#তুমি_তাই,পর্বঃ২১,২২
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২১
বারো ঘন্টা বাদে নিলির জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তাররা টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স অবজারভেশনে রাখছেন। এখন যদিও শংকামুক্ত সে। তবে ডাক্তার জানিয়েছেন এতবড় একটা অপারেশন এর পর এক্সট্রা সিকিউরিটির জন্যে হলেও আরো কিছু হস্পিটালে থাকতে হবে নিলিকে।
জ্ঞান ফেরার পর জাহিদই প্রথম দেখা করতে গেলো নিলির সঙ্গে। রেজোয়ানের কেবিনের বাইরে বারান্দায় বসে ছিলো। জাহিদ দেখা করে এলে উদ্বিগ্ন মুখে নিলির অবস্থার কথা জানতে চাইলো সে। জাহিদ বিস্তারিত সব খুলে বললো। সব শুনে রেজোয়ান স্বস্তি পেলো।
তাঁকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জাহিদ কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করলো,’আপনি দেখা করবেন না স্যার?’
-‘না।’
রেজোয়ানের এমন উত্তর জাহিদকে অবাক করেছে। অপারেশনের পর থেকে নিলির জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত রেজোয়ান ঠায় বসে ছিলো হস্পিটালের বারান্দায়। একমুহূর্তের জন্যেও এদিক ওদিক হয় নি। এখন বলছে দেখা করবে না? এ কেমন অভিমান? মনে মনে দুঃখবোধ করলো জাহিদ। কিন্তু এই দুঃখবোধটা ঠিক কার জন্য সে নিজেও বুঝতে পারছে না। নিলির জন্য নাকি রেজয়ানের জন্য?
রেজোয়ান উঠে দাঁড়ালো। হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জাহিদকে উদ্দেশ্য করে বললো,’টাকা পয়সা যা লাগে খরচ করবে। কিন্তু ট্রিটমেন্ট এর যেন কোন ঘাটতি না হয়।’
রেজয়ান বেরিয়ে গেছে। জাহিদ হতাশভাবে মাথা দোলালো। মনে হচ্ছে ছ্যাঁকাটা নিলি নয় সে নিজেই খেয়েছে। এই অদ্ভুত ভালবাসার কোন কূলকিনারা সে খুঁজে বের করতে পারছে না।
★
শায়লা মুরসালীনের হাতে প্লেনের টিকেট। এইমাত্র রেজোয়ান এসে দিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় বলে শায়লা মুরসালীনকে উদ্দেশ্য করে বলেছে,’আজকের সন্ধ্যা ছটায় আমাদের ফ্লাইট মা। তুমি রেডি থেকো। আমার একটা কাজ আছে। সেটা সেরে আসি।’
শায়লা মুরসালীন অবাক হলেন। এত ঘটনা হয়ে যাওয়ার পর রেজোয়ান নিজে থেকে দেশ ছাড়তে রাজি হবে এটা তিনি ভাবতে পারেন নি। ভেবেছিলেন এবার রেজোয়ানকে নিলির কাছ থেকে সরানো অসম্ভব। মনে মনে সেটা নিয়ে দুঃখবোধও করছিলেন। কিন্তু রেজোয়ান তাঁর ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নিজে গিয়ে টিকেট কেটে এনেছে। আসল ঘটনা কি সেটা জানার জন্য জাহিদের কাছে ফোন করলেন। জাহিদ জানালো সে বলতে পারবে না। রেজোয়ান হস্পিটালেও নিলির সঙ্গে দেখা করে নি। সব শুনে শায়লা মুরসালীন চিন্তায় পড়ে গেলেন! রেজোয়ানের হঠাৎ হলো টা কি! সে কি সত্যিই কানাডা যাবে নাকি প্ল্যান করে শায়লা মুরসালীনকে পাঠিয়ে দিতে চাইছে?
