প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড) #Part_08,09

0
969

#প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড)
#Part_08,09
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_08

রাস্তার পাশে দ্যুতি সিক্ত নয়নে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ তার মনোবল শক্ত থাকলেও সময় যত গড়াচ্ছে তার ভিতরে ভীতি কাজ করছে। বার বার মনে হচ্ছে, সকলে যেন তাকেই ঘুরে ঘুরে দেখছে, কানাঘুঁষা করছে। যা ক্ষণেই তার ভিতরে অস্বস্তি তৈরি করছে। কিন্তু সে তো আর জানে না এই ভিনদেশে কাউকে কারো দেখার সময়ই নেই। দ্যুতির মাথায় আপাতত একটি ভাবনাই বার বার ঘোরপাক খাচ্ছে যে, এই ভিনদেশে এখন সে কিভাবে কি করবে বা কোথায় যাবে জানা নেই তার। অসহায়ত্বের চরম পর্যায়ে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। দ্যুতি চারপাশে একপলক তাকিয়ে পুনরায় মাথা নুয়ে ফেলে। আনমনেই উৎকন্ঠা হয়ে নিদ্রানকে কঠোর কয়েকটা গালি দিয়ে ফেলে। মিনিট দুই-এক গড়াতেই দ্যুতির মাথায় কেউ টোকা দেয়। দ্যুতি কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব করতেই তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে তাকায়। নিদ্রানকে দেখাতে পেয়ে দ্যুতি বিচলিত মন শান্ত হয়,স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে সে। কিন্তু পরক্ষণেই নিদ্রানের আচরণের কথা ভাবতেই দ্যুতির চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। দ্যুতি কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিদ্রান স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠে,

— হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ডুয়িং হিয়ার? তোমাকে কতক্ষণ ধরে খুঁজছি আমি, জানো?

দ্যুতি অকপট রাগ দেখিয়ে বলে,

— খুঁজছিলেন না ছাঁই? এতসময় পর মনে হলো আমার কথা? আমি যদি হারিয়ে যেতাম বা খারাপ যদি কিছু হতো? তার দায়ভার কে নিত শুনি? সব দোষ আপনার। কতবার ডাকলাম, বললাম আস্তে হাটতে কিন্তু একবারও আমার কথা কানে তুলেছিলেন আপনি? আমার জন্য দেশটা সম্পূর্ণ অচেনা তা জানা সত্ত্বেও এমন ব্যবহারের মানে কি? চাইছেনটা কি আপনি?

নিদ্রান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

— এক ডিগ্রি বেশি বুঝা কি মেয়ে জাতিদের জন্মগত রোগ নাকি? অপর পক্ষকে কথা তো বলতে দিবে, ড্যাম ইট!

দ্যুতি মুখ ঝামটা মেরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিদ্রান পুনরায় বলে উঠে,

— আমি তখন ফোনে কথা বলছিলাম, তাই তোমার ডাক আমার কানে যায় নি। আর আমি কি জানতাম নাকি যে, তুমি একটা ছোট বাচ্চা। ছোট বাচ্চাদের মত তোমার হাত ধরে আমায় এদিক-সেদিক নিয়ে না গেলে, হারিয়ে যাবে?

— একদম বাজে বকবেন না। আমি কোন ছোট বাচ্চা-টাচ্চা নই।

— হ্যাঁ, তুমি ছোট বাচ্চা না বড় বাচ্চা। এডাল্ট বেবি!

দ্যুতি কটমট দৃষ্টিতে নিদ্রানের দিকে তাকাতে নিদ্রান রশিকতার সুরে বলে,

— তা এডাল্ট বেবি, কান্না করছিলে কেন শুনি। হারিয়ে গিয়েছিলে বলে? ওলে লে, থাক কান্না করে না। আমি এসে গিয়েছি না।

নিদ্রানের কথা শুনে দ্যুতি ক্রোধের শেষ সীমানায় চলে যায়। নিদ্রানের দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের সেমি হিল জুতা দিয়ে নিদ্রানের পায়ের উপর আঘাত হানে। নিজের সর্বোচ্চ জোর দিয়ে পিষে দেয় নিদ্রানের বাম পা টি। ক্ষণেই নিদ্রান ব্যথা কুঁকড়ে উঠে, নিজের পা ঝামটা মারতেই কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। নিদ্রান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই দ্যুতি কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

