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব ঠিকঠাক করে বিয়ের আলোচনা সেরে নিতে। কিন্তু মেঘ এমনভাবে ইগনোর করে বুঝিয়ে দিল, সে আজও শ্রাবণকে ক্ষমা করতে পারেনি। মেঘের বাবা-মা এতক্ষণ মেঘের সম্মতির জন্যই ওনাদের অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু শ্রাবণের ওভাবে বেরিয়ে যাওয়া ওনাদের বুঝিয়ে দিল দুজনের মান-অভিমানের পাল্লা আরও ভারি হয়ে গেছে।

(৩২)
গত কয়েকদিন ধরেই শ্রাবণ দিন-রাত মেঘকে ম্যাসেজ করা, ফোন করে কথা বলার বাহানা খুঁজতো। কিন্তু মেঘ সেইরাতের পর আর শ্রাবণের সঙ্গে কোনোপ্রকার যোগাযোগ করেনি। তার এই অতিরিক্ত রাগটা আজও কমলো না। শ্রাবণকে ইগনোর করে এই ক’দিন রোশানকেই বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছিল সে। শ্রাবণও বুঝুক, ভালোবাসার মানুষকে অবহেলা করার যন্ত্রণা কেমন হয়! কিন্তু এভাবে তো এভয়েড করে খুব বেশিই ছেলেমানুষী আবেগ চাপিয়ে রেখেছে মেঘ। এখন সে যথেষ্ট ম্যাচিওরড। তার সাথে এখন এই রাগ-অভিমান এসব যায় না। সোজাসাপটা বলে দিলেও হতো। এত বাহানার প্রয়োজন পড়তো না।

অসময়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব ভাবছিল মেঘ। জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে জানলে কোনোদিন ভালোই বাসতো না। শ্রাবণকে বার বার ইগনোর করা মানে নিজেকেও কষ্ট দেওয়া। এরথেকে মুক্তির কী উপায় আছে! মেয়েকে অসময়ে বিছানায় দেখে কাছে আসলেন তিনি। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তুই বড্ড ভুল করছিস মেঘ। এখনও নিজের জেদ আর রাগ ধরে রেখে শ্রাবণকে কষ্ট দিচ্ছিস। অন্যায় আমরা করেছি ওর সাথে, ওর তো দোষ ছিল না। শ্রাবণ তো শুধু তোকে বিশ্বাস করেছিল, অথচ সেই বিশ্বাসটা ভেঙে দিতে দু’বারও ভাবিসনি তুই।”
“ওর দোষ চোখে পড়লো না? আনিকাকে কেন বার বার টেনে আনতো? কিডন্যাপ হওয়ার পর যেদিন বেঁচে ফিরলাম সেদিন তো দেখা করতে আসতেই পারতো। কেন আসলো না?”
“সব মানুষেরই কিছু না কিছু অতীত থাকে, সেটা যতই কঠিন হোক সবাই চায় সেই ভয়াবহ অতীত পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। শ্রাবণও তাই চেয়েছে। একবার ওর জায়গায় থেকে ভাবতো, যদি তোর সঙ্গে কেউ মিথ্যে অভিনয় করে তোর ভেতরে থাকা সেই মানুষটার অস্তিত্ব মুছে দিতে চায়, যাকে তুই এক সময় ভালোবাসতি, তখন তোর কেমন লাগতো? শ্রাবণ কষ্ট পেয়েছিল মেঘ, সেজন্যই আসেনি।”
“কী বলতে চাইছো? আমাদের মাঝখানে আনিকা কোনো বাধা ছিল না?”
“না। কারণ আনিকা একবার বিশ্বাস ভেঙে ক্ষমা না চেয়ে উলটো শ্রাবণের জীবনকে ঝুলন্ত রেখেই চলে গিয়েছিল, যেটা এখন তুইও করছিস। ভরসা আর বিশ্বাস হয়ে তাকে শক্তি দেওয়ার বদলে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিস। তুই সিলেট থাকা অবস্থায় কতবার যে শ্রাবণ এখানে এসেছে, কতবার আমি ছেলেটাকে অপমান করেছি, চড়-থাপ্পড় মেরেছি তবুও তো শ্রাবণ তোকে চায়। মানুষ মাত্রই ভুল হয় মেঘ, তাইবলে একই ভুল বার বার করে একটা মানুষকে পুরোপুরি নিঃশেষ করার অধিকার কারও নেই।”
“মা, এভাবে বলছো কেন? আমি তো শুধু চেয়েছি, শ্রাবণ আমায় একটু বুঝুক। অথচ ও কিন্তু সেটা করছে না।”
“আর কী করলে বুঝতে পারবি তুই? মেরে ফেলতে চাস ছেলেটাকে? কীভাবে পারিস মেঘ? আজ অন্তত তাকে ওভাবে অপমান না করলেও পারতি। তোর মিথ্যেটাকে হজম করতে ও নাহয় এক মাস ভেবেছিল তাইবলে তুই দুটো বছর তাকে এইভাবে অবহেলা করলি! মানুষ সব সহ্য করতে পারে মেঘ, কিন্তু প্রিয় মানুষের দেয়া অবহেলা সহ্য করতে পারে না। আমি তোর মা, আমি যেমন তোর কষ্ট বুঝি তেমনি শ্রাবণের কষ্টটাও আমার অনুভব হয়। ভেবে দেখ, শ্রাবণের চেয়ে তুই কিন্তু তার কাছে বেশি অপরাধী। তাই আমি চাইবো নেক্সট টাইম শ্রাবণ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তুই নিজে তার কাছে ক্ষমা চাইবি। ও কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই এসেছিল আজকে। তুই কোনো সুযোগ দিসনি তাকে।”

