প্রণয়ের_ঢেউ #Part_09 last

0
1062

#প্রণয়ের_ঢেউ
#Part_09 last
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

‘অরণ্যের বিয়ে’ কথাটা শুনোমাত্র দ্যুতির মুখের হাসিটা মিইয়ে যায়। বুকটা মোচড়ে উঠে ক্ষণেই। স্তম্ভিত চাহনি নিক্ষেপ করে সকলের দিকে। বিষয়বস্তুটি তার হজম করে নিতে সময় লাগছে বেশ। পাশে দাঁড়ানো অরণ্যও হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সকলের দিকে। তার বিয়ে মানে কি? কার সাথে বিয়ে? বিয়ের কথা আসছেই বা কোথা থেকে? সে তো এখন পর্যন্ত তার বাবাকে দ্যুতির কথা জানায়নি, তাহলে? আগাগোড়া কিছুই মাথা ঢুকছে না তার। অরণ্য শাখাওয়াত সাহেবকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই দ্যুতি কম্পিত কন্ঠে শাহিদা বেগমকে জিজ্ঞেস করে,

— ভাইয়ার বিয়ে মানে? কবে? কার সাথে?

— অরণ্যের ফুপাতো বোন নুরিকে চিনিস না? ওর সাথেই অরণ্যের বিয়ে ঠিক হয়েছে। এইতো পনেরো-বিশ দিন বাদেই ওদের বিয়ে।

শাহিদা বেগমের কথা কর্ণগোচর হতেই দ্যুতি নিজের বল-শক্তি হারিয়ে ফেলে৷ হাত-পা কাঁপতে শুরু করে পরক্ষণেই। দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে আসে তার জন্য। নিজের ভারসাম্য হারানোর আগেই দ্যুতি কোনমতে সোফার কিনারটা ধরে নিজেকে সামলে দাঁড়ায়। তার কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না বিষয়টা৷ মনে হচ্ছে সবটাই মজা। কিন্তু আদৌ কি তাই? দ্যুতি সিক্ত দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের দিকে। ঘটনাক্রমে অরণ্য নিজেও যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তা তার মুখভঙ্গিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তার চমকিত দৃষ্টি জানান দিচ্ছে এ সম্পর্কে সে অবগত ছিল না, মাত্রই জেনেছে। অরণ্য নিজের মধ্যকার প্রশ্নগুলো দমিয়ে রাখতে না পেরে অন্যরকম স্বরে বলে,

— মানে কি? আমার বিয়ে আর আমিই জানি না? এইটা মানতে বাধ্য করছো আমায়? মজা হচ্ছে নাকি? যদি মজা হয়ে থাকে তাহলে প্রচন্ড ফালতু।

শাখাওয়াত সাহেব এইবার স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠে,

— এইখানে কেউ মজা করছে না অরণ্য। তোমার বিয়ে আসলেই নুরির সাথে ঠিক হয়েছে। আমি নিজেই ঠিক করেছি।

শাখাওয়াত সাহেবের এমন স্বীকারোক্তিতে অরণ্য থমকে দাঁড়ায়, বিহ্বলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার পানে। শুরু থেকে এই পর্যন্ত জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শাখাওয়াত সাহেব তাকেই করতে দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে পথনির্দেশনা দিয়েছেন কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল জনান নি। এইসবের পিছে তার একটা উদ্দেশ্যই ছিল অরণ্যকে আত্মনির্ভরশীল বানানো। কিন্তু আজ সেই মানুষটি অরণ্যকে না জানিয়ে তার জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তা অরণ্য মানতে পারছে না।

দ্যুতি নিজেও বিষয়টা হজম করতে পারছে না বলে সোফার কিনারটা শক্ত করে চেপে ধরে। মাথা নত করে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে। হঠাৎ অরণ্য কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠে,

— বাবা উপরে এসো তো।, কথা আছে তোমার সাথে।

কথাটা বলে আর এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় সে বাসা থেকে। তা দেখে রিনা বেগম বলে,

