বিনি সুতোর টান #পর্ব-২৪

0
1726

#বিনি সুতোর টান
#পর্ব-২৪
#শারমিন আঁচল নিপা

আমি কিছু বলে উঠার আগেই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। নীল গেইট দিয়ে দৌড়ে ভেতরের দিকে প্রবেশ করল। লক্ষ্য করলাম একটা পাগলের সম্মুখীন হলো। পাগলটা বসে বসে কী যেন আবোল তাবোল করছে। নীল পাগলটাকে ধরে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আমি ক্রমশেই ঘটনা বুঝার চেষ্টা করেও পারছিলাম না। হুইলচেয়ারটা একটু সামনের দিকে এগুলাম। নীল কী বলছে বুঝার চেষ্টা করলাম। নীল বলে উঠছে

“চাচা আপনাকে আমি কত খুঁজেছি। কতবার রেললাইনের কাছে গিয়েছি। একবারও পাইনি। বারবার মনে হত হয়তো আপনি আল্লাহ প্রেরিত ফেরেশতা ছিলেন যে আমার জীবনের মোড় পাল্টে দিয়েছে। তবুও মনে আশা রেখেছিলাম কোনোদিন আপনার সাথে দেখা হবে। তবে আপনাকে এ অবস্থায় দেখব কল্পনা করতে পারিনি। চাচা আপনি আমার সাথে চলুন। ”

পাগলটা কিছুক্ষণ নীলের দিকে তাকিয়ে নীলের কথা শুনল। নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে উল্টা পথ ধরল হাঁটার জন্য। নীল যতই সাথে রাখার চেষ্টা করছে ততই ব্যর্থ হচ্ছে। নীল আর জোর করল না। অবাধে ছেড়ে দিল পাগলটাকে। নীলের চোখে এখনও জল জমে আছে। নীল আমার কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম

“উনি কে ছিলেন?”

“আপনাকে একটা বুড়োর কথা বলেছিলাম মনে আছে। তিনি সেই বুড়োটা। আমার জীবনটা পাল্টে গিয়েছিল উনার কথায়। আজকে এ অবস্থায় দেখব ভাবতে পারিনি। খুঁজ নিতে হবে উনি কোথায় কোথায় থাকেন। এখন শত চেষ্টা করেও কাছে রাখতে পারলাম না। তিনি তার মেয়ের শোকটা এখনও হয়তো ভুলতে পারেনি। সেজন্য হয়তো পাগল হয়ে গিয়েছেন। সেদিন আমার কিছু হলে আমার বাবা, মায়েরও হয়তো এ অবস্থা হত। আমাকে উনি আল্লাহর রহমতে পথ দেখিয়েছেন। আজকের আমির পেছনে উনার অনেক অবদান।”

আমি চুপ হয়ে গেলাম। নীলের কথা শুনে বুঝতে পারলাম নীল সহজে কাউকে ভুলে না। তার জীবনের প্রতিটা অধ্যায় তার মনে আছে। আমি নীলকে মৃদু গলায় বললাম

“সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য যা উত্তম তাই করেন। আপনি মন খারাপ করবেন না।”

“হুমমম। যাইহোক চলুন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আজকে আপনি হাঁটতে পারবেন এটা ভেবে ভালো লাগছে।”

নিরা কেমন যেন চুপ হয়ে আছে। নিরাকে বেশ বিষন্ন লাগে আজকাল। কোনো কাজে মন নেই। সবকিছুতে কেমন যেন উদাসীন। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবতেই সে পছন্দ করে। নিরাকে বিষন্ন দেখে নীল বলে উঠল

“নিরা তোমার কী মন খারাপ? কখন থেকে লক্ষ্য করছি তুমি একদম চুপচাপ কোনো কথা বলছো না। কী হয়েছে জানতে পারি?”

