#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর-০৪,০৫
মাহফুজা_আফরিন_শিখা
০৪
৭,
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মৌ দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে থাকা ব্যাক্তিকে দেখে তার চোখ-মুখে হাসির ঝলক ফুটে উঠে। মৃদু হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে মৌ। আগন্তুক ব্যাক্তি মৌ-য়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ওর কপালে চুমু খায়। মৌ তাকে ছেড়ে দিয়ে উৎসুক নিয়ে বলতে থাকে,
– তুমি কখন আসলে আন্টি আর তুমি আসছো আমাদের জানাওনি কেন? তোমার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো।
সৈয়দা মাহবুবা মৌয়ের দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর তার ব্যাগ হাতে নিয়ে মৌকে সাইড করে ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বললেন,
– মেহুর সাথে থেকে তোর স্বভাবটাও মেহুর মতোই হয়েছে। ভিতরে আসতে দিবি তো, নাকি বাহিরে দাঁড়িয়ে তোর সব প্রশ্নের জবাব দিবো।
– হ্যাঁ হ্যাঁ আসোনা সৈয়দা মাহবুবার হাতের ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে নিলো মৌ। ভিতরে এসে সৈয়দা মাহবুবা একটা চেয়ারে বসে পরেন। মৌ ব্যাগটা রেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
– আন্টি পানি খাবে তুমি। তোমাকে পানি দিবো?
– এক গ্লাস লেবুর শরবত করে দে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে। মেহু কোথায়? ওকে দেখতে পাচ্ছি না যে।
– তোমার মেয়ে কখন কোথায় যায় সেটা কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করে নাকি। সকাল সকাল কোথায় যেন বেড়িয়ে গেলো। দেখো আজ আবার কার সাথে ঝগড়া করে ফিরে।
– এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না। চসমা খুলে সেটা শাড়ির আচল দিয়ে মুছে আবার পরে নিলেন সৈয়দা মাহবুবা। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে মেহেরের নাম্বারে ডায়াল করলেন। রিং হয়ে যাওয়ার পরেও মেহের কল রিসিভ করলো না। সৈয়দা মাহবুবা দুই বার কল দিলেন কিন্তু মেহের একবারও কল রিসিভ করে নি।
৮,
এক বছর পর মাধ্যমিক স্কুলে পা রাখলো মেহের। বছর খানেক আগে নববর্ষ উৎযাপনে এই স্কুলে এসেছিলো মেহের। তারপর আর এখানে আসা হয়নি তার। কাল রাতে স্কুলের হেড মাস্টার কল না করলে হয়তো আজও এখানে আসা হতো না তার। এক বছরে স্কুলের অনেক কিছুই বদলে গেছে। স্কুলের সামনে বড়ই গাছটা আর নেই। যেখানে রোজ স্কুলে আসার পথে বড়ই গাছটাই সকলের চোখে পড়তো। শীতের মৌসুমে অনেক বড়ই দেখে যেতো এই গাছটায়। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে সবই বড়ই ছিঁড়ে খেতো। তাই বড়ই গাছের মালিক গাছে একটা সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখতেন, বড়ই গাছে ঢিল দেওয়া নিষেধ। কে শুনে কার কথা। সবাই ঢিল মেরে আগে সাইনবোর্ডটাই নষ্ট করে দিতো। মেহের গিয়ে হেড স্যারের সাথে দেখা করে। হেড স্যার তাকে দেখে খুব খুশি হয়।
– আরে মেহের তুমি এসেছো তাহলে। আমরা তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।
তারপর দারোয়ান গিয়ে চারজন ছেলেমেয়েকে হেড স্যারের রুমে নিয়ে আসে। এখানে কি হচ্ছে আর তাকে কেন ডেকেছে এর কিছুই জানেনা মেহের। আর এই ছেলেমেয়েদের ই বা কেন ডেকেছে। মেহের হেড স্যারকে কিছু বলবে তার আগেই তিনি বলে উঠেন,
– মেহের, তুমি চলে যাওয়ার পর ডিবেটে আমাদের স্কুল একদম পিছিয়ে গেছে। তোমার মতো করে কেও বক্তব্য রাখতে পারেনা। একসময় জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগীতায় আমাদের স্কুল প্রথম ছিলো। ক্রমে ক্রমে আমরা সেই পদটা হাড়িয়ে ফেলছি। প্রতিবারের ন্যায় এবারও আমাদের স্কুল থেকে চারজন প্রতিযোগী জাতীয় স্কুল প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করবে। আমি চাই এদের সকলকে তুমি সাহায্য করো। তুমিই এদের বক্তব্য লিখে দাও।
– এবারের প্রতিযোগীতা কোন বিষয়ের উপর।
– সামনে আসছে আট-ই মার্চ। বিশ্ব নারী দিবস। আট-ই মার্চ নিয়ে হবে এবারের বিতর্ক প্রতিযোগীতা। আমাদের স্কুল নারীর অধীকার আর সম্মান নিয়ে লড়বে। আচ্ছা মেহের তুমি আট-ই মার্চ সম্পর্কে কি কি জানো?
