খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,নবম পর্ব

0
172

খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,নবম পর্ব
গল্প:- মাস্টার অব মাইন্ড গেম
লেখা:- যাবেদ খান আবু বকর

বাইশ.
গাড়ি নিয়ে ছুটতে ছুটতে জঙ্গলের পাড়ে চলে এসেছেন ফারহান। পিচ ঢালা রাস্তা থেকে গাড়ি নামিয়ে দিলেন জঙ্গলের মাটির দিকে। কিছু মিটার সামনে এগোতেই তার নজরে পড়ে নো এন্ট্রি এরিয়াটি। কিছুদিন আগে এখান থেকেই উদ্ধার করা হয়েছিল ইন্সপেক্টর রবিন এবং এমপি রজবানের মৃত দেহ। নজর ঘুরিয়ে দৃষ্টি রাখলেন গাড়িতে থাকা ফোনের দিকে। কাঙ্ক্ষিত লোকেশনটা তার থেকে আরও এক কিলোমিটার দূরে দেখাচ্ছে। ভাবাভাবি বন্ধ করে গাড়ি টান দিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হতেই অবাক হয়ে পড়েন! গাড়ি চলাচল করতে জঙ্গলের এদিকটা প্রায় রাস্তার মতো হয়ে গেছে। তিনি বুঝতে পারছেন না, এটা মিসিং হলো কী করে! জঙ্গলের পাশ থেকে দুটো লাশ উদ্ধার করার পরেও কী করে এদিকটা সার্চ করে দেখা হয়নি? এত বড়ো একটা মিসিং হলো কী করে? আচমকা মস্তিষ্কে চোট পড়ে অতীতের স্মৃতিতে। তারা যখন এখানে লাশগুলো উদ্ধার কাজ করছিল, তখন কিছু উগ্রপন্থী মিডিয়ার লোক ছিল! যারা ভীষণ উগ্রবাদী আচরণ করছিল। সম্পূর্ণ বিষয়টা ধরতে পেরে নিজেই নিজেকে গালি দিলেন। ডান হাতটা স্টেয়ারিংয়ে একটা বাড়ি মেরে বলে উঠলেন ‘ শিট ‘!

মিডিয়ার কর্মী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে উগ্র আচরণ করা লোকগুলো আদতে কোনো মিডিয়ার লোকই ছিল না। তাদের চালচলন কোনোটাই মিডিয়ার কর্মীর সাথে যায় না। বিষয়টা ঘটানো হয়েছে একমাত্র তাদেরকে কেস থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার জন্য। অত্যধিক সময় এখানে কাটালে অবশ্যই আশেপাশে খোঁজ করার নির্দেশ দেওয়া হতো। আর যেটা চায়নি খুনি! যার কারণে এই বিষয়টা থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আর মনোযোগ সরিয়ে দিতে বেছে নিয়েছে কয়েকজন উগ্রবাদী আচরণ করা লোক। ফারহানের এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে! এত বড়ো একটা ভুল তার কী করে হতে পারে? গাড়ি চালাচ্ছে আর নিজেকে দোষারোপ করছে। সামনে যাবার আর রাস্তা নেই। গাড়িটা এক পাশে থামিয়ে নেমে পড়লেন তিনি। গাড়িটা লক করে ফোন হাতে নিলেন। শত মিটার দূরে লোকেশনটা। দেরি করলেন না তিনি। হোলস্টার থেকে বন্দুকটা তুলে লক করে নিলেন। বাম হাতের ঘড়ির দিকে তাকালেন। তার থেকে আহামরি দূরে নেই সাইমুন এবং বাকি ইউনিট। ওরা এখন ফেলে আসা নো এন্ট্রির এরিয়ার আশেপাশে পৌঁছে গেছে। তিনি দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলেন। কিছুদূর অগ্রসর হতে অন্ধকারের মাঝে মৃদু আলোর দেখা মিলল। আলোটা আসছে একটা বাড়ি থেকে। লাইট ভিশন গগলটা তবুও নামাল না। বাড়ির দরজার কাছে উপস্থিত হলেন তিনি। অনুমান করতে পারলেন, বাড়িটি বেশ পুরনো। কোনো শব্দ না করে প্রধান ফটকের সামনে উপস্থিত হন। বেশ পুরোনো দরজা। গগলসটা খুলে ফেললেন। দুই হাতের তর্জনী বন্দুকের ট্রিগারের রেখে কাঁধের কাছে তুলে রাখলেন তা। পা বাড়ালেন দরজায় লাথি দেওয়ার জন্য।

