#বাদামি_চোখ-১০,১১
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
১০
হঠাৎ করে এমন একটা দুঃসংবাদ পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে করে দিলো!
তাই বলে সবকিছু থেমে গেছে তা নয়, যারা আছে তারা পুরো দমে আনন্দ করছে। কিন্তু একজন ছাড়া যেন পুরো বিয়ের আয়োজনটাই আমেজহীন হয়ে গেছে।
এদিকে আমি তনয়ের ফোনে বারবার এসএমএস পাঠাতে লাগলাম যেন পৌঁছেই আমাকে জানায়।
বেশ খানিক্ষন হয়ে গেলো কিন্তু তনয় কলও করলোনা আর কোনো জবাবও দিলোনা।
লিয়নদের পরিবারের সবাই-ই রয়ে গেছে।
সবাই চাচ্ছে পরিবেশটার সতেজতা বজায় রাখতে। কিন্তু আমার ভীষণ ভয় লাগছে, এদিকে তনয় আমার ফোন রিসিভ করছেনা। অন্যদিকে আমার সন্দেহ এখন ধারা হারিয়ে ফেলেছে, অনেকজনকেই সন্দেহ হচ্ছে আবার কাউকেই জোর দিয়ে সন্দেহ করতে পারছিনা।
আবার কে জানে এই নতুন অচেনা শত্রু কে? যে এই ম্যাগাজিনে আমার লেখা ছাপালো এবং আমাদের হাতে পৌঁছিয়েই তবে গেলো! তবে আমি বুঝতে পারছি সবকিছুর পেছনে একজনই আছে যার ইশারায় সব হচ্ছে, সে বিয়ের মতো একটা আনন্দমুখর রঙবেরঙের উৎসবকে অন্ধকারে রূপ দেওয়ার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছে। খুব বড়সড় কারণ তো নিশ্চয়ই হবে? এমনও হতে পারে সে আমার নয় তনয়ের সাথে কোনো রকম সম্পর্কযুক্ত।
কিন্তু এই ধাপে এসে দুজনকেই ধাঁধায় ফেলছে!
আমি এবার আরো ভালো করে মনে করার চেষ্টা করলাম, ওই মোবাইলে কি কি তথ্য হারিয়েছিলাম যাতে ওই আততায়ীর বিশ্বাস জন্মেছে যে আমাদের বিয়ে ভেঙে দেওয়ার মতো অসাধারণ কাজটা সে করতে পারবে?
কিন্তু লিয়নের সাথে আমার কিছু ছবি আর কথোপকথন ছাড়া তেমন কিছুই মনে করতে পারছিনা। লিয়নের সাথে শেষ সময়ে কিছু আবেগময়ী লম্বা রচনার মতো টেক্সট ছিল। পুরোটাই ওর প্রতি ঢেলে দেওয়া আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
এসব তো একটা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় স্বাভাবিক ব্যপার।
‘
এদিকে আমার ভাবনার ভেতর লিয়নের বউ এসে আমার পাশে বসলো, আর রসাত্মক স্বরে বললো,
‘ বর চলে গেছে বলে কি মন খারাপ? অবশ্য মন খারাপ করাটাই স্বাভাবিক। বিয়েতে যদি সর্বোক্ষণ বরই পাশে না থাকে তাহলে কি করে হয়? যাক মন খারাপ করো না, একেবারে তো আর চলে যাচ্ছেনা।
আমি জোর করে হেসে বললাম,
‘ এটা পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা। একেবারে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গ মোটেও নয় ভাবি।
লিয়নের বউ হাসতে হাসতে আবার বললো,
‘ ধরো যদি পালিয়ে যায়?
আমিও উনার দিকে তাকিয়ে আরো হাসলাম। উনি হয়তো বুঝাতে চাচ্ছে পালিয়ে গেলে আমার কলঙ্ক হবে, কেননা বিয়ের আসর থেকে বর পলাতক! বিষয়টা কেমন না?
অথচ আমার মনে হচ্ছে উনি জানেনা যে পালিয়ে যাওয়ার কথা এখানে আনা হাস্যকর। কারণ বিয়ে হয়ে গেছে, এখন বর তার কাজে যে কোথাও যেতে পারে, এখানে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার মতো অলক্ষুণে সম্ভাবনার ভয় তো নেই! হয়তো লিয়নের মতো তিনিও সেটা এখনো জানেন না। কেউ উনাদের জানায়ও নি!
