বাদামি_চোখ-১৪,১৫,১৬

0
620

#বাদামি_চোখ-১৪,১৫,১৬
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
১৪

দুজন মানুষ একসাথে থাকতে না চেয়ে একসাথে কি করে থাকতে পারে? আর থাকলেই বা তারা কেমন করে ভালো থাকবে?
আমি লিয়নের বউয়ের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলাম।
আর লিয়ন তাহলে কয়েকদিন আগে ওই লেখাটায় তার এমন অস্বস্তিকর জীবনকেই বুঝাতে চেয়েছিল। আসলেই সে তার জীবনসঙ্গীর সাথে ভালো নেই। তারা দুজনেই এই সম্পর্কে খুশি না। তবুও কোনো এক অদ্ভুত শিকলের বাঁধায় পড়ে দুজন একসাথে আছে!

আর আমি আমার ভাবনার মধ্যেই লিয়নের বউয়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বসলাম,
‘ তাহলে আপনারা একে অপরকে বিয়ে করলেন কি বুঝে?

লিয়নের বউ হেসে আমার কাঁধ চাপড়ে বললো,
‘ কিছু না বুঝে বিয়ে করার ফলই হলো এটা। অতঃপর বুঝার পর অমিল! আমাদের চিন্তা, ভাবনা, স্বভাব, চরিত্র, ইচ্ছে, অনিচ্ছে, সবকিছুই আলাদা। আর আমাদের কারো মধ্যে ধৈর্য্য ধরে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও নেই। তাই একসাথে থাকার ইচ্ছে ফুরিয়েছে সেই কবে! আমাদের সম্পর্কটা এখন শুধুই লোক দেখানো!

লিয়নের বউ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তখনি সে দেখলো আমি পেছনে তাকিয়ে তনয়ের ছোট ফুফির সাথে কুশলাদি বিনিময় করছি। সে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এরপর ঘুরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।

তনয়ের ফুফু বেশ মজার মানুষ। আর আমিও উনার সাথে কথা বলায় এতটাই মগ্ন হয়ে গেলাম যে লিয়নের বউকে আটকানোর কথাটুকু পর্যন্ত ভুলে গেলাম।
পরবর্তীতে আমার মনে হলো সে কি রাগ করে এখান থেকে চলে গেছে নাকি? কথার মাঝে হঠাৎ অন্যদিকে ফিরে গেলাম রাগ না করলেও অপমানবোধ তো নিশ্চয়ই অনূভব করেছে।
তারপর আমি রান্নাঘরে একবার উঁকি দিলাম, কিন্তু রান্নাঘরে এই মূহুর্তে কেউ নেই। সবাই এখান থেকে বেড়িয়ে গেছে। অথচ পাশে দাঁড়িয়েও আমি খেয়ালই করতে পারিনি সবাই কোনদিকে বেড়িয়ে চলে গেলো।

আমি একা একা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আমার শাশুড়ীর রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। তখনি আমার পথের মধ্যে লিয়ন এসে দাঁড়ালো। আর দাঁড়িয়েই বললো,
‘ নিবিতা তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল!

আমি বেশ অবাক হলাম। বিয়ের কথা থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত অসংখ্যবার দেখা হলেও একবারও সে সাহস করে কোনো কথা বলতে আসেনি। আজকে খুব সাহস নিয়ে একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু আমি অবাক হওয়ার ভাবখানা লুকিয়ে রাগান্বিত চেহারায় বললাম,

‘ দুঃখিত! আপনার কথা থাকতে পারে তবে আমার শোনার মতো কোনো ইচ্ছে নেই।

বলেই আমি শাড়ির কুঁচিটা বা হাতে ধরে ওকে পেরিয়ে চলে আসলাম। সে অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু ওর এই দৃষ্টি আমার মায়াতে একটুও বাঁধেনি । এমনকি ওর কথা শুনতেও আমার কোনো রকম ইচ্ছে হয়নি ৷ আর কিই বা বলবে সে? আবেগময় কথা ছাড়া দরকারী কথা তো আর নয় ৷ আর এসব আমি কেন শুনবো? যখন একটু প্রায়োরিটি পাওয়ার জন্য ছটপট করে মরেছি তখনি তো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে ওর গায়ে হলুদের রাতে আমি ওকে ২০০ বারেরও বেশি ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু সে আমার ফোন দেখে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছিলো। কেননা রিসিভ করলেও কোনো অভিযোগে ধমকাতে পারবেনা, কারণ সে তখন পরিবারের লোকজনের দোষ দিয়েছিলো, তারা নাকি আমার বাদামি চোখের জন্য আমাকে মেনে নিবেনা, আর সেসময় যদি সে ফোন রিসিভ করতো এবং আমি নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করতাম এতে তো সে বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করতে পারতোনা, আর বিষয়টা তখন কেমন দেখাতো? তাইই হয়তো রিসিভই করেনি।
তবে আমি সেসবের কিছুই ভুলিনি,প্রতিটি সেকেন্ড আমার মনে গাঁথা আছে। বেশ হয়েছে ওর কাছাকাছি আমার স্থান হয়েছে, কাছ থেকে ওর অতিরিক্ত ভালো থাকাকে তো এখন দেখতে পাবো!
আর সেও দেখবে একজনকে ছাড়াও কেউ খুব ভালো থাকে।

এদিকে আমার শাশুড়ির রুমে যেতে কেবল আর একটা দরজা পেরুনো বাকি। লিয়ন এখনো আমাকে দেখছে। আমি খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে এই অচেনা রুমটা পার করতে যাবো তখনি হাতে শক্ত করে ধরে কে জানি একটানে এই দরজাটার ভেতরে নিয়ে গেলো। বাহির থেকে আমি শুধু ঝাপসা তার হাতটাই দেখলাম। ভয়ে কেঁপে ওঠতে গিয়েও পারলাম না, তার আগেই দেখলাম এটা আর অন্য কেউ নয়, আমার সে,আমার পৃথিবী!

আমি ভয়ার্ত চেহারাখানাকে হাসিতে রূপান্তর করে বললাম,
‘ কি হ্যাঁ? এত মানুষের মধ্যে এভাবে টেনে নেওয়ার মানে কি?

তনয় গম্ভীর হয়ে বললো,
‘ এখানে শুধু লিয়ন ভাই ছাড়া এখানে আর কেউ দেখেনি৷ উনি তোমাকে কিছু বলছিলো মনে হচ্ছে?