– আট-ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের প্রতিটা দেশে নানা রুপে এই দিবসটি পালিত হয়। সভা সমিতি ধর্মঘটও হয়। এসব সভায় নারী-পুরুষের বেতন-ভাতায় অসাম্য, নারী নির্যাতন, মেয়ে শিশু নির্যাতন এবং গর্ভপাত ইত্যাদি বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। কোন কোন দেশে নারীরা ধর্মঘট পালন করেছে। তবে কোথাও কোথও নারীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি অনুষ্ঠানকে ম্লান করে দিয়েছে।
– বাহ। আমি জানতাম তোমার থেকে ভালো এই বিষয়ে আর কেও লেখতে পারবে না। তুমি ওদের সাথে যাও আর ওদেরকে সব বুঝিয়ে দাও।
৮,
হেলেদুলে হেটে যাচ্ছে মেহের। স্কুল থেকে ফিরতে দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়েগেছে। তাই ভাবলো এলমাদের বাসায় গিয়ে ওকে পড়িয়ে একেবারে বাসায় ফিরবে সে। এখন এলমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যেই হাটছে মেহের আর গুনগুনিয়ে গান গাইছে। এমনি সময় একটা বড় গাড়ি দ্রুত স্পিডে ওকে পাস করে গেলো। গাড়িটা এত দ্রুত যাচ্ছে যে রাস্তার থাকা কিছু ময়লা এসে পরে মেহেরের শরীরে। রাগে মেহের চিৎকার করে বলে উঠে,
– গাড়ি কিনে কি পুরো রাস্তাটাই কিনে নিয়েছেন নাকি? রাস্তার আশেপাশে লোক চলাচল করে এগুলো দেখতে পাননা নাকি। চোখ পকেটে নিয়ে গাড়ি চালান নাকি।
গাড়িটা কিছুদূর যেতেই থেমে যায় তারপর গাড়ি থেকে একটা মেয়ে নেমে আসে। মেয়েটাকে দেখেই মেহেরের রাগ মাথা চাপা দিয়ে উঠে। এই তো সেই মেয়ে। সেদিন যে মেহেরকে অডিটোরিয়ামে নিয়ে গেছিলো। আজ আবার মেয়েটা এখানে! কি চাইছে কি এই মেয়েটা? উহঃ বিরক্তিকর।
– এই মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে চিৎকার কেন করছো?
মেহের রাহির কথার জবাব দিলোনা। দাঁত কটমট করে তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। মেহেরকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখুনি রাহিকে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থেকে এক মাধ্যবয়স্ক মহিলা বের হয়ে আসলেন। এই মহিলাকে দেখে মেহেরের মনে হচ্ছে তাকে আগে কোথাও দেখেছে? কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে পড়ছে না মেহেরের। মহিলাটি ওদের কাছে এসে জিগ্যেস করে,
– কি হচ্ছে এখানে! আর রাহি তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও গিয়ে গাড়িতে বসো।
– দেখনা এই বেয়াদব মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিভাবে চিৎকার করছে। সেদিন এই মেয়েটাই রাহনাফকে ধাক্কা দিয়েছিলো।
– ভদ্রভাবে কথা বলো। অপরিচিতদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তোমাকে কেও শেখায়নি! আর কাকে বেয়াদব মেয়ে বলে সম্বোধন করছো! তোমারকি কি নিজের সম্পর্কে কোন ধারনা নেই নাকি।
– তোমার সাহস করে কি করে আমার সাথে এভাবে কথা বলার। রাহি হাত উঠায় মেহেরকে মারার জন্যে কিন্তু তার আগেই সেই মহিলাটি রাহির হাত ধরে বলে,
-এটা তুমি কি করছো রাহি।
– এখানে কি হচ্ছে এসব? পুরুষালির কন্ঠস্বর পেয়ে সবাই পিছনে তাকায়। পিছনে তাকিয়ে যাকে দেখতে পায় তা দেখেই প্রচুর রাগ হয় মেহেরের। এই লোকটা এখানে কেন? যত বলি আমি এই লোকটার মুখ দর্শন করবো না ততই এই লোকটা আমার চোখের সামনে এসে হাজির হয়। লোকটাকে দেখেই দু-পা পিছিয়ে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় মেহের তখন সে বলে উঠে,
– মেহের,
সৈয়দ নওশাদ আহমেদের কথা শুনে রাহি ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকায়। তারপর বলে,
– বাবা তুৃমি ওই ষ্টুপিড মেয়টাকে,,, রাহি আর কিছু বলার আগেই সৈয়দ নওশাদ আহমেদ তার হাত উঁচু করে রাহিকে থামিয়ে দেন। নওশাদ আহমেদ এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিলো। রাহি যখন মেহেরে উপর হাত উঠায় তখন তিনি এগিয়ে আসেন। এদিকে মেহের রাহির মুখে বাবা ডাক শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। রাহি সৈয়দ নওশাদ আহমেদকে বাবা বলে কেন ডাকলো তাহলে কি এই রাহি! পিছনের দিকে ঘুরে তাকায় মেহের। রাহির দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে করুন চোখে নওশাদের দিকে তাকায়। নওশাদ মেহেরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। তখন নওশাদে চোখে ছিলো অনুতাপের ছোয়া। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় মেহের। তারপর সেখান থেকে ছুটে চলে আসে।
কিছুদূর এসে একটা তেতুল গাছের নিচের বসে পরে মেহের। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে বড় বড় করে কয়েকটা শ্বাস নিয় সে। ভালোই তো আছেন মিস্টার নওশাদ ওরফো আমার জন্মদাতা। নিজের স্ত্রী সন্তান নিয়ে কত সুখে দিন কাটাচ্ছেন আপনি। আপনার মেয়ে আজ বড় গাড়ি করে ঘুরে। সমাজে আপনার উঁচু স্থান রয়েছে। সবাই আপনাদরে কত সম্মান করে। তাহলে কেন বারবার আমার সামনে আসন আপনি? আমাদের লাঞ্ছনা মানুষের অপমান আর কটু কথা ছাড়া আর কি দিয়েছেন আপনি। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না আমার মা মানুষের কতটা অপমান সহ্য করেছে। এখনো করে। সবাই যখন আমার জন্মপরিচয় জানতে চায় তখন আমি বলি আমার মা সিঙ্গেল মাদার। তখন লোকে আমার মায়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলে। আচ্ছা আমি ভুল কি বলি বলুন তো। জম্ম থেকে মা আমাকে একা বড় করে তুলেছে তাহলে আমার মা তো সিঙ্গেল মাদারই তাইনা। তাহলে লোকে কেন আমার মায়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলে। আর সেখানে আপনি আপনার পরিবার নিয়ে কতটা সুখে আছেন। সত্যি স্বার্থপররা সবমসময়ই ভালো থাকে।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।
#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৫]
জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। তাই, মা হওয়ার পর যদি বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা বৈধব্যের অঘটন ঘটে, তাহলেও বিরহে অশ্রুবিসর্জন নয়, একলা মায়ের মানে Single Mother হয়েও দায়িত্ব নিয়ে পূর্ণ আনন্দ উপভোগ করা যায়। এমন উত্তরণের কাহিনি বহু ছবিতেই তুলে ধরা হয়েছে।আমাদের সমাজ আজও সিংগল মাদার-এর বিষয়টিকে খুব সহজে মেনে নিতে পারেনি। সন্তানকে বড়ো করার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে, পুরুষের সাহায্য ছাড়া মহিলারা অক্ষম বলে মনে করে আমাদের সমাজ। হাজারো প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয় একলা মায়েদের। অবশ্য, সিংগল মাদার হওয়া কঠিন জেনেও, শুধু মনের জোরে লড়াই জারি রেখেছেন অনেকে। তার অন্যতম উদাহরণ হলো সৈয়দা মাহবুবা। সৈয়দা মাহবুবা যেদিন প্রথম মেহেরকে স্কুলে ভর্তি করাতে যান তখন সেখানেও তাকে অপমানিত হতে হয়। স্কুলের এক শিক্ষিত তার চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলে। মেহের সৈয়দা মাহবুবার পাপের ফল এটা বলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। স্কুলের শিক্ষকদের অনেক বুঝিয়েও সৈয়দা মাহবুবা সেদিন মেহেরের বাবার পরিচয় আড়াল করতে পারেন নি। বাধ্যহয়েই তাকে মেহেরের বাবার নাম বলতে হয়। হ্যঁ মেহেরের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক এটাই। একটা সার্টিফিকেট। এর বাইরে কিছুনা। সার্টিফিকেটে বাবার নামের জায়গায় গুনে গুনে এগারো অক্ষরের একটা নাম লেখে মেহের এটাই ওর সাথে ওর বাবার সম্পর্ক। মেহের যখন ক্লাস সেভেন এ উঠলো তখন প্রথমবার তার বাবাকে দেখতে পায় সে। সৈয়দ নওশাদ সেদিন তার প্রথম সন্তানকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে মেহেরের কাছে ক্ষমা চায়। আর বাংলা সিনেমার মতোই বলে,
– আমাকে একবার বাবা বলে ডাক মা।
মেহের সেদিন তার বাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। আজ অব্ধি সে তার বাবাকে মেনে নিতে পারে নি মেহের। ক্ষমা করেনি সে তার বাবাকে। তার কাছে তো তার মা আছেই। তার মা-ই তার বাবা -মা। যেখানে তার মা সমাজের মানুষের কটু কথা শুনে তাকে একলা বড় করে তুলেছে সেখানে এই লোকটাকে বাবা বলে ডাকার কি দরকার। তাকে বাবা বলে ডাকার জন্যে তো তার একটা মেয়ে আছে। মেহের না হয় তার মাকে আঁকড়ে ধরেই সারাটা জিবন কাটিয়ে দিবে। চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু গাল গড়িয়ে পড়লো।
– আপনি কাঁদছেন কেন লেখিকা সাহেবা?
পরিচিত এক কণ্ঠস্বর শুনে হচকচিয়ে উঠে মেহের। হাতের আলতো স্পর্শে চোখের পানি মুছে সামনে তাকিয়ে বলে,
– আপনি?
– হ্যাঁ। মাঠে যাচ্ছিলাম। আপনি কাঁদছেন কেন?
– কাঁদছিনা তো। আপনি যান না যেখানে যাচ্ছিলেন।
– লেখিকা সাহেবা, আপনার চোখ বলছে আপনি কাঁদছেন আর মুখে মিথ্যে বলছেন?
– আমি লেখিকা নই। শক্তগলায় বলল মেহের।
মেহেরের কথা শুনে স্মিত হাসলো রাহনাফ। ওষ্ঠদ্বয় চেপে মনে মনে বলল,
– আমি তো আপনাকে লেখিকা বলেই ডাকবো ম্যাডাম। যার লেখা প্রতিবেদন, গল্প প্রতিমাসে খবরের কাগজে ছাপা হয় সে কি লেখিকা নয়। যার লেখা ডিবেটের কারনে একটা স্কুল প্রতিবছর স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়েছে সে কি লেখিকা নয়।নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকায় রাহনাফ। এতে বেশ বিরক্ত হয় মেহের। রাহনাফের হঠাৎ করে মেহেরের সামনে চলে আসা ওর সাথে কথা বলা এগুলো খুব বিরক্ত লাগে মেহেরের। মেহের রাহনাফের দিকে বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই পিছন থেকে রাহনাফ বলে উঠে,
– আমার বলটা?
– ওটা আমি কেটে রোদে শুকাতে দিয়েছি। ভালো করে শুকানোর পর সেটা জ্বালানি হিসাবে ব্যাবহার করবো। আপনি আমার পিঁয়াজু খেয়েছেন না। আমি আপনার বল জ্বালিয়ে পিঁয়াজু ভাঁজবো আর সেটা গপাগপ খেয়ে নিবো। মেহেরের কথা শুনে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকে রাহনাফ। মাঝে মাঝে মেহের এমনসব কথা বলে না, অবাক না হয়ে পারা যায়না। রাহনাফ তার ভ্রূদ্বয়ে কিৎচিত ভাজ ফেলে বলে উঠে,
– আপনি এমন শুকনো শুকনো কথা বলেন কেন?
– ভেজা কথা কিভাবে বল! তাহলে কি এখন মুখে পানি দিয়ে কথা বলতে হবে।
মেহেরের কথাশুনে ফিক করে হেসে দেয় রাহনাফ। এই মেহেরটাও না রাগের সময় এমন একেকটা কথা বলে না হেসে পারা যায় না। রাহনাফ পকেটে দুহাত গুজে হাসি মুখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাহনাফের হাসি দেখে মেহের প্রচন্ড বিরক্ত। সে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। বিনিময়ে রাহনাফ অধরোষ্ঠ চেপে হাসে।
মেহেরের চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রাহনাফের মোবাইলে একটা কল আসে। বুকপকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মোবাইলের স্কিনে নাম্বার দেখে খুশির ঝলক ফুটে উঠে রাহনাফের মুখে। মৃদু হেসে কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে মাঠের দিকে এগিয়ে যায়।
৯,
সৈয়দা মাহবুবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে মেহের। সৈয়দা মাহবুবা তার মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কতদিন পর এভাবে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে মেহের। মায়ের কোলে মাথা রাখলে নিমিষেই সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে হয়। মেহের সৈয়দা মাহবুবার কোলে মুখ গুজেদিয়ে দু-হাতে ওনার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,
– জানো মা আজও রাস্তায় ওই লোকটার সাথে দেখা হয়েছিলো। সে তার মেয়ে আর বউকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। মেহেরের কথার প্রতিউত্তরে কোন জবাব দেয়না তার মা। অতঃপর মেহের বলে,
– আমি আজও কোন কথা বলিনি তার সাথে। তুমিই বলো মা আমি কেন তার সাথে কথা বলবো। মেহের কথা শুনে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে সৈয়দা মাহবুবা। মেহের যতই তার বাবাকে অস্বীকার করুকনা কেন? বাবা বলে ডাকতে না পারার আক্ষেপ যে তারও আছে। সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের মাথায় উষ্ণ ভালোবাসার স্পর্শ একে দিলেন। মেহের আরো শক্তকরে তার মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরলো।
আয়নার দিকে অন্তর্দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিছানায় বসে আছে মেহের। কপালে তার কদাচিৎ ভাজ। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে আয়নাতে মৌয়ের প্রতিবিম্ব দেখছে। মৌ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ। কখনো সে মাথা আছড়াচ্ছে কখনো হাতে চুড়ি পরছে আবার কখনো কানের দুল পরছে। আর এগুলো পরে আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আবার খুলে ফেলছে। আজ মৌকে একটু অন্যরকম লাগছে। চোখমুখ উজ্জল যেন এক আকাশ পরিমান সুখ এসে ভীড় জমিয়েছে তার মনে। ঠোঁটের কোনে তো আলতো হাসি লেগেই আছে।
– এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের কাজ কর। অনেক বড় দায়িত্ব মাথায় নিয়েছিস। সেগুলো ঠিকঠাক মতো পালন করতে হবে তো নাকি? হাতের চুড়ি খুলতে খুলতে বলল মৌ।
– আজ তোকে একটু বেশীই খুশি খুশি লাগছে কাহিনী কি??
