#এক_চিলতে_রোদ,Part_36,37
#Writer_Nondini_Nila
#Part_36
আইসক্রিম হাতে গাড়িতে উঠে বসলাম। ভাইয়ার হাতে আরেকটা ব্যাগ। আমি আড়চোখে তাকিয়ে আছি ব্যাগের দিকে। ভাইয়া ব্যাগ তার হাটুর উপর রেখে আমার পাশে বসে পরলো চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিলো।
আমি কাগজে মুড়ানো বড় ব্যাগটার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছি।
“আইসক্রিম গলে পানি হয়ে গেলো তো।”
আচমকা ভাইয়া কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম। আর নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলাম।
ভাইয়া চোখ মেলে তাকালো আর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তারাতাড়ি খাওয়া শেষ কর।”
আমি ভাইয়া দিকে মুখ তুলে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। আইসক্রিম এর কাগজ খুলে মুখে দিতে যাব তখন মনে পরলো ভাইয়া নিজের জন্য কিনলো না। সে কি খাবে না। আমি কি জিজ্ঞেস করবো বা সাধবো একটু আমার এখানে থেকে খাওয়ার জন্য। ভাবতে ভাবতে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মিনমিন গলায় বললাম,
“ভাইয়া আপনি আমার এখানে থেকে আইসক্রিম খাবেন একটু? আমি এখনো খাইনি একটু নিতে পারেন।”
ভাইয়া আমার কথা শুনে বলল,
“আমার খাওয়ার হলে কিনেই আনতাম। আনিনি যখন খাবো না।”
আমি আর কিছু বললাম না। নিজের মতো খেতে লাগলাম। আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। বাইরের শব্দ করে চলে যাওয়ার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবছি ওই ব্যাগে কি আছে? ভাইয়া কি নিজের জন্য কিছু কিনেছে? হবে হয়তো! নিজের মনে প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে নিলাম।
আইসক্রিম খাওয়া শেষের দিকে। আর একটু আছে। আমি একবারই সব টুকু মুখে পুড়তে যাব তখন কেউ ছিনিয়ে নিলো আমার হাত থেকে আইসক্রিম।আমি হতবুদ্ধি হয়ে ভাইয়ার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালাম। ভাইয়া আমার এঁটো আইসক্রিমের বাকি টুকু নিজে খেয়ে নিলো। আমি বিস্মিত হয়ে বড় চোখে তাকিয়ে আছি ভাইয়ার দিকে। তিনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে। আমার চোখে মুখে চরম বিষ্ময়।
ভাইয়া আমার বিষ্ময় টুকু কাটালো ও না উল্টা আমার এমন গোল গোল বড় চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমক সুরে বলল,,
” হোয়াট হ্যাপেন্ড? এমন বড় চোখ করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, ” আপনি আমার খাওয়া আইসক্রিম খেলেন কেন?”
“আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি খেয়েছি। এতে তোর সমস্যা কোথায়?”
আমি অবাক গলায় বললাম, ” আপনার এমন ইচ্ছে কেন হলো?”
“ঊষা বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করিনা। টায়ার্ড লাগছে আমার। কথা বলা অফ কর। তোর তো ক্লান্তি টান্তি কিছু নাই।”
বলেই আবার সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছু ক্ষন। তারপর নিজে থেকে বিরক্ত হয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম।
ভাইয়া আর কথা বললো না। বোধহয় ঘুমিয়ে পরেছে। আমি উশখুশ করে বসে আছি। আমার কেমন জানি লাগছে। ভাইয়া আমার খাওয়া আইসক্রিম খেলো ভাবতেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে।ছটফট করতে করতে স্কুল এ এসে পৌঁছালাম। ভাইয়া একহাতে তার ওই ব্যাগ ও আরেক হাতে আমাকে ধরে নিচে এলো। আমি নিশার সাথে জরাজরি করে কথা বলে নিলাম। আবার কবে দেখা হবে কে জানে! নিজের বাড়ি থাকলে যেতে বলতাম কিন্তু আমার তো তাও নাই। কিন্তু নিশা ওর বাসায় আমাকে গিয়ে থাকতে বললো।
সবার সাথে একটু আধটু কথা বললাম। তারপর অটোতে করে বাসার গেইট এ নামলাম। ভাইয়া ভাড়া মিটিয়ে আমার হাতে তার কাগজে মুড়ানো ব্যাগটা দিলো। আমি আতকে উঠে বললাম,
“এটা আমাকে দিচ্ছেন কেন?”
