খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,দ্বাদশ পর্ব

0
188

খুন সিরিজ তৃতীয় সিকুয়েন্স,দ্বাদশ পর্ব
গল্প:- মাস্টার অব মাইন্ড গেম
লেখা:- যাবেদ খান আবু বকর

আটাইশ.
ভোর রাত থেকে গেটের বাহিরে মিডিয়ার লোকেদের ভীড়! সকাল যত বাড়ছে, ভীড়ের মাত্রা ততটাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। এদিকে ভেতরের অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। অবস্থা বেগতিক। ফারহান প্রায় পাগলপাড়া। সিনিয়রকে জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করেছেন। যাবেদ তাকে সামলাতে পারছেন না। খানিকটা বিরক্ত হলেন। সেই সাথে রাগও ধরা পড়ল তার চোখ-মুখে। তিনিও নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তার দুই হাত ফারহানের কাঁধে রাখলেন। কিছুটা ধাক্কা দিয়ে নিজের বুক থেকে সরিয়ে সামনে দাঁড় করালেন। কান্নায় বিজড়িত চেহারাটা ভেসে উঠল তার সামনে। মুখটা নিচের দিকে করে রেখেছেন তিনি। কিঞ্চিৎ ধমকের সুর করে বলে উঠলেন যাবেদ, ‘ আমার দিকে তাকাও ‘। তার এরকম স্বরে কেঁপে উঠলেন ফারহান। মাথা উঁচু করে তাকালেন সিনিয়রের দিকে। উপস্থিত সকলে নীরব দর্শকদের মতো চেয়ে আছে তাদের দিকে। কারও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। আর বেরুবেই বা কী করে! এখানে বিষয়টা এখন আর একদিকের নেই। নানান দিকে চলে গেছে। তাছাড়া তাদের মাঝে উপস্থিত আছেন ডিডো সংস্থার শীর্ষ অ্যাজেন্ট। যার ক্ষমতা ডিআইজি থেকেও কোনো অংশে কম নয়। বরং বেশি বললেও ভুল হবে না। সেখানে তারা নিজেদের নাক গলিয়ে ব্যাপারটা আরও ঘোলাটে করার দুঃসাহস মোটেও দেখাবে না। কাজেই চুপচাপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করাই তাদের পক্ষে উত্তম। তাদের দিকে কোনো পাত্তা নেই অ্যাজেন্ট যাবেদের। কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই রাগী স্বর নিয়ে জুনিয়রের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন,
‘ পরিবার হারানো কী ব্যথা তা আমি জানি। কান্না থামাও। ‘
প্রথমবার আদেশে তার জুনিয়র অমান্য করে ফেললেন। কান্না না থামিয়ে বরং মেয়েদের মতো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে আরও কেঁদে দিলেন। যা দেখে তার সিনিয়র চটে গেলেন ভীষণ। চিৎকার করে ধমক দিলেন তিনি। ‘ কান্না থামাও বলছি। ‘ চিৎকারের শব্দে কেঁপে উঠলেন ফারহানসহ আরও গুটিকয়েক অফিসার। সিনিয়রের মাত্রাতিরিক্ত রাগ দেখে দমে গেলেন তিনি। দ্রুত নিজ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলেন। গম্ভীর কণ্ঠ নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন অ্যাজেন্ট,
‘ এই সময়টাই নিজের ধৈর্যকে ধরে রাখার। ওরা চাইছে, তুমি যেন পাগলের মতো উদ্ভট আচরণ করতে শুরু করো। আর এই উদ্ভট আচরণের মাঝেই ওরা তোমার নাগাল থেকে আনন্দ নিতে চাচ্ছে। পাশাপাশি তোমার নাকের ডগা দিয়ে ওরা ওদের উদ্দেশ্য সাধন করে নেবে। কিন্তু তুমি টেরও পাবে না। তোমার মেয়েকে কিডন্যাপ করে ওরা তোমার স্ট্রেস বাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। তুমি যেন চিন্তায় চিন্তায় সঠিক তদন্ত থেকে সরে এসো। কান্নাকাটি না করে তদন্তে লেগে যেতে হবে। তোমার এই কেসটা দিন দিন বেগতিক হয়ে ওঠার জন্য প্রফেসর নিয়াক