#প্রণয়ের_ঢেউ
#Part_03
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে ধরণীর বুকে গলিয়ে পড়ছে কিঞ্চিৎ চাঁদের আলো। চাঁদের দিকে মুখ করে উড়ে যাচ্ছে বাদুড়ের দল। শীতল বাতাসের দোল যেন বারিয়ে দিচ্ছে নিস্তব্ধতা। ছাদের মুখ্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দ্যুতি। চোখ-মুখে তার বিরাজমান করেছে অপার বিষ্ময়। চাঁদের আবছা আলোয় অরণ্যের অবয়ব স্পষ্ট। উল্টোপিঠ হয়ে এক ধ্যানে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। এক হাত সিমেন্টের বাঁধানো রেলিং উপর ভড় দেওয়া আর অন্য হাতে জলন্ত সিগারেট। যেটাই দ্যুতির কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ছোট থেকে সে অরণ্যকে দেখে আসছে। বলতে যখন থেকে বুঝতে শিখেছে ঠিক তখন থেকেই। অরণ্য সবসময় সকলের কাছে অতি ভদ্র ছেলে। যার নাকি স্কুল, কলেজে ও বাইরে কোন খারাপ রেকর্ড নেই। আর না আছে কোন বাজে অভ্যাস। পড়ালেখা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আউটডোর এক্টিভিটিস সবকিছুতে সেরা। খেলাধুলায় এত এক্টিভ না হলেও সাইন্স ফেয়ার ও বিভিন্ন জ্ঞানের অলেম্পিয়াডের চ্যাম্পিয়ন রয়েছে সে। এত মেধাবী ছাত্র বলেই হয়তো বুয়েটে টপ টেনে নিজের জায়গা দখল করে নিয়েছিল সে। সকলের সাথে দ্যুতি নিজেও জানতো তার অরণ্য ভাইয়ের কোন খারাপ দিক নেই। কিন্তু আজ যেন সেই ধারণা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। দ্যুতির এইভাবেই সিগারেট জিনিসটা সহ্য হয়না তার উপর অরণ্যের হাতে জিনিসটা দেখে মেজাজটাই তার বিগড়ে যায়। দ্যুতি এইদিক সেদিক আর না তাকিয়ে সোজা অরণ্যের কাছে চলে যায়। কোন রকম দ্বিরুক্তি না করে সোজা অরণ্যের হাত থেকে সিগারেটটা টেনে ছাদের অন্যপাশে ছুঁড়ে মারে। ঘটনাটা এত দ্রুত হওয়ায় অরণ্য কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। সচকিত দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকালো সে। এই সময়ে দ্যুতিকে ছাদে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে। চঞ্চল দৃষ্টিতে এইদিক সেদিক তাকিয়ে পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলো সে। দ্যুতি অরণ্যের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
— এইসব কি হচ্ছে? আপনি সিগারেট খান?
অরণ্য সোজা স্বীকারোক্তি করলো,
— হ্যাঁ খাই। তো কি হয়েছে? আমার উপর কি শেখ হাসিনা সিগারেট খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারী করে রেখেছে নাকি যে আমি সিগারেট খেলেই কেস ফাইল হয়ে যাবে?
দ্যুতি ফুঁসে উঠে বলে,
— তাই বলে এই ছাইপাঁশ গিলবেন।
কথাটা বলে ফেলা দেওয়া সিগারেটটির দিকে ইশারা করে চোখ ফিরিয়ে নিতেই অরণ্যের পায়ের দিকে দৃষ্টি আটকে যায়, সেখানে প্রায় চার-পাঁচ সিগারেটের শেষাংশ পড়ে আছে। দ্যুতির বুঝতে দেরি নেই এইগুলো কে ফেলেছে। তার মানে কি অরণ্য চেইন স্মোকার? দ্যুতি কিছুক্ষণ আহত দৃষ্টি সেদিকে তাকিয়ে থেকে চোখ তুলে। নিভিয়ে যাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে,
— কেন খান এইগুলা?
