এক_চিলতে_রোদ-২,২১,২২

0
637

#এক_চিলতে_রোদ-২,২১,২২
#Writer_Nondini_Nila

২১.

সাজেকের সবোর্চ্চ চূড়া কংলাক পাহাড়। চূড়ায় উঠতে উঠতে দেখতে পাই মিজোরাম সীমান্তের পাহাড় ও সবুজের মিতালি। চূড়ায় উঠে চারপাশে তাকাতেই আমার সমস্ত ক্লান্তি, কষ্ট নিমিষেই দূর হয়ে এক মিষ্টি সিগ্ধ হাওয়া আর অপূর্ব সৌন্দর্যের এই প্রকৃতির দেখে দেহ, মন পুলকিত হয়ে উঠে।
পাহাড়ের চূড়ায় থেকে নেমে সবাই গ্রাম কংলাক পাড়া ঘুরে আসি। কংলাক পাড়া লুসাই জনগোষ্ঠীর অধ্যুষিত এলাকা। কংলাক পাড়া থেকে কর্ণফলীর নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের লুসাই পাড়া দেখা যায়।
এরপর রুইলুই পাড়া থেকে ট্রেনিং করে কমলক ঝর্না ভ্রমন করালাম। এই ঝর্নাটি অনেকের কাছে পিদাম তৈস ঝর্না বা সিকাম তৈসা ঝর্না নামেও পরিচিত।

বিকেলে বের হতে চাইলেও রেস্ট নিয়ে সন্ধায় পর আগেই ডিনার করে বের হতে হয় সবাইকে। বেড়ানোর পর আমার মনটা অনেকটায় ভালো হয়ে আছে। তবু্ও মনের এক কোণে কষ্ট লুকিয়ে আছে। ইহানের জন্য ই এই কষ্ট টা অনেকটাই কাটিয়েছি। আসার সময় আমার ইহান আমার সাথে ছিলো। কিন্তু যাওয়া থেকে শুরু করে সব জায়গায় ই আমার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছিলো। আধা ঘন্টার মতো রেস্ট নিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। কোন গাড়িতে বসবো বুঝতে পারছি না। ইহানের আসার জন্য অপেক্ষা করলাম কিন্তু দেখা পেলাম না। স্যাররা তারা দিচ্ছে উঠার জন্য তাই আর না দাঁড়িয়ে আমাদের গাড়ির দিকেই হাঁটা ধরলাম।
বাসে উঠার সিঁড়িতে পা রাখতে যাব এমন সময় হাতে টান পরে চমকে পেছন ফিরে দেখি ইহান আমার হাত ধরে আছে। কিছু বলার আগেই টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো ইহান।

আমার রাগ লাগলো এমন টেনে আনার জন্য কড়া কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে র‌ইলাম। আজকে তিনি আমার মন ভালো করেছে তাই শান্ত থাকলাম। আগের বারের সেই সিট টায় ই এনে থেমেছে।

‘ আমি তো আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আপনাকে কোথাও দেখলাম না তাই ওই গাড়িতে উঠছিলাম। এখন আমাকে ভালো করে বললেই তো আসতাম এমন টেনে আনার কি দরকার ছিলো?’

ইহান আমার পাশের সিটে ধপাস করে বসে বললো,

‘ শোনো তোমাকে আমার পাশে বসে যাওয়ার জন্য আমি পাগল হয়ে যায়নি। শুধু মাত্র ফারিয়ার জন্য আমাকে এই নাটক গুলো করতে হচ্ছে। নাহলে….

আমি রাগী গলায় বললাম, ‘ আমি আবার আপনার পাশে বসার জন্য দেওয়ানা হয়ে গেছি তাই না।আমি বাধ্য হয়ে এসব করছে মনে রাখবেন যতসব ফালতু।’

বলেই রাগে গজগজ করতে করতে জানালার দিকে ঘুরে গেলাম। আজকের ব্যবহারে একটু উনাকে ভালো মনে হয়েছিলো কিন্তু না উনার মতো বদ লোক দুটো নাই। আমি কি করে ভুশৈ গেলাম। প্রথম থেকেই যা না তাই বলে আমাকে অপমান হেনস্তা করবেই সে।