— টিট ফর টেট।

নিদ্রান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে বলে,

— উই উইল সি। এখন চল, আমার দেরি হচ্ছে।

দ্যুতি আর কিছু না বলে নিদ্রানের সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করে। মিনিট পাঁচেক পেরুতেই নিদ্রান নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠে,

— নিজেকে কখনো হারিয়ে যেতে দিতে নেই। সবসময় নিজের পরিচয় ও অস্তিত্বকে ধরে রাখতে হয়৷ হোক সেটা জীবনের দৌড়ে বা ভিড়ে। ইউ হ্যাভ টু ফাইট ফর ইউরসেল্ফ ওলোয়েস।

কথাটা দ্যুতির কর্ণগোচর হতেই সে কিছুটা সময়ের জন্য নিশ্চুপ থাকে৷ অতঃপর কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

— নিজের ভালোর জন্যই মাঝে মধ্যে নিজেকে হারিয়ে যেতে দিতে হয়। নতুন করে গড়ে তুলতে হয় নিজেকে৷ নাহলে জীবনটাই বড্ড বেমানান হয়ে যায়।

নিদ্রান কিছু না বলে একপলক দ্যুতির দিকে তাকায়। হঠাৎ করেই তার দ্যুতিকে রহস্যময়ী মনে হচ্ছে। যার চারদিকটা ঘিরে আছে অদৃশ্য দেয়ালে।

_______________

ইস্তাম্বুলের বুকে আঁধার নেমেছে কিঞ্চিৎ প্রহর পূর্বেই। আঁধারের প্রখরতা বাড়তেই তীব্রতা পাচ্ছে শীতলতা। এই হিম বায়ুর আলতো ছোঁয়াই যথেষ্ট যে কারো হাড় কাঁপিয়ে দিতে। আবহাওয়াটা অনুমান করতে পেরে দ্যুতি গায়ে মোটা শাল জড়িয়ে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায় বারান্দার এককোনে। আনমনে তাকায় আকাশের পানে। আজ দুইমাস হতে চললো সে ইস্তাম্বুলের মাটিতে পাড়ি জমিয়েছে। ভার্সিটিও এখন নিয়মিতভাবে যাওয়া-আসা শুরু করেছে। ক্লাস করছে পুরোদমে। নিজেকে ডুবিয়ে রাখছে পড়াশোনার অতুল গহীনে, অতীতকে ভুলে থাকার কিঞ্চিৎ আশায়। কিন্তু আদৌ কি অতীত ভোলা সম্ভব? এইটা তো জীবনেরই একটা অংশ। এই যে এখনো মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায় তার,বুকটা হু হু করে উঠে, অবোধ যন্ত্রণায় কাতর হয়,কণ্ঠনালী ভার হয়ে আসে,অশ্রুরা জমা হয় চোখের কার্নিশে৷ এইগুলাই তো প্রমাণ এখনো আছে আর সর্বদাই থাকবে। সময়ের সাথে সাথে ঘা শুকিয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু এর গভীর দাগ যে থেকেই যাবে। তা কিভাবে মুছবে সে?

দ্যুতি আনমনে ঠোঁট ছোঁয়ায় কফির কাপে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় বসফরাস নদীর পানে। বিভিন্ন রঙের সজ্জিত বসফরাসটি আজ। নদীটির প্রত্যেক ঢেউয়ে খেলা করছে রঙগুলো। দ্যুতির বারান্দা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় নদীটি। প্রায়শই নদীর কলধ্বনি এসে পৌঁছায় তার কক্ষ, আহ্বান জানায় তাকে দেখার। দ্যুতিও তার আহ্বানের মর্যাদা রেখে চলে আসে বারান্দার এই দিকটায়। যতবারই সে বসফরাসের দিকে ততবারই তার ঢাকার মধ্যকেন্দ্রে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা নদীটির কথা মনে পড়ে। আনমনে তুলনা করে বসে দুই নদীর মাঝে। অথচ দুই নদীর মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। কোথায় ঢাকার নর্দমার গন্ধযুক্ত ঘোলাটে পানির এক নদী, আর কোথায় স্নিগ্ধতায় ঘেরা স্বচ্ছ নদীটি। কিন্তু ওই যে, তার বাংলাদেশি মন। সবকিছুতেই তার বাংলার ছোঁয়া চাই এই চাই। আনমনে হাসে দ্যুতি। আনমনে বলে,