দ্যুতির এমন কন্ঠ শুনে অরণ্য কিছু সময়ের জন্য থমকালো। অতঃপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— বদভ্যাস! জানিসই তো সব ছাড়া যায় কিন্তু বদভ্যাসগুলো ছাড়া যায় না। মৃত্যুর আগপর্যন্ত সেগুলো রয়েই যায়। যেমন আমার দুইটা বদভ্যাস চিরদিন রয়েই যাবে। এক সিগারেট, দুই…
কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করলো না অরণ্য। এর আগেই চুপ রয়ে গেলো। স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো দ্যুতির দিকে। নীরবেই চোখের ভাষায় যেন বুঝিয়ে দিতে চাইলো দ্বিতীয় বদভ্যাসটা সে। কিন্তু সেই দৃষ্টি বুঝার ক্ষমতা আদৌ কি দ্যুতির আছে? অরণ্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। দ্যুতি অরণ্যের শেষের কথা গায়ে না মেখে বলে,
— চাইলেই পরিবর্তন করা যায়। ইচ্ছাশক্তিটাই এইখানে আসল। কথাটা কিন্তু আপনি বলেছিলেন।
অরণ্য কৌতুকের সুরে বলে,
— আমি বলেছিলাম নাকি? কই মনে নেই তো।
দ্যুতি ফুঁসে উঠে বলে,
— একদম ফাজলামো করবেন না। বাজে লোক একটা। আমি এখনই গিয়ে আঙ্কেলকে বলছি দাঁড়ান।
দ্যুতির সামনের দিকে এক-দুই পা এগুতেই অরণ্য হুংকার দিয়ে বলে,
— আরেক পা যদি এগিয়েছিস তাহলে এখনই তোকে ছাদ থেকে ফেলে দিব বলে দিলাম।
দ্যুতি কথাটা গায়ে না মেখে সামনে এগিয়ে যেতেই অরণ্য ওকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ক্ষণেই কিছু বুঝে উঠার আগে দ্যুতির কোমড় চেপে ধরে রেলিং-এর উপর বসিয়ে দেয়। কিছুটা হেলিয়ে দেয় পিছনের দিকে। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতেই দ্যুতি হকচকিয়ে যায় এবং অরণ্যের টি-শার্টের গলা খামচে ধরে। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠে,
— কি করছো ভাইয়া? পড়ে যাব তো। নামাও আমায় বলছি।
অরণ্য নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
— বাবাকে কি জানি বলতে যাচ্ছিলে তুই? আবার বল তো একটু।
দ্যুতি একপলক অরণ্যের দিকে তাকিয়ে নিচে তাকায়। আটতলা বিশিষ্ট ভবনের উপর দেখে নিচের দৃশ্যটা দেখামাত্র দ্যুতি ভয়ে পুরো জমে যায়। কোনভাবে নিচে পড়ে গেলে তার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে এই পৃথিবীর বুক থেকে। কথাটা ভাবতেই নিস্তেজ হয়ে আসে শরীর। কোনরকম কম্পিত কন্ঠে বলে উঠে,
— কিছুই না ভাইয়া। আঙ্কেলকে কিছুই বলতে যাচ্ছিলাম না আমি। প্লিজ নামাও না ভাইয়া। প্লিজ! পড়ে যাব তো।
অরণ্য দ্যুতির কোমরটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে পিছনের দিকে হেলিয়ে দিতে দিতে বলে,
— বলবি কখনো তাকে এইসব নিয়ে?
দ্যুতি চোখ বন্ধ করে বলে,
— মরলেও না। আই প্রমিস আমি কাউকে কিছু বলবো না৷ প্লিজ এইবার নামিয়ে দাও না ভাইয়া। প্লিজ!
অরণ্য চোখ পিটপিটিয়ে কতক্ষণ দ্যুতির দিকে তাকিয়ে থাকে। দ্যুতির ভয়ার্ত চেহারা দেখে নিঃশব্দে হেসে উঠে। নিভৃতেই টেনে নিয়ে আসে নিজের দিকে। মুখের উপর কারো তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়তেই দ্যুতি ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায়। অরণ্যকে নিজের মুখের একদম সামনে দেখে কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও সে যে তাকে ফেলে দেয়নি তার জন্যে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। দ্যুতি পূর্ণ চোখে অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্য ভ্রু কুটি নাচিয়ে বলে,
— আমার সিগারেট খাওয়া নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন?
