তুমি_তাই,পর্বঃ১৯,২০

0
601

#তুমি_তাই,পর্বঃ১৯,২০
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৯

শায়লা মুরসালীনের মেজাজ অত্যাধিক খারাপ। রাগে গরগর করছেন। রেজোয়ান মৌনমুখে তাঁর পাশে বসে আছে। চোখের দৃষ্টি উদাস, চেহারা বিষন্ন। মনে হচ্ছে কত রাত্রি নিদ্রাহীন কাটিয়ে এসেছে। গতকালই হস্পিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে সে। আসার পর থেকে সারাক্ষণ চুপচাপই ছিলো। একটু আগে হঠাৎ শায়লা মুরসালীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি মা। এই দেশে আর থাকবো না। সব বেচে দিয়ে বিদেশে স্যাটেল হবো।’

শায়লা মুরসালীন অবাক হলেন। রেজোয়ান মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে এখন বলছে বিদেশে চলে যাবে। কি বলছে ও এসব? তেঁতে উঠলেন। ক্ষিপ্ত গলায় বললেন,’কেন?’

-‘আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

-‘ভালো লাগছে না? কেন? ঐ মেয়েটার জন্য? আর কত কষ্ট দিবি তুই আমাকে? নিজেও শান্তিতে থাকবি না আমাকেও শান্তিতে থাকতে দিবি না। এত কষ্ট করে ব্যবসা দাঁড় করালি এখন বলছিস সব ছেড়েছুঁড়ে বিদেশে স্যাটেল হবি। কেন রে? তোর কোন লজ্জাবোধ নেই? একটা মেয়ের জন্য তুই নিজের মাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস? বুঝতে পারছিস কতটা অন্যায় করছিস?’

মায়ের রাগের বিপরীতে অসহায় দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো রেজোয়ান। নিজের ভেতরে যন্ত্রণা সে কাউকে বোঝাতে পারছে না। অসহ্য বেদনায় ক্রমাগত বুক ভারী হয়ে আসছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ কেউ তাঁকে বুঝতে পারছে না। সবাই ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

হাটুমুড়ে মায়ের সামনে বসে পড়লো সে। মাথাটা তাঁর কোলের ওপর রেখে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত গলায় বললো,’প্লিজ মা, আর কোনদিন কিচ্ছু চাইবো না তোমার কাছে।’

শায়েলা মুরসালীন জবাব দিলেন না। তবে নরম হলেন। মায়ের মন সন্তানের বেদনায় ব্যথা পায়। বললেন,’ঠিক আছে। কিন্তু তুই আগে আমাকে একটা কথা দে। আমার গা ছুঁয়ে শপথ কর, আর কখনো ঐ মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করবি না।’

রেজোয়ান প্রথমে কিছুক্ষণ কোন কথা বললো না। মরার মতন শায়লা মুরসালীনের পায়ের ওপর পড়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললো,’তোমার গা ছুঁয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যি কথাটা বলার সাহসও সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেন নি মা। শপথ অনেক দূরের কথা। নিজের ওপর ভরসা থাকলে তোমাকে নিয়ে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস আমার নেই।’

শায়লা মুরসালীন মনে মনে খুশি হলেন। তবে শংকামুক্ত হতে পারলেন না। একবার মনে হলো রেজোয়ান তাঁকে ফাঁকি দিচ্ছে, আবার মনে হলো মায়ের কাছে মিথ্যে বলার ছেলে রেজোয়ান নয়। অতঃপর মুখ কালো করে বললেন,’তুই আমাকে ফাঁকি দিচ্ছিস রেজোয়ান। মাকে কষ্ট দিচ্ছিস তুই।’

-‘না মা। আমি তোমাকে ফাঁকি দিচ্ছি না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। নিলির সঙ্গে আমার আর কখনো যোগাযোগ হবে না। আমি আর কখনো ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবো না।’

শায়লা মুরসালীন আর কিছু বললেন না। ছেলের ওপর তাঁর বিশ্বাস আছে। অন্যদিকে নিলিও রেজাকে বিয়ে করছে। তাই বিয়েটা হয়ে গেলে রেজোয়ান চাইলেও আর যোগাযোগ করতে পারবে না। অতএব এই বিষয় নিয়ে আপাতত মাথা ঘামানো বন্ধ।