★
দুদিন পরের ঘটনা,
নিলি এখন সম্পূর্ণ সচেতন। কথাবার্তা বলতে পারে। জাহিদ সর্বক্ষণ ওর আশেপাশেই আছে। জ্ঞান ফিরতেই নিলি তাঁকে দেখে মলিন হাসলো। ক্ষীণস্বরে বললো,’এবারেও মরলাম না জাহিদ ভাই।’
-‘কেমন লাগছে এখন? মাথায় পেইন আছে?’
-‘না।’ দুদিকে মাথা নাড়ালো নিলি।
জাহিদ ব্যাগ থেকে একটা হলুদ ফাইল বের করে নিলি দিকে এগিয়ে দিলো। নিলি ভ্রু কুঁচকালো। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’ কি এটা?’
-‘খুলে দেখুন।’
খুললো নিলি। ভেতরে ফ্ল্যাটের কাগজপত্র! রেজোয়ানের নামে কেনা ফ্ল্যাটটা নিলির নামে ট্রান্সফার করে দিয়ে গেছে সে!
নিলি অবাক হলো। হতবিহ্বল চেহারা নিয়ে জাহিদের দিকে চেয়ে রইলো। জাহিদ মুচকি হেসে বললো,’স্যার একেবারে পাকাপোক্তভাবে দলিল করে দিয়ে গেছে ম্যাম। কারো বাবার ক্ষমতা নেই এখানে হাত লাগায়।’
নিলি বিমূঢ়, অশ্রুসজল চোখে ফাইলটার দিকে নিনির্মেষ চেয়ে রইলো। অসহনীয় যন্ত্রনায় শরীর বিবশ হয়ে আসছে তাঁর। নিদারুণ মর্মপীড়ায় বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে একবারও রেজোয়ানের দেখা পায় নি সে। জাহিদের কাছে শুনেছে রেজোয়ানই অপারেশনের সব ব্যবস্থা করেছে। এখন আবার এই ফ্ল্যাটের কাগজপত্র।
নিলি কিছুতেই নিজের মনকে শান্ত রাখতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে রেজোয়ানের সঙ্গে অন্তত একবারটার দেখা করতে পারলে অনুতাপের বোঝাটা কিছুটা হলেও হালকা হতো। রুগ্ন গলায় বললো,’আপনার স্যার হস্পিটালে আসেন না জাহিদ ভাই?’
-‘অপারেশনের দিন ছিলো।’
-‘এরপর আর আসেন নি?’
-‘স্যার এখানে নেই ম্যাম। মঙ্গলবার সন্ধার ফ্লাইটে ঢাকা ছেড়েছেন। যাওয়ার সময় আমাকে বলে গিয়েছেন আপনার খেয়াল রাখতে। বলেছেন আপনি যদি মি.রেজার নামে কোন ধরনের মামলা করতে চান তাহলে আমি যেন আপনাকে সাহায্য করি। টাকা পয়সার ঝামেলা স্যার সামলে নেবে।’
নিলির মস্তিষ্ক এবার ফাঁকা হয়ে গেলো। জাহিদের কথাগুলোর ঠিক কি রিয়েকশন দেবে বুঝে উঠতে পারলো না। শূন্য দৃষ্টিতে জাহিদের মুখের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। চোখের পানি গলগল বেরিয়ে পড়লো। এত কষ্ট, এত গ্লানি নিয়ে সে কেন বেঁচে আছে? রোজ এত মানুষ মরে, সে কেন মরে না! কেন নিলি যেই ডাল আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় সেই ডালই ভেঙ্গে পড়ে?