“তোর জিনিস তোকে দেবো না তো আমি রেখে দেবো নাকি?”
“আমার জিনিস?” অবাক গলাতে বললাম।
“হুম তোর জিনিস।”
“আমার জিনিস কিভাবে ? এটা তো আপনার কাছে ছিলো। আপনি বোধহয় কিনেছেন। সেটা আমার কি করে?”
“উফফ সব কিছুতেই তোর এতো কথা। আমার বিরক্ত লাগে ঊষা। প্লিজ কথা না বলে এটা নিয়ে নিজের ঘরে যা। ”
বলেই বড় বড় পা ফেলে আমার সামনে দিয়ে বাড়িতে ঢুকলো ভাইয়া ।আমি হতভম্ব হয়ে ব্যাগ নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলাম। আসার সময় সোফায় বসে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চাচির দিকে আমার নজর ঠিকই পরেছিলো। আমি মাথা নিচু করে রুমে এসেছি কোন কথা বলিনি।
রুমে এসেই ফাইল এক পাশে রেখে ব্যাগ নিয়ে বসলাম।কি আছে এতে এটা আমার জিনিস কি করে ? আমি কাগজ খুলতেই মৃদু চেঁচিয়ে উঠলাম উত্তেজনায়। সাথে সাথে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম।আনন্দে আমার গলার দিয়ে জোরে আওয়াজ বেড়িয়ে গেছিলো।
আওয়াজ করলে বিপদ চাচির ধমক খেতে হবে। তাই নিজেকে কন্ট্রোল করে হা করে নিজের পছন্দের জিনিস এর দিকে তাকিয়ে আছি। এতো গুলো চুড়ির মাঝে সাদা রঙের চুড়ি হাতে নিলাম। এটাই তো কেনার জন্য কতো অনুরোধ করেছিলাম কিন্তু দেয়নি। আর এখন এটার সাথে আরো কতো চুড়ি আমার সামনে। এই সব চুড়ি আমার। আনন্দে আমার চোখে জলে ভর্তি হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে ভাইয়া একটা চুড়ির দোকান আমাকে দিয়েছে।
এতো চুড়িতে তো সারা জীবন চলে যাবে আমার। আমি উজ্জ্বল মুখে সব দেখছি ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
এদিকে দরজার আড়াল থেকে সব কিছু দেখলো ইহান। মুখে এই হাসি দেখার জন্য ইহান সমস্ত চুড়ি কিনে এনেছে দোকান থেকে।এখন ও তা দেখতে পাচ্ছে। ঊষার আনন্দের হাসি। যা দেখে ওর ঠোঁটের কোনে ও হাসি চলে এলো অজান্তেই।
বিকেল ভর ঘুমিয়ে কাটালো ঊষা।
রাতে চুপিচুপি ইহানের রুমে এলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছি। রুমে ভাইয়া নাই। কিন্তু তার সেই মনমুগ্ধ কর কন্ঠে গান ভেসে আসছে। বারান্দায় আছে ভাইয়া। গানের সুর শুনেই তো ঊষার আগমন এখানে। অপূর্ব গায় ভাইয়া একদম মনটা ভালো হয়ে যায়।
বেলকনির দরজা এসে দাড়াতেই ভাইয়া গান অফ করে দিলো। আমি চমকে উঠলাম। বুঝে গেলো নাকি আমি হাত উঁচু করে মুখে কাছে নিতে যাব। তখন ঝুনঝুন শব্দ শুনে থমকে গেলাম। চুড়ির শব্দ। আমি যে চুড়ি পরেই এসে পরেছি মনেই ছিলো না। তার মানে এই শব্দ শুনে ভাইয়া বুঝে গেছে আমি এখানে। ভয়ার্ত মুখ করে দাড়িয়ে আছি। এই বুঝি একটা ধমক খাবো কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।
ভাইয়া খুব শান্ত গলায় আমাকে ডাকলো কাছে।
আমি কাচুমাচু মুখ করে এগিয়ে গেলাম।ভাইয়া আমাকে তার পাশে বসতে বললো। আমি চমকে উঠে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়ার মুখ আবসা অন্ধকারে হালকা দেখা যাচ্ছে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি ভয়ার্ত গলায় বললাম,
“আমি আসলে গান শুনতে পেয়ে এসেছি…
আমার কথার মাঝে থামিয়ে বলল, ” তোকে কি জিজ্ঞেস করেছি কেন এসেছিস ? তাহলে বলছিস কেন? বসতে বলেছি বস।”
আমি ঢোক গিলে বসে পরলাম। ভাইয়া তার গিটার বাজাতে লাগলো সাথে গান ও আমি বিস্মিত হয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে বসিয়ে গান গাইবে ভাবিনি।
“রাতের সব তারা আছে দিনের গভীর এ বুকের মাঝে মন যেখানে রাখবো তোকে সেখানে
তুই কি আমার হবি রে,(২)
মন বারিয়ে আছি দাড়িয়ে তোর হৃদয় এ গেছি হারিয়ে, তুই জীবন মরণ সবই রে, তুই কি আমার হবি রে।…….