মেঘ কী জবাব দিবে ভেবে পেল না! আসলেই কি সে ভুল করেছে? শ্রাবণ তো তাকে ত্যাগ করেনি, অস্বীকার করেনি শুধু একটু বিশ্বাস ভাঙার জন্যই দূরে সরে গিয়েছিল। সে কী পারতো না, নিজে থেকে সেই বিশ্বাসটাকে আবারও জোড়া লাগানোর চেষ্টা করতে? অথচ নিজের জেদকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে শুধু শুধু এতগুলো দিন শ্রাবণকে কষ্ট দিয়েছে। কী পাচ্ছে এসব করে? তৃপ্তি নাকি যন্ত্রণা? একজনের ভুলে দু’জন কষ্ট পাচ্ছে। এই অভিমান আর জেদের দেয়াল কি ভাঙা যায় না? কী করবে মেঘ! কোনো কূল-কিনারাই যে খুঁজে পাচ্ছে না সে।

খুব সকালেই বেরিয়ে পড়লো মেঘ। সারারাত ভেবেছে। এখন তার মনে হচ্ছে সব কথা সবাইকে বলা দরকার, অন্তত শ্রাবণ সবটা জানুক। কিন্তু যদি সব বলার পরে শ্রাবণ আবার রেগে যায় তখন কী হবে? মোবাইল বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো মেঘ। ওপাশ থেকে তিনি বললেন,
“কেমন আছিস মা? এখন আর আমাকে মনে পড়ে না তাই না?”
“খুব পড়ে। তাইতো তোমাকে দেখতে আসছি।”
“এত সকালে! আমার জন্য নাকি অন্যকিছু?”
“এবার সব বলা উচিত মা।”
“ঠিক আছে আয়। নাশতা খেতে খেতে আলাপ হবে।”

ফোন রেখে সামান্য হাসলো মেঘ। অনেকদিন হলো ও বাড়িতে যাওয়া হয় না। আজ ওখানে যাওয়ার বাহানার পুরনো সব কথাই তোলা যাবে। ভাগ্যে কী আছে তা মেঘ জানে না, শুধু জানে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here