— ভাইজান আপনি বাসায় যান। দেখেন অরণ্য কি বলে৷ কোন সমস্যা হলে জানিয়েন আমি নিজেই কথা বলবো নে ওর সাথে। এখন আমি আসি, বাসায় নুরি একা জানেনই তো। ফোন দিচ্ছে বার বার কখন আসবো।

শাখাওয়াত সাহেব চিন্তিত কন্ঠে বলেন,

— তুই যা আর ওইদিকে খেয়াল রাখিস৷ আমি এইদিকে দেখছি, চিন্তা করিস না।

রিনা বেগম সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে যান নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। শাখাওয়াত সাহেবও চিন্তিত মুখেই চলে যান উপরে৷ শাহিদা বেগম এতক্ষণ চুপ থাকলেও এইবার মুখ খুলেন,

— অরণ্যকে না জানিয়ে এইভাবে বিয়ে পাকাপাকি করা কি ঠিক হলো? ছেলে যদি এখন রাজি না হয়?

রুহুল সাহেব নিজের চোখের চশমাটা ঠিক করে বলেন,

— সেটা বাপ-ছেলে বুঝবে নে। তোমার এত চিন্তা করতে হবে না। যা হওয়ার তা হবেই নে।

— কিন্তু তাও!

— এই বিষয় নিয়ে বেশি ভেবো না।

অতঃপর রুহুল সাহেব দ্যুতিকে ফ্রেশ হতে বলে তিনি রুমে চলে যান। শাহিদাও চুলে হাতখোপা করে উঠে দাঁড়ান। রান্নাঘরে যেতে নিতেই দ্যুতি সিক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠে,

— হুট করে অরণ্য ভাইয়ার বিয়ে কিভাবে ঠিক হলো মা?

শাহিদা বেগমের মেয়ের প্রশ্ন শুনে মেয়ের মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ান৷ স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,

— হুট করে কিছু হয়নি। আগে থেকেই বিয়ের কথা বলা ছিল, যা এখন পাকাপোক্ত করা হলো। এখন এসব কথা রাখ, যা ফ্রেশ হয়ে নে।

কথাটা বলেই শাহিদা চলে গেলেন রান্নাঘরে রাতের খাবার চড়াতে। আর দ্যুতি দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। ভাবতে থাকে অরণ্য আর তার ভবিষ্যতের কথা। আদৌ তাদের কোন ভবিষ্যৎ আছে কি? ক্ষণেই অজানা এক ভয়ে দ্যুতি কাবু হয়ে যায়। সেই ভয় কি অরণ্যকে হারানোর নাকি ভালোবাসার ময়দানে পরাজিত হওয়ার ভয় তা দ্যুতি জানে না। ধীরে ধীরে সে ধাতস্থ হচ্ছে সেই ভয়ে। মন বার বার কু ডাকছে। পারছে না চুপচাপ এইখানে দাঁড়িয়ে থাকতে,মন চাইছে এখনই ছুটে অরণ্যের কাছে যেতে। দ্যুতি আর থাকতে না পেরে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, সোজা চলে যায় অরণ্যের ফ্ল্যাটে।

___________________

— এইসব কি হচ্ছে বাবা?

শাখাওয়াত সাহেব নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,

— কোন সব?

অরণ্য তেতে উঠে বলে,

— ভণিতা করবে না। আমাকে না জানিয়ে আমার জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানে কি?

— আমি তোমার বাবা, তোমার জীবনের সকল সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে।

— ছোট থেকেই তুমি আমার জীবনের সকল সিদ্ধান্ত আমায় করতে দিয়েছ তাহলে আজ যেখানে বিষয়টা আমার সারাজীবনের সাথে জড়িত সেখানে তুমি কিভাবে আমার সিদ্ধান্ত জানার আগ্রহ পর্যন্ত দেখাচ্ছ না? একা একা সব ঠিক এখন আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছ কেন? একটা কথা জেনে রাখো আমি কিন্তু এই বিয়ে করছি না। কোনভাবেই না।

— কারণ কি এর? তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?