লিয়নের বউ এরকম আরো বিরক্তিকর যতসব রসিকতা করার চেষ্টা করলো। আমিও ভেতরকার বিরক্তি চাপিয়ে তার সাথে সাথে হেসেই কথাগুলো হজম করলাম। নতুন বউ,বাড়তি কিছু বললে চারদিকে আবার রটনা করে ফেলবে।
তারপর আমার মধ্যে তার কথায় তেমন আগ্রহ না দেখে আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলো।
কিন্তু সে এখান থেকে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরেই কে জানি বললো, সে নাকি হঠাৎ ভরা মানুষের ভীড়েই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।
বেশ আশ্চর্য হলাম আমি। কেননা আমার সাথে কিছুক্ষণ আগেই হাতে কোনো একটা ঠান্ডা পানীয় নিয়ে কতো হেসে কথা বলছিলো, আর এখনি এভাবে পড়ে যাওয়ার মানে কি?
আমি একদমই বুঝতে পারছি না চারপাশে এসব কি হচ্ছে? আমাদের বিয়েতেই কেন সব রকম খারাপ সংবাদ আর বাধার সৃষ্টি? সবকিছু বারবার এতো বিষাদময় হয়ে উঠছে কেন?
আমি বিরাট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সেখান থেকে উঠে চলে গেলাম লিয়নের বউকে দেখতে।
কিন্তু ততক্ষণে একটা গাড়ী এনে পাশেই একটা হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে।
সবকিছু ভীষণ দ্রুত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমার কাছে যেন সময় পেরুচ্ছিলোই না। আমি ফোনটা বের করে তনয়ের নাম্বারে কল লাগালাম।
অস্বস্তি লাগছে শুধু!
কল করার পর মূহুর্তেই মেয়েলী কণ্ঠে একজন কয়েকখানা বাক্য উচ্চারণ করলো, যা নিতান্তই পরিচিত হতাশাময় বাক্য । মানে তনয়ের ফোনে কল যাচ্ছেনা, তার ফোন নাকি অফ,এটাই বলছে!
তারপর আমি বাধ্য হয়ে আমার শ্বশুরের নাম্বারে ফোন লাগালাম, একটু রিং হতেই উনি রিসিভ করলেন, আমি সাথে সাথেই বললাম,
‘ বাবা সবকিছু ঠিক আছে তো?
তিনি কণ্ঠস্বরে রুক্ষতা মিশিয়ে জবাব দিলেন,
‘ নিশির শরীরের বিভিন্ন জায়গা বেশ মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। অনেক রক্ত ক্ষয় হয়েছে। এখন রক্তের জন্য আটকে গেছি। এক ব্যাগ জোগাড় করতে পেরেছি কেবল, কিন্তু আরেক ব্যাগ দরকার। তনয় যদি থাকতো এতটা কষ্ট হতোনা।
উনার কথা শুনে এবার ভীষণভাবে আৎকে উঠলাম। ভয়ার্ত গলায় বললাম,
‘ কি বলছেন? সে ওখানে নেই? কিন্তু আপনাদের পেছনে পেছনেই তো গেলো।
ওপাশ থেকে আরো আতংকের সাথে বাবা জবাব দিলেন,
‘ কি বলছো বউমা? আমি তো এতক্ষণ ধরে ওকে আসতে বলছিনা কারণ বিয়ের আসর থেকে আসতে বলাটাকে আমার মনে সায় দেয়নি। এমনকি ওকে আসার সময়ও বলে আসছি আমরা এদিকটা দেখবো, তুই আসিস না। কিন্তু সে আমার কথা শুনেনি, আর যদি আসে তাহলে কোথায়? এতক্ষণ তো লাগার কথা না। আচ্ছা ফোন করছি আমি দাঁড়াও।
আমি এবার কান্না জড়িত গলায় বললাম,
‘ লাভ নেই বাবা। ওর ফোন বন্ধ বলছে। আমি এখন রাখছি আর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছি।
বলেই আমি ফোনটা কেটে দিলাম।
আর আমার ভাইয়াকে বলে পাঠালাম। ভাইয়াও খুঁজতে সাথে সাথে বেড়িয়ে গেলো।
এদিকে সারা শরীর কাঁপছে আমার। লিয়নের বউ যে হেসে হেসে বলছিলো বর পালিয়ে গেলে কি করবে? এই কথাটাই কানে ভাসছে এখন।
আর সেই বা হঠাৎ এমন অসুস্থ হয়ে গেলো কেন?