— একসময় মাইকেল মধুসূদন দত্তের লিখা ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটিকে নিয়ে কতই না রসিকতা করেছিলাম। বলেছিলাম, “একটা নদীর জন্য আদৌ কারো মন কাঁদে নাকি? ঢঙ যতসব! আমি বিদেশে থাকলে তো কখনোই বাংলাদেশকে মনে করতো না। এই দেশে আছে কি মনে করার মত ময়লার স্তুপ বাদে?” অথচ আজ আমি নিজেই বাংলাদেশটাকে পদে পদে মনে করছি। যে নদীকে নিয়ে এত ট্রোল করেছি বন্ধুদের সাথে মিলে তাকেই মনে করছি। এখন এসে বুঝতে পারছি, আসলেই জন্মভূমির জন্য মন কাঁদে।

হঠাৎ দরজায় কড়া পড়তে দ্যুতি সচকিত দৃষ্টিতে রুমের ভিতরে তাকায়,এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজা খুলতেই তার সমবয়সী এক মেয়ের হাস্যজ্বল মুখশ্রী ফুটে উঠে দ্যুতির সামনে। দ্যুতি মানুষটিকে দেখে কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

— কি খবর নাদিরা? তোমার তো কয়েকদিন ধরে খোঁজই নেই৷

নাদিরা দ্যুতির দিকে চমৎকার এক হাসি উপহার দিয়ে বলে,

— ফ্লিড ট্রিপে গিয়েছিলাম সুইটি, আজই ফিরলাম। বিকেলে তো তুমি ছিলে না তাই হয়তো আভাস পাও নি আমার আসার।

— অহ আচ্ছা। তা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন ভিতরে আসো।

নাদিরা ছোট এক হাসি দিয়ে রুমে ঢুকে পড়ে। দ্যুতি একপলক তাকায় নাদিরার মুখপানে। মেয়েটার ঠোঁটের কোনে সর্বদাই একটা হাসি ঝুলানো থাকে। কখনো হাসিমুখ ছাড়া কথা বলে না। সেই সাথে, বেশ মিশুক। এই তো দ্যুতি আসার দিন কয়েকের মাঝে ভালো সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল তাদের। অবশ্য দ্যুতি প্রথমে তার প্রায় কথাই বুঝতে সক্ষম হতো নয়। জন্মসূত্রে টার্কিশ উপাধি পাওয়ায়, নাদিরা বাংলা ভাষাটা একবারে ব্যবহার করে না বললেই চলে। সবসময় ইংরেজিতে অথবা টার্কিশ ভাষায় কথা বলে। আবার অন্য দিকে শারমিন বেগম ও হারুন সাহেব দ্যুতির সাথে শুদ্ধ বাংলাতেই কথা বলেন আর নিদ্রান বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে। মাঝে মধ্যে টার্কিশ ভাষায় কি যেন পটরপটর করে। প্রথম দিকে দ্যুতির টার্কিশ ভাষাটা বুঝতে অসুবিধা হলেও সময়ের ব্যবধানে ঠিকই এই ভাষাটা রপ্ত করে ফেলেছে।

দ্যুতি দরজাটা ভিড়িয়ে নাদিরার কাছে গিয়ে বসতেই নাদিরা ওর সাথে গল্প মেতে উঠে। ঘন্টাখানিক এইভাবেই গল্পের মধ্য দিয়ে চলে যায়। অতঃপর নাদিরার ফোন আসতেই সে উঠে চলে যায়। নাদিরা চলে যেতেই নিদ্রান আসে রুমে। দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলে,

— এই যে এডাল্ট বেবি, তোমাকে মা ডাকছে।

দ্যুতি ফুঁসে উঠে বলে,

— আপনাকে কতবার না করেছি আমাকে এই নামে ডাকতে। জাস্ট অসহ্য লাগে আমার।

নিদ্রান একপলক দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলে,

— তাতে আমার কি?

দ্যুতি কিছু না বলে শুধু ফোঁস ফোঁস করে। অতঃপর দ্যুতি নিদ্রানের দিকে তীক্ষ্ণ তাকিয়ে ওর পাশ কাটিয়ে যেতে নেয়। ক্ষণেই হাতে টেবিলের কার্নিশের সাথে বারি খেতেই দ্যুতি চাপা আর্তনাদ করে উঠে। আঘাত পাওয়া স্থানে হাত চেপে ধরে মুখ ঘুচে ফেলে। তা দেখে নিদ্রান বলে,

— তোমার চেয়ে তো একটা দুই বছরের বাচ্চাও দেখে-শুনে হাঁটতে জানে। দিনে কয়বার আঘাত পাও হিসাব আছে? কেয়ারলেস পার্সন একটা!