নিরা তেমন কোনো সাড়া দিল না। কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বলল

“না ভাইয়া কিছু না তো।”

নীল আর কথা বাড়াল না। আমাকে নিয়ে সরাসরি হাসপাতালের ইমারজেন্সি রুমে গেল। সেখানে ডাক্তার আমার পায়ের প্লাস্টার খুলে দিয়ে বলল হাঁটার চেষ্টা করতে। টানা ২১ দিন পায়ে এরকম প্লাস্টার লাগানোর পর সেটা এখন খোলার পরও কেমন জানি পা অসাড় লাগছে, ঝিঝি করছে। চাইলেও যেন পা নড়াতে পারছি না৷ নাড়াতে একটু ভয়ও হচ্ছে। ডাক্তার আমার ভয় টের পেয়ে প্রশস্ত মৃদু হাসি দিয়ে বললেন

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পায়ে ভর করার চেষ্টা করে দাঁড়ান। আপনারর কিছু হবে না। আপনার পায়ের পজিশন একদম ঠিক আছে।”

আমি এবার যেন একটু সাহস পেলাম। সমস্ত শক্তি খাটিয়ে পা টা বেড থেকে ফ্লোরে নামিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেই পড়ে যেতে নিলাম। নীল সাথে সাথে এসে আমাকে ধরল। দুজনের চোখ ততক্ষণে দুজনের চোখে আবদ্ধ হয়ে গেল। এ চোখের দিকে তাকিয়ে যেন সহস্র যুগ পারি দেওয়া যাবে। মোহনীয় নেশাক্ত চোখ যেন আমাকে তার কাছে আরও ডাকছে। আমি কিছুটা চুপ রইলাম। নিরা আমাদের নীরবতা ভেঙে দিল। সে নীলকে হালকা হাতে ধাক্কা দিয়ে বলল

“ভাইয়া এবার তো ছাড়ুন। ডাক্তার ম্যামও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সব জায়গায় প্রেম করতে হবে না।”

নিরাকে এতক্ষণ যে বিষন্নতায় ডুবতে দেখেছিলাম এখন যেন সেটায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। ওর কথাটা বেশ প্রফুল্ল লাগছে। বাচ্চা মেয়ে বয়স কম মুড সুইং হওয়া অস্বাভাবিক না। নিরার কথা শুনে নীল নিজেকে সামলে আমাকে আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল

“আমাকে ভর করে হাঁটার চেষ্টা করেন। আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। এত ভয় পেলে চলে নাকি। সাহস সঞ্চয় করুন।”

আমি নিজেকে আরেকটু সামলে এবার পা টা সামনের দিকে এগুলাম। প্রথম দিকে নীলকে ভর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হলেও এখন সেটা হচ্ছে না। এখন ভর ছাড়াই বেশ হাঁটতে পারছি। নিজেকে যেন মুক্ত খাঁচার পাখি মনে হচ্ছে। তাই বেশ দ্রূত পায়ে হাঁটতে লাগলাম। নীল আমার পিছু ডেকে বলল

“আস্তে হাঁটেন। দ্রূত হাঁটতে গিয়ে আবার যেন পা টা না ভাঙে।”

নীলের কথা শুনে ডাক্তার ম্যাম ও হালকা হেসে বললেন

“এবার একটু সাবধানে থাকবেন। যাতে করে আর ডাক্তারের কাছে আসতে না হয়। আপনার জন্য শুভকামনা রইল। কিছু এক্সারসাইজ আছে আমি সেটা প্রেসক্রিপশনে লিখে দিচ্ছি। নিয়মিত সেগুলো করবেন। তাহলে শরীর মন সতেজ থাকবে।”,

আমি উনার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে গেলাম।

অতঃপর ডাক্তার দেখানো শেষ হলো। মনটা বেশ ভালো। পা টা ভালো হয়েছে মানে নীলকে পাওয়ার সময়টাও ঘনিয়ে এসেছে। নীল আমাকে আর নিরাকে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে বসিয়ে বুড়ো লোকটার আরও খোঁজ খবর নিতে গিয়েছে। নিরা আমার সামনে বসা। ওকে আবারও বিষন্ন লাগছে। আমি নিরাকে এবার জিজ্ঞেস করেই বসলাম

” তোকে কেমন আনমনা লাগছে তোর কী কিছু হয়েছে?”