ওদের জামাই বউ দুজনের উপর স্থির সন্দেহও করতে পারছি না আর সরাতেও পারছি না।
মাথায় পুরো গন্ডগোল পাকিয়ে গেছে আমার!
নিশ্চয়ই কেউ আড়াল করে পরিকল্পনা করে আমাদেরকে এমন এলোমেলো করে দিতে চাচ্ছে, আসলেই এসব করে কি এমন ফায়দা হবে তার?
খাওয়াদাওয়ার পর্ব প্রায় শেষ। আর তার অনেক আগেই আমাদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে।
ছবি এবং ভিডিও ধারণকারীরা বসে ঝিমুচ্ছে, হয়তো মনে মনে বলছে, এমন কাজে প্রতিদিন ডাক আসলে মন্দ হয়না, অল্প কাজেই পুরো টাকা পাবে।
আসলেই এমন বিয়ে ওরাও হয়তো দেখেনি আর।
হুট করে আমার মাথায় আসলো ম্যাগাজিন দেওয়ার সময় তনয়দের বাসার কাজের মেয়ে রূপা বলছিলো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে এটা দিয়েছে।
আমি আমার ভাবিকে ডেকে বললাম,
‘ রূপা কোথায় ভাবি? ওকে আসতে বলো তো।
ভাবি মাথা নেড়ে ডাকতে গেলো। কিছুক্ষণ পরে দইয়ের একটা গ্লাস হাতে রূপা এসে বললো,
‘ ডেকেছিলেন?
আমি বললাম,
‘ হ্যাঁ ডেকেছিলাম। তুমি আমাকে বলো, আমাদের কাছে যেই ম্যাগাজিনটা দিলে, ওটা কে দিতে বলেছিলো? নাম কি তার? কিছু কি জানো?
সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
‘ না কিছুই জানিনা।
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
‘ জানোনা? সেটা কি করে হয়? আচ্ছা তাহলে সিসিটিভি চেক করতে বলছি।
রূপা এবার অবাক হয়ে বললো,
‘ কিন্তু সেই ছেলেটা তো বাইক থেকে নেমেই আমাকে এটা দিলো, হেলমেট পরা ছিল। সিসিটিভি দেখে কি করবে? আর কিসের জন্য?
আমি কিছুটা রাগ নিয়ে বললাম,
‘ তাহলে কি মুখ না দেখেই হ্যান্ডসাম বলছো?
রূপা হেসে বললো,
‘ হ্যাঁ খুব স্টাইলিশ, মুখ না দেখেই বুঝা যায়। তাই আরকি!
আমি খুব বিরক্তি নিয়ে রূপা শেষ কথাকে এড়িয়ে বললাম,
‘ আচ্ছা ঠিক আছে যাও এখন।
রূপা চলে গেলো।
এদিকে আমি অসংখ্যবার তনয়ের ফোনে ট্রাই করেছি, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছেনা।
এদিকে সন্ধ্যার পরে এই জায়গা অন্যরা বুকিং নিবে।
তার আগে আমাদের চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু জানিনা এখন কি হতে যাচ্ছে?