একসপ্তাহের ভেতর রেজোয়ান বাইরে যাওয়ার সব কাগজপত্র রেডি করে ফেললো। প্রোপার্টি যা আছে সব নিলামে উঠে গেলো। বিক্রি হলেই আর দেরী করবে না। জাহিদ বেশ দৌড়াদৌড়ি করছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সেরে ফেলার জন্য। তাঁর ওপর দায়িত্ব দিয়ে রেজোয়ানও বেশ নিশ্চিন্তে আছে।

বাসার গোছগাছও সব শেষ। তিন্নি প্রায়ই দেখা করতে আসে শায়লা মুরসালীনের সঙ্গে। রেজোয়ানের সঙ্গেও দেখা হয় কিন্তু কথা বলে না। রেজোয়ানও আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায় না। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

বলা প্রয়োজন, তিন্নির এখন আর আগের মতন রাগ নেই রেজোয়ানের ওপর। বরঞ্চ মনে মনে কষ্ট হয় রেজোয়ানের জন্য। মানুষটা কাছে পেয়েও ভালোবাসার মানুষকে আবার হারালেন। ভালোবাসার মানুষটা ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিয়েছে তাঁকে, একবারও তাঁর মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে নি। এসব ভাবলে তিন্নির কষ্ট হয়। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না।


পরশু ফ্লাইট। ফুয়াদ এসেছে দেখা করার জন্য। শায়লা মুরসালীন জোর করে রেখে দিলেন। তিন্নিও আছে। প্রথমে এই বাসায় ফুয়াদকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলো সে। পরে শায়লা মুরসালীনের কাছ থেকে জানতে পারলো ফুয়াদ তাঁর ভাইয়ের ছেলে। ফুয়াদ অবশ্য তাঁকে দেখে তেমন রিয়েক্ট করে নি। সামনাসামনি পড়ে গিয়ে একবার শুধু,’কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করেছে এইটুকুই। আর কোন কথা হয় নি।

অন্ধকারে ছাদের একপাশে একা দাঁড়িয়ে আছে রেজোয়ান। ফুয়াদ কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বললো,’তোকে ফুপু নিচে ডাকছে। জাহিদ ফোন করছে। তোকে না পেয়ে নাকি ফুপুর নাম্বারে ফোন করছে। কি জরুরী কথা বলার জন্য।’

-‘ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দেবো। সেই ব্যাপারে আলাপ করার জন্যই ফোন করেছে বোধহয়। তোমার কি খবর?’

-‘আমার আর কি খবর! ফুপু তো এখান দিয়ে এক ভেজাল লাগিয়ে দিয়েছে।’

-‘কি ভেজাল লাগিয়েছে?’

-‘আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তোদের নিচের ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে আছে না তিন্নি? ওর বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়েছে। বাবাকেও ফোন করে পাগল করে দিচ্ছে দেখতে আসার জন্য। বাবা তো ফুপুর কথা শুনেই অর্ধেক রাজী। আমার কোন কথাই শুনছেন না।’

রেজোয়ান অবাক হলো। শায়লা মুরসালীন ভেতরে ভেতরে এই কান্ড কখনো ঘটালো? একবারও তো তাঁকে বললো না? তবে যাই হোক না কেন ফুয়াদের সঙ্গে তিন্নির বিয়ে হলে খারাপ হবে না। অবশ্য তিন্নি যদি রাজি হয় তাহলে। কি জানি মেয়েটা রেজোয়ানের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে কি না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’দেখো। মেয়ে দেখতে তো সমস্যা নেই। দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নাও। এখুনি এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।’

-‘ফুপু তোকে বলে নি?’

-‘কি?’

-‘মেয়ে আমি দেখেছি। কথাও বলেছি। সেজন্যই আমার মনে হচ্ছে আমার একে অপরের জন্য পার্ফেক্ট চয়েস না।’

ফুয়াদ সেদিনের ঘটনা একে একে সব খুলে বললো রেজোয়ানকে। সব শুনে রেজোয়ান কিঞ্চিৎ হাসলো। তিন্নি তাহলে এরমাঝেই এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। মেয়েটা কবে যে বদলাবে! পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বললো,’কে কার জন্যে পার্ফেক্ট চয়েস সেটা আমরা কেউ বলতে পারি না। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালো বলতে পারবেন তিনি কার জন্য কাকে ঠিক করে রেখেছেন। অতএব এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা বাদ দাও। চলো নিচে যাই।’

ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পাসপোর্ট চেকিং শেষে লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছে রেজোয়ান। তাঁর পাশে মেয়েকে নিয়ে গোমড়া মুখে বসে আছে শায়লা মুরসালীন। এই বুড়ো বয়সে নিজের দেশ ছাড়তে হচ্ছে দেখে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। এখন তাঁর নাতি নাতনী নিয়ে হেসেখেলে জীবন পার করে দেবার বয়স, এখন কিনা তিনি দেশছাড়া হচ্ছেন। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

ফুয়াদ এসেছিলো সি অফ করতে। তাঁকে দেখে শায়লা মুরসালীন কম করে হলেও অর্ধ শতাধিক বার তিন্নির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে তিন্নিকে দেখতে যাওয়ার কথা আছে ফুয়াদের বাবা মায়ের। সেখানে গিয়ে ফুয়াদ যেন কোন গণ্ডগোল না করে সেই বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন।

ফুয়াদ বাধ্য ছেলের মতন চুপচাপ সব শুনলো। শেষে শায়লা মুরসালীনকে আশ্বস্ত করে বললো,’আমি কোন গণ্ডগোল করবো না ফুপু। তুমি শুধুশুধু টেনশন করছো। বিয়ে যেহেতু সারাজীবনের ব্যাপার তাই আমি শুধু বলেছি তোমরা আরেকটু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। কারণ মেয়ে যে একটু মেজাজি সেকথা তুমিও জানো আমিও জানি।

শায়লা মুরসালীন স্বীকার করলেন না। বললেন,’মেয়েমানুষের ওরকম একটু আধটু মেজাজ থাকে। এসব কিছু না। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কি কম মেজাজ ছিলো? তোর বাবা জানে আমি কতটা মেজাজি ছিলাম। তাই বলে তোর ফুপার সঙ্গে আমি সংসার করি নি? কোনদিন হয়েছে আমাদের দুকথা?’

শায়লা মুরসালীনের নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না বুঝতে পেরে ফুয়াদ চুপ করে গেলো। তিনি যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে তাতে মনে হচ্ছে বিয়েটা দিয়েই ছাড়বেন।

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২০

যাত্রীদের প্লেনে উঠার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। রেজোয়ান বারবার জাহিদের নাম্বারে ট্রাই করছে। নাম্বার আনরিচেবল। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। এইসময়ে জাহিদের ফোন কিছুতেই বন্ধ থাকার কথা নয়। রেজোয়ানের চিন্তায় হচ্ছে। নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় আটকে গেছে জাহিদ। আরো কয়েকবার ট্রাই করলো। এবার রিং হলো কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না।

মাথা থেকে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আস্তে আস্তে প্লেনে উঠার প্রস্তুতি নিলো সে। মিনিট খানেক বাদে জাহিদ নিজেই কল ব্যাক করলো। রেজোয়ান ফোন রিসিভ করে সর্বপ্রথম তাঁর অবস্থানের কথা জানতে চাইলো,’হ্যাঁ জাহিদ। কোথায় তুমি? তোমার ফোন বন্ধ কেন? আধঘণ্টার মাঝে প্লেইন টেইক অফ করবে।’

-‘একটা খারাপ খবর আছে স্যার।’ ওপাশ থেকে জাহিদের উদ্বিগ্ন ককন্ঠস্বর শোনা গেলো। রেজোয়ান এমনিতেই টেনশনে ছিলো। তারওপর খারাপ খবরের কথা শুনে ধৈর্য রাখতে পারলো না। কিঞ্চিৎ গলা চড়িয়ে বললো,’কি?’

-‘নিলি ম্যাম অ্যাক্সিডেন্ট করে হস্পিটালাইজ। সারভাইব করার চান্স খুবই কম। অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে মি.রেজা পালিয়েছে। স্থানীয়রা একটা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছে উনাকে। কিন্তু এখানে আইসিইউ, বেড, কেবিন কিছুই খালি নেই। তাই বাধ্য হয়ে বারান্দায় রাখা হয়েছে। ডাক্তাররা বলছে এক্ষুনি যদি আই সি ইউর ব্যবস্থা না করা হয় তবে খুব তাড়াতাড়ি কোন অঘটন ঘটে যাবে।

রেজোয়ানের হাতে ফাইল পত্র,কাগজ যা কিছু ছিলো সব মাটিতে পড়ে গেলো। শূন্য, ভোঁতা দৃষ্টিতে শায়লা মুরসালীনের মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। ক্রমশ দৃষ্টি ঝাপ্সা হয়ে আসছে তাঁর। মস্তিষ্ক ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। শায়লা মুরসালীন ছেলের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে রেজোয়ানকে।চাদর দিয়ে তাঁর মুখমন্ডলের ঘাম মুছে দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,’কি হয়েছে বাবা? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

-‘মা জাহিদ কি বলছে এসব?’ বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো রেজোয়ান। শায়লা মুরসালীন এবার আরো বেশি ঘাবড়ে গেলেন। আতংকিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,’কি বলছে?’

-‘নিলি অ্যাক্সিডেন্ট করে হস্পিটালে ভর্তি মা। বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি এখন কি করবো মা!’

রেজোয়ানের পাগলের মত অস্থির আচরণ করছে। কান্নার বেগ ক্রমশ বাড়ছে তাঁর। আশেপাশে সবাই হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শায়লা মুরসালীন রেজোয়ানের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিজে জাহিদের সঙ্গে কথা বললেন,’কন্ডিশন কেমন জাহিদ? বাঁচবে?’

-‘ভালো না ম্যাম। যে কোন সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে আই সি ইউতে শিফট করা প্রয়োজন।’

-‘ব্যবস্থা করো। আমরা আসছি।’

ফোন রেখে ছেলের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন শায়লা মুরসালীন। ধমক দিয়ে বললেন,’কান্নাকাটি পরে হবে। আগে হস্পিটালে চল।’

রেজোয়ান কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। যার জন্য সে এতগুলো দিন অসহ্য বেদনায় দিন কাটিয়েছে, এত আত্মত্যাগ করেছে, দেশ ছেড়ে পর্যন্ত পালিয়ে যাচ্ছে সে আজ দুনিয়া ছেড়ে পালানোর পায়তারা করছে। নিজেকে কি করে স্থির রাখবে রেজোয়ান। শায়লা মুরসালীন একপ্রকার টেনে ছেলেকে বের করে নিয়ে গেলেন।

নিলির কন্ডিশন খুব একটা ভালো নয়। ব্রেনে মারাত্মক আঘাত লেগেছে। মেজর অপারেশন করানো লাগবে। বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। পরিস্থিতি আউট অফ কন্ট্রোল দেখে রেজা সটকে পড়েছে। এতদিন রেজোয়ানকে শায়েস্তা করার জন্য নিলিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো সে। নিজামউদ্দিন সাহেবের চিকিৎসার সব দায়ভারও নেবে বলেছিলো। কিন্তু এখন যখন সেটা হচ্ছে না তখন আর নিলিকে দিয়ে তাঁর কোন কাজ নেই। উপরন্তু রেজোয়ানও সব ছেড়েছুড়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অতএব এই উটকো ঝামেলার মরা বাঁচাতে তাঁর কিছু আসে যায় না।

রেজোয়ান রিসেপশনে টাকা জমা দিয়ে আই সি ইউর বাইরে বসে আছে। আজই অপারেশন করা হবে নিলির। যাবতীয় ফর্মালিটিজ সব জাহিদ পালন করছে।

শায়লা মুরসালীন এই প্রথম স্নেহের দৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে চাইলেন। দুহাতে মুখ চেপে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে তাঁর আদরের ছেলেটা। চোখের পানি হাতের গাল ভিজে যাচ্ছে।

রিসেপশনের কাজ শেষ করে ফিরে এলো জাহিদ। রেজোয়ানকে উদ্দেশ্য করে নরম গলায় বললো,’আপনি টেনশন করবেন না স্যার। উনার কিচ্ছু হবে না।’