গাল ফুলিয়ে বসে র‌ইলাম। ফোন বের করে গান ছেড়ে ইয়ার ফোন কানে লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে র‌ইলাম।
এবার পেছনের লম্বা ছিট দখল করে বসেছে ইহানের বন্ধুরা আমরা তাদের এক সিট আগে। ইহান ফট করেই উঠে চলে গেলো আর তার বন্ধুদের মধ্যে জায়গা করে বসে পরলো। আর শুরু হলো তাদের আড্ডা চিৎকার চেঁচামেচি।
ভেংচি কেটে একবার তাদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম।
হঠাৎ মিষ্টি কন্ঠের গান ভেসে এলো। আমি না চাইতেও পেছনে ঘুরে দেখলাম ইহান গান গাইছে আমি তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো।

তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি, তুমি আসলে জোনাকি রাশি রাশি…
রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে, বলো কিভাবে বুঝায় ভালোবাসি..
সব চিঠি সব কল্পনা জুড়ে, রঙ মিশে যায় রদ্ধ দুপুরে, সেই রঙ দিয়ে তোমাকেই আঁকি আর কিভাবে বলো ভালোবাসি,
প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই সবটুকু ধ্যান সারাক্ষণ দিতে চায় তোমাকে, ওওওতোমাকে, স্বপ্ন সাজাই নিজেকে হারাই, আর দুটি নয়নে রোজ শুতে যাই তোমাকে ওওও তোমাকে,
জেনেও তোমার আঁখি চুপ করে থাকি, রোজ দুই ফোঁটা যেন আর ভালো লাগে, লারে অভিসারে,চায় শুধু বারে বারে তোমাকে ওওও তোমাকে….
যেদিন কানে কানে সব বলবো তোমাকে, বুকের মাঝে জাপ্টে জরিয়ে ধরবো তোমাকে…
পথ চেয়ে র‌ই, দেরি করো না যত‌ই, আর ভুলা যাবে না জীবনে কখনো তোমাকে ওওও তোমাকে, ওওও তোমাকে..
জেনেও তোমার আঁখি চুপ করে থাকি, রোজ দুই ফোঁটা যেন আর ভালো লাগে, লারে অভিসারে,চায় শুধু বারে বারে তোমাকে ওওও তোমাকে….

রেগে থাকলেও তার গানের গলা শুনে আমার রাগ উবে গেলো। মুগ্ধ হয়ে গান শুনলাম। লোকটা বদ থাকলেও গানটা খুব‌ই ভালো গায়। আরো কয়েকটা গান গাইলো বন্ধুরা মিলে। বাসের সবাই দাঁড়িয়ে হ‌ইহুল্লা করলো সবাই ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিলো। আড্ডা বন্ধ করে লাইট অফ করে দিলো। আমি অন্ধকারে বাসের ভেতরে উঁকি ঝুঁকি মারলাম। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম একটার উপরে। দুই একজনের ফিসফিস ছাড়া আর কোনা কথা আসছে না।
সবার শ্বাস প্রশ্বাস শোনা যাচ্ছে শুধু ভয় লাগলো আমার সাথে চোখে রাজ্যের ঘুম। আমি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পরলাম আর আমাদের সামনের সিটে উঁকি মারলাম। বাইরে থেকে চাঁদের আলো হালকা উঁকি মারছে গাড়িতে তাতে যা দেখলাম তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। ছিঃ বলেই ঠাস করে আমার সিটে বসে পরলাম।
ছিঃ এটা আমি দেখলাম। চোখ মুখ ঢেকে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলাম।‌ সামনের সিটে দুজন নর নারী লিপকিস করছিলো তা স্পষ্ট দেখেছি আমি। আর কারো না দিকে উঁকি না মেরে চোখ বন্ধ করে র‌ইলাম। ঘুম চোখে আগে থেকেই ছিলো এবার চোখ বন্ধ করতে ঘুমিয়ে পরলাম।
পেছনে থেকে ইহান ঊষার দিকে নজর রাখছিলো। ঘুমিয়ে গেছে গাড়ির ঝাঁকুনিতে ঊষার মাথা জানালায় বারি খাবে এমন সময় ইহান এসে ওর মাথা আটকে ধরলো। আর বিরক্ত হয়ে তাকালো ঊষার দিকে।