আমি চোখ বাঁকিয়ে বললাম,
‘ বউয়ের উপর খুব নজরদারি তাইনা? এটা শুনতেই টেনে আনলেন?

তনয় আমার নাক টেনে বললো,
‘ এই যে এতো নাক ঘামছে কারণ কি জানো? বর বেশি ভালোবাসবে! সবসময় ছায়ার মতো থাকবে৷ না মানে আমি ছোট বেলায় বয়স্কদের কাছে এসব শুনতাম আরকি, তবে সত্য মিথ্যে যাই হোক আমার ক্ষেত্রে এখন বাস্তবায়ন করতে দোষ কি বলো? তাই সবসময় নজর রাখি! আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে বলো , লিয়ন ভাই কিছু বলতে চাচ্ছিলো মনে হলো, তুমি চোখ রাঙিয়ে বিরবির করে কিছু বলে চলে এলে! কি বলছিলে?

আমি তনয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ সে বললো, আমাকে কিছু কথা বলার আছে। আর আমি বললাম, আমার শোনার ইচ্ছে নেই৷ এইটুকুই। আর আমি কেন শুনবো বলেন তো? এই মূহুর্তে আমার কাছে আপনার পরিবার ছাড়া দুনিয়ার কাউকেই দরকারী বলে মনে হচ্ছেনা। সেখানে ওর মতো একটা মানুষ তো একদমই না!

তনয় কিছু বলতে গিয়েও আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা যাও কোথায় যেন যেতে চাচ্ছিলে৷

আমি কিছু না বুঝে চোখ ঘুরিয়ে দেখি এই রুমের খোলা জানালা দিকে তাকাতে তাকাতে লিয়নের বউ দরজা পেরিয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম তনয় এইজন্যই সরে গেছে। আমিও তনয়ের দিকে মিটমিট চোখে তাকিয়ে দরজা খুলে লিয়নের বউকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

‘ এই ভাবি, সরি! হঠাৎ এভাবে অন্যদিকে মনোযোগী হয়ে আপনার কথা শেষ করতে দিলাম না। এখন আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু এখানে!

লিয়নের বউ চাপা হাসি দিয়ে বললো,
‘ আহা! কত্তো রোমান্টিক দেবর আমার! আমার কাছে যাওয়ার আগেই আটকে নিলো ? আচ্ছা থাকো তুমি! পরে একসময় বলবো সব।

এটা বলে উনি লিয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন আর আমি পেছনে তনয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ এখানে কি করছিলেন আপনি?

তনয় একটু কি ভেবে যেন বললো,
‘ কিছুই না, এমনি আসছিলাম। আচ্ছা মাকে বলে দুটো পান সাজিয়ে আনো । আমি এখন রুমে যাচ্ছি!

আমি ভ্রু ভাঁজ করে বিরক্তি প্রকাশ করার আগেই তনয় হনহন করে চলে গেলো। উফফ, পান? খুবই ভয়ানক জিনিস, মূহুর্তেই সাদা চকচকা দাঁতগুলোকে লাল করে দিবে। সাথে জর্দ্দা দিলে মাথায় চক্কর দেওয়া তো আছেই !
ছোট বেলায় একবার দাদীর সাথে শখের বশে পান খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, সেখান থেকেই অজ্ঞান হওয়া শুরু আমার। অল্পতেই এখন এই সমস্যার সম্মুখীন হই।

তবুও আমি এসবকিছু না ভেবে মা’র রুমে প্রবেশ করলাম। গিয়ে দেখি তিনি আলমারিতে কিছু দেখছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন,
‘ আরে তোমাকেই ডাকতাম! দেখোতো এই শাড়ীটা। এইটা আমার বিয়ের শাড়ী বুঝেছো? যত্ন করে আলমারিতে তুলে রেখেছিলাম। তোমার বাবার বড়চাচা এটা বিলেত থেকে এনেছিলো। তুমি এটা আজ পরো কেমন? আর যেটা আজকের জন্য আমরা কিনেছিলাম, সেটা কালকে তোমাদের এখানে পরো। জানো তোমাকে দেখার পরেই আমি এই শাড়ীতে তোমাকে বারবার কল্পনা করছি, এটা কতো সুন্দর না? ছুঁয়ে দেখো!

আমি উনার চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি! আমার জন্য কতো ভালোবাসা উনার চোখেমুখে! নিজের সব পছন্দের জিনিসগুলোই আমাকে সপে দিতে চাচ্ছেন। উনি যেন পারছেন না আমাকে উনার কলিজাটা খুলে দিয়ে দেন!
আমি হাত বাড়িয়ে শাড়ীটা নিলাম। বেশ পুরনো ডিজাইন, কিন্তু এগুলো আবার এই যুগে নতুন করে ফিরে আসছে! আমিও দেখেই কেন জানি ধারণা করতে পারলাম এটা সেজেগুজে পরলে আমাকে অবশ্যই খুব মানাবে! রঙটার পরিচয় সোজা বাংলায় দিতে গেলে গাঢ় ইটের রঙ বলতে হবে। শাড়ীর প্রতিটা সুতোর বুনন একদম নজরকাড়া,মিহি এবং বেশ পরিপাটি।

আমি এটা হাতে নিয়ে বললাম,

‘ এখনি একটু পরে দেখাই! এটা এতো সুন্দর! আচ্ছা মা এটা আপনার বিয়ের দিন পরেছিলেন? বাবা নিশ্চয়ই আপনাকে দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিলো!

তিনি লজ্জা মাখিয়ে বললেন,
‘ হাহাহা! এখনো যদি পরে সামনে যাই, হা করে তাকিয়ে থাকবে! কিন্তু আমি শাড়ী সামলাতে পারিনা, বিয়ের পরে কয়েক জায়গায় অনুষ্ঠানে কেবল শাড়ী পরেছি, আর এমনিতে তো অলওয়েজ থ্রিপিস!

আমি শাড়ীটা কাঁধের উপর থেকে ঝুলিয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললাম,
‘ কেমন লাগে?

উনার খুশির পরিমাণ যেন আরো তীব্র হলো। খুশির সাথে আমার কথায় সায় দিয়ে বলতে লাগলেন,
‘ অনেক সুন্দর !

আমি তারপর এটাকে পাশে রেখে বসলাম, আর বললাম,
‘ মেহমানদের জন্য কি পানের আয়োজন আছে? মানে একজন আমার কাছে দুইটা পান চাইলো!