এত লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে তো মরে যাওয়াই ভালো! যাকে সে নিজের ভালোবাসার মানুষের চাইতে বেশি বিশ্বাস করেছে, বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছে, সে-ই তাঁকে অসহায় অবস্থায় ফেলে চোরের মত পালিয়ে গেলো! নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে নিলির। অসম্ভব ঘৃণা হচ্ছে। তাঁর ঠাঁই কোথাও নেই। চোখের পানি মুছে নিজেকে স্থির করে নিলো। তারপর ম্লান হেসে বললো,’আপনার স্যার আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আমি সারাজীবন তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো জাহিদ ভাই। উনাকে বলবেন নিলি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আর আমি মি.রেজার নামে কোন মামলা করবো না। যদি সম্ভব হয় আপনি একবার আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চলুন।’
জাহিদ মনে মনে বিরক্ত হলো। এই সুযোগ ছিলো রেজাকে আচ্ছামত শায়েস্তা করার। নিলি মামলা করতে রাজি হলে রেজোয়ান কিছুতেই ওকে ছাড়তো না। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণার মামলায় চৌদ্দশিকের ঘানি টানাতো। কিন্তু এতকিছুর পরেও রেজার প্রতি নিলির শীতল মনোভাব জাহিদকে বিরক্ত করলো। নিলিকে অপেক্ষা করতে সে বেরিয়ে গেলো রিলিজের কাগজপত্র জোগাড় করতে।
★
এদিকে গতকালই তিন্নিকে দেখে এসেছেন ফুয়াদের বাবা মা। মেয়ে উনাদের পছন্দ হয়েছে। এবার ফুয়াদের মতামতটা জানা প্রয়োজন। ছেলেকে নিজের ঘরে ডাকলেন ফুয়াদের বাবা আহমেদ শফিক। ফুয়াদ নিজের ঘরে বসে অফিসের ফাইল রেডি করছিলো। বাবার ডাক শুনে হাতের কাজ রেখে বেরিয়ে গেলো।
-‘বাবা ডেকেছো?’
-‘হ্যাঁ। বসো। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
ফুয়াদ খাটের ওপর বাবার মুখোমুখি বসলো। মনে মনে ধারণা করে নিলো বিয়ের ব্যাপারেই কোন কথা বলতে ডেকেছেন আহমেদ শফিক। তার ধারণা একেবারে নির্ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আহমেদ শফিক গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,’গতকাল তোমার ফুফুর বাসায় তাঁর পছন্দের পাত্রীকে দেখে এসেছি আমি এবং তোমার মা। এই বিষয়ে তুমি কিছু জানো?’
-‘হ্যাঁ মা বলেছে।’
-‘যাইহোক, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ। কিন্তু বিয়েটা তোমার। তাই তোমার মতামত জানা সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। তোমার যদি কোন আপত্তি থাকে বলতে পারো।’
ফুয়াদ চুপ করে রইলো। কি বলবে বুঝতে পারছে না। আহমেদ শফিক ছেলেকে চুপ থাকতে দেখে আশ্বস্ত করে বললেন,’তুমি নির্দ্বিধায় নিজের মতামত জানাতে পারো। কোন সমস্যা নেই। আমি আর তোমার মা তোমার মতামতের বাইরে কিছু করবো না। তুমি হয়ত ভাবছো তুমি অমত করলে তোমার ফুপু মনে কষ্ট পাবে কিংবা বাবার সঙ্গে ফুপুর সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। তেমন কিছুই না। তোমার ফুপু বুঝবেন। প্রয়োজনে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলবো। কিন্তু তুমি মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ো না।