ভোরের আলো ফোটার আগেই ইহান ঊষার মাথা কাঁধে থেকে সরিয়ে আগের সিটে চলে গেলো।
আর এদিকে আমি ঝাঁকুনি তে হেলে কপালে বারি খেয়ে উঠে পরলাম। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখি আমরা গাড়িতে আছি। কালকের কথা মনে পরলো। সাথে সামনের আপত্তি কর অবস্থা দেখেছিলাম। আমি আবার উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম। তারা জেগে আছে দুজনেই ফোন টিপছে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। মেয়েটা আমার দিকে তাকালো ফট করেই আমি তা দেখে বসে পরলাম। সারা রাত কি একাই ছিলাম না সিটে! ভাবতে ভাবতে পেছনে তাকাতে যাব তার আগেই ইহান এসে আমার পাশে শব্দ করে বসে পরলো। আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললাম,

‘ আপনার চোখ লাল হয়ে আছে কেন?’

ইহান সিটে হেলান দিয়ে চোখ করে র‌ইলো। আমি উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে র‌ইলাম কিন্তু হুনুটা আমার কথা শুনে নি এমন ভাব করে র‌ইলো। রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠলো। এতো ভাব দেখাতে পারে। ভাবে মাটিতে পরে না এনার। বিরবির করে বকতে লাগলাম।

সাতটায় আমার ঢাকায় এসে পৌঁছালাম। তখনো ইহান চোখ বন্ধ করে আছে। আমি তাকিয়ে চেয়ে আছি ডাকবো কিনা ভাবছি‌। বাবার সাথে কথা বলেছি বাবা বাসায় আছে দুপুরের পর নানুবাসায় যাব। আম্মু সেখানে আছে। এদিকে আমার নূপুর এর কথাটাই মনে নাই। ভুলে বসে আছি। গাড়ি থামতেই ইহান চোখ মেলে তাকালো। আমি তখনও তারদিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ইহান চোখ মেলে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ হা করে তাকিয়ে আছো কেন? জীবনে সুন্দর ছেলে দেখো নি?’

ইহানের কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। এতো বড় অপমান। আমি না হা করে তাকিয়ে আছি।
আমি রাগী চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে ইহান হাত দিয়ে থামিয়ে বললো,

‘ এখন আমার ঝগড়া করার মুড নাই বাই!’

বলেই ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেলো। আমি রাগ নিয়ে নিজেও বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসেই আব্বুকে দেখে ইহানের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম।

.
বিকেলে নানুবাড়ি এলাম। প্রথম দিন কার সেই পিচ্চি কে দেখলাম। আব্বুর থেকে জানতে পেরেছি এটা আমার মামাতো ভাই। আমার তিন মামা। আমাদের তো নানা দেখতে পারতো না তাই তারা ও তাই তাদের সাথে সম্পর্ক ছিলো না। নানা জান মারা যাবার আগে নাকি সবাইকে বলে গেছেন আমার আম্মুকে যেন আর দূরে সরিয়ে না রাখে। তিনি আম্মুকে ক্ষমা করে দিয়েছে। নানা জানের কথা সবাই আমাদের আপন করে নিয়েছে। যার জন্য দূরে ঠেলে দিয়েছিলো তিনি যেহেতু ক্ষমা করেছে সেখানে আর কারো কথা থাকতে পারে না।

বড় মামার দুই মেয়ে লিজা ও লিনা। লিজা আপু মাস্টার্সে পরে। লিনা আমার সমবয়সী। মেজ মামার এক ছেলে দুই মেয়ে। ছেলে আবির ভাইয়া অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, দুই মেয়ে জমজ( দিনা, নিসা) দুজনেই থ্রিরিতে পরে। ছোট মামার এক ছেলে যাকে আমি প্রথম দিন দেখছিলাম সামি ফাইভে পরে।
আমার এক খালা তার বিয়ে হয়েছিলো স্বামী নেশাখোর তাই ডির্ভোস দিয়ে আলাদা থাকে তিনি স্কুলের ম্যাডাম। তার সন্তান নেই।
আমি আর লিনা এক রুমে ঘুমালাম। সব ভাই বোনরা রাত জেগে আড্ডা দিলাম। এক দিনে সবাই আমাকে আপন করে নিয়েছে। সবাই এতো ভালো কি বলবো। এতো ভাই বোন আমার আর আমি কিনা এতো দিন নিঃসঙ্গ কাটিয়েছি।

এই বয়সেই আমাদের লিনা বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে তার ফেসবুক এ ঘুমাতে এলে আমাকে লুকিয়ে বললো। সাথে মেসেজ ও ছেলের ছবি দেখালো। ছেলেকে এখনো সামনে থেকে দেখে নি দেখবে কি করে ছেলের বাসা যে ঢাকায় আর আমাদের লিনার বাসা তো দিনাজপুর। একা একা ঢাকা যাবে কি করে?