আস্তে আস্তে মানুষের সমাগম কমতে লাগলো, কেউ আসে শুধু আমাকে দেখে তারপর চলে যায়। আবার কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে বর কোথায়? আশেপাশে যারা আছে তারা বলে, বর তার এক আত্মীয়ের দূর্ঘটনার সংবাদে সেখানেই ছুটে গেছে।
এদিকে আমি আমার ভেতরের কথা তনয় ছাড়া আর কাউকে বলার ভরসা পাচ্ছিলাম না। কাকে বলবো? বললেই বিস্তারিত উঠে আসবে! আর বিস্তারিত কাউকেই বলা যাবেনা।
ভাইয়াকে কয়েকবার ফোন দিয়েছি কিন্তু ভাইয়া বললো অনেকদূর পর্যন্ত মানুষকে জিজ্ঞাসা করে চলেছে কালো বাইকে বরবেশে কাউকে দেখেছে কিনা! তার ছবিও দেখিয়েছে কিন্তু কারো থেকেই পজিটিভ উত্তর পাচ্ছেনা।
শেষ উপায় না দেখে কল লিস্টের কিছুটা নিচে গিয়ে সেই অদ্ভুত সংখ্যার নাম্বারটায় ফোন দিলাম।
রিং বাজার সাথে সাথেই রিসিভ করে ফেললো, এদিকে আমার সাথে ভাবি দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাবিকে পাশ কাটিয়ে একটু আড়াল হয়ে ফোনটা ভয়ে ভয়ে কানে নিলাম।
তখনি মেয়ে কণ্ঠে তীব্র হাসির আওয়াজ ভেসে আসলো। আমি আস্তে আস্তে বললাম,
‘ হাসছেন কেন আপনি?
মেয়েটা জোরে জোরে বললো,
‘ হাসছি কেন আমি? খুব হাসতে ইচ্ছে করছে তাই হাসছি! কারণ খুশির সময়ই এসেছে আমার। আর আমি জানতাম এবার তুমিই আমাকে ফোন করবে! শুনো আমি আমার ভালোবাসাকে পেয়ে গেছি। তোমার হবু বর এখন আমার বর হতে যাচ্ছে!
আমি এসব শুনতে শুনতে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলাম প্রায়। তবুও বিরবির করে বললাম,
‘ তনয়কে তাহলে আপনি নিয়ে গেছেন? যদি ভালোবাসেন আগেই নিয়ে যেতেন, এখন এভাবে বিয়ের মধ্য থেকে কেন নিলেন?
মেয়েটা উচ্চহাসির সাথে বললো,
‘ আমার উপর করা প্রতিশোধ নিতে! তাই আমিও পণ করেছি বিয়ে ওকেই করবো তবে তার আগে ওকে আমার মতো করে লোকলজ্জার শিকার করে!
আমি আস্তে আস্তে বলে ফেললাম,
‘ জানিনা কিসব বলছেন? তবে বিয়ে করলেও দ্বিতীয় বউ হবেন আপনি, কারণ আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে দুপুরের আগেই। জিজ্ঞাসা করুন তনয়কে!
মেয়েটা এবার চুপ হয়ে গেলো। আমিও চুপ করে শোনার চেষ্টা করছিলাম তনয় সেখানে সত্যিই আছে কিনা!
কয়েক মিনিট পর মেয়েটা বললো,
‘ তনয় তুমি বিয়ে করে ফেলছো? আমাকে এতক্ষণ কথাটা বললেনা? ছিহ!
তখন আমি একদম তীক্ষ্ণ আওয়াজে শুনলাম তনয়ের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সে বলছে,
‘ আমার চোখ খুলেন, তারপর সব বলতেছি। আর আপনি বারবার কিসের প্রতিশোধের কথা বলছেন? আমার উপর কারো সামান্যতম রাগ অভিমান আছে বলে আমার ধারণা নেই, অথচ আপনি আমার উপর এত প্রকট রাগ পোষে অন্য মালবাহী গাড়ী দ্বারা আমার বোনদের গাড়ীর উপর ইচ্ছেকৃত দূর্ঘটনা ঘটিয়েছেন, অতঃপর আমাকে রাস্তা থেকে উল্টা পাল্টা বলে লোকজন দিয়ে ধরিয়ে এনে বেঁধে রেখেছেন। নিজের পরিচয়ও দিচ্ছেন না, আর সবকিছু খুলে বলেছেনও না।
মেয়েটা এবার ফোনের স্পিকারে মুখ এনে বললো,
‘ বুঝলে আমার ক্ষমতা, তুমিই তো তৃতীয় লিঙ্গ বলে বেশ তামাশা করছিলে। দেখো আমি তৃতীয় লিঙ্গ না হয়েও কি কি করতে পারি? তোমার বর এখন আমার কব্জায়!