আমি ভয় ভুল মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে গান শুনছিলাম। ভাইয়া গান শেষ করেই গিটার পাশে রেখে আমার দিকে এগিয়ে এলো আমি হকচকিয়ে গেলাম। ভাইয়া আমার হাত টেনে নিয়ে চুড়ি পরা হাতে দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো। ভাইয়া তার দুহাতের মাঝে আমার হাত ধরে রেখেছে।
বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। হঠাৎ মনে পড়ল আমার হাতে আংটি নেই আমি চমকে হাত টেনে নিয়ে নিলাম। ভাইয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
আমি হাত বুকে চেপে উঠে দাঁড়ালাম।
‘আমি যাই।”
বলেই বেলকনির দরজার কাছে গিয়ে আবার পেছনে তাকিয়ে বললাম,
“অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আমার পছন্দের জিনিস দেওয়ার জন্য।”
বলেই এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলাম না ছুটে রুমের বাইরে চলে এলাম।
ভাইয়া আংটি না দেখতে পেলেই এই নিয়ে ঝামেলা করতো একটুর জন্য বেঁচে গেছি।
আমি সিড়িতে পা দিতে যাব তখন কারো হাত নিজের চুলের মুঠিতে পেলাম। সে আমার চুল শক্ত করে ধরেছে যার ফলে আমার ব্যাথা লাগছে। আমি মৃদু চিৎকার করতে যাব তখন চাচির ককর্শ গলায় আওয়াজ কানে এলো,
“একদম শব্দ করবি না। ”
চাচির আওয়াজ শুনে আমি থমকে গেলাম।আমার মুখের আওয়াজ অফ হয়ে গেলো। চাচি টেনে হেঁচড়ে আমাকে আমার রুমে এনে ধাক্কা মারল আমি ফ্লোরে পরে গেলাম। মাথায় আঘাত ও পেয়েছি। চাচি দরজা আটকে আমার কাছে এলো আর আবার আমার চুলের মুঠি ধরে বললো,,
“আমার ছেলের রুমে এতো রাতে কি করছিলি? ”
ব্যাথায় আমার চোখ দিয়ে পানি পরছে। আমি অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছি চাচির দিকে। ঠোঁট কামড়ে ধরে ব্যাথা সহ্য করছি।
চাচি বললো আবার,
” ওইদিন বললাম না আমার ছেলের কাছে যাবিনা। ওকে এরিয়ে চলবি। কিছু করিসনি উল্টো আরো বেশি করে যাস লজ্জা করেনা এসব করতে। রাতে গিয়ে কি করছিলি। এই ভাবে নিজের শরীর দেখিয়ে আমার বোকা ছেলেকে নিজের বশ করতে লজ্জা করে না নির্লজ্জ বেহায়া। তোর কোন যোগ্যতা আছে আমার ছেলের বউ হবার। ”
চাচির আমাকে ইচ্ছা মতো বকলো তারপর চলে গেলো। হাতের চুড়ি কয়েকটা ভেঙে হাতে ঢুকে গেছে। আমি হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছি।
মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে।
পরদিন আমি বেলা করে উঠলাম। আর উঠে চমকে গেলাম। আমার হাত ধরে বসে আছে ভাইয়ার তাকে এলোমেলো লাগছে দেখতে। চোখ দুটো লাল টকটকে তার সে চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তাকাতেই উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল আমি কেমন আছি? আমার কেমন লাগছে।
আমি উঠার চেষ্টা করে বুঝলাম আমার সারা শরীর ব্যাথায় আচ্ছন্ন। মাথাও চাপ ধরা ব্যাথা । হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি ব্যান্ডেজ করা। ভাইয়া সেই হাতে বার কয়েক চুমু খেতে দেখিছি চোখ মেলে।
আমার কাল রাতে ফ্লোরে বসে থাকার কথা মনে পরছে আর কিছু মনে পরছে না। ভাইয়া এখানে কিভাবে? আমার ভাবনার মাঝে চাচি এলো থমথমে মুখ করে আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে ভাইকে ফোন দিয়ে বললো,
“ইমা কল করেছে?”