তাই আমি বললাম, ‘ তাহলে আমার সাথে তুই চল আমাদের বাসায় তারপর দেখা করে নিবি।’

আমাদের মধ্যে তুই সম্পর্ক চলছে এসেছে। আমার কথা শুনে লিনা লাফিয়ে উঠে বললো,

‘ সত্যি। আচ্ছা আমি এক পায়ে খাড়া কিন্তু সামনেই তো পরিক্ষা যেতে দেবে না মনে হয়!’ মন খারাপ করে বললো।

‘ এখন না যেতে পারলেও সমস্যা নাই পরিক্ষার পর যাবি আর অনেকদিন থাকতে পারবি।’

‘ হ্যাঁ।’

পরদিন ও নানুবাড়িতে হেসে খেলে কাটিয়ে দিলাম। সাথে বিশাল আয়োজন হলো খাওয়ায় দাওয়া আত্নীয় স্বজন দিয়ে বাড়ি ভরে গেলো। পরদিন আমরা চলে এলাম বাসায় আমরা পরিক্ষা তাই আসতেই হলো।
এতো দিন পর নানু বাড়ি আদর খেলাম তাই আসতে মন চাইলো না।

বাসায় এসে ইহানকে ফোন করলাম রেগে নাম্বার বন্ধ। অসহ্য লোকটা আমার নূপুর দিবে বলেও দেয়নি। আমার না হয় মনে ছিলো না তার কি উচিত ছিলো না দায়িত্ব নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া। আর কখনো চাইবো না। পায়ে থেকে বাকিটাও খুলে রেখে দিলাম। আম্মু জিজ্ঞেস করলে বলেছি পরে থাকতে ভালো লাগে না তাই খুলে রেখেছি।
এস এস সি পরিক্ষা ঘনিয়ে এলো। মন দিয়ে পরতে লাগলাম। বিদায় অনুষ্ঠান এ ইহানের দেখা মিললো কথা বলতে চাইলাম কিন্তু সুযোগ হলো না।
দেখতে দেখতে এস এস সি পরিক্ষা শেষ হলো।
কাল লিনা আসবে বড় মামার সাথে। এর মাঝে নানু একবার এসেছে সবার সাথে সম্পর্ক ঠিক হয়েছে তাই আসা যাওয়া ও হয়েই থাকে।

#চলবে…..

#এক_চিলতে_রোদ-২
#Writer_Nondini_Nila

২২.

লিনা এসেছে দুইদিন হলো। আজ আমি, লিনা, তুলি
আর রিমা বেড়াতে যাব। পরিক্ষার পর এক সপ্তাহ হয়ে গেছে ওদের সাথেও দেখা হয় না‌। আর লিনা ও আসার পর থেকে বের হ‌ওয়ার জন্য পাগল প্রায় হয়ে গেছে। তুষারের সাথে দেখা করবে। তুষার হলো লিনার সেই ফেসবুক বয়ফ্রেন্ড। একা তো বের হতেই দেবে না আর আমি ওর সাথে একা কোন ছেলের সাথে দেখা করতে যাব ভাবতে কেমন লাগে। তাই তুলি আর রিমাকেও ফোন করে বলেছি চলে আয় আজ আমরা বেড়াতে যাব।
রিমা আর তুলি আসতেই চারজন বেরিয়ে পরলাম। আজ লিনা খুব সেজেছে। গায়ের রং শ্যামলা হলেও দেখতে খুব মিষ্টি। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক চোখে মোটা করে কাজল পরেছে। গায়ে বাসন্তী রঙের গাউন ওরনা একপাশে ফেলে রেখে চুল খোলা রেখেছে। প্রথম দর্শন তার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে তাই ও সকাল থেকে সাজুগুজু করেছে। ‘আমাকে দশ বারের মত জিজ্ঞেস করেছে ওকে সুন্দর লাগছে কি না? সবকিছু ঠিক আছে কিনা?’
তুলি দের সাথে লিনাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। লিনা খুব মিশুক একটা মেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তুলি আর রিমার সাথে মিশে গেল।