কথাটা বলার পরমুহূর্তেই নিদ্রান দ্যুতির রুম ত্যাগ করে। দ্যুতি সেদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,

— আপনার সামনে পড়লেই আমি কোন না কোন আঘাত পাই। আপনি ভাই, মানুষটাই আমার জন্য কুফা।

_________________

স্বচ্ছ হলেও আকাশটা আজ বেশ পাংশুটে। আজ আকাশের বুকে নেই কোন তুলোরাশির ছাঁয়া, ঝিকিমিকি তারার দল,অর্ধচন্দ্রের স্নিগ্ধ আলো৷ স্বচ্ছ হলেও নির্জীব প্রায়। পরিবেশটাও কেমন ঝিমিয়ে আছে, কোন প্রাণই নেই যেন তাতে৷ এই নিরলস পরিবেশের মাঝেই তীব্র ঝংকার তুলছে একটি কন্ঠে, জানান দিচ্ছে নিজের মনের আকুলতা। প্রকাশ করছে নিজের মনে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত ইচ্ছাগুলো। ছাদের এককোনে গিটার হাতে নিয়ে বসে আছে অরণ্য, মন তার আজ বেজায় খারাপ। মনে পড়ছে তার কাউকে, তাও তীব্রতর ভাবে। মন চাইছে, সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যেতে সাত-সমুদ্র পাড়। হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে আপন করে নিতে। কিন্তু বাস্তবে যে তা নিছক বিলাসিতা। তাই আজ অনেক দিন পর মনের খরক মিটাতে টুংটাং শব্দের ঝংকার তুলেছে সে, বিষন্ন গলায় গাইছে নিজের অনুভূতিগুলো।

“তুমি সাইকেল চালানো শিখবে তাই
আমি আজো সাইকেলে ঘুরে বেড়াই
শুধু ছলনায় তোমার ছোঁয়া মেলেনা

তুমি কবিতাগুলো পড়বে তাই আমি
আজো রাত জেগে ছন্দ সাজাই
রাত শেষে শুধু ভোর ফিরে আসে না

আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেবোই তাই
ব্যাগে আজো রাখি ফিজিক্স বই
শুধু তুমি নেই তাই বইটা খুলি না

তুমি ছুঁড়ে ফেলে দিবে এই ভয়ে
আমি সিগারেট আজো লুকিয়ে শুধু
এখনতো কেউ বারণ আর করে না

তুমি এতো সহজে ভুলতে পারো
অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরো
আমি কেনো শুধু ভুলে যেতে পারিনা

আজ অবাক লাগে তোমায় দেখে
আমায় আজ তোমার অচেনা লাগে
এতো ভালো অভিনয় কেনো জানিনা?”

হঠাৎ গানটা থামিয়ে দিল অরণ্য। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো আকাশের পানে। আনমনেই সিক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

— শেষের লাইনগুলো তোর সাথে বড্ড বেমানান রে চাঁদ। তুই তো আমায় ধোঁকা দেস নি, প্রতারণাও করিস নি। করেছি তো আমি, শুধু আমি। আজ আমার জন্য তোর লাইফটা এত অগোছালো৷ কেন জড়ালাম আমি আমার জীবনের সাথে, কেন ভালোবাসতে শিখালাম তোকে? কেন? তুই আমায় দোষ না দিলেও জানি, সব দোষ আমরাই। দোষী আমি তোর কাছে, এমনকি নুরির কাছেও। চাইছি সব ঠিক করতে কিন্তু তাও, ঠিক করতে পারছি না আমি কিছুই। পাগল হয়ে যাব আমি, সত্যি পাগল হয়ে যাব৷

অরণ্য সিমেন্টে বাঁধানো রেলিংটায় মাথা এলিয়ে দেয়। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকে সেভাবেই, আনমনে। ভাল্লাগছে না তার কিছুই। বাস্তবতার মুখে পড়ে দোটানায় ভুগছে সে, সামাল দিতে পারছে না কিছুই। এলোমেলো হয়ে পড়েছে সে বেশ। জীবন এত কঠিন না হলেও হয়তো পারত। অরণ্য নয়ন দু’টির কপাট বন্ধ করে দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকতে থাকে, অবোধ যন্ত্রণা হচ্ছে মাথা ভিতর। সে মুক্তি চায়, সব কিছু থেকেই মুক্তি।
হঠাৎ কারো পদধ্বনির তীক্ষ্ণ শব্দ হানা দেয় অরণ্যের কর্ণকুহরে। ক্ষণেই অরণ্য চোখ খুলে তাকায় সামনে। আঁধারে কারো অবয়ব দেখতে পেয়ে ভ্রু কুটি কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে তার৷ ক্ষীণ কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করে উঠে,

— কে?

#চলবে

#প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড)
#Part_ 09
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

হঠাৎ কারো পদধ্বনির তীক্ষ্ণ শব্দ হানা দেয় অরণ্যের কর্ণকুহরে। ক্ষণেই অরণ্য চোখ খুলে তাকায় সামনে। আঁধারে কারো অবয়ব দেখতে পেয়ে ভ্রু কুটি কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে তার। ক্ষীণ কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করে উঠে,

— কে?

প্রথম কিছু প্রহর অবয়বটির মাঝে কোন হেলদোল দেখা দিব না। সে দাঁড়িয়ে থাকলো স্থির ভাবেই৷ অরণ্য দ্বিতীয় বার ‘কে’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই অবয়বটি ধীর পায়ে এগিয়ে আসে অরণ্যের দিকে৷ অরণ্য লোকটি পানে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়, হাত থেকে গিটারটা নামিয়ে রেলিং এর উপর আড়াআড়িভাবে দাঁড় করিয়ে মুখটা ঘুরায় লোকটির দিকে। এতক্ষণে লোকটি অরণ্যের একদম মুখ বরাবর চলে এসেছে, অরণ্য মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই লোকটি অরণ্যের পাশে বসে পড়ে। স্মিত কন্ঠে বলে উঠে,

— এত রাতে ছাদে কি করছো?

শাখাওয়াত সাহেবের কন্ঠ শুনে পিলে চমকে উঠে অরণ্য। বিস্মিত নয়নে তাকায় তার পানে৷ এতক্ষণে শাখাওয়াত সাহেবের মুখশ্রী স্পষ্ট হয়েছে অরণ্যের নিকট। মলিনতা ছড়িয়ে আছে চোখে মুখে। সচরাচর শাখাওয়াত সাহেব ছাদে আসেন না, তাও এই সময়ে তো একদমই না। কিন্তু আজ কেন এসেছেন তাই ভেবে পাচ্ছে না অরণ্য। ক্ষণেই শাখাওয়াত সাহেব আবার বলে উঠেন,

— উত্তর দিলে না যে।

অরণ্য নিজের দৃষ্টি শাখাওয়াত সাহেবের উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে আকাশের পানে স্থির করে৷ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,

— কিছু না।

শাখাওয়াত সাহেব কয়েকটা ফাঁকা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে, স্মিত কন্ঠেই বলেন,

— এইভাবে আর কত দিন?

— কি আর কতদিন?

— সংসারের প্রতি এই অনিহা আর কতদিন? ছয় মাস তো হলো। এতদিন কিছু বলি নি কারণ মনে করেছিলাম তোমার সবটা মানিয়ে নিতে সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু তোমার মধ্যে তো কোন পরিবর্তনই দেখছি না আমি। কখন যাও আর কখন ফিরো তার কোন হিসাব নেই। শুক্রবারও তোমার খোঁজ পাওয়া যায় না। বাসায় তোমার একটা বউ আছে, বুড়ো বাপ আছে ভুলে গিয়েছ? বাপ না-হয় দোষ করেছে, কিন্তু মেয়েটার কি দোষ? তাকে কিসের শাস্তি দিচ্ছ? কেন এইভাবে পোড়াচ্ছ তাকে? কেন মানিয়ে নিতে পারছো না সবটা?

অরণ্য একপলক শাখাওয়াত সাহেবের দিকে তাকিয়ে পুনরায় আকাশের পানে তাকায়। স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে,

— এইটাই কি স্বাভাবিক না? যে সম্পর্কের শুরুটাই অনিচ্ছায় গাঁথা সে সম্পর্কের পরিনতি তো এমনই হওয়ার ছিল। বিয়ে করতে তো বাধ্য করেছিলেই, এখন কি সংসার করতেও বাধ্য করবে আমায়?