বলেই লাইনটা কেটে দিলো। আমি আবারও ফোন করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাহ আর পারছিনা।
এবার আমি পুলিশে ইনফর্ম করার চিন্তা করলাম।
আমার আব্বুকে গিয়ে যাবতীয় না বলে শুধু ওকে আটকে রাখার বিষয়ে বলতে গেলেই বাবা বললো,
‘ দুইটা খুশির সংবাদ। লিয়নের বউ সন্তান সম্ভবা।
আর তোর ভাইয়া বললো, তনয়ের খোঁজ পেয়েছে।
বাবার কথা শুনে আমি পুরো তাক খেয়ে খেলাম! খোঁজ পেয়েছে মানে? কীভাবে সম্ভব? এখনি না আমি কথা বললাম? আর তনয়ের গলার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেলাম!
চলবে…..
#তাজরীন_খন্দকার
#বাদামি_চোখ [১১]
আব্বুর দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি!
লিয়নের বউ সন্তান সম্ভবা কথাটা বিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু তনয়কে ভাইয়া কীভাবে খুঁজে পাবে?
মাত্র কিছুক্ষণ আগেই না শুনলাম তনয় চিৎকার করে বলছিলো আমার চোখ খুলে দেন, আমাকে কেন আপনি বেঁধে রেখেছেন?
আমি জানিনা কি হচ্ছে এসব? আমার মাথার শিরা-উপশিরা স্বাভাবিক কাজ করা থামিয়ে দিয়েছে। সেখানে যানজট পাকিয়ে গেছে।
তবে এখন অপেক্ষা করে দেখা যাক সত্যিই তনয় আসছে কিনা? সে আসলেই তো সবকিছু পরিষ্কার হবে।
অতঃপর আমি পিছাতে পিছাতে গিয়ে একটা সোফায় বসে পড়লাম। কপালে একটা হাত ভর করে মাথা নিচু করে আছি! অবিশ্বাস্য আর অসম্ভব যা-ই হোক না কেন, শুধু তনয় ফিরে আসুক।
বেশ খানিক্ষণ পেরুনোর পর বাহির হতে বাইক থামার আওয়াজ এলো। আমি বধূবেশেই একা সবার আগে দৌঁড়ে বেড়িয়ে গেলাম। আমার পেছনে পেছনে এখন অন্যরাও আসছে!
আমি গেইটের কাছে গিয়েই হাঁফাতে হাঁফাতে থেমে গেলাম। মূহুর্তেই ঠোঁটের কোণে কিছু হাসি এসে জড়ো হয়েছে,তবুও আমার চোখে জল। তনয় একদম সুস্থ স্বাভাবিকই ফিরেছে।
ভাইয়ার পেছন থেকে নেমেই তনয় আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আস্বস্তির পলক ফেললো।
ভাইয়া আর তনয় একসাথেই উপরে উঠে এলো, ভাইয়া আগে আগে ভেতরে যেতে থাকলো। আর তনয় এসে আমার হাত ধরে বললো,
‘ হাসছো আবার কাঁদছো যে! আরে দেখো আমি একদম ঠিক আছি।
আমি কোনো প্রশ্ন না করে তনয়ের সাথে ভেতরে গেলাম। ভেতরে গিয়েই আমার মনে হলো নিশি আপুর রক্তের জন্য বাবা পেরেশান করছেন খুব।
আমি তনয়ের হাত টেনে বললাম,
‘ নিশি আপার রক্ত..
বলার আগেই তনয় বললো,
‘ রক্তের সন্ধানেই একজনের সাথে রওয়ানা দিয়েছিলাম। হাসপাতালে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে যখন জানলাম রক্ত লাগবে তখন আমি বাবার সাথে দেখা না করেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম, তারপরই লোকটা আমাকে ভুলভাল রাস্তায় নিয়ে গেলো, আর বাইক থেকে নামিয়ে কিছু লোকজন আমাকে বেঁধে ফেললো।
আমি অবাকের সাথে তাকে বসতে বললাম। তনয় ক্লান্তির রেশ তুলে জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বসে পড়লো।
আমিও পাশে বসলাম। এর মধ্যে মা ভাবি বাকিরা এসে জানতে চাইলো তনয় ঠিক আছে কিনা আর নিশির কি খবর?