অরণ্যের সহজ স্বীকারোক্তি,

— যদি বলি তাই।

শাখাওয়াত সাহেব তিক্ত কন্ঠে বলেন,

— আমি আশাবাদী ছিলাম তুমি এই বিয়েতে না করবে না। কিন্তু এখন তো দেখছি আমি ভুল ছিলাম।

— তোমার সকল সিদ্ধান্তই আমি মানতে রাজি কিন্তু এইটা না বাবা। আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব না। একদমই না।

শাখাওয়াত সাহেব নরম কন্ঠে বলেন,

— বিয়েটা যেহেতু আমি একা একাই ঠিক করেছি সেহেতু এর পিছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে। আমি বাধ্য না হলে কখনোই তোমার উপর সবটা চাপিয়ে দিতাম না।

অরণ্য উৎকন্ঠা হয়ে বলে,

— কি এমন কারণ যার জন্য তুমি আজ এতটা কঠোর হচ্ছো? আমি কারণটা জানতে চাই।

শাখাওয়াত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

— আপাতত তোমাকে সেটা বলা সম্ভব না। শুধু এতটুকু জেনে রাখ এতে তোমার মা জড়িত।

অরণ্য এইবার তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,

— মা জড়িত মানে কি? খুলে বল সব।

— সেটাই আমি বলতে পারছি না এখন। আমার হাতে এখন কিছুই নেই৷ আপাতত কথা এইখানেই রইলো, তোমার আর নুরির বিয়েটা হচ্ছে৷

— তাহলে তুমিও জেনে রাখো আমি এই বিয়ে করছি না।

শাখাওয়াত সাহেব হুংকার দিয়ে বলেন,

— তুমি এই বিয়ে করতে বাধ্য।

অরণ্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

— সবটা চাইলেই চাপিয়ে দেওয়া যায় না বাবা। আমি এই বিয়ে করবো না। জানিয়ে দিও সবাইকে।

কথাটা বলে অরণ্য পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই দরজার পাশে সিক্ত চোখে দাঁড়ানো এক মানবীকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। শীতল চোখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। দ্যুতিও অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে অরণ্যের দিকে। এতটা সময় ধরে সে দরজার পাশে দাঁড়িয়েই সবটা শুনেছিল আর নীরবে তার অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল। অরণ্য বরাবরই তার বাবাকে সবচেয়ে মান্য করে৷ আর সবচেয়ে ভালো সে তার বাবাকেই বাসে। তাই তো কখনো তার বাবার সাথে উঁচু গলায় কথা বলে না৷ কিন্তু আজ সে বলেছে, একমাত্র দ্যুতির জন্য। নিজের ভালোবাসার জন্য। আর সেটাই দ্যুতিকে আশাহত করেছে। সে তো কখনো চায়নি তার জন্য বাবা আর ছেলের সম্পর্ক নষ্ট হোক বা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হোক। এমনটা তাহলে কেন হচ্ছে? কেন?

হঠাৎ শাখাওয়াত সাহেবের অস্পষ্ট কন্ঠ অরণ্যের কানে এসে বারি খেতেই সে চটজলদি পিছনে ঘুরে তাকায়। শাখাওয়াত সাহেব সোফায় বসে বড় বড় শ্বাস ফেলছেন, চঞ্চল গতিতে এইদিক সেদিক করছে। ইতিমধ্যে মুখ তার রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। অরণ্য দৌড়ে যায় তার কাছে,উদ্বিগ্ন কন্ঠে বার বার জিজ্ঞেস করতে থাকে তার কি হয়েছে। শাখাওয়াত সাহেবের এমন করুণ অবস্থা দেখে দ্যুতিও দ্রুত এগিয়ে আসে। অরণ্যের অপরপাশে বসেই শাখাওয়াত সাহেবের হাত ঘষতে শুরু করে।
অরণ্যের বুঝতে আর দেরি নেই তার বাবার আবার শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। সেবার স্টোক করার পর থেকেই প্রায়শই শাখাওয়াত সাহেবের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।এজন্যই ডাক্তার তাকে ইনহোলার সাজেস্ট করেছিলেন। ইনহোলারের কথা মনে পড়তেই অরণ্য আর দেরি না করে ছুটে যায় শাখাওয়াত সাহেবের রুমে। কাবার্ডের ড্রয়ার খুলে ঔষধের বক্সটা বের করে ইনহোলার খুঁজতে শুরু করে সে৷ অতঃপর সেটা পেতেই দ্রুত সোফার রুমে ফিরে আসে সে। শাখাওয়াত সাহেবের মুখে ইনহোলারটা চেপে ধরতেই তিনি ক্ষান্ত হোন। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসেন ঠিকই কিন্তু পরমুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়েন অরণ্যের কাঁধে।

__________________

রুমময় জুড়ে পিনপতন নীরবতা। কারো মুখে কোন কথা নেই। সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ বিছানায় নিস্তেজ অবস্থায় শুয়ে থাকা শাখাওয়াত সাহেবের দিকে। শাখাওয়াত সাহেবের মাথার কাছে বসেই ডাক্তার সাহেব তার চেকাপ করছেন। চেকাপ শেষে তিনি বলে উঠেন,

— ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তিনি আপাতত ঠিক আছেন। বেশি উত্তেজিত হওয়ার কারণে তার শ্বাসকষ্ট উঠে গিয়েছিল। ঠিক সময়ে ইনহোলার দেওয়ার ফলে তিনি এখন স্টেবল। আর সুগার লেভেল ফল করেছিল বলেই তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি সেগুলো রাতের খাবারের পর তাকে দিবেন।

কথাটা বলেই তিনি একটা ছোট নোটপ্যাডে প্রেসক্রিপশনটা লিখে দেন। অতঃপর সেটা অরণ্যের হাতে দিয়ে বলে,

— এইগুলা খাওয়াবেন আর কিছু টেস্ট দিয়েছি সেগুলো করিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে আমার চেম্বারে দেখা করবেন। আর খেয়াল রাখবেন তিনি যাতে বেশি উত্তেজিত না হয়। যেহেতু তিনি একবার স্টোক করেছেন সেহেতু উত্তেজিত হলে তার জন্য ক্ষতি। পুনরায় স্টোক করার চান্সও আছে বেশ। আর তিনিই যদি আবার স্টোক করেন তাহলে পরিস্থিতি কিন্তু বিপক্ষেই যাবে। তাই তার দিকে বিশেষ নজর রাখবেন।

অরণ্য কিছু না বলে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে শাখাওয়াত সাহেবের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। ডাক্তার সাহেব উঠে দাঁড়াতেই রুহুল সাহেব তাকে এগিয়ে দিতে চলে যান আর দিহান অরণ্যের হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে চলে যায় ঔষধগুলো কিনতে। অরণ্য যে ভালো নেই তা দিহান জানে। অরণ্যের বাসায় থাকা প্রয়োজন তাই দিহানই চলে যায় ঔষধগুলো আনতে৷ শাহিদা বেগমও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে আসেন। থেকে যায় শুধু দ্যুতি। ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে সে একবার অরণ্যকে দেখছে একবার শাখাওয়াত সাহেবকে। দৃষ্টি তার এলোমেলো। মনের মাঝে চলছে তুমুল ঝড়। না পারছে সইতে, না পারছে কিছু করতে। বার বার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে শাখাওয়াত সাহেবের এমন অবস্থার জন্য। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তো সেই দায়ী। সম্পূর্ণ কাহিনীটাই যে তাকে ঘিরে। কিভাবে কি করবে সে এখন? ভাগ্য তাদের কোন কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে কে জানে।