দ্যুতি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে তিক্ত কন্ঠে বলে,
— আমার ভালো লাগে না সিগারেট। যে খায় তাকেও না।
— তোর ভালো লাগা, না লাগা দিয়ে কি আমি আচার দিব, ডাফার?
অরণ্যে কথায় দ্যুতি এইবার প্রত্যুত্তর করলো না। নাক ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো। অরণ্য তা দেখে হালকা হেসে বলে,
— যেদিন আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটা চিরতরের জন্য তার অধিকারের লিখিত দলিলটা আমার হাতে সঁপে দিবে, সেদিন সব বদভ্যাস ছেড়ে দিব রে চাঁদ। প্রমিস!
দ্যুতি কিছু বুঝতে না পেরে চোখ পিটপিটিয়ে তাকায়। এত কঠিন আভিধানিক শব্দ তার মস্তিষ্কের কয়েক’শ গুণ উপর দিয়ে যায়। যার দরুন কথাগুলো কয়েকবার মনে আওড়াতে চেয়েও ব্যর্থ হলে সে। অরণ্যের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করতেই অরণ্য এক হাতে দ্যুতির নাক টেনে ওকে নিচে নামিয়ে দেয়। অতঃপর নির্বিকার কন্ঠে বলে,
— কেন এসেছিলি এইখানে?
— আপনার দেওয়া অঙ্কের আগামাথা বুঝি না। পাক্কা দুইঘন্টা যুদ্ধ করেছি এর সাথে কিন্তু তাও লাভ হয়নি। ওই ফালতু অঙ্কগুলো বুঝিয়ে দেন।
অরণ্য দ্যুতির মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,
— যুদ্ধ না করে একটু বুদ্ধি খাটালেই অঙ্ক এতক্ষণে সলভ হয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকা শুরু করে দিত। তোর মাথায় যে গোবর ভরা তা বার বার প্রমাণ করতে আসিস কেন? দুনিয়ার সব গরু ছাগল আমার গলায় এসে কেন ঝুলে বুঝি না।
দ্যুতি নাক ফুলিয়ে বলে,
— বাজে লোক একটা। বুঝবোই না আমি এখন আপনার কাছে আর অঙ্ক। আপনি আর আপনার অঙ্ক দুইটাই গোল্লায় যান। হুহ!
কথাটা বলে দ্যুতি চলে আসতে নিলে অরণ্য বলে উঠে,
— দ্বিতীয় আরেক পা ফেললে সোজা ছাদ থেকে তোকে ফেলবো আমি এখন।
অরণ্যের সতর্কবার্তায় দ্যুতি আর সাহস পেলো না এগোনোর। শুধু ভয়ার্ত চোখে তাকালো অরণ্যের দিকে। অরণ্যের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। অরণ্য যে কি পরিমাণে ঘাড়ত্যাড়া তা দ্যুতি জানে। যা বলবে তাই করবে। দোয়া-মায়া বলেও কিছু নেই। জল্লাদ একটা! দ্যুতি দ্বিরুক্তি না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। অরণ্য তার অন্য পাশ থেকে গিটারটা কাঁধে নিতেই দ্যুতির ভ্রু কুঁচকে আসে। এতক্ষণ সেটা খেয়াল করেনি সে। অরণ্য সাধারণত মন ভীষণ ভালো বা খারাপ হলে সুর তুলে এতে। মাঝে মধ্যে অনেক জোড়াজুড়িতে কিছু ফাংশনে গায়। এর বাদে তার পিঠে বা হাতে গিটার দেখা যায় না। তা আজ অরণ্যের মন কেমন ছিল? ভালো নাকি খারাপ? ভাবনায় পড়ে যায় দ্যুতি। হঠাৎ হাতে টান পড়তে নিজ ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে। অরণ্য বলছে,