দুই রিকশা করে রেস্টুরেন্টের সামনে এসে নামলাম। নেমেই লিনা আমার হাত খামচে ধরলো,

‘ আমার খুব নার্ভাস লাগছে রে ঊষা।’

‘ কেন এমন ছটফট করছিস কেন? চল তাড়াতাড়ি।’
বলেই ওর হাত ধরে ভেতরে হাঁটা ধরলাম।

লিনা আমাকে টেনে থামিয়ে বললো, ‘ আমার কেমন জানি লাগছে রে। এখন‌ কি করবো।’

বলেই অসহায় মুখে তাকালো। তুলিরা নেমেই আমাদের কাছে এসে বলল, ‘ কিরে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ভেতরে চল।’

‘ আচ্ছা দেখো তো সব ঠিক আছে কিনা।’ লিনা চুল ঠিক করতে করতে বললো। তা দেখে রিমা বললো,

‘ হায়রে কতো ভাব রে। এই শোন তোরে পছন্দ হ‌ওয়ার হ‌ইলে এমনেই হবে। এতো স্টাইল করার দরকার নাই। চল তো শরমে ও যেন মরে যাচ্ছে এতোক্ষণ খুব পটর পটর করছিলি এখন এমন মিইয়ে যাচ্ছিস কেনো?’

রিমাদের সাথে তুই করেই কথা বলা শুরু করেছে।

রিমা লিনাকে টেনে ভেতরে ঢুকলো। আমি আর তুলিও পেছনে পেছনে এলাম।
তুষার বসে আছে একটা সিন দখল করে। লাল পাঞ্জাবি পরা ক্লিন শেভ করা গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। তাল গাছের মতো লম্বা আমাদের দেখে দাড়াতেই বুঝতে পারলাম। দাঁত কেলিয়ে হাসলো আমাদের দেখে। লিনা লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। ছেলেটাও কেমন লজ্জা পেয়ে চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। এদিকে লিনা ও সেম নতুন বর ব‌উ যেন!! রিমা সব চেয়ে চঞ্চল মেয়ে আমাদের মধ্যে ও বসেই একের এক কথা বলেই যাচ্ছে। ছেলেটার ইন্টারভিউ নিচ্ছে তা দেখে তুলিও কথা বলছে‌। আমি শুধু হা করে ওদের কান্ড কারখানা দেখছি।
ছেলেটার বাসা বনানী। লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার কাপড়ের দোকানে বসে।
লিনা কে ছেলেটা কেমন আছো বললো। লিনা লাজুক মুখে বললো,’ ভালো। আপনি?’

ছেলেটা এতোক্ষণ শত লজ্জায় থাকলো এখন বলে উঠলো, ‘ ফোনে তো তুমি করে কথা বলতে এখন আপনি বলছো কেন?’

লিনা মিনমিন করতে‌ লাগলো তা দেখে রিমা বললো, ‘ এই তুই মিনমিন করছিস কেন? এতো লজ্জা তাহলে রুমে দরজা আটকে বসে থাকতি। দেখা করতে এলি কেন রে লজ্জা বতী লতিকা।’

রিমার কথায় এক দফা হাসিল রোল পরলো। রিমা এত্তো এত্তো খাবার অডার করে টেবিল ভরে ফেলেছে। লিনা আস্তে আস্তে অনেকটা স্বাভাবিক হলো। খাবার খাওয়া হলো তুষার বিল মিটিয়ে তারা দেখিয়ে চলে গেলো। তার আগে একটা কল‌ এসেছিলো। যাওয়ার আগে লিনাকে ইশারায় কি যেন বললো।

এবার আমরা চারজন ই বসে আইসক্রিম খাচ্ছি আর কথা বলছি। তখন কোথা থেকে ইহানের আগমন ঘটলো। কোন কিছু বুঝার আগেই আমার পাশে এসে বসে পরলো। আর সবার দিকে তাকিয়ে হাই দিলো।

রিমা বললো, ‘ ভাই তুমি এখানে কি করে?’

‘ এদিকেই এসেছিলাম। তোদের দেখলাম তাই এলাম।”

‘ ওহ ভালো করেছো।’

লিনা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ইহানের দিকে। আমি মুচড়া মুচরি করছি তা দেখে লিনা বললো,

‘ কি হয়েছে ঊষা এমন করছিস কেন?’