বহুদিনের পুরোনো দরজা হওয়ায় অনেকটা নড়বড়ে অবস্থা। জীর্ণশীর্ণ হয়ে টিকে থাকা দরজাটি ফারহানের বুটের লাথি খেয়ে স্থায়িত্বকাল বেশি দীর্ঘ হয়নি। 9mm ডেজার্ট ইগল বন্দুকটা হাতে নিয়ে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলেন। আচমকা ভেতর থেকে একটি ছুরি উড়ে এলো তার দিকে। সামনে তাকিয়ে তেড়ে আসা ছুরি দেখে কিছুটা হতভম্ব হলেন। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মাথটা বাম দিকে হেলিয়ে দেন। ডান কাঁধের উপর দিয়ে উড়ে যায় ছুরিটি। ফলে আঘতের হাত থেকে বেঁচে যায় তার কপাল। কিন্তু থামলেন না তিনি, অনেকটা দৌড়ে পা চালালেন সামনের দিকে।

নজরে আসে, রুম জুড়ে মৃদু অন্ধকারের ছড়াছড়ি। কেবল রুমের মধ্যখান আলোকিত করে রেখেছে একটি পঁচিশ ভোল্টের একটি বাতি। তবে আলোর বিচ্ছুরণ চারদিকে পড়ায় অন্ধকারের পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে। বাতির আলোর নিচে রয়েছে একটি কাঠের টেবিল। তার উপরে রয়েছে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। ডাক্তারী ব্লেড হতে শুরু করে আরও বেশকিছু নির্যাতন করার মতো অস্ত্র। টেবিলের পাশেই একটি চেয়ার রয়েছে। আদিবার নগ্ন দেহটা চেয়ারেই বেঁধে রাখা আছে। মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে বসে আছে। তবে অস্পষ্ট হলেও বুঝা যাচ্ছে নগ্ন গা থেকে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। রক্তাক্ত নগ্ন পেটের দিকে তাকিয়ে তিনি নিশ্চিত হলেন, আদিবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। ফারহান যখন লাইভ দেখছিল, তখনও আদিবার মাথায় চুল ছিল। কিন্তু এখন নেই। অর্থাৎ কেটে ফেলা হয়েছে চুলগুলো। মাথার চুলগুলো না থাকায় তার নগ্ন দেহটা যেন আরও প্রদর্শনী হয়ে উঠেছে। লজ্জা স্থানগুলোতে ইতোমধ্যে রক্তে লাল হয়েছে গেছে। একটি সাদা টেপ দিয়ে মুখটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। চোখগুলো বড়ো বড়ো করে রাখা। সহজেই অনুধাবন করা যায়, ভীষণ কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে মেয়েটাকে। দেহের অসংখ্য স্থান থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। রক্তের একটা আস্তরণ ইতোমধ্যে মেয়েটির নগ্ন দেহের উপর জমাটবদ্ধ হয়ে গেছে। টেবিলের উপর আধো বসে দুই হাত দিয়ে একটি ছুরির মাথা থেকে হাতল হাতের মাঝেই ঘোরাচ্ছে একজন যুবক। তার দিকে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন ইন্সপেক্টর ফারহান। নিজ ধারণা অনুযায়ী যুবকটির বয়সের সমীকরণ মেলালেন। বয়স খুব একটা না। সাতাশ থেকে আটাশের মাঝে সীমাবদ্ধ।

হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটির অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছেন ফারহান। তখনও তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছেন। তার তাকানো দেখে যুবকটি মুখ খুলল,
‘ ইন্সপেক্টর ফারহান সাহেব, ইকটু লেট কইরা হালাইলেন। ওহ সরি, ইকটু না, অনেক দেরি করে হালাইছেন। এতক্ষণে হের আত্মা যেহানে থাকার কথা, সেহানে চইলা গেছে। ‘
যুবকটি এটুকু বলে থামল। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না ফারহান। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মেয়েটির দিকে তাকালেন। কিন্তু তা ক্ষণিকের মাঝেই ফিরিয়ে আনলেন যুবকটির দিকে। তা দেখে যুবকটি আবার বলে উঠল,
‘ স্যার, আমার এক্টিং কেমন? অস্কার পাব তো? ‘
ফারহাব ছেলেটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত নজর বোলালেন। নিজের পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে ড্রেস কোড দেখে বুঝতে পারলেন, ছেলেটা মোটামুটি পর্যায়ের শিক্ষিত। এক্টিং করতে বলার কথা বলে প্রকাশ করতে চাইছে, তার এক্টিংয়ের প্রতি ঝোঁক আছে।
‘ স্যার, দেখেন না, আফরান নিশু খুন করেও কী সুন্দর এক্টিং করে! আমারটা কি তার মতো হয়েছে? ‘
ফারহান তখনও কিছু বললেন না। তিনি কেবল শুনে যাচ্ছেন ছেলেটার সব কথা। বুঝার চেষ্টা করছেন, তার হাবভাব। এতটুকু নিশ্চিত আছেন, এই ঘটনার পেছনে এই ছেলের একার হাত নয়। পেছনে আরও অসংখ্য লোকের হাত রয়েছে। আর তাদের ক্লু-ই ধরতে চেষ্টা করছেন তিনি।
‘ কিছু বলতাছেন না যে স্যার? এমন চুপ কইরা কী ভাবতাছেন? আমার খুনের ভিডিওটা কেমন হইছে? একটু রেটিং দিবেন না? থাক, আপনার রেটিং দিতে হইব না। আমি নিজেই জানি, ভিডিওটা একদম অস্থির হইছে। ইতোমধ্যে তো আমার সোনার ভায়েরা ভিডিও ভাইরাল করতেই ব্যস্ত হইয়া গেছে। তাছাড়া এখনও লাইভে এরকম খাসা মালের নগ্ন শইরলডারে দেখার লইগগা উৎসুক হয়ে আছে বহুত মানুষ।
সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হয়ে আছেন ইন্সপেক্টর ফারহান। অনেকটা যেন ঝড়ের পূর্বাভাস হিসেবে ঠান্ডা ও শীতল পরিবেশ। তার হাবভাব না বুঝার চেষ্টা করেই ছেলেটা বলল,
‘ খাসা মালটাকে না-হয় ফেসবুক লাইভে আইসা মারলাম। তইলে এবার লাইভে একজন ইন্সপেক্টরকে হত্যা করার একটা দৃশ্য হয়ে যাক? কী বলেন স্যার?’
কথাটি বলে যুবকটি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না।

টেবিলের উপর বসে থাকা অবস্থা থেকে অনেকটা উড়ে এসে হাতে থাকা ছুরিটা দিয়ে আক্রমণ চালাল। আঘাতের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে বুদ্ধি খাটালেন ফারহান। ডাইভ দিয়ে ছেলেটির পেছনে চলে যাওয়ায় ছুরির আঘাত থেকে রেহাই পেয়ে যান। মেঝে থেকে উঠেই যুবকটির কাছে উপস্থিত হন। কিন্তু ততক্ষণে তার হাতে আরও একটা ছুরির মতো দেখতে পাতলা ধারালো অস্ত্র চলে এসেছে। পেছন ঘুরেই দুই হাতে থাকা ছুরি ও পাতলা ব্লেড জাতীয় অস্ত্রটি দিয়ে আক্রমণ চালায় ফারহানের দুই ঘাড়ে। বন্দুকটা আনলক করে মুহূর্তের মাঝে হোলস্টারে রেখে দুই হাত দিয়ে আগত আক্রমণ রোধ করেন। দুই হাত দিয়ে অনেকটা ক্রস আকৃতির বানিয়ে সেখানে আটকে ফেলেন যুবকটির অস্ত্র ধরা দুই হাত। যেন একটি ক্রস প্যাচে তার দুটি হাত আটকে গেছে। কিন্তু ফারহান তাকে দ্বিতীয় আক্রমণ করার সুযোগ দিলেন না। চোখের পলকে বুট পরা ডান পা দিয়ে আঘাত করেন যুবকটির বাম পায়ের হাঁটুর কার্নিশে। টাস করে একটা আওয়াজ হয়। যেন শব্দটা দুটো সমন্বিত হাড়ের মাঝে ভাঙন সৃষ্টির শব্দ। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে ব্যথায় চিৎকার দিয়ে ওঠে। পা বাঁকিয়ে অর্ধ বসা অবস্থায় বসে পড়ে।

তখনও ফারহানের দুই হাতের মাঝে যুবকটির দুই হাত আটকে রেখেছেন। ব্যথায় অনেকটা ছটফট করতে লাগল ছেলেড়া। কিন্তু তিনি ছাড়লেন না তার হাত। এভাবে কিছু মুহূর্ত চলতেই সেখানে টিম নিয়ে উপস্থিত হয় সাব-ইন্সপেক্টর সাইমুন। দ্রুত ঘরটির ভেতরে প্রবেশ করে তারা। নজরে আসে, ফারহান সাহেব আধবসা একটি যুবকের দুই হাত তার দুই হাতের মাঝে নিয়ে আটকে রেখেছেন। যুবকটির চেহারা আধো আধো দেখা যাচ্ছে। ব্যথায় ফরসা নাক-মুখ লাল হয়ে গেছে। দ্রুত সেখানে উপস্থিত হয় তারা। দুজন হাবিলদার যুবকটিকে যেয়ে আকড়ে ধরে। ছেড়ে দেন ফারহান। তার হাতের মাঝে চাপা খেয়ে যুবকটি অনেক আগেই হাত থেকে অস্ত্র দুটো ছেড়ে দিয়েছে। সেদিকে ধ্যান না দিয়ে তিনি তাকালেন টেবিলের কর্ণারে স্ট্যান্ডে ঝুলানো মোবাইলে। এখনও ফেসবুক লাইভ চলছে সেখানে। দূর থেকেই ভিউয়ের দিকে নজর যায়। প্রায় ষাট হাজারেরও অধিক লোক এই মুহূর্তে এই লাইভটি দেখছে। তার লুক দেখামাত্রই পুরো স্ক্রিনে লাভ রিয়েক্টের ছড়াছড়ি দেখতে পান। সাথে কমেন্টের বন্য। দ্রুত পা বাড়িয়ে স্ট্যান্ডে ঝুলন্ত অবস্থাতেই লাইভ অফ করে দিলেন। লাইভটা ডিলিট করতে যেয়েও কেন যেন লাইভটা ডিলিট না করে সেভাবেই রেখে দিলেন। তবে তার আগে প্রাইভেসি অনলি মি করে দিলেন। ফোনটা স্ট্যান্ড থেকে খুলে পকেট থেকে একটি এভিডেন্স প্যাকেট বের করেন। ইতোমধ্যে দুই হাতে গ্লাভসও পরে নিয়েছেন। ফোনটি বন্ধ করে এভিডেন্স প্যাকেটে পুড়ে রাখলেন। চারপাশে পাওয়া যাবতীয় সরঞ্জামাদি এভিডেন্স প্যাকেট বন্ধি করছে অন্যান্য পুলিশ সদস্য। সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে নজর ঘোরালেন তিনি। আদেশ করলেন,
‘ সাইমুন, নিয়ে চলো। ‘ তার আদেশে সম্মতি দিলো সাইমুন।
‘ জি স্যার। ‘
ইন্সপেক্টর ফারহান আহমেদের কঠিন স্বরের কথা শুনে সে সম্মতি বিহীন পালটা প্রশ্ন ছোড়ার মতো দুঃসাহস দেখাল না। কিছুক্ষণ পূর্বেই তার এই পালটা প্রশ্নের কারণে ধমক খেয়েছে। এই মুহূর্তে আর খেতে চাচ্ছে না। তাই ছেলেটিকে গাড়িতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সাব-ইন্সপেক্টর এবং পুলিশ অফিসারগণ। তাদের পিছুপিছু নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে ছুটলেন থানার উদ্দেশ্যে। তবে ছয়জন পুলিশ অফিসার সেখানে রেখে এসেছেন। তাছাড়া মৃত দেহটির জন্য অ্যাম্বুলেন্স ও ফরেনসিক বিভাগের কয়েকজনকে সেখানে উপস্থিত হবার জন্য বলা হয়েছে। সাধারণের তুলনায় দ্বিগুণ গতিতে গাড়ি চালিয়ে দীর্ঘ ত্রিশ মিনিট পর থানার সামনে এসে তারা থামল। থানা থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে অবস্থিত স্থান থেকে মূল ক্রিমিনালকে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তারা। কিন্তু কেন যেন সন্তুষ্ট হতে পারলেন না ফারহান। তার বারবার মনে হচ্ছে, এখানে আরও কিছু ঘটনা আছে। আরও লোক যুক্ত আছে। কিংবা আরও বেশ কিছু ঘটনা আছে। যা তিনি জানেন না বা খেয়াল করেননি।