বাচ্চা শিশুর মত ফুঁপিয়ে উঠলো রেজোয়ান। চোখের সামনে নিলির এমন করুণ অবস্থা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না সে। তাঁর আসার আগে হস্পিটালের বারান্দায় পড়ে ছিলো নিলি। জাহিদ ছাড়া সঙ্গে কেউ ছিলো না। একটা লোক ছিলো না আফসোস করার মতন। রেজোয়ানের পূর্বের সব অভিমান ভুলিয়ে দিলো নিলির অসহায় অচেতন মুখ। বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো হৃদপিন্ডটা। শত চেষ্টা করেও নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না সে। ছুটে গিয়ে নিলিকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে চাইছে,’অভিমান আমার করার কথা ছিলো হৃদয়হীনা নিষ্ঠুর, তোমার নয়। তুমি কেন আমাকে বারবার কষ্ট দিচ্ছো? কেন তুমি আমার ভালোবাসা বুঝতে পারো না।’

শায়লা মুরসালীন ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলেন। অশ্রুসজল, করুণ মুখে মায়ের দিকে চাইলো রেজোয়ান। ঠোঁট কাঁপছে তাঁর। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। বাচ্চা ছেলেটির মতন তাঁর মাথা বুকে টেনে নিলেন শায়লা মুরসালীন। মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’পুরুষ মানুষ এত ভেঙ্গে পড়লে চলে না। পুরুষ মানুষকে শক্ত হাতে সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়।আল্লাহ ভরসা। ধৈর্য রাখ।

রেজোয়ান ফের কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মায়ের হাত দুটো চেপে ধরে বললো,’ওকে তুমি বদদোয়া দিও না মা। ও বেঁচে থাকলেই আমি খুশি। ওর কাছে যাবো না। কথা দিচ্ছি তোমাকে।’

শায়লা মুরসালীন ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তেমন কোন কঠোর মনোভাব দেখালেন না। রেজোয়ান মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। এইমুহূর্তে মা হিসেবে উনার ছেলের পাশে থাকা দরকার। ছেলেকে আশ্বস্ত করে বললেন,’এসব কথা এখন থাক। আমি চাই সে বাঁচুক। অন্যের সন্তানের মৃত্য কামনা করা কোন মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়।


নয়ঘন্টা যাবত অস্ত্রপাচার শেষে ওটি থেকে বের করা হলো নিলিকে। মাথা, হাতে, পায়ে গলায় ব্যান্ডেজ। অচেতন অবস্থায় আই সি ইউর বেডে পড়ে আছে তাঁর নিথর দেহ। রেজোয়ান গ্লাসের ফাঁক দিয়ে চাইলো। চোখের পানি আজকে বাধ মানছে তাঁর। সারাজীবন এই মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। সবাই তাঁকে ঠকিয়েছে। কখনো রেজোয়ানকে বাঁচাতে গিয়ে ঠকেছে কখনো বা নিজেকে সুখি করতে গিয়ে। কিন্তু ঠকেছে। সুখের দেখা একমুহূর্তের জন্যেও পায় নি। হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো রেজোয়ান। শায়লা মুরসালীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’তুমি মামার বাসায় চলে যাও মা। গিয়ে রেস্ট নাও। আমি হস্পিটালে থাকি।’

-‘কিন্তু ওর জ্ঞান তো এখনো ফেরেনি। তাছাড়া ওর বাবাকেও খবর দেওয়া হয় নি।’

-‘উনি আজ বারোদিন যাবত হস্পিটালে ভর্তি। হুঁশ নেই। ডাক্তাররা অক্সিজেন দিয়ে রেখেছে।’

-‘বলিস কি?’

-‘হ্যাঁ। জাহিদ নিলির বাসায় গেছিলো খবর জানাতে। সেখানে ওর প্রতিবেশিরা বললো নিলির বাবা আজকে বারোদিন যাবত অচেতন।’

শায়লা মুরসালীন কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। নারীহৃদয় স্বভাবতই কোমল। তাঁর ওপর নিলির এমন দুর্দশার কথা শুনে বিগলিত হয়ে গেলেন। আফসোসের সুরে বললেন,’লোকটা নিজেও শান্তিতে রইলো না মেয়েটাকেও শান্তিতে থাকতে দিলো না।’

রেজোয়ান জবাব দিলো না। নিলির এমন পরিস্থিতির জন্য সে ঠিক কাকে দোষ দিবে বুঝতে পারছে না। সে নিজেও তো দোষী। চাকরীতে জয়েন করার পর থেকে কম অত্যাচার তো করে নি নিলির ওপর। বাধ্য হয়ে মেয়েটা চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। এতকিছুর পর রেজোয়ান নিলিকে কি করে একতরফা দোষ দেয়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here