অরণ্য কোনদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যায় শাখাওয়াত সাহেবের দিকে। নীরবে তার মাথার পাশে বসে থাকে। চোখে তার বিষন্নতার ছায়া স্পষ্ট, যা দ্যুতির নজর এড়ায়নি। দ্যুতি বেশ কিছুটা সময় সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসে নিচে, এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে। ঝর্ণা ছেড়ে তার নিচে বসে পড়ে সে। নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সে। ভিতরটা তার আজ যেন দহনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। পানির শীতল পরশ বাহ্যিক অংশ শীতল করতে সক্ষম হলেও অন্তরটা শীতল করতে অক্ষমই রয়ে গেল। দ্যুতির হাটু ভাঁজ করে তার মাঝে মুখ গুঁজে নিল। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো অরণ্যের মুখ, দুইজনের সাথে কাটানো মুহুর্ত, সেই কাঙ্ক্ষিত রাত, অবশেষে আজকের দিনটি, শাখাওয়াত সাহেবের নিস্তেজ মুখটি। ক্ষণেই দ্যুতির ভিতরের সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। চোখের পাতা থেকে হারিয়ে স্মৃতিগুলো, মনের দুয়ারে হানা দিল প্রশ্নের দল, উচিৎ-অনুচিতের প্রসংগ উঠে এলো তখনই। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো চলতে শুরু করলো অবিচ্ছিন্নভাবে। যার জন্য কোনকিছুরই সমীকরণ মিললো বরং ঘেটে আরও বিশ্রী অবস্থা হয়ে গেল। যে প্রণয়ের ঢেউ এতটা সময় ধরে আঁচড়ে পড়ছিল তার মনের পাড়ে তা মিইয়ে যেতে থাকলো চরম বাস্তবতার মুখে পড়ে। অজানা এক যুদ্ধ চললো মন ও মস্তিষ্কের মাঝে। বেশ খানিকটা সময় গড়ালো। সিদ্ধান্তের কৌটা এখনো শূন্যের ঘরে।

ঘন্টাখানেক এইভাবে অতিক্রম হওয়ার পর অবশেষে দ্যুতি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় এবং অটল হয় তাতে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন আর নির্মম সিদ্ধান্ত এইটা হলেও ভালো এতেই নিহিত।

______________

ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে দ্যুতি ও অরণ্য। কারো মুখেই কোন রা নেই। জ্যােৎস্নার বলো গলিয়ে পড়ছে তাদের উপর। তারই আলোয় দুইজনের মুখে ছেয়ে আছে বিষাদের ছায়া।শীতল বাতাসের ঢেউ বাড়াচ্ছে নীরবতা প্রবলতা। অরণ্য উদাস ভঙ্গিতে চেয়ে আছে নিকষিত আকাশের পানে। বাহির দিকটা তার শান্ত দেখালেও ভিতরটা তার বড্ড অগোছালো। দ্যুতি আজ অরণ্যকে দেখছে না। মুখ ঘুরিয়ে রেখে অরণ্যের বিপরীতে পাশের আকাশে। সাহস জাগাচ্ছে মনে তিক্ত কথাগুলো অরণ্যের উপর বর্ষিত করার জন্য। কিন্তু বারংবারই সে ব্যর্থ হচ্ছে। এইভাবেই কিছু প্রহর অতিক্রম হওয়ার দ্যুতি নিজের মনোবল শক্ত করে, নীরবতা ঠেলে বলে উঠে,

— আমাদের সম্পর্কের এইখানেই ইতি টানা উচিৎ তাই না?

অরণ্য সচকিত দৃষ্টিতে দ্যুতির দিকে তাকায়। দ্যুতি এখনো অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টি তার সেদিকেই নিবদ্ধ। দ্যুতির এমন গা ছাড়া ভাব দেখে অরণ্য বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দ্যুতির পানে৷ ক্ষণেই স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠে,

— কি বলতে চাইছিস?