ভাইয়া কেমন জানি করে তাকিয়ে ফোন নিলো হাতে। চাচি রেগে আবার যেমন করে এসেছিলো তেমন করেই চলে গেলো। তখন লতা হাতে খাবার নিয়ে এলো। আর আমার সামনে রাখলো। ভাইয়া ফোন নিয়ে উঠে কথা বলতে লাগলো। আমি লতার দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম এসব কি?
ও যা বললো তাতে হতভম্ব। কাল রাতে চাচি চলে যাওয়ার পর ভাইয়া আমার রুমে এসে আমাকে ফ্রোরে পড়ে থাকতে দেখে চেঁচিয়ে উঠে।
তার জোরে চেঁচিয়ে উঠা শুনে লতা সহ সবাই আসে।
আমার নাকি তখন জ্ঞান ছিলো না।পানি দিয়েও উঠিনি। হাতের আঘাত দেখে ভাইয়া চাচির উপর চেঁচামেচি করতে লাগে। তারপর ডাক্তারকে সেই এগারোটার সময় ফোন করে বাসায় আনে। ডাক্তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে যায়।আমার শরীর এ নাকি জ্বর চলে আসে। ভাইয়া সারা রাত আমার পাশে জেগে হাত ধরে বসে ছিলো জল পট্টি দিয়েছে।
তখন আবার আরেক চেঁচামেচি শুরু হয় আমার হাতে আংটি নেই দেখে। চেঁচামেচি শুনে ভয়ে চাচি আংটি নিজে থেকেই এনে দিয়ে দেয়।
তা দেখে চাচি কে ইচ্ছে মতো কথা শুনায় ভাইয়া। কোন সাহসে আংটি আমার কাছে থেকে নিয়েছে এই নিয়ে অনেক ঝামেলা হয় রাতে।
ভাইয়া এগিয়ে আসতেই লতা আমার কাছে থেকে উঠে চলে গেলো। আমি হতভম্ব হয়ে হাতের আঙ্গুল এর দিকে তাকিয়ে আছি।
#চলবে
#এক_চিলতে_রোদ
#Writer_Nondini_Nila
#Part_37
ভাইয়া এসে আমাকে ধরে বালিশে হেলান দিয়ে বসালো। আমি ভয়ার্ত মুখ করে তাকিয়ে আছি ভাইয়ার দিকে। আমার হাত সাবধানে হাঁটুর উপর রেখে দিলো ভাইয়া। আমি অসহায় মুখে চেয়ে আছি তার মুখ পানে। এখন আমাকে ধমক খেতে হবে সেটা আমি সিউর। আমি চোখ ভাইয়ার থেকে সরিয়ে হাতের দিকে দিলাম। ভাইয়ার পরিয়ে দেওয়া আংটি আমার হাতে চিকচিক করছে।
আংটিটা চাচি নেওয়ার পর আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
এই সামান্য আংটির জন্য আমার এতো কষ্ট কেন হচ্ছিলো আমি বুঝতে পারিনি। এখন সেই কষ্ট অনুভব করতে পারছি না। আংটিটা আবার পাওয়ার জন্য কি ছটফটানি কমছে।
ভাইয়াকে আংটি নেওয়ার ব্যাপারে না জানানোর জন্য আমাকে বকবে জানি। আচ্ছা শুধু কি বকবে নাকি মারবে ও। আমি আবার ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভয় হচ্ছে খুব আমার। ভাইয়া দিকে বিস্মিত হলাম।
ভাইয়া আমার দিকে না তাকিয়ে আছে রেগে । আর না রেগে আছে। না বকার চেষ্টা করছে। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই খাবারের প্লেট নিজের দিকে নিয়ে খাবার মাখতেছে। আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া আমাকে বকছে না কেন?
ভাইয়া খাবার মেখে আমার মুখের সামনে ধরলো। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি চোখ বড় করে।
“এমন বড় চোখ করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
আমি চমকে মাথা নিচু করে ফেললাম। ভাইয়া এতো অবাক কেন করে আমাকে। তাহলে কি বকবে না? আমি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
ভাইয়া তখন বললো,” মাথা নিচু করে বসে না থেকে খাবার শেষ কর।”
আমি চকিতে মাথা তুলে তাকালাম।
“আপনি খাবার দিচ্ছেন কেন? আমি নিজেই খেতে পারবো আপনার খাইয়ে দিতে হবে না।”
আমার কথা শুনে ভাইয়া রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” থাপ্পড়িয়ে গাল লাল করে ফেলবো তোর ইডিয়েট! এই হাতে নিজে খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছিস?”
আমি ভাইয়া কঠিন গলার স্বর শুনে চুপসে গেলাম। আর কিছু বলতে পারলাম না। ভাইয়ার হাতে আমাকে খাবার খেতে হলো। খাওয়া শেষ হতেই ভাইয়া আমাকে পানি খাইয়ে দিলো। ওষুধ খাইয়ে দিলো তারপর ব্যাসিং এ গিয়ে হাত ধুয়ে এলো। আমি তখন শুধু ভাবছি ভাইয়া আমাকে বকলো না কেন? আমার চিন্তার মাঝে ভাইয়া আওয়াজ আমার কানে এলো আমি চমকে উঠলাম।
“এতো কিছু কোন সাহসে আমার থেকে আড়াল করেছিস?”
ভাইয়ার গম্ভীর গলায় বলা কথা শুনে আমার হাত পা কাঁপতে লাগলো।
যেই ভয় এতোক্ষণ পাচ্ছিলাম এখন তাই হলো। কিন্তু দেরিতে আমি নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁপছি। ভাইয়া আমার সামনে বসে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আমি জানি। আমার সেই রাগী চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না।
এতো সাহসী তো আমি না।
“এ্যান্সার মি ঊষা। তুই আমার থেকে এসব লুকালি কোন সাহসে? আমার দেওয়া আংটি আম্মু তোর থেকে কেড়ে নিলো আর তুই চুপ করে দেখলি। কোন প্রতিবাদ করলি না কেন? এটা আমার জিনিস আমি তোকে দিছি এখন তোর আর তোর জিনিস কেউ নিয়ে নিলো তুই চুপ করে হাত পা গুটিয়ে বসে রইলি। এমন হলে দেখবি একদিন আমাকেও কেউ তোর থেকে নিয়ে নিবে আর তুই চুপ করে দেখবি।”
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাইয়ার কথা শুনছি। ভাইয়ার গম্ভীর গলায় কথা শুনে কেপে কেপে উঠছি। ভাইয়ার শেষের কথা শুনে থমকে মাথা উঁচু করে তাকালাম। না চাইতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো আমার। ভাইয়া রাগে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। আমি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছি ভাইয়া দিকে ঢোক গিলে।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ” আমি চাইনি এটা নিয়ে আবার ঝামেলা হোক, ঝগড়া হোক। এসব আমার ভালো লাগে না। আমার জন্য চাচির সাথে আপনার দ্বন্দ্ব দেখতে একদমি ভালো লাগে না। ”
ভাইয়া বললো, ” তোর কি মনে হয় এটা না বললেই আম্মু সব ভুলে চেঁচামেচি অফ করে দিবে। তোর সাথে লাগবে না। আচ্ছা তুই তো আংটির কথা বলিসনি তাহলে কাল মার খেলি কেন?”
আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমি জানি এসব চাচি করবেই। কেননা আমাকে সহ্য করতে পারে না। এখন ভাইয়া এসবের মধ্যে এখন আরো রেগে আমার উপর চাচি। কাল তো ভাইয়ার রুমে যাওয়ার জন্য। আমার চোখ ছলছল করে উঠলো মায়েদের মতো একটু ভালোবাসলে কি হতো চাচির?