আমার শাশুড়ী মা আরো হেসে কুটিকুটি হয়ে বললেন,
‘ একজন আর কে! তনয়? ওর জন্য নিবে? জানো সে পান খেয়ে রঙিন দাঁত বের করে খাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুরে বেড়াবে!? আবার বারবার জিজ্ঞাসা করবে দেখো তো লাল হলো কিনা? এসব কান্ডে তুমি নিশ্চিত রেগে যাবে, তাই বুঝেশুনে নিয়ে যাও।

আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম,
‘ প্রথমবার চেয়েছে তো, নিয়ে দেখি একবার।

তিনি পাশ থেকে পানের বাটা বের করে আমার হাতে ধরিয়ে বললেন,
‘ পুরো বাটাটাই নিয়ে যাও। যা যা লাগে দেখো!

আমি শাড়ী এবং পানের বাটা দুটো একসাথে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। চারদিকে তাকিয়ে ধিরে ধিরে রুমে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দরজার কপাট লাগাতেই তনয় শোয়া থেকে আমার ফোনটা নিয়ে বসে বললো,
‘ এদিকে আসো তাড়াতাড়ি।

আমি ভাবলাম ওই মেয়ে বুঝি আবার ফোন দিয়েছিলো,তাই রাগান্বিত হয়ে ফোনটা কেড়ে নেওয়ার জন্য এগুতেই তনয় পুরনো একটা কথোপকথনের কল রেকর্ড অন করে বললো,
‘ এই মূহুর্তে আমি এগুলো চেক করতেই সম্পূর্ণ মনে করতে পেরে গেছি এই মানুষটা আসলে কে? আর কেনই বা বলছিলো আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়!

আমি হাতের জিনিসগুলো বিছানায় রেখে বসে পড়লাম আর ফোনের রেকর্ডটা প্রথম থেকে শুনতে গিয়ে অল্পক্ষণেই চোখ বড় বড় করে বললাম,
‘ স্বাভাবিক কথার মধ্যেও মাঝে মাঝে কান্নার হেঁচকির মতো নিঃশ্বাস? হ্যাঁ আমিও তাকে চিনি!

তনয় এবার অবাকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলো।
হঠাৎ করে আবার দুজনেরই একসাথে মনে পড়ে গেলো! এই মূহুর্তে আমিও জানিনা মেয়েটার সাথে তনয়ের পরিচয় কিভাবে, আর তনয়ও জানেনা মেয়েটার সাথে আমার সম্পর্ক কিভাবে! শুধু দুজনেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি!

চলবে…..

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

#বাদামি_চোখ [১৫]

আমরা দুজনেই বলতে চাচ্ছি আমরা যে মেয়েকে আঁচ করেছি সে কেন এসবের পেছনে থাকবে?
কিন্তু দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি কে আগে শুরু করে!
আমার উদিত ধারণা সেই মেয়েকে একদম স্পষ্টতর ধরা দিয়েছে, আর কোনো সন্দেহই নেই এখানে।
আমি কিছু না বলে হঠাৎই তনয়ের থেকে চোখ সরিয়ে কল রেকর্ডটা আবার শুরু করলাম। তনয় সেই ভাবনা চক্রেই আছে,হয়তো সে ধারণা করার চেষ্টা করছে তার প্রতি মেয়েটার কিসের এমন প্রতিশোধ নেওয়ার থাকতে পারে?
এদিকে রেকর্ডটা আবার শুনে আমি একেবারেই নিশ্চিত হয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। আর তনয়ের হাত ঝাকিয়ে বললাম,
‘ অরলি তাসনিম!?

তনয় চমকে বললো,
‘ হ্যাঁ একদম! অরলিকে কি করে চিনো তুমি?

ওর কথার সাথে সাথে আমিও বললাম,
‘ আরেহ, আপনি কি করে চিনেন? মানে ওকে আপনার চেনার এবং শত্রুতা হওয়ার কোনো রাস্তা তো দেখতে পাচ্ছিনা।

তনয় দম নিয়ে বললো,
‘ আগে তুমি বলো তুমি কীভাবে চিনো আর তোমার সাথে কখনো কোনো ঝামেলা হয়েছিল কিনা?

আমি একটু ভেবে বললাম,
‘ নাহ আমার জানামতে ওর সাথে আমার কখনো ঝামেলা হয়নি, মানে আমরা সরাসরি কখনো কোনো বিষয়ে তর্কেও জড়াইনি। আর আমরা তো ইউনিভার্সিটিতে এসে পরিচিত হয়েছিলাম, একই ডিপার্টমেন্টে ছিলাম দুজন!

তনয় অবাক হয়ে বললো,
‘ কি বলো? কিন্তু আমি জানি সে এই ঢাকা শহরের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পড়ালেখা করেনি। তারা ঢাকাতে থাকেও না। আর সে তোমার এক বছর জুনিয়র!

আমি আমার ঠোঁটের উপর বিষ্ময়ের সাথে ডান হাত তুলে বললাম,
‘ তাইতো! আমিও জানতাম ও এখানে ওর এক আত্মীয়ের বাসা থেকে পড়ালেখা করতে এসেছে। তাদের পুরো পরিবার অন্য বিভাগ এবং অন্য জেলাতে থাকে! কোথায় বলেছিল আমার ঠিক মনে নেই এখন। কিন্তু সে এক বছর পর হুট করে ইউনিভার্সিটি থেকে চলে গিয়েছিল। তার মানে পরবর্তীতে সে নিজের শহরে গিয়ে এক বছর বাদ দিয়ে আবার ভর্তি হয়েছে! জানেন এক বছরেই আমার সাথে ক্লাসে বেশ ভালো বন্ধুত্ব করে নিয়েছিলো? ক্লাসে আসলে সে নিজে থেকে এসে আমার সাথে বসে গল্প করতো। তবে পরের ইয়ারে উঠে ওর কোনো খোঁজ পাইনি, আমরা এক অপরের ফোন নাম্বারও নেইনি। সেসময় ফোনে কথাও হয়নি তাই এখন আমি একদমই ওর কণ্ঠস্বর ফোনে চিনতে পারিনি। তার চেয়ে বড় কথা ওর ওই অভ্যাস! মানে স্বাভাবিক কথার মধ্যেও হেঁচকি উঠা, এটা ক্লাসে সবার নজরে ছিলো। কিন্তু আপনি কি খেয়াল করেছেন এতোগুলো ফোনের মধ্যে শুধু এই একটাতেই এই হেঁচকি শোনা যাচ্ছে?