ফুয়াদ ভেবেচিন্তে কোন কুল কিনারা পেলো না। তিন্নির ব্যাপারে সে ভালো খারাপ কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না। শায়লা মুরসালীন জানপ্রাণ দিয়ে বলছে তিন্নি ভালো। বাবার মায়েরও পছন্দ হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় সেদিন তিন্নির যে আচরণ করেছে তাতে কোন দিক দিয়েই তাঁকে শান্তশিষ্ট লক্ষ্মী মেয়ে মনে হচ্ছে না ফুয়াদের। আবার সামান্য একটা কারণ নিয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতেও মন টানছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলো সে। নিজেকে স্থির করে নিয়ে বললো,’তোমাদের পছন্দ হলেই হবে। আমার আপত্তি নেই।’
শফিক সাহেব খুশি হলেন। বললেন,’তবে আমি আত্মীস্বজনদের সবাইকে জানাই? বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে হবে তো।’
ফুয়াদ ঘাড় কাত করে সায় জানালো। এত ভেবে লাভ নেই। সৃষ্টিকর্তা ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। হতে পারে সত্যিই তিন্নির সম্পর্কে তাঁর ধারণা ভুল। তাঁরা দুজনে সত্যিই একে ওপরের জন্য উপযুক্ত।
★
বিয়ের সব প্রস্তুতির মাঝে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে এংগেইজম্যান্ট এর দিনই তিন্নির সঙ্গে ফুয়াদের বিয়েটা হয়ে গেলো। কথা ছিলো আগে এংগেইজম্যান্ট হবে তারপর আত্মীয়স্বজনরা সবাই এলে বড় করে বিয়ে অনুষ্ঠান করা হবে।
কিন্তু গণ্ডগোল পাকালেন তিন্নির নানুভাই মোঃ আতাহার আলী। এংগেইজম্যান্ট দিন বৃদ্ধ বেঁকে বসলেন। তাঁর এক কথা এংগেইজম্যান্ট যদি হয় তাহলে বিয়েও হতে হবে। নইলে দুটোর একটাও হবে না।
তিনি আগেকার দিনের মানুষ। শুধুমাত্র এংগেইজম্যান্ট এর ওপর ভিত্তি করে ছেলেপক্ষকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাই নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করালেন, এংগেইজম্যান্ট এর পর আল্লাহ না করুক কোন কারণে যদি ছেলেপক্ষের সাথে মেয়ের পরিবারের কোন ঝামেলা হয় তখন মেয়ের কি হবে? তখন যদি ছেলেপক্ষ কোন একটা বাহানা বানিয়ে বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়? কে নেবে তার দায়ভার? ক্ষতিটা তো মেয়েরই হবে। সবাই তো বলবে মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। কেউ তখন আর বুঝবে না এটা সামান্য একটা এংগেইজম্যান্ট।
ফুয়াদের সঙ্গে আসা আত্মীয়রা জোর দিয়ে বললেন এসব কিচ্ছু হবে না। আহমেদ শফিকের কথা দাম আছে। তিনি এক কথার মানুষ। দুনিয়া উল্টে গেলেও তাঁর কথার নড়চড় হয় না।
কিন্তু আতাহার আলীকে কিছুতেই মানানো গেলো না। তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল। এদিকে মুরুব্বী মানুষ। লজ্জায় তার মুখের ওপর কথাও বলতে পারছেন না মেয়ে আর মেয়ের জামাই। লেগে গেলো দুপক্ষের মাঝে বাকবিতণ্ডা। মেয়েপক্ষ বলছে এংগেইজম্যান্ট হলে বিয়ে এখনই হবে। আতাহার আলী একদম ঠিক বলছেন। এদিকে বরপক্ষ বলছে আত্মীয়স্বজন ছাড়া এভাবে বিয়ে হয় না। এটাকে লোকে চোরাই বিয়ে বলে।
পরিস্থিতি হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেত যদি না শেষমুহুর্তে ফুয়াদের বাবা আহমেদ শফিক মুখ খুলতেন। তিনি মজলিসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন বিয়ে আজই হবে। কিন্তু বউ এখন তুলে নেওয়া হবে না। বউ তোলা হবে অনুষ্ঠান পর। তার একমাত্র ছেলের বউ। তিনি সাজিয়ে গুজিয়ে বউ ঘরে তুলতে চান।’