“কি হলো কথা অফ হয়ে গেলো কেন? আম্মুর সাথে আমার ঝামেলা নিয়ে আর কখনো ভাববি না। আর কখনো নিজের জিনিস কাউকে কেড়ে নিতে দিবি না বুঝেছিল?”
আমি চোখ ভর্তি জল নিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,, ” আমার কি কিছু আছে যে কাউকে নিতে দেবো না।”
ভাইয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর আমার গালে নিজের হাত ডুবিয়ে দিয়ে বললো,
” কিছু না থাকলেও যেটুকু আছে তাই আগলে রাখার চেষ্টা করবি। কাউকে নিতে দিবি না। এই আংটিটা তো তোর হয়ে গেছে এটা কেন নিতে দিলি। আটকাতে পারতি না তুই। পারতি, কিন্তু চেষ্টা করিস নাই।সব কিছু সহ্য করিস বলেই সবাই তোকে ইচ্ছে মতো কষ্ট দিতে পারে কিন্তু যদি প্রতিবাদ করতি তাহলে এসব হতো না।”
আচমকা আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম শব্দ করে।
ভাইয়া আমার কান্না দেখে ঘাবড়ে গেলো।
উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো কি হয়েছে?
আমি কান্না গলায় থেমে বলতে লাগলাম,
” আমি সত্যি নিজের জিনিস রাখতে পারিনা। সব হারিয়ে ফেলি। এই যেমন, মাম্মা বাপি কে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। কোন দিন তাদের পাবো না। চিরদিনের জন্য আমাকে এই পৃথিবীতে একা রেখে চলে গেছে। আমি তাদের নিজের কাছে রাখতে পারিনি। চাচি তো ঠিকিই বলে আমি রাক্ষসী নিজের বাবা মা কেও বাঁচতে দেয়নি। ”
ব্যাথা হাত উঠিয়ে মুখে চেপে ধরে কান্না করছি। বুকটা ফেটে কান্না আসছে। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে আমার? এতোটা আপন বিহীন এই পৃথিবীতে আমার এখন বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। ইহান ভাই এগিয়ে আমার হাত সরিয়ে দিলো মুখে থেকে আর শান্ত হতে বললো। আমি পারছি না থামতে আমার কান্না আজ থামতেই চাইছে না।
কান্নার মাঝেই আমার মাথা ঘুরাতে লাগল আমার আর কিছু মনে নাই।
কাল মাথায় আঘাত পেয়েছি আর তার মাঝে শরীর এ জ্বর তাই কান্নার ফলে আমি জ্ঞান হারিয়েছি।
জ্ঞান ফিরে রুমে একা পাই নিজেকে। আমি আসতে আসতে উঠে বসতেই লতা আসে আর বলে ভাইয়া অফিসে গেছে। আমাকে বিছানা থেকে উঠতে বারন করেছে।
আমি উঠে গোসল করলাম । খাবার লতা খাইয়ে দিলো ওষুধ খেয়ে আবার শুয়ে পরলাম। শরীর ব্যাথা নরতে ইচ্ছে করে না। রাতে ভাইয়া বাসায় এসে অফিসের পোশাক পরেই আমার রুমে এলো। আর আমার মাথা হাত দিলো। আমি তখন জেগে চোখ বন্ধ করে ছিলাম। ভাইয়ার স্পর্শে আমি চোখ মেলে তাকালাম। ভাইয়ার আমার গালে হাত দিয়ে বললো,
“এখন কেমন লাগছে? জ্বর তো কমেনি ডাক্তার ডাকবো?”