তনয় মাথা ঝাকিয়ে বললো,
‘ ওই যে বললে এটা সবার নজরে আছে। এটা আমারও খেয়াল আছে। তাই সে এটাকে আঁটকে রাখতে চায়। আর সে কয়েক মিনিট এটাকে আটকাতে পারে, এরপর না চাইতেও অদ্ভুতভাবে হেঁচকে উঠে, তখন ওকে দেখলে মনে হয় কান্না করে এসেছে মাত্র। এমনকি কলটায় ভুল করে মনে হয় এটা প্রকাশ হয়ে গেছে। অথচ এসময় সে জোর গলায় হুমকি দিচ্ছিলো, হেঁচকি আসার কোনো কারণই নেই। এটা নিঃসন্দেহে অরলি, সে-ই এসব করছে।

তনয় এটা বলে আমার দিকে তাকাতেই আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
‘ আপনার সাথে পরিচয় কীভাবে সেটা বলেন তো?

তনয় আমার রাগী চেহেরায় তাকিয়ে এবার হাসতে হাসতে বললো,
‘ প্রতিশোধমূলক পরিচয় আমাদের!

আমি রেগে আবার বললাম,
‘ ফাজলামো রেখে সত্যিটা বলেন।

তনয় হাসতে হাসতে আমার কাছ থেকে উঠে তার বুকশেলফের দিকে এগিয়ে গেলো আর সেখান থেকে একটা ডায়েরি বের করে কিছুক্ষণ ঘেঁটে বললো,
‘ আমার জন্য মোট ৫৭ টা পাত্রী দেখা হয়েছে, অরলি হলো ৫৫ নাম্বার! আর অরলির সাথে এভাবেই পরিচয়! এই দেখো পঞ্চান্ন নাম্বারে ওর নাম লেখা আছে।
তবে জানো? খুব ইচ্ছে ছিল পাত্রী দেখায় সেঞ্চুরি করে তারপর বিয়ে করবো! কিন্তু তোমাকে দেখে সাধের ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিয়ে ডায়েরিটাই আড়াল করতে হয়েছে। আর মন থেকে সেঞ্চুরি করার ইচ্ছেকেও বাদ দিতে হলো। পরবর্তীতে মনকে অনেক বুঝালাম, নিজেকে শান্তনা দিলাম এই বলে, হাফ সেঞ্চুরি কম কিসে, যদি এতেই জয়ী হওয়া যায়!?

আমি ওর এসব অদ্ভুত কথায় আর তীব্রতর রাগে নাক ফুলিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। একটানে ডায়েরিটা টেনে নিয়ে বললাম,
‘ সেঞ্চুরি না? ইচ্ছেকে নাকি মাটিচাপা দেওয়ায় মনে খুব কষ্ট জমেছে?

তনয় আমার কথা শুনে আরো হাসছে। আর আমি চোখ নামিয়ে ডায়েরিতে লক্ষ্য করলাম। সিরিয়ালের ছাপ্পান্ন পর্যন্ত ছাপ্পান্ন জনের নাম এবং পুরো ইনফরমেশন লেখা। আর পঞ্চান্নতে লেখা আছে অরলির নাম পাশে ব্রেকেট দিয়ে লেখা (হেঁচকি বালিকা)। এরপর ছাপ্পান্নতে আরো একটা নাম কিন্তু বিস্তারিত লিখা নেই।
আর এরপর আমার নামের সাথে লিখে রেখেছে ( আমার বউ)। পাশে স্যাড ইমোজি এঁকে এটাও লিখে রেখেছে ‘মনের মতো কাউকে পেলে সেঞ্চুরি করার দরকার হয়না!’

আমি ডায়েরিটা ভাঁজ করে এটা দিয়ে তনয়ের মাথায় একটা জোরে আঘাত করে বললাম,
‘ মানুষ কি ডায়েরিতে এসব উল্টা পাল্টা লিখে? আচ্ছা আচ্ছা আমি বুঝতে পারছি খুব দুঃখ নিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন? বাবা মার একমাত্র ছেলে, অন্তত ১০০ টা মেয়ে বেছে বিয়ে করতে না পারার কষ্ট তো আকাশবাতাসকেও কাঁদানোর কথা! আসলেই মাত্র সাতান্নতে থেমে যাওয়া উচিত হয়নি।

তনয় তার নিজের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শুধুই হেসে যাচ্ছে। আমি নিজ হাতে বুকশেলফে রেখে বললাম,
‘ সেঞ্চুরি টেঞ্চুরি রেখে আপনার প্রতি ওই মেয়ের প্রতিশোধ কিসের বলুন?

তনয় এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার বিছানায় বসলো আর আর বলতে লাগলো,
‘ আমার জন্য এতো মেয়ে দেখেও আমার মা মনমতো কাউকে পাচ্ছিলোনা। আর আমার মনমতো তো একদমই না। অবশেষে অরলির সবকিছু মা’র ভালো লেগেছিল শুধু কথা বলার ধরন ছাড়া। আমিও মার উপর সব ছেড়ে দিলাম। এদিকে সবার সাথে কথা বলে মা মেনেই নিয়েছিলেন সবদিকে সবাই যথাযথ পরিপূর্ণ হয়না। তাই অরলিই ফাইনাল! তারপর বিয়ের কথাও প্রায় পাকা ছিল, এর মধ্যে কার কথা শুনে যেন আবার আরেকটা মেয়েকেও দেখলো, সেটা শুধু বাবা দেখেছে। ওইদিকে অরলির সাথে কথা প্রায় ঠিকঠাক সেই অবস্থায় হুট করে তোমার সন্ধান পেলো!
আর সেখানে বেশ সংকোচ নিয়েই প্রথম আমাকে পাঠানোর কথা ভাবলো। আর সেদিন যখন তোমাকে দেখে সেখান থেকে আমি ফিরলাম, তখন আমার পরিবার প্রথমবার আমার চোখেমুখে খুশির ফোয়ারা দেখলো,তারা বুঝলো এতদিনে আমার কাউকে খুব বেশি পছন্দ হয়েছে। এরপর সবাই তোমাকে দেখার পরে তো তোমাকেই পুরোপুরি বউ হিসেবে পাকাপোক্ত করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো!
অন্যদিকে আমার মা অরলির পরিবারকে কীভাবে আলাপ আলোচনা বদলানোর কথা বলেছিলো জানিনা ! তবে ওদেরকে যেভাবেই হোক মানা করে দিয়েছিলো। আর এর আগে অরলির সাথে আমার ১০ মিনিটের মতো দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল, এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিলো আমাকে মেয়েটা অনেক পছন্দ করেছে, তবে বিশ্বাস করো আমি ওর মধ্যে আমার ভেতর কোনো মুগ্ধতা খুঁজে পাইনি। সে অবশ্যই সুন্দরী ছিল, কিন্তু সবার চোখ আসলে সবার সৌন্দর্য্য বুঝার জন্য না। দেখো তোমাকে দেখেই আমার চোখ নিজ গন্তব্যে ফিরতে চাচ্ছিলোনা, আরো দেখার আকুলতা প্রকাশ করছিলো শুধু। আমার মন বারবার আমাকে বলছিলো একেই চায় তোর! তাহলে আমি কি করবো বলো? কি করার আছে আমার? আমাদের তো আমাদের মনের কথাই শোনা উচিত তাইনা? কিন্তু হতে পারে সেই পর্যায়ে বিয়ে ভেঙে অন্য জায়গায় আমার বিয়ে সংবাদে তার মধ্যে রাগ, জেদ বেড়ে উঠেছে। সে খোঁজ নিয়ে হয়তো এটাও জেনেছে যে তোমার বাদামি চোখে আমি বেশি আকৃষ্ট হয়েছি, তাই বারবার এই কথাটাই বলছিলো। এছাড়া এই শত্রুতায় আমি আর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা।