আমার হাতে কেসটা হ্যান্ড ওভার করেছেন। প্রথমে বিরক্ত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তুমিই তো সামলে নিতে পারতে কেসটা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এবার খেলাটা জমবে। ‘ দীর্ঘসময় নিয়ে একটানা কথাগুলো বললেন অ্যাজেন্ট যাবেদ। পুরোনো দিনের অভিজ্ঞতা বলা যায়। যার জন্য মাঝপথে একটিবারের জন্যও থেমে যাননি তিনি। এক দমে সম্পূর্ণ কথা শেষ করে তবেই ক্ষ্যান্ত হয়েছেন। ফের বললেন, ‘ এখন আমাদের শুরু করতে হবে প্রথম থেকে। ঠিক যেখান থেকে গতকালের মূল ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছে। ‘ থামলেন তিনি। সিনিয়রের দিকে তাকিয়ে তার কথাটার ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু তার এই মুহূর্তে মস্তিষ্ক কাজ করছে না। চঞ্চল মস্তিষ্কটা আগের মতো চলছে না। সব যেন নিরামিষ হয়ে গেছে। সিনিয়র সত্যিই বলেছেন, এই সময়টা তার মাথা বিগড়ে দিয়ে অপরাধীরা যাচ্ছে তাই করতে পারে। এমনকি তার নাকের ডগা দিয়ে ফের অন্যায় করলেও তা তিনি ধরতে পারবেন না। তার এমন চাহনি দেখে অ্যাজেন্ট যাবেদ বুঝে নিলেন, কী প্রশ্ন করতে চাচ্ছে ফারহান! একটু দম নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন তিনি, ‘ আমাদের তদন্ত শুরু করতে হবে তোমার বাসা থেকে। মূল ঘটনার সূত্রপাত সেটাই। আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি, এই আজকের এই ঘটনা ঘটাবার জন্যই গতকাল রাতে সাইট ঘটনা হিসেবে লাইভ মার্ডারটা করানো হয়েছে। যার হেতু, তোমরা মেতে থাকো এই ঘটনাতে, আর ওরা মেতে উঠতে পারে ওদের মূল উদ্দেশ্যতে। ‘ ঠোঁট দুটো নাড়ানো বন্ধ করলেন অ্যাজেন্ট। এখনও আগের মতোই চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। তিন বছর আগে যেমন বোকাসোকা লাগত তাকে। তিন বছরেও যে আহামরি পরিবর্তন হয়েছে তাও না অনুভব করলেন অ্যাজেন্ট। ফের শব্দ ব্যয় করলেন তিনি, ‘ আমি বলতে চেয়েছি, এখন তোমার বাসায় যাব আমি। তদন্তটা সেখান থেকেই স্টার্ট করব। তুমি কি যাবে আমার সাথে? ‘ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন ফারহান। তিনি জানেন, তার সিনিয়র মোটেও কোনো সাধারণ মস্তিষ্কের অধিকারী নন। পূর্বের কেস থেকেই তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন, অসম্ভব মস্তিষ্কের অধিকারী তিনি। কাজেই তার থেকে এই মুহূর্তে আর কাউকে ভরসা করার জন্য মন সায় দিচ্ছে না। তার মাথা নাড়ানো দেখে অ্যাজেন্ট নতুন বাক্য আওড়ালেন।
‘ তাহলে দেরি করাটা ঠিক হবে না। তুমি আমার সাথে এসো। আর বাকি অফিসারগণ এখানেই থাকুন। প্রতি সেকেন্ডের ঘটনা বাটার ফ্লাই এফেক্টের মতো কাজ করবে। কাজেই সবাই সাবধানে থাকবেন। এমনকি ডাক্তারদের বাহিরের যাবতীয় কন্টাক্ট অফ করে দেন। অফিসিয়াল অথবা আন অফিসিয়াল হোক, টোটালি কন্টাক্ট অফ। বিষয়টা অস্বাভাবিক কিংবা অনৈতিক মনে হলেও তদন্তের স্বার্থে করতে হচ্ছে। ডাক্তারগণের পরিবারকে আপনাদের দুজন করে সিভিল সার্জন ভাগ করে দেন। এবং নজর রাখুন তাদের উপর। এবং তা দ্রুত। চব্বিশ ঘণ্টাই তাদের নজরে রাখার ব্যবস্থা করুন। ‘ ফারহানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে দৃষ্টি ফেরালেন ডিআইজির উপর। শেষ কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই ছুড়েছেন তিনি। এরপর গটগট শব্দ তুলে পা বাড়ালেন সামনের দিকে। তার পিছুপিছু আসছেন ফারহান। পদ ফেলা বন্ধ করলেন অ্যাজেন্ট। কঠিন স্বরে হুশিয়ারি দিলেন, ‘ আমি যেটা বলেছি, এট এনি কস্ট, সেভাবেই কাজ করবেন। যা থেকে যা হোক। আমার কথাগুলোর যেন নড়চড় না হয়। সিনসিয়ারলি কাজটা করবেন বলে আশা রাখছি মারুফ সাহেব। ‘ হালকার উপরে যে থ্রেট দিয়ে গেলেন তিনি তা আর বুঝতে বাকি নেই ডিআইজির। কিন্তু কিছুই বলার নেই তার। আর না তিনি কিছু বলতে পারবেন। তার কথায় অ্যাজেন্টকে সাসপেন্ড করা হবে না। কিন্তু অ্যাজেন্টের কথায় তাকে ঠিকই সাসপেন্ড করবে। কাজেই এখন তার কথাগুলো ফলো করা ছাড়া কোনো পথ নেই। বিষয়টা উপর পর্যায় চলে গেছে। তাছাড়া তার নিজের মেয়ের বিষয়ও বটে। কাজে হেলাফেলা তো মটেই নয়। যে-কোনো মূল্যেই নিজের মেয়ের উপর হামলাকারীদের শাস্তি চান তিনি। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালাতে লাগলেন। ডিসিকে বলে পাঁচজন ডাক্তারের পরিবারের পেছনে দুজন করে সিভিল সার্জন নিয়োগ করিয়ে দিলেন তাৎক্ষণিক। ডাক্তারদের ফোন নিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে ডাক্তারগণ মানতে চাননি। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করে কো-অপারেট করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। রাহেলাকে ২৪ ঘণ্টাই অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি এখন অনুকূলেই বলা চলে। কিন্তু কখন অনুকূল থেকে প্রতিকূল হয়ে যাবে জানা নেই কারও!

উনত্রিশ.
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে,
‘ দেশের পুলিশদের পরিবারই যদি নিরাপদ না থাকে, তবে কীভাবে নিরাপদ থাকতে পারে দেশেএ মানুষ! প্রশ্ন রয়ে যায় এখানেই। গতকাল রাত দুটোর দিকে হামলা হয় উত্তরা থানার ইন্সপেক্টর ফারহান আহমেদের বাড়িতে। সেখানে গোলাগুলিও চলে। গুলির আঘাতে গার্ডসহ দুজন পুলিশ অফিসারও মারা পড়ে। অফিসারের স্ত্রীর গায়ে গুলি লাগে। ভর্তি করানো হয় উত্তরার এক স্থানীয় হাসপাতালে। আমাদের সহকর্মী হাসপাতালের সামনেই আছেন। চলুন শুনে আসি তার কাছ থেকে। স্ক্রিনের পাশে এখন পঁচিশ থেকে আটাশ বছরের এক যুবককে দেখানাও হচ্ছে। য়ার দুই কানে দুটি ইয়ারফোন। হাতে রয়েছে সময় টিভি চ্যানেলের লোগো যুক্ত একটি মাউথ। তার উদ্দেশ্য করে খবর পাঠদাতা প্রশ্ন করলেন, ‘ ফায়াজ, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? ‘ ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ জি, আমি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি। ‘ তার থেকে সম্মতি পেয়ে পালটা প্রশ্ন ছুড়ল মেয়েটি। ‘ ওখানের আপডেট কী? কী চলছে এখন ওখানে? অফিসারের স্ত্রী কি এখনও জীবিত নাকি মারা গেছে? ‘
প্রশ্ন উত্তরে ফায়াজ নামের ছেলেটি বলতে আরম্ভ করল, ‘ আম আমার পেছনে দেখতে পাচ্ছেন, মিডিয়ার কর্মীদের বিশাল ভীড়! ‘ ক্যামেরাটা চারপাশে ঘোরানো হলো। কিন্তু ছেলেটি বলেই চলেছে, ‘ এখন অবধি হাসপাতালের ভেতর থেকে কোনো খবর জানানো হয়নি। হাসপাতালের মেইন গেইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যাতে করে হাসপাতালের ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। ‘ যখনই ফায়াজ নামের ছেলেটি তার বক্তব্য শেষ করতে যাবে, তখনই সবার গেটের দিকে অগ্রসর হওয়া দেখে সেদিকে তাকায়। নজরে পড়ে ফারহানকে। তার সাথে আরেকজনকে নজরে পড়ে। উঁচু লম্বা করে কেউ একজন। মুখে মাস্ক পরা। চোখে সানগ্লাস এবং মাথায় ক্যাপ। কালো শার্ট এবং কালো প্যান্ট যেন ম্যাচিং করে পরা। তা দেখে সে বলতে আরম্ভ করল, ‘ ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন অফিসার ফারহান। দেখতে পাচ্ছেন আপনারা। হয়তো কিছু বলতে চান। কিন্তু তাকে গাড়িতে বসতে দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোথাও যাচ্ছেন তিনি। ‘ ফারহান ড্রাইভিং সিটে বসেছেন। তার পাশে যাবেদ। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালের উঁচু গেটের কাছে চলে এসেছেন। কাচ লাগানো। গাড়িটা কোনোরকমে গেট পার হতেই ঘিরে ধরল মিডিয়ার কর্মীরা। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই বলতে চাচ্ছেন না তারা। কাচ না নামিয়েই হর্ন বাজিয়ে গাড়ি অল্প অল্প করে সামনের দিকে আগাচ্ছেন। তা দেখে রিপোর্ট করা ছেলেটি বলতে আরম্ভ করল, ‘ হয়তো কোথাও যাচ্ছেন তিনি। লোকেদের ভীড় ঠেলে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। কারও কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না। প্রচণ্ড ব্যস্ত মনে হচ্ছে তাকে। এমনকি তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার নয়। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, ভীড় ঠেলে গাড়ি নিয়ে মেইন রোডে চলে গেছেন। ফায়াজ মাহমুদ। উত্তরা, ঢাকা। ‘ ফায়াজ নামের ছেলেটির কথা শেষ হতেই স্ক্রিন সম্পূর্ণ খবর পাঠদাতা মেয়েটির দখলে চলে গেল। মেয়েটি বলতে আরম্ভ করল,’ এই ছিল সকাল আটটার সময়ের সংবাদ। আপডেট জানতে সঙ্গেই থাকুন আমাদের। ‘

ত্রিশ.
ফারহান এবং অ্যাজেন্ট যাবেদ হাসপাতাল থেকে বের হয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসেন। বাহিরে মিডিয়ার ভীড় দেখেও ভাবান্তর নেই তাদের মাঝে। যে-কোনো মূল্যেই এসব বাধা অতিক্রম করে লক্ষ্য অবধি পৌঁছাতে হবে। গাড়ি চালানো শুরু করলেন ফারহান। গেটের কাছে যেতেই কর্মরত দুজন গেট খুলে দিলো তাড়াতাড়ি। খুলে দিতেই ঝেঁকে ধরল মিডিয়ার লোক। তাদের গাড়ির আশেপাশে তাদের ভীড় যেন বেড়েই চলেছে। দায় হয়ে পড়েছে সামনে আগানো। অবস্থা বেগতিক দেখে সিনিয়রের দিকে তাকালেন তিনি। তার তাকানো দেখে সিনিয়রও তার দিকে তাকিয়ে মাথাটা উপর-নিচ করে সম্মতি জানালেন। বুঝতে পারলেন, এখন তার কী করণীয়! সময় ব্যয় না করে লেগে গেল পুরোনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে। হর্ন দিতে দিতে গিয়ার বাড়িয়ে ব্রেক কষে আওয়াজ তুলতে লাগল। ব্যাপারটা নজর কাড়ল উপস্থিত সকল মিডিয়া কর্মীদের। কিছুটা গতি দিয়েই ব্রেক চেপে সামনে আগাতে শুরু করল। মিডিয়ার কর্মীরাও যেন এহেন কর্মে সম্পূর্ণ বেকুব বনে গেছে। সামনে থেকে সরে যেতে শুরু করেছে তারা। মরার ভয় সবারই আছে। গাড়ির শব্দ শুনে যে কারও মনে হবে, হুট করে যদি ব্রেক থেকে পা সরে যায়, তবে যে সামনে আছে, সে শেষ! কাজেই সরে যাওয়া উত্তম। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বেশিক্ষণ সময় লাগল না ভীড় থেকে বেরিয়ে আসতে। সিনিয়র আশেপাশে দেখছেন, কিছু যেন খুঁজছেন তিনি। কিন্তু এই বিষয়টা পাত্তা দিলো না ফারহান। তিনি এখন তার নিজের ভাবনায় ব্যস্ত। গাড়ি ছুটিয়ে চলেছে সত্তর কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা বেগে। সামনে গাড়ি-ঘোড়া খুব একটা নেই, তবে যা আছে তা নেহাৎই কম নয়। তার মাঝেও দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই পৌঁছে গেলেন তাদের লক্ষ্যে। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে, দোতলা একটা বাড়ি। গাছের সারি দিয়ে সাজানো হয়েছে চারিদিক। গাড়ি গেটের কাছে যেতেই দরজা খুলে একপ্রকার লাফিয়ে নেমে পড়লেন ফারহান। তার এহেন কর্মে অ্যাজেন্ট যাবেদের কিঞ্চিৎ বিরক্তি এলেও তা নিয়ে ভাবলেন না। তিনিও গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। পা বাড়ালেন বাড়ির ভেতর দিকে। ইতোমধ্যে বাড়ির চারপাশে পুলিশ অফিসার এবং ফরেনসিক বিভাগের লোকেদের সমাগম। তারা সবাই তাদের কাজে ব্যস্ত। ফারহানের দিকে নজর দিলেন তিনি। নজরে আসে তার, ছেলেটা পাগলের মতো হন্ন হয়ে বাড়ির ভেতর দিকে ছুটছে। তাকে উপস্থিত পুলিশ অফিসারগণ চিনেনি। ফলে তাদের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যেন সে আম লোক। এতে তিনিও খুশি হলেন। সব স্থানে নিজেকে জাহির করতে ভালো লাগে না। কিছু স্থানে নিজের পরিচয় লুকিয়ে রেখেও কাজ করা উত্তম মনে করেন তিনি। ফরেনসিক বিভাগের লোকজন চারপাশটা ভালো করে সার্চ করার চেষ্টা করছে। পুলিশ অফিসারগণ নিজেদের কর্মে ব্যস্ত। কেউ মাছি তাড়ানোয় আবার কেউ ফরেনসিক বিভাগের লোকেদের সাহায্য করছে। ব্যাপারটা দেখে হাসি পেল তার। নিজে নিজে বলতে লাগলেন, এরা কবে পরিবর্তন হবে? সব দায়িত্ব কেন সিনিয়র অফিসারদের তদন্ত করতে হবে? তারা কি নিজস্বভাবে কাজ করতে পারে না? কিন্তু এই প্রশ্নের জবাব নেই তা তার ভালো করেই জানা আছে। তাদের দিকে আর ধ্যান না দিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন। প্রধান ফটক পেরিয়ে বাড়ির ড্রয়িং রুমের মেঝেতে পা রাখলেন। এই প্রথমবারের মতো ফারহানের বাড়িতে এসেছেন তিনি। তিন বছর আগে বহুবার তাকে দাওয়াত করেছে ফারহান। কিন্তু প্রত্যেকবারই প্রত্যাখান করে দিয়েছেন তিনি। ভাবেননিও, ফারহানের বাসায় তিনি এভাবেও কখনো আসবেন! ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে ফারহান। বিষয়টা তার কাছে খারাপ লাগল। কিন্তু তিনি দাঁড়ালেন না। সম্পূর্ণ বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। প্রত্যেকটা ঘর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে নজর বোলাচ্ছেন। যেন ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মস্তিষ্কে সাজানোর চেষ্টা করছেন।

উপরের দুটো ঘর এবং নিচের ঘর দুটো ভালো করে দেখলেন। শোবার ঘরে ঢুকতে নজরে আসে, বিছানাটা কিঞ্চিৎ ঘুচে আছে। তাছাড়া বিছানার উপরে পাতলা কম্বল খোলা অবস্থায় দেখতে পান। বুঝতে পারেন, ঘুমিয়ে ছিলেন কিংবা ঘুমানোর চেষ্টা করছিলেন তারা। দোতলা থেকে নেমে এলেন ড্রয়িং রুমে। মেঝেতে এখনও রক্তের দাগ রয়েছে। মার্ক করা হয়েছে একটা দেহ আকৃতির। দরজার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন তা। নাহ, তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন নেই। অর্থাৎ বুঝা যায়, দরজা ভেঙে নয়, হয় দরজা চাবি দিয়ে খুলেছে, নয়তো ভেতর থেকে কেউ খুলে দিয়েছে দরজা। ভাবনায় ব্যস্ত হলেন, ভেতর থেকে যদি খুলতে হয়, তবে কে খুলবে? মস্তিষ্কে প্রশ্নের দানা আরেকটা বাঁধল যখন উপরে চারিদিকে তাকালেন। নজরে পড়ল সিসি ক্যামেরা। দ্রুত ফারহানের কাছে উপস্থিত হলেন। প্রশ্ন রাখলেন গম্ভীর স্বরে,
‘ সিসিটিভি ফুটেজ কোথায় পাওয়া যাবে? ‘
তার এই প্রশ্নে চমকে ওঠেন ফারহান। তার মাথাতে এই বিষয়টা ছিলই না। ভুলেই গেছিলেন তিনি, তার বাসায় যে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। দৌড় লাগালেন স্টোর রুমে। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির নিচে একটা দরজা আছে। যা খুব সূক্ষ্মভাবে না তাকালে দেখা যাবে না। দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন ফারহান। তার পিছু পিছু ভেতরে আসেন অ্যাজেন্ট যাবেদ। ভেতরে প্রবেশ করেই ফারহান লাইটগুলো সুইচ চেপে জ্বালিয়ে দেন। মুহূর্তে অন্ধকারে জীর্ণ কক্ষটা আলোয় ভরে ওঠে কানায় কানায়। কক্ষের মাঝে পুরোনো জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে। তবে দরজার উপর প্রান্তে একটা বড়োসড়ো টেবিল রয়েছে। অবাক হলেন যাবেদ। সাধারণত স্টোর রুম তেমনভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে না কারও। কিন্তু ফারহানের বেলায় যেন তা উলটো। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যেন কদিন পরপরই পরিষ্কার করা হয় ঘরটি। নজর করলেন, টেবিলের উপর রাখা বেশ কয়েকটা মনিটর। কাছে গিয়ে দেখলেন, চল্লিশ ইঞ্চির তিনটা মনিটর। প্রত্যেক মনিটরে বারোটি করে ফুটেল রান করতেছে। মোট ছত্রিশটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে এই বাড়িতে। মনিটরের সামনে আসতে ফুটেজ স্টোর করার জন্য বেশ কয়েকটি হার্ডডিস্ক রয়েছে পাশে। সেদিকে ধ্যান না দিয়ে ফারহান টেবিলের ওপারে থাকা চেয়ারে বসে পড়লেন। একটাই চেয়ার দেখে সিনিয়রকে প্রথমে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মানা করে দেন সিনিয়র। আদেশ করেন তাকেই বসার জন্য। সিসিটিভি ফুটেজ প্লে করেন আগের দিন রাতের বেলায়। রাত একটা থেকে প্লে করে ফুটেজ। দুই গতিতে ফার্স্ট মোশনে ফুটেজগুলো প্লে করে দিলো। একটা আটচল্লিশ মিনিট হতেই দুটো গাড়ি বাড়ির রাস্তা দিয়ে তার বাড়ির দিকে আসতে দেখা যায়। দুই নং মনিটরের ছয়-সাত এবং আট-নয় ফুটেজে দেখা যায় বিষয়টি। কিন্তু অবাক বিষয় আচমকাই সম্পূর্ণ স্ক্রিন কালো হয়ে যায়। ঝিরিঝিরি কর‍তে শুরু করে ফুটেজ। বেশ কয়েকবার টেনে দেখলেন। কিন্তু একই! প্রায় দীর্ঘ এক ঘণ্টার মতো স্ক্রিন সম্পূর্ণ ব্ল্যাঙ্ক ছিল। যা বুঝার বুঝে নিলেন। ফারহানকে আদেশ করলেন, গাড়িগুলো যেখান থেকে দেখা যাচ্ছিল, ফুটেজ সেখানে নিয়ে তিন মনিটরে সম্পূর্ণ জুম করতে। তার আদেশ মতো কাজ করলেন জুনিয়র। তিনটি স্ক্রিনে গাড়িগুলোর তিন এঙ্গেলে ফুটেজ ভেসে উঠল। তিন নাম্বার মনিটরে গাড়ির পেছন দিকের একটা ফুটেজ ভেসে ওঠে। পজ করার আদেশ দেন যাবেদ। গাড়ির নাম্বার প্লেট স্পষ্ট না হলেও ব্রেক কষায় পেছনের লাল আলোয় নাম্বার প্লেটটা যেন আরেকটু স্পষ্ট করে তুলেছে। যতটুকু বুঝা যায়, অনুধাবন অনুসারে গাড়ির নাম্বারটি নোট করলেন যাবেদ। যেন খেই খুঁজে পেলেন কেসের।

– চলবে –

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here