মেহের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের কোন জবাবই দেয়না মৌ। নেইলপালিশের কৌটা নিয়ে মেহেরের পাশে বসে। নোখে নেইলপালিশ লাগিয়ে তাতে ফুঁ দিয়ে বলে,
– আজ আমি অনেক খুশি মেহু।
-সেটাই তো জানতে চাইছি। এত খুশির কারন কি।
মৌ হাসে কোন জবাব দেয়না। নেইলপালিশ লাগানো শেষে পুরো রুম ঘুরে ঘুরে ডান্স করতে থাকে। অতঃপর বলে,
– আমি কাল আমার ড্রিম বয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমি তাকে আমার মনের কথা বলবো। আমার ড্রিম বয় আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছে মিহু।
– এতে নাচার কি হলো। সে এমনকি যে দেখা করতে চাইছে বলে তোকে খুশিতে নাচতে হবে। পাগল টাগল হলি নাকি।
মেহেরের কথা শুনে মৌ থেমে যায়। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কোমড়ে হাত রেখে মেহেরের দিকে তাকায় মৌ। মেহের মৌয়ের চাহনি উপেক্ষা করে নিজের কাজে মন দেয় আর বিরবির করে বলে,আমার সময়টুকুই নষ্ট। এদিকে মৌ বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে পুরো ঘর ঘুরে ঘুরে ডান্স করতে থাকে।
১০,
তিনদিন পর আজ কলেজে এসেছে মেহের। এই তিনদিনে ডিবেট প্রতিযোগীতার সব বক্তব্য লেখা শেষ করে স্কুলে জমা দিয়ে এসেছে। আজ কলেজে পা রাখতেই রাহির মুখোমুখি হতে হয় মেহেরকে। রাহিকে দেখে অন্যদিককে চলে যেতে চাইলে রাহি গিয়ে মেহেরের সামনে দাঁড়ায়। মেহের রাহিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করে নিয়ে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে।তারপর বলে,
– প্রবলেম কি তোমার? বারবার আমার পথ আটকিয়ে দাঁড়াচ্ছ কেন?
– আজ তোমার গলার স্বর এত নিচু যে। কোথায় গেল তোমার দম।
– আমি তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাইছি না। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় মেহের। রাহি এবার গিয়ে মেহেরের হাত ধরে সাথে সাথে মেহের তার হাত মুঠি করে ফেলে। তার হাতদুটি বারবার করে মেহেরকে বলছে,
– তুই এখনো কিছু বলবি না মেহু। মেয়েটা তোর হাত ধরেছে মেহু। ওর হাতটা ধুমড়েমুচরে দে তুই।
দু-চোখ বন্ধকরে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নেয় মেহের। তারপর সে রাহির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সেই অংশটাকে ঝাড়া দিতে থাকে সে। আর বলে,
– নেক্সট টাইম এরকম কিছু করার দুঃসাহস করোনা। নাহলে এর ফল খুব খারাপ হবে। মনে রেখো।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।