তনয় মাথা নেড়ে সবাইকেই বললো নিশি আপার রক্ত জোগাড় হয়েছে চিকিৎসা চলছে, ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে!
অতঃপর সব প্রশ্ন থেমে যাওয়ার পরে আমি বললাম,
‘ বাড়ি তো যাচ্ছি কিছুক্ষণ পরে। সবাই হয়তো যাওয়ার প্রস্তুতিই নিচ্ছে এখন৷ কিন্তু আপনাকে এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়ার মানে কি? আর আমি ফোন করার ক্ষানিক পরেই আবার ছেড়ে দেওয়ারই কি কারণ?
তনয় আমার দিকে ফিরে বললো,
‘ সেই প্রশ্ন আমারও। আমি বুঝতেছিলাম তোমার ফোন রাখার পর পরেই আমাকে গাড়ীতে তুলে অল্প সময় কোথায় যেন নিলো, তারপর ধরে একটু হাঁটিয়ে নিয়ে হঠাৎ কে জানি কাঁচি দিয়ে হাতের বাঁধন কেটে দিলো। আমি তখন হাত দিয়ে ধিরে ধিরে চোখ খোলার চেষ্টা করলাম, খুব শক্ত করে বেঁধেছিলো, তারপর খুলে দেখি আমি মেইন রাস্তার পাশে একটা গাছপালায় ঘেরা জায়গা দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে কেউ নেই! আমি চোখ খুলতে খুলতে সবাই চলে গেছে হয়তো। আর এই সময়টা খুব অল্প ছিল, তারা আমাকে এর আশেপাশেই নির্জনে নিয়ে গেছিলো। কোনদিকে নিলো আর আনলো কিছুই আঁচ করতে পারলাম না।
তারপর আমি মেইন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে দেখলাম জায়গাটা অচেনা নয়, অসংখ্যবার এই রাস্তায় এসেছি আমি!
এর মধ্যেই তোমার ভাইয়া চলে আসলো, আমি জানিনা এটা কীভাবে সম্ভব ? আমি গাড়ীর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম,তখন হুট করেই উনি চলে আসলেন!
আর আমাকে উনার সাথে তুলে নিলেন।
এদিকে আমার ফোন আর আমার বন্ধুর বাইক কোথায় আছে তা এখনো জানিনা।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে তনয় থামলো। সে ভালো করে দম নেওয়ার আগেই আমি আবার বললাম,
‘ কে ছিল একটুও বুঝতে পারেননি?
তনয় আমার দিকে ফিরে বললো,
‘ নাহ একদমই বুঝতে পারি নি। তবে বারবার বলছিলো কিসের যেন প্রতিশোধ নিতে চায়?! আমি নাকি তার সাথে অন্যায় করেছি। ওর চোখ যদি তোমার মতো বাদামি হতো তাইলে নাকি তোমার জায়গায় সে থাকতো! আর বারবার বলে যেভাবেই হোক সে আমাকে ঠিকি বিয়ে করবে! আমার বিয়ে হয়ে গেছে শুনেও বলে, সে নাকি তার পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করবে, আমাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে হলেও সে আমার সংসারে আসবে! নিবিতা, মেয়েটা ভীষণ বিপদজনক। আমার জানামতে আমার কোনো শত্রু নেই, আমার কোনো মেয়ের সাথে কখনোই সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু আড়াল থেকে এমন কেউ কিভাবে উদ্ভব হলো, আমার মাথায় ধরছেনা।
আমি বুঝতে পারছি তনয় আমার চেয়েও বেশি হতবিহ্বল। আমি আর কথা বাড়ালাম না। তবে বাস্তব জীবনে একটা মেয়ে মানুষ কীভাবে এতোকিছু করতে পারে এসব শোনার আগে আমি কখনো আন্দাজ করতে পারিনি।
তনয় আমাকে বসতে বলে উঠে গেলো। এখানকার যাবতীয় কাজ শেষ করে সবকিছু গোছগাছ আছে কিনা দেখে নিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা চলে যাওয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম।
সবাই সবার গন্তব্যে রওয়ানা দিলো, শুধু আমার গন্তব্য নতুন! শুরুতেই যে পরিমাণ বাঁধা বিপত্তির শিকার হয়েছি, জানিনা কপালে কি আছে? তার উপর কোনো কিছুরই সঠিক সমাধান পেলাম না।
আমার শ্বশুর শাশুড়ী হাসপাতাল থেকেই বাড়ি ফিরবে, তনয় আমার ফোন থেকে তাদের খোঁজ নিয়েছিলো। নিশি আপা নাকি এখন কিছুটা ভালো।
কিন্তু উনার জন্য খুব খারাপ লাগছে, বেচারা বিয়ে খেতে এসেছিল কিন্তু জায়গামতো আর পৌঁছাতে পারলোনা। তার আগেই জীবন যুদ্ধের লড়াই!