আমি তনয়ের কথাগুলো অবিশ্বাস্যভাবে শ্রবণে নিচ্ছি, পারিবারিক সম্মতিতে বিয়েতে বর কনের কি দোষ থাকে? গায়ে হলুদে গিয়েও কোনো ত্রুটিতে বিয়ে ফিরে যায়। তবে এসবকে সময়ে যাচাই করার উপরে ছেড়ে দিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম,
‘ অরলি তো নিজ গন্তব্যে চলে গিয়েছিলো, তাহলে সে আবার এই শহরে?

তনয় ধিরে বললো,
‘ ওই কি আত্মীয় যে! ওখানেই তো আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। এখন কোথায় আছে, কাকে সঙ্গী করে এভাবে ঘুরছে আর এসব করছে তা আমার অজানা।

আমি তনয়ের পাশে বসে গম্ভীর হয়ে বললাম,
‘ আপনাকে হতে পারে তার খুব ভালো লেগেছিলো, এবং ভালোবেসে ফেলেছিলো। আর তাই এটা হতেই পারে সে এভাবে বিয়ে ঠিকঠাক করেও ভেঙে দেওয়ায় খুব রেগে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছে।
তবে পরবর্তীতে সে আমাকে দেখে হয়তো আমাকে নিয়ে আমার না জানা কোনো জেদ তার মনকে আরও বিষিয়ে দিয়েছে। শুধু একটা কারণে অরলি এমন করবেনা, কয়েকটা কারণ তো নিশ্চয়ই আছে!

তনয় আমার দিকে চিন্তাভরা চোখে ফিরে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। কিছু না বলে হঠাৎ দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো।
আমি বুঝলাম না সে এভাবে চলে গেলো কেন? হতে পারে জরুরী কোনো কাজের কথা মনে পড়েছে।
তবে ওর চলে যাওয়ার থেকেও বেশি ভাবছি অরলির কথা!
মেয়েটাকে আমি বেশ সাদাসিধে বলেই জানতাম, এক বছরের চেনাজানা তো কম কিছু নয়। আচ্ছা আমার প্রতি কি ওর কোনো রাগ আছে?
আর ওই ম্যাগাজিনে আমার লেখা কবিতা? আমার হারিয়ে যাওয়া ফোন? এসবের সাথে অরলির কি সংযোগ থাকতে পারে? আমার সাথে কিছু তো গোলমাল নিশ্চয়ই আছে! যা আমি জানিনা।

তবে তনয়কে ভরসা করে আমি আমার মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। দেখলাম, ইতোমধ্যে সবাই রান্নার কাজে বেশ ব্যস্ত হয়ে গেছে । আমাকে নিয়ে যেতে আসা আমাদের বাড়ির লোকজনকে সমাদৃত করতে আজকে এখানে ছোটখাটো আয়োজন করবে। তনয়কে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে কিনা সেটাই দেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম না।
এদিকে ৮ বছর বয়সী একটা পিচ্চি বলে উঠলো,
‘ কাকা নেই, চল নতুন কাকীর কাছে যাই!

বলেই ওরা এদিকে ছুটে এলো। আমিও ওদেরকে দেখে দরজা খুলে হেসে দাঁড়ালাম। ওরা আসতেই এক এক করে নাম আর পরিচয় জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। পরে বুঝলাম ওরা তনয়ের চাচাতো ভাইবোনের বাচ্চাকাচ্চা। ওরা অনেক বড় হয়ে গেছে, আর তনয় মাত্র বিয়ে করেছে। আমাদের এখন ছেলেমেয়ে হলে এদের থেকে অনেক ছোট হবে। আর এমন একটা হাস্যকর ভাবনা অজান্তেই মাথায় চলে এলো আর আমি চাপা হাসিকে মূহুর্তে ভেতরেই চাপিয়ে রাখলাম। অন্য হাসির তালে ওদের সাথে গল্প করতে লাগলাম। ওরা বিয়ে উপলক্ষে অনেকদিন পর এক জায়গায় মিলিত হয়েছে, এমনিতে নাকি একেকজন একেক এলাকায় আলাদা আলাদা বাসায় থাকে।

এদের সাথে কথা বলার অনেক সময় পরে ওদের দুজনের মায়েরা এসে প্রবেশ করলো। সম্পর্কে তারা ভাবি হয়, তবে ওদের মধ্যে রসরঙ্গের পরিমাণ কম। তবে এই মূহুর্তে এসে বললো,
‘ আরে বউ দেখি একা সাজগোজও করতে পারেনা। এভাবেই বসে আছে এখানো! এই বাচ্চারা তোমরা এখন যাও, বউকে বউ বানাতে হবে তো।

আমি উনাদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললাম,
‘ সাজানোর জন্য আজ লোকজন আসবেনা? আমি তো এটা ভেবেই এভাবে বসে আছি।

উনাদের মধ্যে একজন হেসে বললো,
‘ আমরা কি লোকজন না? আচ্ছা শুধু তাকিয়ে দেখো ওদের থেকেও কতো ভালো সাজাতে জানি!

অপরজন উনার সাথেই বললো,
‘ আজকে আসার কথা থাকলেও ওদেরকে মানা করে দেওয়া হয়েছে। এখানকার আজকের আয়োজন তেমন জাঁকজমক হবেনা কারণ তোমাদের এখান থেকে কম সংখ্যক মানুষ আসবে। তাই এসব বিরক্তিকর মেকাপ করার কি দরকার বলো? এতো ভারী মেকাপে স্কিনের ক্ষতি হবে ভেবে আমরাই বারণ করে দিয়েছি। তবে তনয় চেয়েছিলো।

আমি এটা শুনে এবার হেসে বললাম,
‘ তাই বলেন! আসলে আমারও ভারী মেকাপ পছন্দ নয়। আচ্ছা তাহলে আপনারাই দেখেন কিভাবে সাজবো!

বলার পরে উনারা দুজন মিলে আমার শাশুড়ীর দেওয়া সেই শাড়ীটা পরিয়ে সুন্দর করে চুল ঠিক করে হালকার মধ্যেই বেশ আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে তারপর আরেক দফা বউ দেখা আর ছবি তুলতে সবাইকে এখানে ডেকে দিলো।
মূহুর্তেই এই রুম মানুষে পরিপূর্ণ। এরপর এই জায়গা আর আর খালি হলোনা,তনয়ের সাথেও আর দেখা হলোনা।
একদম পড়ন্ত বিকেলে যখন আমাদের ওখানকার সবাই খেয়েদেয়ে জিড়িয়ে মেয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া করলো তখন একবার তনয় রুমে এসেছিলো পোশাক পরিধান করতে। সবার সামনে দিয়েই বাথরুমে গেলো এবং পোশাক পরে আবার বেড়িয়ে গেলো।
আমাকে বিদায় দেওয়া পর্যন্ত কেউই আর আমাকে একা ছাড়লোনা।

যাওয়ার সময় শাশুড়ী মা বারবার ঝাপসা চোখে বলে দিলেন,
‘ আগামীকাল তোমরা ফিরবে! নয়তো একা আমি দমবন্ধ হয়ে মরে যাবো।

এতে তনয় হ্যাঁ সম্মতি দিলো।

সবার ভীড়ে লিয়নের বউকেও দেখা যাচ্ছে। লিয়নের বউয়ের কথাগুলো আজ শোনা হলোনা। আর লিয়নও কিছু বলতে চাচ্ছিলো যেটা আসলেই আমি শুনতে চাইনা।
তবে এখন অরলির থেকে অনেককিছু শোনার ইচ্ছে। গাড়ী বসার পরেও কিছুক্ষণ পর্যন্ত বিদায়ের হাত নাড়ানো অব্যাহত থাকলো।
এরপর সবাইকে আড়াল করার পরে আমি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নড়েচড়ে বসলাম।

তনয় মজার ছলে ইচ্ছে হেঁচকি তুলে বললো,
‘ কান্না পাচ্ছে খুব!

আমি চোখ বাঁকিয়ে বললাম,
‘ আমি জানি আসলেই আপনার কষ্ট হচ্ছে, কেননা মাকে ছেড়ে যাচ্ছেন। তবে এমন হেঁচকি তোলার মানে কি? পরে দেখবেন এমন বদস্বভাব আপনারও হয়ে গেছে!

তনয় হাসতে হাসতে পকেট থেকে ফোন বের করলো

আমি ওর ফোনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ নতুন ফোন?

তনয় কিছু একটা করতে করতে বললো,
‘ কিনলাম আজ। ওই সিম বাতিল করে সিমও তুলেছি । এখন হেঁচকি বালিকাকে ফোন করে প্রথম বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আনন্দ শেয়ার করবো।

ওর কথায় আমি নিঃশব্দে হাসলাম। তনয় সত্যি সত্যি ওকে ফোন দিলো।
আর সাথে সাথে রিসিভও হলো। আর রিসিভ করে ওই মেয়ে ন্যাকা স্বরে বললো,
‘ গাড়ীতে তুমি? শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছো বউ নিয়ে তাইনা?

তনয় আমার দিকে তাকিয়ে চোখ একটু বড় করে আবার ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে জবাব দিলো,
‘ বিয়ে করেছি, তো শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে। আর আমার শ্বশুরবাড়ি কাছেই, আপনার সাথে কথা বলতে বলতেই পৌঁছে যাবো। তবে আপনাকে বিয়ে করলে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাতেই রাত পোহাতে হতো!

ওপাশ থেকে জবাব এলো,
‘ মানে? কি বলছো এসব?

আমি আমার মুখ চেপে হাসছি! আমি জানি মেয়েটার এই ভাব কিছুক্ষণ পরে আর অক্ষত থাকবেনা।

এদিকে তনয় তখনি সোজাসাপটা বললো,
‘ মানে কি জিজ্ঞাসা করছেন? আপনি জানেন না বুঝি? আপনাদের বাড়ি যেতে এখান থেকে সুদূর পথ পাড়ি দিতে হয়,মিস অরলি তাসনিম!

তনয় এই কথাটা বলতেই একটা বিকট আওয়াজ আসিলো ওই প্রান্ত থেকে, আর সাথে সাথে কলটা কেটে গেলো।

চলবে……

#বাদামি_চোখ [১৬]

এভাবে অরলি কলটা কেটে দেওয়ায় তনয় আমার দিকে অল্পসময় স্থির হয়ে তাকিয়ে হুহুহু করে হেসে উঠলো। তারপর আমার সিটের কাছাকাছি ঘেঁষে বললো,
‘ অরলির এখন কি অবস্থা বলোতো? ওইখানে জোরে একটা আওয়াজ হয়েছে, আর তার সাথে সাথে কলটা কেটে গেছে, মনে হচ্ছে তার ফোনটার আর অস্তিত্ব নেই! আর এখন হয়তো মাথায় দুইহাত ভর করে বারবার বলছে, ওরা কীভাবে চিনে গেলো আমায়? কীভাবে? !

আমিও হাসতে হাসতে বললাম,
‘ আমাদেরকে তো খুব নাচালো, চাচ্ছিলো নাকে দড়ি বেঁধে ওর ইশারায় ঘুরাবে, হাহাহা এখন টের পাবে ডুবে ডুবে বারংবার শালুক মিলেনা।

তনয় হাসতে হাসতে তার ফোন পকেটে রেখে আমার কাঁধ জড়িয়ে বসলো।
আর অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা আমাদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বিয়ের পরে জামাই প্রথম শ্বশুরবাড়ি আগমন করেছে, তাই চারদিকে হৈহল্লা বেশ!
ভাবি আম্মু,আব্বু, ভাইয়াকে একসাথে একদিন পরে মাত্র দেখেছি, মনে হচ্ছে যেন বহুবছর দেখিনা।
সবাই সানন্দে আমাদের বরণ করে নিলো!


শাশুড়ীর মা’র কথামতো তনয় এখানে একদিন মাত্র অবস্থান করলো। আমরা পরেরদিন যথারীতি বিকেল বেলাতেই ফিরার জন্য রওয়ানা দিয়ে দিলাম।
বাড়িতে কাটানো একদিন হুট করেই চলে গেলো, মানুষের সমাগম, আলাপ পরিচয় আর খাবারদাবারের উপরেই একদিন শেষ। এমনকি ভাবির সাথেও এক জায়গায় বসে ভালো করে কথা হয়নি, হবে কি করে? একমাত্র ননদ জামাইকে ভালোমতো সমাদরে রাখাটাই যে শুধু উনার মাথায় ছিল।

এর মধ্যে অরলি আর ফোন দেয়নি, এমনকি তনয় ইচ্ছে করে নিজে থেকে তাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সে পরবর্তীতে নিজের মোবাইলই বন্ধ করে ফেলে।
বাড়িতে ফিরে পরিবারের সাথে তনয়ের একা শ্বশুরবাড়িতে থাকার মজার অবিজ্ঞতা বলতে বলতেই সেদিনের সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো।
এর মধ্যে আমি প্রথমবার রান্নার পাতিল হাতে তুলে নিলাম, কথার মাঝে মধ্যে শাশুড়ী মা আমাকে সবকিছু দেখিয়ে দিলো আর আমি রান্নাবান্না শেষ করে ফেললাম।

আমি গতকাল যাওয়ার পর পরেই এখানকার মেহমান সবাই যার যার গন্তব্যে চলে গেছে। এমনকি আজকে এখনো পাশের বাসার, মানে লিয়নের পরিবারের কাউকেও দেখা যায়নি। আমি ভেবেছিলাম এসেই বুঝি আবার দেখতে পাবো।
আর উনি আমার অপেক্ষা করবেন, আমারও উনার প্রতি অনেকটা আগ্রহ জন্মেছে। কেননা লিয়নের বউয়ের কথাগুলো শেষ পর্যন্ত শুনতে হবে তো। তারা বাচ্চা হওয়ার পরবর্তী সময়ে কি করবে তার জন্য কিছু ভেবে রেখেছে হয়তো। এটাই আসলে শোনার ইচ্ছে খুব। মনে হয়না থাকবে বলে!

সেদিন রাতটাও কেটে গেলো ঝামেলাবিহীন, এখানে বাড়তি চাপ আর সৃষ্টি হলোনা। তবে লিয়নের বউ এবং তাদের পরিবারের কেউই কালকে না আসার পেছনের কারণ আঁচ করতে পারিনি৷ এমনকি আজকের সকাল পেরিয়ে দুপুর প্রায়
ওদের কাউকেই এখানে আসতে দেখা যায়নি৷
তনয় বলে ওদের নাকি এই বাসায় না আসলে পেটের ভাত হজম হয়না, অথচ এমন সময়ে তারা না এসে থাকছে, বিষয়টা অসম্ভাব্য!

এদিকে বিকেলে আমার শাশুড়ি আমাদের দুজনকে একসাথে ডেকে বললেন,
‘ তোমরা এক দুইদিন কোথা থেকে ঘুরে আসতে পারো। প্রথম যেহেতু কাছাকাছিই কোথাও যাও, এরপর সিদ্ধান্ত নিয়ে দূরে কোনো জায়গায় যেও।

এটা শুনে তনয় হেসে বললো,
‘ মা বলো তুমি আর বাবা বিয়ের পরে প্রথম কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলে? আমরাও বরং প্রথম সেখানেই যাই!

তিনি হেসে বললেন,
‘ আমরা শ্বশুরবাড়ি বাবারবাড়ি যাতায়াত ছাড়া বিয়ের তিন বছরে কোথাও যাইনি। এরপর তো শহরে এলাম তুই আমার কোল আলো করে পৃথিবীতে আসলি, তারপর অবশ্য তোকে নিয়ে শহরের অনেক প্রান্তে ঘুরাঘুরি হয়েছে।

তনয় কিছুক্ষণ চুপ করে শুনে বললো,
‘ তাহলে আমরাও তিন বছর অপেক্ষা করি, তিনজন হওয়ার জন্য?

মা তনয়ের কথা শুনে রাগী চোখে তাকিয়ে সোফা থেকে ছোট বালিশটা তনয়ের দিকে ছুড়ে বললো,
‘ কবে বড় হবি তুই? বাচ্চামো কথাবার্তা গেলোনা তোর!যাহ তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নে কোথায় যাচ্ছিস। তোর ছুটি কিন্তু বেশি বাকি নেই।

তনয় ফিকফিক করে হেসে উঠে রুমে চলে গেলো। এর পেছন পেছন আমিও গেলাম। রুমে গিয়ে সেই আবার চিৎপটাং হয়ে শুয়ে গেলো । কোথায় যাবে এ নিয়ে আমার সাথে কিছুই আলোচনা করলোনা। আমার আবার বেশি জার্নি ভালো লাগেনা, অসুস্থ হয়ে যাওয়ার চান্স আছে।
তবে এটা তনয়কে জানানোর ইচ্ছে নেই এখন, নইলে আগেই এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাবে! আর তার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যাক!


রাত ৯ টা। তনয় আর আমি বারান্দায় বসে কথা বলছি। আমাদের বারান্দাটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। লাইট অফ করে দুজন বসেছি। কিন্তু এখান থেকে উপরে লিয়নদের ফ্ল্যাটের সেই বারান্দাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভেতরে আলো জ্বলছে বলে এই মূহুর্তে গাছের ভীড়েও ছোট ফাঁকফোকরে কি আছে তা অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে, লিয়নের বউ গ্রীলে হাত রেখে বাইরে মনোযোগ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তনয়ের সাথে কথা বলার সময় অনেক্ষণ থেকে এটা আমি খেয়াল করছিলাম। ঠায় দাঁড়িয়েই আছে, বসছে না কিংবা ভেতরেও যাচ্ছে না। তার জামার কিছু অংশ এবং হাতটা অল্প দেখা যাচ্ছে কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছেনা।
আমি এবার তনয়কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
‘ আপনি উনাকে খেয়াল করছেন? আর কালকে আমরা আসার পরেও একবার আসলোনা। আজও আসলোনা, গড়বড় লাগছেনা? ওই অরলিও ফোন ধরছেনা উনারাও এমন চুপচাপ, এমনকি ওই বাসার আন্টিও আসছেনা, কি ব্যপার বলুন তো?