দ্যুতি একটু সময় নীরব থেকে স্পষ্টস্বরে বলে,

— যে সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ নেই, কোন পরিনতি নেই সেই সম্পর্ক বাজিয়ে রাখার দরকার আমি মনে করছি না। আঙ্কেল তীব্রভাবে চাইছেন আপনি বিয়েটা করেন, বড্ড আশাবাদী সে আপনার প্রতি। এখন আপনি যদি তাকে আশাহত করেন তাহলে এর পরিমাণ কি হতে পারে তা সম্পর্কে আপনি আমি অবগত। প্রমাণ তো একবার নয় দুই দুইবার পেয়েছেন তাই না। ক্ষণিকের একটা সম্পর্ক রক্ষা করতে গিয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কয়েকটি পুরনো অতি মজবুত সম্পর্ক। নিজেদের সুখ খুঁজতে গিয়ে আমি আমার আপন মানুষগুলোকে ছন্নছাড়া করে দিতে পারি না। তাদের মন বিষিয়ে, নিজের স্বার্থ আদায় করতে পারবো না আমি। তাই আমার মতে কয়েকটি সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার চেয়ে একটি সম্পর্কই নষ্ট হয়ে যাক। আর সেটা হোক আমাদেরই।

দ্যুতির কথা শেষ হওয়ামাত্র অরণ্য দ্যুতির হাত টেনে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। তার হাত দু’টি নিজের হাতের বাঁধনে আবদ্ধ করে উৎকন্ঠা সুরে অরণ্য বলে উঠে,

— পাগল হয়েছিস তুই চাঁদ? কিসব আজেবাজে কথা বকছিস তুই? তোকে আমি ছাড়তে পারবো না। কোনভাবেই না। তুই আমার ক্ষণিকের চাওয়া নারে চাঁদ, আমার দীর্ঘদিনের সাধনা তুই।

দ্যুতি এইবার অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলে,

— আমার জন্য নিজের বাবাকে হারাতে পারবেন? যেই বাবা আপনাকে সেই ছোট থেকে আগলে রেখেছে, সকল ঝড়ঝাপটার মাঝেও আপনার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে অবজ্ঞা করতে পারবেন?

কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র অরণ্যের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দ্যুতির পানে। তা দেখে দ্যুতি বলে,

— সেদিন আপনার আর আঙ্কেলের কথা আমি শুনেছি ভাইয়া। যতটুকু বুঝেছে সে এই বিয়ে নিয়ে প্রচন্ড সিরিয়াস। যতবারই বিয়ে নিয়ে কথা উঠবে ততবারই আপনাদের মাঝে দ্বিধা-দন্দ লাগবে। আঙ্কেল এইভাবেই অসুস্থ, তার উপর এইসব তাকে আরও আঘাত করবে। বিধস্ত করবে। আল্লাহ না করুক যদি তার কিছু হয়? তখন এর দায়ভার নিয়ে কি আমি বা আপনি বাঁচতে পারবেন? সে কথা নাহয় বাদই দিলাম, আপনি যদি বিয়েতে রাজি নাও হন তাহলেও পরিস্থিতি এমন হয়ে আসবে যে, আঙ্কেল আর আমার মাঝে যেকোন একজনকে বেছে নিতে হবে। তখন কাকে রেখে কাকে বেছে নিবেন আপনি? বলুন! আদৌ কি সম্ভব যেকোন একজনকে বেছে নেওয়া? পারবেন আপনি তখন চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নিতে?

অরণ্য নির্বিকার। তার মুখে আজ কোন ভাষা নেই। বাক্যহারা সে আজ৷ জীবনের মোড় এমন এক জায়গায় এসে থেমে যেখানে না পারছে সে এগুতে, না পারছে পিছাতে। দুইদিকেই তার পিছুটান আছে আর সে দুইটাই তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে৷ কাকে রেখে কাকে আঁকড়ে ধরবে সে? আদৌও কি তা সম্ভব? দ্যুতি অরণ্যকের নির্বিকারত্ব দেখে স্মিত স্বরে বলে,

— আপনি যেকোনো একজনকে বেছে নিতে পারবেন কিনা জানি না কিন্তু আপনার জায়গায় আমি থাকলে, আমি কখনোই আমার বাবাকে অমান্য করে আপনার হাত ধরতাম না। যে বাবা তার সর্বস্বটা দিয়ে আমায় আগলে রেখেছে, জীবনের অর্ধেকটা জীবন আমার নামে করে দিয়েছে, আমার চাওয়া-পাওয়ার কোন কমতি রাখে নি তাকে আর যাই হোক আমি অবজ্ঞা করতে পারতাম না।

অরণ্য তখনও নির্বিকার। কি বলবে সে? কিছু কি বলার আছে তার? পরিস্থিতি এতটা বাজে না হলে সে কখনোই এতশত কথা তোয়াক্কা করতো না। যে করেই হোক দ্যুতিকে নিজের করে নিত। কিন্তু আজ পরিস্থিতি এমন যে, তার বাবা তাকে নুরীর সাথে বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবেন না। শাখাওয়াত সাহেবের অসুস্থতা সাড়ার পর তিনি আবার এই বিষয় নিয়ে কথা তুলেছেন আর অরণ্য সেবারও নাকচ করেছিল। ফলাফল তখন কি হলো? শাখাওয়াত সাহেবের অসুস্থতা দৃঢ়ই হলো। অবনতি দেখা দিল স্বাস্থ্যে। এখন চাইলেও সে দ্যুতিকে আশ্বস্ত করে বলতে পারছে না, “আমার উপর একটু ভরসা রাখ, আমি সব ঠিক করে।” এই অসহায়বোধের মত নিকৃষ্ট অনুভূতি হয়তো দুনিয়াতে আর দুটো নেই।

অরণ্যের নির্বিকারত্ব দেখে তার ভিতরকার অবস্থা বুঝতে পারে। সে ভালো করেই জানে অরণ্যকে কখনোই তার আর তার বাবার মাঝে কাউকে বেছে নিতে পারবে না। আর না পারবে এইভাবেই ভেসে বেড়াতে। কোন চূড়ান্ত ফলাফল নিতে গেলেও এইবার সে ব্যর্থ হবে৷ উপরন্ত, সে কখনোই পারবে না তার চাঁদকে কষ্ট দিতে, তার মন ভাঙতে। পিছুটান তখন থেকেই যাবে। তাই দ্যুতি আজ নিজ থেকেই সম্পর্কটা জটিল না করে সহজ করে দিতে চাইছে। মুক্ত করে দিতে চাইছে অরণ্যকে এই প্রণয়ের সম্পর্ক হতে। চিরতরের জন্য। তাই দ্যুতি এইবার বলে উঠে,

— আপনার আর আমার মধ্যে একটা কমন জিনিস কি জানেন? আপনি আমি দুইজনেই দুইজনের বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। তাদের জন্য জানও দিতে পারি। তাই তো, তাদের কষ্ট দেওয়া আমাদের কাম্য নয়। আর তাদের কষ্ট দিয়ে আমরা কিছু করতেও পারবো না। তাই এইটাই ভালো হবে আমরা আলাদা হয়ে যাই। এখন থেকে আপনি শুধুই আমার ভাইয়ের বন্ধু আর আমি আপনার বন্ধুর বোন। এর ব্যতীত কিছুই না।

কথাটা বলেই দ্যুতি ঘুরে দাঁড়ায়। আড়াল করে নিচের চোখের পানি। কথাগুলো সে কতটা কষ্টে বলেছে তা শুধু দ্যুতি নিজেই জানে। ভিতরটা দহনে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে তার৷ সে নিজেও জানে সে থাকতে পারবে না অরণ্যকে ছাড়া। অরণ্যকে সে ভালোবাসে৷ প্রচন্ড ভালোবাসে। তাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনাও করাও তার জন্য দুষ্কর৷ কিন্তু তাই বলে সে স্বার্থপর নয়। নিজের কথা ভেবে সবকিছু এইভাবেই শেষ হয়ে যেতে দিতে পারে না সে। অরণ্যের জীবনের সাথে দ্যুতি যতদিন জড়িত ততদিন অরণ্য কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তাই দ্যুতি আজ নিজ থেকে সরে গেল। যে সম্পর্ক হওয়ারই নয় তা রেখে কি লাভ?