গাড়ীতে বসে আমি তনয়কে বললাম,
‘ আচ্ছা আপনি বলছিলেন আমাদের জন্য কেউ পরিকল্পিত দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে, এটা কি আসলেই সত্যি?
তনয় বললো,
‘ এটা আমি নিজে থেকে বলছিলাম। আমার তো তাই মনে হচ্ছে। আর এটা বলার পরে ওই মেয়ে কোনো হাঁ কিংবা না সূচক কিছু বলেনি। তাহলে তো বুঝাই যায় এসব তার ইশারাতেই হয়েছে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললাম,
‘ জানেন মেয়েটার কণ্ঠস্বর আর কথার ধরন কেমন যেন চেনা চেনা। হয়তো বাস্তবে আমি শুনেছি কিন্তু ফোনে শোনা হয়নি। আবার জোর দিয়ে বলতেও পারছিনা।
আমার কথা শুনে তনয়ও বললো,
‘ একদম আমার সন্দেহের কথা বললে তুমি, এতদিন আমার তাই মনে হতো। কিন্তু আজকে সরাসরি শুনেও মনে হলো এই কণ্ঠস্বর অবশ্যই চেনা আমার, তবে কোনোভাবে মনে করতে পারছিনা কোথায় শুনেছি?
তনয়ের কথাটা বেশ অবাক করার ছিল। আমাদের দুজনেরই এমন মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক, কেননা সে চিনলে আমি কি করে চিনতে পারি?
তনয় আমাকে হাত বাড়িয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ চিন্তা করো না, কিছুই করতে পারবেনা সে। আমরা একসাথে দুজনকে বুঝেশুনে থাকলেই সব জটিলতা সহজ হতে থাকবে।
আমি আমার একটা হাত তনয়ের বুকের উপর রেখে ওর কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিতমনা হলাম।
মাথা রাখার মতো এমন একটা বিশ্বস্ত কাঁধ পেলে দুনিয়ার যাবতীয় অশান্তি মাথায় চেপে বসলেও কি কিছু করতে পারবে? এই মূহুর্তে তা মনে হচ্ছেনা! এইতো জীবন সংসারের প্রথম অনূভুতিটা ভীষন সুন্দর!
‘
কিছুক্ষণের পর আমরা পৌঁছে গেলাম। সবাই বরণ করতে এগিয়ে আসছে।
আমার শ্বশুর শাশুড়ী ইতোমধ্যে বাড়িতে চলে আসছে।
এখানকার সবকিছুই ঠিকঠাক।
আর সবাই এখানে উপস্থিত আছে, তবে লিয়ন তার বউকে নিয়ে এখনো ফিরেনি।
সেখানে গিয়ে সারাদিনের বিরক্তিকর পরিস্থিতির কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। আশেপাশের যারা অনুষ্ঠানে যায়নি তারাও এখন বউ দেখতে আসছে।
সবার মধ্যে আগের উৎফুল্লতা আবার জাগ্রত হয়েছে।
সবার সাথে আনন্দ গল্পগুজবে রাত ১১ টা প্রায়। লিয়ন এবং তার পরিবার মাত্রই হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। তারা নিজেদের বাসায় না গিয়ে আমাদের এখানেই প্রথম আসলো।
লিয়নের বউ এসেই আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘ রুম ঠিকঠাক সাজিয়েছে তো? দেখো আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম হঠাৎ, এতক্ষণে ফিরলাম। এখন চোখে সবকিছু অন্ধকার অন্ধকার লাগছে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘ অন্ধকার আর যাই লাগে, বলেন মিষ্টি এনেছেন তো?