— সারারাত এইখানে পেত্নিদের সাথে আড্ডা দেওয়ার প্লেন বাদ দিয়ে পড়তে বস। রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু কপালে শনি আছে তোর।
____________________
পৌষ মাসের মাঝামাঝি। শীতের আবরণে ঢাকা পড়েছে সমস্ত শহর। হীম শীতল বাতাসের আনাগোনা বেশ। ঘরের মেঝেতে ভোরের মেঠো রোদ উপচে পড়ছে দক্ষিণা জানালা দিয়ে। কিছুটা রোদ এসে পড়ছে দ্যুতির মুখে চোখেও। মিষ্টি উষ্ণতার পরশ মেয়ে কম্বলটা আরেকটু উপরে টেনে নেয় দ্যুতি। এক পলক দেয়াল তাকিয়ে পুনরায় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে। টেস্ট হয়েছে দু’দিন হতে চললো। লাস্ট ক্লাস হয়ে গিয়েছে টেস্টের আগেই তাই সাতসকালে উঠে স্কুলে যাওয়ার প্যারা নেই তার। তাই আজ সে দেরি পর্যন্ত ঘুমাবে বলে ঠিক করেছে।
ঘুম তার ভাঙ্গলো গিয়ে একদম এগারোটায়। আড়মোড়া ভেঙে ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই দেখা মিললো দিহানের। সোফার উপর পা তুলে কফি খাচ্ছে সে আর টিভিতে কোন এক ইংলিশ মুভি দেখছে। দ্যুতিকে দেখেই সে বলে উঠলো,
— কি রে পেত্নি এখন তোর উঠার সময় হলো? কয়টা বাজে দেখিস? জমিদারের মেয়ে একখান হয়েছে।
শেষের কথাটা একটু ব্যঙ্গ করেই বললো৷ দ্যুতি একবার দিহানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো টেবিলের দিকে। মায়ের কাছে নাস্তা চেতেই শাহিদা বেগম দিয়ে গেলেন। সে সাথে এত দেরিতে উঠার জন্য কয়েকটা কথাও শুনিয়ে দিলেন। পিছন থেকে দিহান তো আছেই। একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে। আস্ত মাথাব্যথা একটা। দ্যুতি সেসব কথা গায়ে না মেখে নাস্তা চিবুতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নাস্তা যখন শেষ হবার পথে তখন অরণ্য এসে হাজির হলো। মূলত দিহানের সাথেই দেখা করতে এসেছে সে। দিহান আর অরণ্য দুইজনে খোস আলাপ জুড়ে দিলো। যেন কত কাল পর দেখা হচ্ছে। অথচ প্রতিদিন উঠতে বসতে দেখা হয় তাদের। এমনকি তাদের ভার্সিটিও এক। দ্যুতি সেদিকে তোয়াক্কা না করে নিজের খাবার খেয়ে উঠলো। রান্নাঘরে প্লেট রেখে রুমের দিকে যাওয়ার পথে একবার সোফার দিকটা নজর বুলিয়ে নিলো। দিহান বা অরণ্য কেউ নেই সেখানে। হয়তো দুইজনেই দিহানের রুমে চলে গিয়েছে। দ্যুতি নিজের রুমে যেতে নিলে অরণ্য দিহান রুম থেকে চেঁচিয়ে উঠে,
— এই চাঁদ, সোফার উপর ফোনটা ফেলে এসেছি, সেটা দিয়ে যা তো। জরুরি কল আসার কথা একটা আমার।
দ্যুতি বিরক্তিতে বিরবির করতে করতে এগিয়ে যায় সোফার দিকে। সোফার উপর অরণ্যের ফোনের দেখা পেতেই দ্যুতি সেটা হাতে নিয়ে নেয়। অতঃপর দিহানের রুমের দিকে অগ্রসর হতেই অরণ্যের ফোনটা ভাইব্রেট হয়ে উঠে আর স্ক্রিনে একটা মেসেজ এসে উঁকি মারে। দ্যুতি ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই দৃষ্টি স্থির হয়ে আসে তার৷ নিজের অজান্তেই থমকে দাঁড়ায়।
#চলবে