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই ইহান লিনাকে বললো, ‘ হাই, তোমাকে তো চিনলাম না!’

লিনা বললো, আমি লিনা ঊষার মামাতো বোন।

ইহান আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে আমি জোর করেও হাত সরাতে পারলাম না। তাই বললাম, ‘পাগল নাকি আপনি এখানে আমার পাশে চপকে বসলেন কেন? আর আমার হাত ধরেছেন কেন ছারুন আমার হাত। ‘

ইহান হাত ছাড়লো আমি রাগী চোখে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। আইসক্রিম মুখে দিতে যাব ফট করা ইহান আমার আইসক্রিম খাওয়া শুরু করলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম,

‘ এটা আপনি কি করলেন? আমার খাওয়া আইসক্রিম খেয়ে নিলেন ছি!’

রিমা, তুলি লিনা হা করে তাকিয়ে আছে।আমার লাগে দুঃখে এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে।আমার চিৎকার এ রেস্টুরেন্টের অনেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছে।

ইহান ততক্ষণে বাই বলে উঠে দাড়ালো আর আমার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,’ একটু টেস্ট করলাম মাত্র। তার জন্য এমন চিৎকার। উফফ কানটা গেলো।’

আমি রিমার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘দেখলি তোর ভাইটা কেমন খবিশের খবিশ। কিভাবে আমার আইসক্রিমটা খেলো। এই দেখ লাল হয়ে গেছে কেমন শক্ত করে হাত ধরেছিল।’

রিমা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে। লিনা তুলিও আমি কটমট করে ইহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। অসহায় মুখে আইসক্রিমের দিকে তাকালাম।

.
বাসায় আসার পর থেকেই আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে লিনা। কানের কাছে এক কথা ঘ্যানঘ্যান করছে। ইহান কি আমার বয়ফ্রেন্ড। আর এই এতো বড় কথাটা আমি কেন ওর থেকে লুকালাম।

‘ ওই কিউট হিরোর মতো দেখতে ছেলেটা তোর বয়ফ্রেন্ড তাই না। এই কথাটা তুই আমার থেকে কেন লুকালি বল। আমি তো প্রথম দিনেই তোকে আমার সব জানিয়েছি আর তুই সব কিছু আড়াল করে গেলি। সেদিন যখন বলেছিলাম তোর বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা, তুই কি বলেছিলি! বলেছিলি তোর এসব বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড নাই। ছেলেদের সাথে কথা বলা দূরে থাক কাছে ও ঘেঁষিস না। এখন কি হলো। খুব তো হাত ধরলো তোর খাওয়া আইসক্রিম অবধি খেয়ে গেলো। এই ভাবে আমাকে পর করে দিলি।’

রাগে এখন হয় নিজের মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে নাহলে এই ন্যাকা টার। সব কিছু ইহানের জন্য হয়েছে। এখন এই মাথা মোটা টাও আমার কথা বিশ্বাস করছে না।কতো বার বললাম ও আমার বয়ফ্রেন্ড না ও আমার চরম শত্রু। কিন্তু উনি আমার কথা বিশ্বাস করছে না উল্টা এখন প্রেম কি ভাবে হলো, প্রথম দেখা কোথায়? এসব ফালতু কথা বলছে।

‘ তুই যদি এই নিয়ে আমাকে আর একটু বিরক্ত করিস। তাহলে এই মুহূর্তে আমি মামুকে কল করে তোর ওই তুষাপাতের কথা বলে দেব মাইন্ড ইট।’

এই একটা‌ কথাই ছিলো লিনার মুখ বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট।
কয়েকদিন পর আমি, লিনা আর আবির ভাইয়া বিকেলে বেরিয়েছি ফুসকা খেতে। হেঁটে ফুসকা খেতে চলে এলাম। আবির ভাইয়া এসেছে সকালে ঢাকায় কি একটা কাজে এসেছিলো তাই আমাদের বাসায় ও এসেছে।
তিন প্লেট ফুসকা হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলাম। আমার খাওয়া সবার আগে হয়ে গেছে। লিনার আর ভাইয়ার রয়েছে এবার ওদের টায় আমি ভাগ বসালাম। ভাইয়া তাই নিজেই আমাকে খাইতে দিতে লাগলো তার প্লেট থেকে। ভাইয়ার একটা তোতলা গার্লফ্রেন্ড ছিলো তার কথা বলছে লিনা। আর সেসব শুনে তিনজন‌ই হাসাহাসি করছি।

ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডের নাম ছিলো হুমাইরা। মেয়েকে ভাইয়া ভার্সিটিতে ভর্তি হ‌ওয়ার পর পছন্দ করে দেখতে মারাত্মক সুন্দর ছিলো। ভাইয়াদের সেম ব্যাস ছিলো। ডিপার্টমেন্ট আলাদা। মেয়েটাকে দূর থেকে দেখেই খুব পছন্দ করে ফেলে। তারপর একদিন হুট করেই প্রপোজ করে‌ বসে। মেয়েটা হ্যা না কিছু না বলে নাম্বার দিয়ে চলে যায়। তিনমাস দূর চেখে দেখতে দেখতে মেয়ে টাকে অনেকটাই পছন্দ করে ফেলেছিলো সাথে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। তারপর এই ভাবে মেয়েটার নাম্বার পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় কিন্তু ফোন করে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম।

কথা শুনে তার মাথা ঘুরে যায়। প্রথমদিন সালাম দিতেই 10 মিনিট কভার করে ফেলেছিল। এমন তোতলানো কন্ঠ শুনে আবির ভাইয়া ফোন কেটে বলে মাইয়া তো খুব পাজি কোন কার কোন তোতলা কন্ঠের বেটির নাম্বার দিসে আমারে। পরের দিন মুখোমুখি ধরে মেয়েটাকে কঠিন স্বরে বলে,

‘এই মেয়ে তুমি আমাকে কার নাম্বার দিয়েছো? আমি তোমার নাম্বার চাইছি! আমি তোমাকে পছন্দ করেছি। প্রপোজ করেছি আর। তুমি কোন তোতলা বেটির নাম্বার দিয়েছিলা আমাকে হ্যাঁ।তোমার তো সাহস কম না তোমার আমাকে পছন্দ না। তাহলে আমাকে না করে দিতা এমন ঢং করার কী আছে অসভ্য মেয়ে।’

আবির ভাইয়া রেগে চেচিয়ে উঠলো। আবির ভাইয়ার কথা শুনে তো মেয়েটা চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে আর ঠাস করে গালের মধ্যে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসে। আবির ভাইয়া গালে হাত দিয়ে হতভম্ব মুখ করে মেয়েটার দিকে তাকায়। তারপর মেয়েটা ফোনের কন্ঠে তোতলাতে তোতলাতে আবির ভাইয়াকে বলে,

‘ কিইই ববলললি তুওওই আমি তোতততলা বেবেবেটি?’

আবীর ভাইয়া কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারে এই মাইয়ার কন্ঠ এই রকম। ভয়ে এক দৌড়ে মাঠের ওপারে চলে যায়‌। আর জীবনে মেয়েটার সাথে কথা দূরে থেকে আশেপাশে দেখলেও মুখ লুকিয়ে পালায়।’
তিনজন গলা ফাটিয়ে হাঁটতে লাগলাম আর এই হাসি আমার কাল হলো। আমার কাশি উঠে গেলো। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো চোখে ও পানি চলে এসেছে আমার। ভাইয়া ও লিনা ভয় পেয়ে গেলো।
ফুসকা ওয়ালার কাছে পানি নাই। কিছুটা দূরে চায়ের দোকান আছে ভাইয়া দৌড়ে চলে গেলো। লিনা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমার গলা ব্যাথা করছে কাঁশতে কাঁশতে। এতো হাসা উচিত হয়নি। ফুসকা মুখে দিয়ে হেসেছি তাই এমন বাজে পরিস্থিতে পরতে হলো।

হঠাৎ কেউ পানির বোতল এগিয়ে দিলো। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে ঢকঢক করে অনেকখানি পানি খেয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। এখনো কাশি আসছে কিন্তু কম আগের থেকে। মাথায় কারো হাতের স্পর্শে চোখ তুলে তাকিয়ে চমকে উঠলাম‌। ইহান আমার মাথার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর পলক হীন চোখে তাকিয়ে আছে‌ আমার মুখের দিকে। তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here