ভাইয়া খুব নরম গলায় বললো। আমি কথা বললাম না চুপ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ভাইয়ার দিকে। এই মানুষটি চোখে আমার ব্যাথা কষ্ট দেখতে পায়। দেখতে ভালো লাগে কেউ আমার জন্য কষ্ট পায়। আমাকে নিয়ে চিন্তা করে। খুব ভালোলাগে।
জ্বর বেড়েছে অনেক আগেই আমার দুপুরে খাওয়ার পর থেকে এই ভাবেই শুয়ে আছি তাকাতে পারিনি। এখন ও কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। ভালো লাগছে তাকিয়ে থাকতে।
ভাইয়া আমার আওয়াজ না পেয়ে কিছু বললো না। লতা বলে হাক ছেড়ে ডেকে উঠলো। লতা দৌড়ে আসলে ভাইয়া ওকে আমার কাছে রেখে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ভাইয়া গেঞ্জি আর ট্রাইজার পড়ে এলো চুলে পানি। গোসল করেই এসেছে বুঝা যাচ্ছে।
ভাইয়া লতাকে দিয়ে পানি আনিয়ে আমার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলো। কাউকে কল করে বললো আমার কথা সে কি বললো জানি না ভাইয়া কথা শেষ করে খাবার স্যুপ খাইয়ে দিলো আমাকে। আরেকটা কথা এইটা ভাইয়া নিজে বানিয়েছে আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ভাইয়ার দিকে। আমার জন্য খাবার তৈরি করলো। আমি থমকে খাবার খেয়ে নিলাম। রাতে ভাইয়া আমার মাথার কাছেই বসে রইলো। আমি যতক্ষন জাগানা ছিলাম তাই তো দেখেছি। হয়তো আমি ঘুমানোর পর চলে গেছিলো।
সকালে ভাইয়া কে আর দেখিনি। আমার জ্বর কমে এসেছে ।আমি রান্না ঘরে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে কাজ করতে।
লতা অবাক হয়ে বললো,’তুই এখানে কেন?’
‘কাজ করবো না এইভাবে বলছিস কেন?’
‘ তুই কাজ করবি কেন? আল্লাহ ভাইজান জানলে কিন্তু খবর আছে তোর শয়তান চাচি আবার বলেছে তাইনা!’
আমি বললাম, ‘না আমি নিজে থেকেই এসেছে।’
‘ হায় হায় কেন? চলে যা ভাইজান কিন্তু কাজের লোক রেখেছে এতো কাজ নাই এখন। তুই এখানে এসে বকা খাস না।এমনিতেই জ্বর তোর।’
‘ কিছু হবে না এমন জ্বর গায়ে কতো কাজ করেছি হিসেব নাই।’
‘ হুম এখন তো তোর কাজ করা মানা তুই এই বাড়ির হবু বউ ভুলে গেছি। ভাইজান কিন্তু রাগ করবে? ‘
‘করুক আমি তো পরিক্ষার জন্য কাজ থেকে দূরে থেকেছি। তাই বলে সারাজীবন এর জন্য নাকি? আমাকে তো করতেই হবে।’
কাজ করা থেকে লতা আমাকে আটকাতে পারলো না। আমি তেমন কাজ পেলাম না তাই থালাবাসন ধুয়ে নিলাম। লতা ঝাড়ু দিতে চলে গেলো রেগে মেগে।
আরেকটা কাজের মহিলা তার বয়স বেশি তিনি রান্নার যোগার করছেন।
হাতের গা শুকিয়ে গেছে হাল্কা ব্যাথা থাকলেও তাই কাজ করতে পারছি। চাচি কটমট করে তাকিয়ে ছিলো কথা বলেনি।
আমি মাথা নিচু করে থেকেছি। রাতে ভাইয়া বাসা আসতেই ফাজিল লতা সব বলে দিয়েছে আর আমি এখন আসামির মতো ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আর ভাইয়া তার বিছানায় বসে রেগে তাকিয়ে আছে। যেন চোখ দিয়েই ভষ্স করে দেবে।
আমার শরীর কাঁপছে জ্বর আসলো নাকি আবার?
ভাইয়া বলে উঠলো, ‘ তোর খুব কাজ করার শখ তাই না।’
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম।
ভাইয়া আবার বললো, ‘ আচ্ছা ফাইন আজ থেকে আমার সব কাজ তুই করবি? কতো কাজ করতে পারিস আমিও আমিও দেখবো।’
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
আর মিনমিন গলায় বললাম, ‘ কি কাজ আপনার?’
‘ আমার অনেক কাজ আছে। এই যেমন,আমার জামা কাপড় ধুয়ে দেওয়া, রুম গুছানো, শার্ট আয়রন করা, অফিসে যাওয়ার আগে আমার সব জিনিস এগিয়ে দেওয়া রুমে থেকে, আসার পর ঠান্ডা পানি দিবি, আরো যা আছে আস্তে আস্তে জেনে যাবি। এখন থেকে তোর আমার যাবতীয় কাজ করতে হবে। তোর কাজের শখ মেটাবো। ‘
#চলবে