এরপর আর কেউ অমত করলো না। কাজি ডেকে সাদামাটা ভাবেই বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো। ফুয়াদ এবং তিন্নি দুজনের কেউই এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। তারওপর দুপক্ষের ঝামেলার কারণে আলাদাভাবে কথা বলারও সুযোগ পায় নি। সবমিলিয়ে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা। শেষে
যাওয়ার সময় ফুয়াদের এক খালাতো বোন বুদ্ধি করে তিন্নির নাম্বার যোগাড় করে নিলো ফুয়াদকে দেওয়ার জন্য। তিন্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,’চিন্তা করো না ভাবি। আজ রাতেই বরের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবো।
#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২২
তিন্নির কাছে সেদিন রাতে কোন ফোন এলো না। এ নিয়ে অবশ্য তাঁর কোন মাথাব্যথাও ছিলো না। মেহমানরা চলে যাওয়ার পরপরই ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে চলে গিয়েছিলো সে। সকাল থেকে বিয়ের ঝামেলায় দুদন্ড নিরিবিলি বসার সুযোগও হয় নি। সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচিতে কানের তালা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তাই সুযোগ পেয়ে আর দেরী করে নি। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর একঘুমেই রাত পার।
পরেরদিন নিতান্ত কৌতূহল বশতই ফোনে কোন আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে কি মা চেক করলো। আসে নি দেখে আর বেশি মাথা ঘামালো না।
ফোন এলো দুদিন পরে। সন্ধ্যার সময়। তিন্নি তখন নিজের ঘরে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। এমন সময় ফুয়াদ ফোন করলো। কিন্তু সংকোচ আর অস্বস্তিতে ঠিকমত কথা বলতে পারে নি তিন্নি। সে নিজেও বুঝতে পারছিলো না কেন তাঁর এমন অস্বস্তি হচ্ছিলো? ফুয়াদ খুবই সাধারণ কথাবার্তা বলেছে। এতে লজ্জা পাওয়ার মত কিছুই নেই।
তাছাড়া, তিন্নি বিয়েটা করেছে কেবল করতে হবে বলে। এছাড়া আর অন্য কোন এক্সপেক্টেশন তাঁর নেই। ইমোশন তো বহুদূরের কথা। শেষমেশ ফুয়াদের কথার মাঝখানেই ফোন কেটে দিয়েছে সে। ফুয়াদ কল ব্যাক করলো কিন্তু রিসিভ করলো না।
দুদিন বাদে ফুয়াদ বাসায় এলো দেখা করার জন্য। দুপক্ষের আত্মীয়স্বজনরাও তাই চাইছিলো। বউ উঠিয়ে নেওয়া হয় নি তো কি হয়েছে? ফুয়াদ তো আসাযাওয়া করতে পারে। স্বামী স্ত্রীর মিল মহাব্বতেরও তো একটা ব্যাপার আছে! ফুয়াদের নিজেরও মনে হচ্ছিলো তিন্নির সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন। আর কিছু না হোক অন্তত কথাবার্তা সহজ করার জন্যে হলেও প্রয়োজন।
★
ঘুম ঘুম চোখে আড়মোড়া ভাঙলো তিন্নি। সামনের চেয়ারে বসা ফুয়াদকে দেখে চমকে গেলো। স্বপ্ন দেখছে ভেবে চোখ কচলালো।
ফুয়াদ সুতির কাজ করা একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরে এসেছে। নতুন জামাই লাগছে তাঁকে। ফোনে নিউজফিড স্ক্রল করছিলো সে।
তিন্নিকে চমকাতে দেখে হালকা হাসলো। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বললো,’তুমি খুবই সুখি একজন মানুষ। কারণ তোমার ঘুম ভালো ঘুম হয়।’
তিন্নি সোজা হয়ে বসলো। তাঁর পরনে একটা বেগুনী সেলোয়ার কামিজ। নাকফুল, চুড়ি সব খুলে রেখে দিয়েছে। ফুয়াদকে দেখে সেগুলোর কথা মনে পড়লো। খাটের পাশেই ড্রেসিংটেবিল। টেবিলের ওপর চুড়ি রাখা আছে। চিকন দেখে দুগাছি চুড়ি পরে নিলো সে। এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে বললো,’কখন এসেছেন?’
-‘আধঘণ্টার মত হবে।’
-‘আপনি বসুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’
-‘বসেই তো আছি। তোমার কাজিনরা জোর করে আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।ঢুকে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। কয়েকবার ডেকেছি, সাড়াশব্দ করছিলে না দেখে আর ডিস্টার্ব করি নি।’
-‘আমার ঘুম গাঢ়। ঘুমালে হুঁশ থাকে না।’
তিন্নি ফোন করে তাসলিমা বেগমকে ঘরের দরজা খুলে দিতে বললো। তার কাজিনগুলো ভয়ানক অসভ্য। ওদেরকে বললে খুলবে না। তাই বাধ্য হয়ে তাসলিমা বেগমকে ফোন করেছে। তাসলিমা বেগম এসে দরজা খুলে দিয়ে গেলেন।
তিন্নি ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় জিজ্ঞেস করলো ,’কি খাবেন? চা না কফি?’
যদিও এখানে আসার পর একবার নাশতা করেছে ফুয়াদ। কিন্তু এইমুহূর্তে এক মগ কফি ভীষণ প্রয়োজন। অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে শরীরে ঝিমুনি এসে গেছে। তিন্নির প্রশ্নের জবাবে হাসিমুখে বললো,’কফি।’
মিনিট পাঁচেক বাদে কফি নিয়ে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করলো তিন্নি। কফির মগটা ফুয়াদের হাতে তুলে দিয়ে খাটের ওপর বসলো। ফুয়াদ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,’কফি ভালো হয়েছে।’
তিন্নি জবাব দিলো না। ফুয়াদ ঠিক কি উদ্দেশ্য এই বাসায় এসেছে সে জানে না। স্বামীর অধিকার প্রয়োগ করতে নাকি শুধু গল্পগুজব করতে? যাই হোক আপাতত দুটোর একটাতেও ইন্টারেস্ট নেই তিন্নির। কিছুদিন নিজেকে সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
-‘আসলে বিয়েটা এত হুট করে হয়ে গেছে যে আত্মীয়স্বজন কাউকেই ঠিকমতো জানানো হয় নি। তাই একটু ঝামেলা চলছে বাসায়। তোমাকেও ঠিকমত সময় দিতে পারছি না।’
-‘সমস্যা নেই। আপনি আগে বাসার সমস্যার সমাধান করুন।’
-‘বোঝার জন্য ধন্যবাদ।’
ফুয়াদ কফির মগ রেখে উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখলো। রাত বেশি হলে বাসায় ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। তাছাড়া ফেরার পথে একবন্ধুর সাথেও দেখা করার কথা আছে। তাসলিমা বেগমের সঙ্গে দেখা করেই বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
তিন্নি দূরত্ব বজায় রেখে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। ফুয়াদ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে তিন্নির দিকে চাইলো। তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গি যথেষ্ট আড়ষ্ট। ফুয়াদ সপ্রতিভ হাসলো। বললো,’তুমি কি আমাকে দেখে বিব্রত হয়েছো?’
তিন্নি চুপ করে রইলো। ফুয়াদ জবাব না পেয়ে নিজে থেকেই বললো,’হয়ে থাকলে আমি সরি। আমার আসলে ফোন করে আসা উচিৎ ছিলো। ট্রাস্ট মি, তোমাকে বিব্রত করার কোন ইন্টেনশন আমার নেই। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।’
তিন্নি এবারেও জবাব দিলো না। এইমানুষটার সঙ্গে সেদিন রাস্তায় ঝগড়া হয়েছে তাঁর। যদিও ঝগড়াটা একতরফাই ছিলো। ফুয়াদ দোষ স্বীকার করে চুপচাপ মিটমাট করার চেষ্টা করেছে কেবল, রাগ যা করার তিন্নিই করেছে। কিন্তু প্রথম পরিচয়ের পর থেকে এইপর্যন্ত এই লোকটাকে কোনভাবেই ভায়োলেন্ট মনে হয় নি তাঁর। তবুও কেন সে স্বাভাবিক হতে পারছে না? এই প্রশ্নের উত্তর তিন্নির নিজেরও জানা নেই। এই মানুষটার সঙ্গে সে আদৌ স্বাভাবিক হতে পারবে কি না তাও জানে না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বললো,’বিব্রত না। আমি আসলে একটু অন্যমনস্ক। আপনি কি আজকে থাকবেন?’