নিরা আমার কথাটাও এড়িয়ে গিয়ে বলল

“আরে আপু কিছু হয়নি।”

আমি ওর কথাটায় আর কোনো কথা বাড়ালাম না। ব্যক্তিগত অনেক কারণ থাকতে পারে হয়তো সেগুলো আমাকে বলতে পারছে না। এ সময়টায় ওকে জোর করাও ঠিক হবে না। তাই আর জোর করলাম না।

নীল ততক্ষণে চলে এসেছে। সবাই বাসায় পৌঁছালাম। আজকে যদিও নীলের বাসায় থাকা হবে না। এখন মনে হচ্ছে পা টা ঠিক হওয়া এত দ্রুত ঠিক হয়নি। অপরদিকে খুব দ্রূত নীলকে পাব সে চিন্তা করে মনে হচ্ছে পা টা ঠিক হয়ে ভালোই হয়েছে।

নীল আমার বাসার দরজার সামনে দিয়ে গিয়ে আমার কানের কাছে এসে বলল

“সাবধানে থেকবেন। নিজের যত্ন নিবেন। সামনের শুক্রবারেই আকদ টা সেরে ফেলব। এ কয়দিনে কাজের প্রেসার কমাতে হবে। তাই সময়ও কম দিতে হবে। মন খারাপ করবেন না যেন।”

আমি সুবোধ বালিকার মতো উত্তর দিলাম

“আপনি আপনার কাজে মনোযোগ দিন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।”

দিন পেরিয়ে রাত নামল। নীলের সাথে ফোনে কথা হচ্ছে। নিরা ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আচমকা একটা আওয়াজ আমার আর বাবার কানে আসলো। আমি ফোনটা রেখে পাশের রুমে দৌঁড়ে গেলাম। নিরাকে ফ্যানে ঝুলতে দেখে জোরে চিৎকার দিলাম। বাবা কোনো রকম চেয়ারে উঠে নিরাকে নামাল। শ্বাসপ্রশ্বাস এখনও চলছে। দ্রূত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। নীলকে কল দিলাম। নীল এসে নিরাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। নীল বের হতেই নিরার টেবিলের উপর আমার নজর গেল। খন্ড কাগজে কিছু লেখা। আমি কাগজটা নিয়ে নীলের পিছু নিলাম। এখন পড়ার সময় নেই। নিরাকে পেছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে আমি আর বাবা বসলাম আর নীল গাড়ি চালাচ্ছে। আমি এবার খন্ড কাগজটা পড়তে লাগলাম। তাতে লেখা।

“প্রিয় নীল
তোমাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ লাগে। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত আমাকে ভীষণ যন্ত্রণা দেয়। আমাকে তুমি এভাবে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতে পারিনি। এতদিনের সম্পর্ক এভাবে নিঃশ্বেস হয়ে যাবে চিন্তা করতে পারিনি। আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছি না তোমাকে ছাড়া। তাই নিজেকে শেষ করে দিলাম।”

লিখাগুলো পড়ে আমার বুক কাঁপতে লাগল। নীল আর নিরার সম্পর্ক ছিল সেটা আমার অগোচরে কীভাবে রয়ে গেল! আর নিরার মধ্যেও কখনও এমন কিছু পায়নি। নীলও আমাকে বলেনি। তাহলে কী আমার সব কিছু জানার আড়ালে ছিল। বিশ্বাসের জায়গাটা ঠন ঠন করে ফেটে গিয়ে বুকটা ভারী হয়ে আমার যেন দম টা আটকে যেতে লাগল।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here