লিয়নের বউ জিব কামড়ে পেছন ঘুরে লিয়নকে বললো,
‘ একি আপনি মিষ্টি আনতে ভুলে গেলেন?
এখানকার উপস্থিত সবাই লিয়নের বউয়ের কথা শুনে বিষয়টা খেয়াল করলো আর চিৎকার করে বললো,
‘ তাইতো? মিষ্টি কোথায়?
লিয়ন ভেবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাত এগারোটা বাজে সে মিষ্টি আনতে যাবে এখন?
সে তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ তুমি এতো রাতেই কেন এটা মনে করলে? কাল সকালেই বলতে! এখন?
লিয়নের বউ সবার সামনে সমানতালে নাছোড়বান্দা হয়ে বললো,
‘ যেখান থেকে পারেন এখনি আনবেন। আর সবাই আজকেই মিষ্টি খাবে। বিশেষ করে নিবিতার জন্য বেশি করে আনবেন। যেন আমার সন্তানের চোখ ওর মতো বাদামি হয়!
আমি হেসে বললাম,
‘ আমি বেশি মিষ্টি খেলে আমার মতো চোখ হবে?
লিয়নের বউ আমতা আমতা করে বললো,
‘ মানে খেয়ে বেশি বেশি প্রার্থনা করবে আরকি,যেন হয়!
লিয়ন মুখ ফিরিয়ে বের হয়ে গেলো। লিয়নের বউ এসব বলছে আর খুব হাসছে, আমিও তার সাথে সাথে হাসছি।
ওদের সম্পর্কটা বুঝা যায় না, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সুন্দর। অথচ কাল থেকে দেখছিলাম কেমন যেন আলাদা আলাদা ছিল। লিয়নের বউ এখন হাসিখুশি কিন্তু লিয়নের মধ্যে খুশির মাত্রা ততটাও নেই।
আধা ঘণ্টা পরে সবাই একসাথে থাকতে থাকতেই লিয়ন বিরাট বড় মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির হলো।
আর লিয়নের বউ নিজ হাতে সবাইকে খাওয়ালো।
না চাইতেও আমাকে জোর করে দুইটা খাওয়ালো! আর লিয়ন চুপচাপ এক জায়গায় বসে রইলো।
মাঝে মাঝে লিয়নের বউ আমার সাথে কথা বলার সে আড়চোখে তাকায়, আমি তাকালেই সে আবার চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
ওদের উপর থেকে আমার সন্দেহ পুরোপুরিই কেটে গেলো। আর লিয়নের বউকে এখন আমার অসহ্য লাগছেনা। যে আড়াল থেকে এসব করছে সে অন্য কেউ হবে। তাদের সাথে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেনা।
রাত বারোটা,
এখানকার কয়েকজন বলতে লাগলো, এবার আস্তে আস্তে সবাই ঘুমুতে যাও। আর বউকে তার বরের রুমে দিয়ে আসো।
এখানকার কয়েকজন আমাকে নিয়ে যেতে এগিয়ে আসলো, সবার আগে আগে লিয়নের বউ।
সে আমাকে রুমে বসিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা আগে আগেই একটা কথা বলে রাখি, আমার পেটের বেবিটা যদি ছেলে হয়, আর তোমার যদি প্রথম মেয়ে হয় তাহলে আমি কিন্তু আমার ছেলেকে দিয়ে সেই মেয়ে নিয়ে যাবো। তোমার মেয়ে নিশ্চয়ই তোমার চোখ পাবে, আর সে আমার পরিবারে গিয়ে আমার বংশকেও বাদামি চোখে পরিণত করবে। শুধু বাদামি চোখের জন্য নিবো বুঝলে?
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
‘ আচ্ছা আচ্ছা সে দেখা যাবে নে!
লিয়নের বউ যেতে যেতে বললো,
‘ মনে রেখো কিন্তু!
আমি অদ্ভুদভাবে হাসলাম। আর উনি আস্তে আস্তে দরজাটা একটু লাগিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।
দুই মিনিটের মাথায় দরজা আবার খুললো, আমি খেয়াল করে দেখি তনয় আসছে।
ওকে দেখে আমি তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠে বড় করে ঘোমটা টেনে বসলাম।
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার