বিনি সুতোর টান #পর্ব-২৫

3
1986

#বিনি সুতোর টান
#পর্ব-২৫
#শারমিন আঁচল নিপা

আমি চিঠিটা ভাঁজ করে নিজের কাছে রাখলাম। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার গলায় কেউ ফাঁস দিয়েছে। এ অবস্থায় নীলকে কিছু জিজ্ঞেস করাও ঠিক হবে না। আগে নিরাকে বাঁচাতে হবে। তারপর নিরার মুখ থেকে সমস্তটা শুনে বিচার বিশ্লেষণ করা উচিত। হয়তো নিরা যাকে পছন্দ করে সে অন্য নীল। এসব ভেবেই নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছিলাম।

গাড়িটা ঢাকা মেডিকেলের সামনে থামল। সাধারণত সুইসাইডের রোগী গুলো প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি নেয় না। তাই ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়েছে নিরাকে। নিরাকে ইমার্জেন্সিতে দিয়ে আমি আর বাবা বাইরে দাঁড়ালাম। এক তো নিরার কী হবে এটা ভেবে হাত পা কাঁপছিল দ্বিতীয়ত নিরার সাথে নীলের কিছু আছে কি’না সেটা ভেবেও হাত পা কাঁপছিল। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা ক্রমশও খারাপ হচ্ছে। নীল একবার ইমারজেন্সি রুমে প্রবেশ করছে আরেকবার করিডোরে আসছে। নীলকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে। নীলের অস্থিরতা জানান দিচ্ছে যে নিরার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পেছনে নিশ্চয় তার কোনো যোগসূত্র রয়েছে। নাকি আমিই একটু বেশি ভাবছি বুঝতে পারছি না। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে আমার। চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে। বাবা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে কোনো কথা বলতে পারছে না। মায়ের মৃত্যুর পর আমরা দুই বোনেই বাবার সকল আবেগের জায়গা জুড়ে ছিলাম। আজকে যেন নিরার এ অবস্থা বাবা মানতেই পারছে না। বাবা বুঝতে পারছে না নিরা কেন এমন টা করেছে। নীল আবারও ইমারজেন্সিতে প্রবেশ করল। কিছুক্ষণ থেকে পুনরায় বের হয়ে বাবাকে বলল চিন্তা না করতে নিরার অবস্থা উন্নতির দিকে৷ বাবার কাছ থেকে সে আমার কাছে আসলো৷ আমার হাতটা চেপে ধরে বলল

“নিজেকে শান্ত করেন নিরার কিছু হবে না। মানসিক প্রেসার থেকে হয়তো এমনটা করে ফেলেছে।”

আমি কেন জানি না নীলের স্পর্শটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছিলাম না। শরীরটা আমার জ্বলে যাচ্ছিল৷ চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছা করছিল

“আপনার কি নিরার সাথে কিছু আছে?”

তবে শত চেষ্টা করেও বলতে পারলাম না। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। বারবার মনে হচ্ছিল আরেকটু যাচাই করে নীলকে বলি। নিরা সুস্থ হোক আগে। তারপর নাহয় নিরাকেই জিজ্ঞেস করব সব। হাজারটা ভাবনা প্রশ্ন আর যন্ত্রণা আমাকে ঘিরে ধরল। এর মধ্যেই নীল আবারও বলে উঠল

“আপনি এদিকে সামলান আমি একটু বাসা থেকে এখনই আসছি। একটু জরুরি কাগজ ফেলে এসেছি।”

বলেই নীল হাসপাতাল থেকে বের হলো। এদিকে যতই নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করছি ততই যেন আমাকে চিন্তা আরও ঘিরে ধরছে। আমি নিজেকে সামলাতে চেয়েও পারতেছি না। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে মন চাইলেও কান্নাটাকে দমিয়ে রাখছি। মনে হচ্ছে বিশ্বাসের ঘরটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

করিডোরে নার্স এসে ডাকতে লাগল

“আঁচল কে?”

আমি চমকে উঠে উত্তর দিলাম

“আমি কিন্তু কেন?”

“আপনার রোগীর জ্ঞান ফিরেছে আপনাকে ডাকছে। ভেতরে আসুন।”

বাবা নার্সের কথা শুনে দ্রূত বসা থেকে উঠল। আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইলে নার্স বাঁধা দিয়ে বললেন

“দুজন যাওয়া যাবে না শুধু একজন যেতে হবে। ”

বাবা অসহায় চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি বাবার ক্রন্দনরত চোখগুলো দেখে বলে উঠলাম

“বাবা তুমিই নাহয় নিরাকে দেখে এসো। আমি পরে যাচ্ছি।”

বাবা চোখের পানি মুছে আমাকে উত্তর দিল

“তুই যা তাহলেই ভালো হবে। ও তোকে মন খুলে সব বলতে পারবে। আমি তো ওর বাবা হয়তো সব কথা আমাকে বলতে ওর লজ্জা লাগবে৷ তুই তো ওর বোন একমাত্র বন্ধু। তুই গিয়ে একটু কথা বল। ওর ভালো লাগবে।”

বাবার কথা শুনে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। একজন বাবা তার সন্তানদের কতটা ভালোবাসতে পারে সেটা বাবাকে না দেখলে হয়তো কোনোদিন জানতে পারতাম না। অবশেষে বাবাকে বাইরে রেখে আমি রুমে গেলাম। নিরা বসে আছে। আমি নিরার কাছে যেতেই সে জড়িয়ে ধরল। আমি কোনো কথা বলতে পারছি না। চোখ গড়িয়ে শুধু পানি পড়ছে। ভাবতে লাগলাম নিরাকে কী চিঠিটার কথা জিজ্ঞেস করব নাকি করব না। কিন্তু এর আগেই নিরা বলে উঠল

“আপু নীলকে ছাড়া আমি বাঁচব না।”

নিরার কথা শুনে আমি চমকে গেলাম সে সাথে তাকে প্রশ্ন করার একটা সুযোগও পেলাম। আমি চটপট বলে উঠলাম

“কোন নীল নিরা।”

“আমাদের বাসায় যে নীল থাকে। ভালোবেসে তাকে আমি অভ্রনীল বলে ডাকি। আমাদের তিন বছরের সম্পর্ক। হুট করে সে আমায় রেখে চলে গেল। আপু আমি কিছুই মানতে পারছি না। বাবাকে কিছু বলো না প্লিজ৷ তুমি শুধু সারাজীবনের জন্য নীলকে পাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।”

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। নীল আমার কাছে এত কিছু লুকাল। আর নিরায় বা কেন এতদিন সব বলেনি। এখন নিরাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে আরও বেশি দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে। এর মধ্যে ডাক্তার এসে আমাকে বললেন

“আপনার রোগীকে নিয়ে যেতে পারেন। আপাতত কোনোরকম প্রেসার দেওয়া যাবে না। বাকি কথা নীল সাহেবের সাথে বলতে বলেছেন আমি উনাকে বাকি সব ডিটেইলস বলব। নীল সাহেব নিরার আগের রিপোর্ট গুলো আনতে গিয়েছেন। আপনারা চাইলে নিরাকে নিয়ে যেতে পারেন।”

ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটায় আবারও কম্পন দিতে লাগল। নীল নিরাকে এর আগেও ডাক্তারের কাছে এনেছিল কি’না বুঝতে পারছি না। নিরার কী এমন রিপোর্ট নীলের কাছে আছে আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আমি নিরাকেও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছি না আর নীলকেও এখন সরাসরি যাচাই না করে ধরতে পারছি না। সব মিলিয়ে নিজের কাছেই নিজেকে বেশ ছন্নছাড়া লাগছে৷ এর মধ্যেই নীল চলে আসলো। লক্ষ্য করলাম নীলের হাতে কিছু কাগজ। সে কাগজগুলো নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন৷ ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে নিরাকে ধরে বাইরে বের হলেন। বাবা নিরাকে দেখে অজোরে কাঁদতে লাগল। নিরার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। নীলের হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে সে৷ আমার কলিজাটা যেন দ্বিখন্ডিত হতে লাগল৷ আপনাআপনি চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় আসলাম। নিরাকে ঘরে রেখে নীল বের হতে নিল৷ বাবা নিরার পাশে ঠাঁই বসে আছে৷ আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নীলকে বের হতে দেখে আমিও তার পিছু নিলাম। নীলের সারা মুখে চিন্তার ভাঁজ লেপ্টে আছে সেটা তার মুখ দেখে বেশ ভালো বুঝা যাচ্ছে৷ নীল এগুতে এগুতে মূল দরজার সামনে গিয়ে দরজা খুলতে নিল৷ আমি নীলের পিছু ডেকে বলে উঠলাম

“নিরার কাগজপত্র গুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? বাসায় রেখে যান এগুলো।”

সাবলীল গলায় নীল উত্তর দিল

“এগুলো রেখে গেলে আপনারা কিছু বুঝবেন না৷ আমি সময় মতো ডাক্তারকে দেখিয়ে সবটা গুছিয়ে নিব৷ আপনারা একটু রিলাক্স থাকুন। আশাকরি নিরা এখন আর কোনো পাগলামি করবে না।”

“তা একটু বসে যান।”

“আজকে আর না। কাল এসে বসব। আপনি নিজের যত্ন নিবেন।”

কথাগুলো খাপছাড়া ভাবে বলে নীল বাসা থেকে বের হলো। সাধারণত ফোনে কথা বলার সময়ও নীল যে প্রফুল্লতা নিয়ে কথা বলেছিল নিরার কাহিনি ঘটার পর নীলের মনোযোগ যেন আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে সে প্রফুল্লতা ম্লান হয়ে গেল৷ আমি এখনও বুঝতে পারছি না আমার জীবনের মোড় কোন দিক নিল। রুমে এসে লক্ষ্য করলাম নিরা ঘুমিয়ে পড়েছে৷ বাবা তার পাশেই বসে আছে। আমি আর তাদের বিরক্ত করলাম না। এবার নিজের রুমে এসে নীলকে কল দিলাম। নীলের মোবাইলটা বন্ধ। নিজেকে অনেকটা শান্ত করার চেষ্টা করেও পারছিলাম না।

সারাটা রাত পার করলাম অসহনীয় যন্ত্রণায়। চিন্তায় যেন হাত পা কাঁপতে লাগল। শরীর অসাড় হয়ে গেছে৷ সকালটা শুরু হয় যন্ত্রণা কাতর অনুভূতি নিয়ে। অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। নীল হয়তো ছাদে গিয়েছে। আমি নিজের রুমে আর মন টেকাতে পারলাম না। সরাসরি নীলের বাসায় গেলাম। নীলের রুমের দরজাটা খোলা পেয়ে রুমে প্রবেশ করলাম। নিরার সেই কাগজগুলো টেবিলের উপর। আমার মনে তীব্র কৌতুহল জাগল কাগজ গুলো ঘেটে দেখার জন্য। আমি হাতে কাগজগুলো নিয়ে ঘাটতে লাগলাম। প্রতিটা কাগজ দেখার পর থেকে আমি আরও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলাম। নিরার এবর্সন রিপোর্ট । আমার কলিজা কাঁপতে লাগল পুনরায়।

চলবে?

3 COMMENTS

    • গল্পটা অনেক ইন্টারেস্টিং আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে কিন্তু এর পর কি হলো?পরের পার্ট দিবেন কবে। অপেক্ষায় রইলাম গল্পটা শেষ না হওয়া অব্দি শান্তি পাচ্ছি না।

  1. গল্পটা অনেক ইন্টারেস্টিং আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে কিন্তু এর পর কি হলো?পরের পার্ট দিবেন কবে। অপেক্ষায় রইলাম গল্পটা শেষ না হওয়া অব্দি শান্তি পাচ্ছি না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here