হঠাৎ মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে যেতেই ভীষণ লজ্জায় পড়লো তিন্নি। মনের ভয় তাঁর মুখে প্রকাশ পেয়ে গেছে। ফুয়াদ কি বুঝেছে কে জানে। সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো,’না। আজকে তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি। বিয়ের দিনও ঠিকমতো কথাই বলতে পারি নি।’
তিন্নি পূর্বোক্ত প্রশ্নটা ধামাচাপা দিতে বললো,’না আসলে মা আপনার জন্য রান্না করছেন তো তাই।’
ফুয়াদকে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলো। এখন সবে সাড়ে আটটা বাজে। ডিনার করতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। এদিকে বন্ধুর সঙ্গেও দেখা করতে হবে। চিন্তিত মুখে বললো,’চলো তো মা কি করছে দেখি?’
গিয়ে দেখলো তাসলিমা বেগম সত্যিই চুলায় রান্না বসিয়ে দিয়েছেন। নতুন জামাই কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়বেন না। ফুয়াদও জোর দিয়ে না করতে পারলো না। অভদ্রতা দেখায়। বাধ্য হয়ে থেকে গেলো। বন্ধুকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজকে দেখা করতে পারবে না।
এদিকে অনেকক্ষণ বাদে তিন্নির কাজিনরা সুযোগ পেয়ে দুজনকে জেরা শুরু করে দিলো। এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কি করেছে তাঁরা এই নিয়ে নানারকম লজ্জাজনক প্রশ্ন।
তিন্নি ইচ্ছে করেই চুপ করে রইলো। এই লোক কি বলে সেটা শুনতে চায় সে। ফুয়াদ মুচকি হেসে বললো,’তোমাদের আপুকে গান শুনাচ্ছিলাম।’
সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করলো কি গান। ফুয়াদ দুষ্টুমিষ্টি হাসলো। অনেকটা কবিতা আবৃতির সুরে গেয়ে উঠলো সে,
“একেলা পাইয়াছি হেথা,
পলাইয়া যাবে কোথা
চৌ-দিকে ঘিরিয়া রে রাখিছে
আমার শ্যালিকা গনে।
আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম!”
তাঁর গান শুনে তিন্নি কাজিনরা সবাই হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে পড়লো। তিন্নিকে টিপ্পনী কেটে বললো,’তোমার বর কিন্তু ভীষণ দুষ্টু আপু!’
লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলো তিন্নি। সে ভেবেছিলো ওদের সঙ্গে পেরে উঠবে না ফুয়াদ। লজ্জায় কাঁচুমাচু করবে। কিন্তু এখন তো দেখছে উল্টো, মজা নিচ্ছে এই লোক।
যতক্ষণ ছিলো ফুয়াদ সবার সঙ্গে দুষ্টুমি করেই কাটিয়েছে। তিন্নি কেবল চুপচাপ বসে ছিলো। এমন পরিস্থিতিতে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না তাঁর। উঠে গেলে অভদ্রতা হতো। আবার কথা বলতেও সংকোচ লাগে। তাই চুপচাপ বসেই ছিলো। এরপর থেকে মোটামুটি ঐ বাসায় আসা যাওয়া হয় ফুয়াদের। তিন্নি যদিও পুরোপুরি ফ্রি হতে পারে নি তবে টুকটাক কথাবার্তা বলে এখন।