তেইশ.
ফারহান হাঁটতে হাঁটতে বি ব্লক তিন নাম্বার সেলের কাছে চলে এলেন। তাকে দেখে সেখানে উপস্থিত সকলে স্যালুট করল। কিন্তু তিনি তা পাত্তা না দিয়ে সেলের ভেতরে প্রবেশ করলেন। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন পনেরো বাই পনেরো ফুট স্কয়ার একটি কক্ষ। রুমের মধ্যখানে রকটা ঝুলন্ত লাল বাতি জ্বালানো। কিন্তু আলোর পরিমাণ এতটাই কম যে, রুমের চারিপাশের অন্ধকারকে আলোকিত করতে সক্ষম হচ্ছে না। তাছাড়া সম্পূর্ণ রুমটাই কালো রঙ করা। যার হেতু আরও অন্ধকারাচ্ছন্নর পরিমাণটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাতির ঠিক নিচে একটা টেবিল রাখা। দুই ধারে দুইটা চেয়ার রাখা। একটাতে কিছুক্ষণ আগে ধরে আনা ছেলেটা। অপরপাশে বসেছিল সাব-ইন্সপেক্টর সাইমুন। ফারহানকে দেখামাত্র সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বসতে দেয়। তিনি চেয়ারটা একটু টান দিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি করেন। পাশে নজর করে দেখলেন, পাশে সাইমুন ছাড়াও আরও তিনজন কনস্টেবল হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে তেমন একটা ধ্যান না দিয়ে ছেলেটার দিকে নজর দিলেন। গম্ভীর কণ্ঠ নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন,
‘ তখন তুই বলেছিলি, আমি কেবল শুনেছি। এখন আমি প্রশ্ন করব। তুই শুধু উত্তর দিবি। যদি ভুলভাল বকার চেষ্টা করেছিস, তবে আমি যে তোর চেয়ে কতটা ভয়ানক তা অনুভব করতে পারবি। ‘
তার কণ্ঠস্বরে পুরো কক্ষটা থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল। কারও মুখে কোনো আওয়াজ নেই। সম্পূর্ণ রুমটাই নিস্তব্ধতায় বিদীর্ণ। কেবল নিঃশ্বাস নেওয়া এবং ত্যাগ করার শব্দ ভেসে আসছে কানে। সেদিকে ধ্যান না দিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রথম প্রশ্ন ছুড়লেন তিনি।
‘ এই মেয়েটাকে মারার কারণ কী? ‘
তার প্রশ্ন শুনে ছেলেটা হাসতে শুরু করল। যেন ফারহান কোনো হাস্যকর প্রশ্ন করেছেন। তার এরকম হাসি দেখে ফারহান একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। ছেলেটা হাসতে হাসতে বলতে লাগল, ‘ যেই মেয়েটা আমার সম্পূর্ণ জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে, তাকে কী করে সুখে থাকতে দিই? তাই মেরে দিয়েছি। ‘
‘ কীভাবে তোর জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে? ‘ ছেলেটা থামতে না থামতেই পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি। তার প্রশ্ন শুনে ছেলেটার চেহারার এক্সপ্রেশন দেখে অনুধাবন করা যায়, তার প্রশ্ন শুনে ভীষণ বিরক্ত সে।
‘ মিথ্যা রেপ কেসের জালে ফাঁসিয়ে। ‘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা বলল ছেলেটা। তার এহেন কথায় চমকে উঠলেন ফারহান। প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ কীভাবে? আর তাছাড়া তোর সাথে কে কে ছিল? ‘
‘ স্যার, এতকিছু শুনে আপনি কী করবেন? আমি আগের তিনটা খুন আর আদিবার খুন করেছি। আমি নিজে স্বীকারোক্তি দিচ্ছি। এবার আমাকে ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ‘ তার এরকম কথায় রেগে যান ফারহান। চেয়ার ছেড়ে উঠে যান তিনি। চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে টেনে ধরে ছেলেটার চুলগুলো। কিন্তু ছেলেটা চোখের পলকে তার কোমরে থাকা হোলস্টার থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দেয়। হাতকড়া পরা অবস্থাতেই বন্দুক লক করে তাক করে ফারহানের দিকে। তা দেখে সাইমুনও হোলস্টার থেকে নিজের 4mm ক্যালিভার বন্দুকটা হাতে তুলে নেয়। লক করে তাক করে ছেলেটার দিকে। মুহূর্তের মাঝে একটা ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে যায়। ফারহান বারবার থামতে বলতেছেন দুজনকে। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না। তিনি রেগে একটু আগাতে নিলেই ছেলেটা ট্রিগার চেপে দেয়। সাথে সাথে মাথা নিচু করে বসে পড়েন ফারহান। ফলে বন্দুকের গুলি তার মাথার উপর দিয়ে গিয়ে দেয়ালে লাগে। কিন্তু সাইমুনের লক্ষ্যবিচ্যুত হয় না। প্রথম গুলিটা গিয়ে লাগে ছেলেটার মাথার বাম পাশে। পরের গুলিটা গিয়ে লাগে বুক বরাবর। সাথে সাথে ছেলেটা মেঝেতে পড়ে যায়। রক্তে কালো মেঝে তলিয়ে যেতে শুরু করল। ফারহান কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই রেগে গেলেন নিজের কর্ম এবং সাইমুনের কাজের উপর। চিৎকার করে সাইমুনকে একের পর কথা শুনিয়ে চলেছেন।
‘ তুমি গুলি চালানোর পারমিশন কার থেকে নিলে? ও আমাদের জন্য কতবড় একটা এভিডন্স ছিল তা তুমি জানো? তোমার কী মনে হয়, খুনগুলো ও একাই করেছে? ইমপসিবল। আমি ভেবে পাচ্ছি না, তুমি গুলি চালালে কেন? ‘
সাইমুন সম্পূর্ণ থমকে গেছে। এই মুহূর্তে তার মুখ থেকে একটা শব্দও বেরুবে না। এই পরিস্থিতির সাথে সে পরিচিত নয়। ট্রেনিংয়ের সময় কেবল বন্দুক চালিয়েছিল সে। এরপর আর কখনো চালানো হয়নি। সিনিয়রের উপরে বন্দুক তাক করতেই তার হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছিল। যখন বন্দুক চালিয়ে দেয় ছেলেটি। তখন কোনোকিছু বা ভেবেই অব্যর্থ নিশানা লাগায়।
পরপর তিনটা গুলি চলার ফলে ইতোমধ্যে বি ব্লক তিনের সামনে পুলিশদের ভীড় জমে গেছে। রাগে গজগজ করতে করতে ফারহান বেরিয়ে পড়লেন সেল থেকে। পা বাড়ালেন নিজ কক্ষের দিকে। এমতাবস্থায় তার ফোন বেজে ওঠে।

রাগ নিয়েই ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। রনির ফোন থেকে কল এসেছে। বিলম্ব না করে দ্রুত কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কোনো শব্দ শুনতে না পেয়ে তিনি বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলেন। কিছুক্ষণ পর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ভেসে আসে রনির কথা।
‘ স্যা..র, ম্যা…ডামরে বাঁ….চা..ন স্যা…র। ‘
তার এরকম কথা শুনে ভয় পেয়ে যান ফারহান। বারবার প্রশ্ন করেন, কী হয়েছে। কিন্তু ওপাশ থেকে আর কোনো কথা ভেসে আসে না। হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেন। তার এরকম আচরণ দেখে সন্দেহ জাগে সাইমুনের মনে। সেও কয়েকজনের একটা টিম নিয়ে রওনা দেয় তার স্যারের পিছুপিছু।

‘ চলবে ‘

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here