তনয় বারান্দার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললো,
‘ হুউউম আসলেই কেমন যেন লাগছে! অরলিরও কোনো খবর নেই আর তাদেরও। ওরা এমনিতেই আমাদের বাসায় আসা যাওয়া মিস করেনা, সেখানে কিনা এই বাসায় নতুন মানুষের আমেজ শেষ হওয়ার আগেই ভালোমতো আসছেনা? কিছু তো হয়েছে নিশ্চয়ই!

আমি চুপ করে রইলাম। তনয়ও আর কথা বলছেনা।
আকাশে অর্ধ চাঁদটা এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো, কিন্তু এখন মাথার উপরে চলে গেছে, এখান থেকে বসা অবস্থায় আর দেখা যাচ্ছেনা। তবে আমি আমার মাথার খুব নিকটে ঠিকি একটা পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে পাচ্ছি, যেটার আলোয় আমি আলোকিত থাকতে চাই প্রতি দিন, প্রতি মূহুর্ত, আর আজীবন!


পরেরদিন,
মঙ্গলবার!
আজ সূর্যের উত্তাপ প্রবল! খাওয়াদাওয়ার পরে আজ কেউ কারো রুম থেকে বের হচ্ছেনা। নিজেদের রুমে এসি চালু করে বসে আছে।
তনয় টিভিতে কার্টুন দেখছে, আর আমি বসে বসে ফোন ঘাঁটছিলাম। এর মধ্যে হঠাৎই তনয় বলে উঠলো,
‘ ইয়েস! যাওয়ার জায়গা পেয়ে গেছি। চলো চলো আজ বিকেলেই আমরা বেড়িয়ে পড়বো।

আমি ফোনটা পাশে সরিয়ে বললাম,
‘ কিসের জায়গা?

তনয় টিভি বন্ধ করে তোয়ালে হাতে নিয়ে বললো,
‘ তাড়াতাড়ি কাপড় গুছাও! আমরা বেড়াতে যাবো, মা বলছিলোনা?

আমি এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে বললাম,
‘ আচ্ছাহ এই কথা! ঠিকাছে যান গোসল করেন, আমি সব গুছাচ্ছি।

আমি আমার কিছু কাপড় আর তনয়ের ব্যবহৃত পোশাক জিনিসপত্র ব্যাগে রাখতে রাখতেই তনয় মাথা মুছতে মুছতে বেড়িয়ে বললো,
‘ মা বাবাকে বলে আসছি আমি!

আমি ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার গুছানোতে মনোযোগ দিলাম। আমার গুছানো শেষ, ঠিক সেসময়ই তনয় ভেতরে প্রবেশ করে আবার বললো,
‘ তাড়াতাড়ি গোসলে যাও, রেডি হও! বিকেলের ট্রেনে যাচ্ছি আমরা! এখন দেখি অনলাইনে টিকিট পাওয়া যায় কিনা!

আমি আবারও নিঃশব্দে তনয়ের দিকে তাকিয়ে একটা শাড়ী হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।
খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি তনয় এক হাতে গায়ে পারফিউম মাখছে, আরেক হাতে চুল ঠিকঠাক করছে।

আমি বেরুতেই সে আমার দিকে ফিরে তাকালো। চুল ঠিক করতে থাকা হাতটা সেখানেই স্থির হয়ে গেছে আর সাথে উরাধুরা পারফিউম মাখাটাও!
আমি ভেজা কাপড় সাথে বারান্দার দিকে অগ্রসর হবো তখনি তনয় দ্রুত এগিয়ে এসে আমার টেনে ধরে বললো,
‘ আজকে আর কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছেনা।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ কেন সিদ্ধান্ত কি বদল?

তনয় ধীরে বললো,
‘ প্রকৃতি তো আমার ঘরেই রয়েছে, বাইরে গিয়ে আর কিসের সৌন্দর্য দেখবো বলো?

আমি লজ্জাময় হাসি মেখে হাতটা ছাড়িয়ে ওর কাছ থেকে চলে গেলাম। ওর যতো ন্যাকা কথাবার্তা!


বেলা তিনটার দিকে আমরা বিদায় নিয়ে বের হলাম। এভাবে হুট করে আজ বের হবো কল্পনাও করিনি।
স্ট্যাশন পৌঁছে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, তবে সমস্যা একটাই আমরা একটা সীট পেয়েছি মাত্র।
তনয় বারবার বলছিলো, চিন্তা করো না ব্যবস্থা হয়ে যাবে, নয়তো তুমি সীটে বসো আমি দাঁড়িয়ে থাকবো।
কষ্ট করে যাবে তাও আজকেই তার মাথায় ঘুরতে বের হওয়ার ভূত চেপেছে। গরমে ভুরভুর ঘামছে তনয়!

এদিকে উঠেই আমরা দুজন সেই একটা সীট খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে পেলাম তবে জানালার পাশে একটা মহিলা বসা! আমার সীটটা ভেতরেদিকে, এটা দেখেই আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। তনয় পাশে থাকলে অবশ্য এসব মেনে নিতাম, কিন্তু এভাবে আমিও অস্বস্তিকর জায়গায় বসবো আবার তনয়ও দাঁড়িয়ে থাকবে, কেমন লাগে? এদিকে সিদ্ধ হয়ে যাওয়া গরম পড়েছে!
তবুও কিছু করার নেই আমি সীটে বসলাম।
ভেতরটা শুধু রাগে কিটকিট করছে। কে বলছে এভাবে এরকম পরিস্থিতিতে বেড়াতে যেতে?
ট্রেন ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়েছে, তনয় এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু দেখছে শুধু।

কিছু মূহুর্ত পেরুতেই একজন টিকেট কাউন্টার এসে বললো,
‘ স্যার একজন মেয়ে পাশের কেবিনে আপনাদের জন্য দুইটা সীট বুকিং করেছেন, এই নিন টিকিট!

তনয় টিকিট দুইটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো!
আমরা অতি তাড়ার জন্য সাধারণ টিকিটই দুইটা পাইনি সেখানে আমাদের জন্য কেবিন বুক করে দিয়েছে কে?

চলবে…….ইনশাআল্লাহ!

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here