দ্যুতি সামনে এগিয়ে যেতে নিলে অরণ্য পিছন থেকে ওর হাত টেনে ধরে। করুণ কন্ঠে বলে,

— অন্য উপায় নেই কি? এতটা কঠোর না হলে কি হয়না, চাঁদ?

অরণ্যের কথা শুনে দ্যুতির কান্নারা যেন বেগ পেয়ে যায়। উপচে পড়ে চোখের কার্নিশে। শক্ত মনটা দূর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে তখনই। নিজের দূর্বলতা আড়াল করতেই দ্যুতি ছন্নছাড়া কন্ঠে বলে উঠে,

— সে কথা বলে এখন লাভ নেই। আমাদের পথ হয়তো আলাদা হওয়ারই ছিল তাই হয়ে গিয়েছে। তাই এইটাকে মেনে নেওয়াই শ্রেয়। ভালো থাকবেন ভাইয়া, নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইলো।

কথাটা বলেই দ্যুতি নিজের হাত ছাড়াতে চাইলে অরণ্য বলে,

— তোকে ছাড়া আমি কখনো ভালো থাকবো না চাঁদ। কখনো না!

কথাটা বলেই অরণ্য দ্যুতির হাত ছেড়ে দেয়। ক্ষণেই দ্যুতির চোখের কার্নিশ বেয়ে পড়তে থাকে অজস্র অশ্রুকণা। দূর্বল হয়ে আসে মন ও শরীর। গলা ধরে আসতে থাকে বার বার। দ্যুতি আর কোনদিকে না তাকিয়ে ছুটে চলে যায় নিচে। এইখানে একটি মুহূর্তও থাকলে সে ঝাপিয়ে পড়বে অরণ্যের উপর। বাস্তবতাকে পায়ে ঠেলে দিয়ে আপণ করে নিবে অরণ্যকে। আর এইটা দ্যুতি চায় না। তাই তো একপ্রকার পালিয়ে গেল অরণ্যের কাছ থেকে।
অরণ্য এখনো চেয়ে আছে দ্যুতির যাওয়ার পানে। দেখছে তার স্বপ্ন সব ভেঙ্গে যেতে। জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়াই আজ তার নদীর স্রোতে মিইয়ে গেল। অথচ সে কিছুই করতে পারলো না৷ অরণ্য এইবার আকাশের পানে মুখ তুলে তাকায়। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্ধবৃত্ত আকৃতির চাঁদটির দিকে। অরণ্য ও দ্যুতির সকল মুহূর্তের স্বাক্ষী এই চাঁদ। আর আজ এই চাঁদই আবার তাদের বিচ্ছেদেরও স্বাক্ষী। ভাগ্য কি আসলেই এত নিষ্ঠুর? নাকি শুধু তাদের বেলায় এত নিষ্ঠুরতা? তাদের সম্পর্কের শেষটা কি এইখানেই নাকি আরও কিছু হওয়ার বাকি আছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর অরণ্য জানে না। কিছুই জানে না সে। ক্ষণেই তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। এখন এই দীর্ঘশ্বাস তারই চিরতর সঙ্গী।

?সমাপ্ত?

উপন্যাসটা দুই খন্ডে বিভক্ত আর এইটা ছিল প্রথম খন্ডের সমাপ্তি।
জানি অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি আছে,তাদের দুইজনের শেষ পরিনতি জানার আছে আপনাদের। সবই আপনারা জানতে পারবেন দ্বিতীয় খন্ডে। আর দ্বিতীয় খন্ড খুব জলদিই নিয়ে হাজির হবো। ইনশাআল্লাহ! ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here