— আমার কিছু দায়বদ্ধতা আর প্রতিশ্রুতি যদি না থাকতো তাহলে হয়তো আমি তোমাকে কখনোই বাধ্য করতাম না বিয়েটা করার জন্য৷

— তুমি কি করতে বা না করতে তা এখন আর মুখ্য না বাবা। যা হওয়ার তা হয়েই গিয়েছে, জীবন অবিন্যস্ত হয়েই গিয়েছে।

— আমি জানি, আমি দোষী। এর জন্য আমি অনুতপ্তও৷ কিন্তু একবার কি জানতে চাইবে না, আমার এমন করার পিছনে কারণটুকু?

— তখন যেহেতু কারণটা বলাতে পারো নি, সেহেতু এখন বলে লাভও নেই। এখন আর সবকিছু ঠিক করা যাবে না বাবা।

— তাও আমি জানাতে চাই। জীবনে আমার আর কতটুকু সময় বাকি আছে আমি জানি না। এর মধ্যে যদি কথাটা না বলতে পারি তাহলে হয়তো পরজীবনে গিয়েও আমি শান্তি পাব না।

অরণ্য সচকিত দৃষ্টিতে তাকায় শাখাওয়াত সাহেবের দিকে। শাখাওয়াত সেই দৃষ্টির মর্মার্থ বুঝতে পেরে অগোছালো ভাবে বলতে শুরু করেন,

— তুমি যখন খুব ছোট তখন তোমার মা কোন এক কারণে তোমার ফুপুকে কথা দিয়েছিলেন নুরিকে তিনি তার ঘরের বউ করে আনবেন। কারণটা কি ছিল আমি ঠিক জানি না, কখনো বলে নি আমায়। এমনকি কখন আর কবে তোমার মা এমন ওয়াদা করেছিল তাও আমি জানি না। তোমার মা যখন শেষবারের প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং মৃত্যুর মুখে ঝুঁকে পড়লেন ঠিক সেই সময় তিনি আমায় জানিয়েছিল এই বিষয় সম্পর্কে। সেই সাথে, নিজের শেষ ইচ্ছা হিসাবে আমার কাছে এইটাই আবদার করেছিল, তোমরা বড় হলে যাতে আমি তোমার আর নুরির বিয়ে দেই। আমি প্রথমে অবাক হলেও, কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। কারণ সেই পরিস্থিতি ছিল না, তাই বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম৷ কথা দিয়ে ফেলি তোমার মাকে, আমি তার এই ইচ্ছাটা পূরণ করবো। অতঃপর তোমার মা যাওয়ার পর রিনা আপা এসে বিয়ের কথাটা পাকাপাকি করে রাখেন। বিয়ে নিয়ে তোমাদের পড়ালেখায় যাতে কোন প্রভাব না পড়ে তাই আমি আপাকে বারণ করি তোমাদের এই বিষয়ে কিছু জানাতে। একবারে বড় হলেই নাহয় সব জানানো যাবে। আপাও তাতে সম্মতি জানায়।অতঃপর তোমার জবে ঢুকার পরই আমি তোমাকে এই বিষয় সম্পর্কে অবগত করতে চেয়েছিলাম যাতে তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারো কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা হয়ে উঠেনি। এরপর তুমি যখন দিহানের সাথে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেলে তখন তোমার ফুপা মেজর স্টোক করেন এবং প্যারালাইজড হয়ে যান। ডাক্তারও জানান, তোমার ফুপা যদি আরেকবার স্টোক করেন তাহলে আর বাঁচবেন না। কথাটা জানা মাত্রই তোমার ফুপা চাইলেন বেঁচে থাকতে মেয়ের বিয়েটা দেখে যেতে চান। তাই তোমার ফুপু আমার উপর চাপ দিতে থাকলেন বিয়েটা দেওয়ার। আমি চাইছিলাম আগে তোমার সাথে কথা বলতে কিন্তু তোমার ফুপুর চাপাচাপিতে তা আর সম্ভব হয়নি, অজ্ঞাত আমায় বিয়ের আয়োজন শুরু করতে হয়। সবটা দ্রুত হওয়ার ছিল বলে, সবটা তোমাকে না জানিয়েই ঠিক করে ফেলি। উপরন্তু, তুমি কখনো আমায় তোমার পছন্দের কথা জানাও নি বলে আমি ধরেই নিয়েছিলাম বিয়েতে তোমার আপত্তি থাকবে না। কিন্তু তুমি যখন জানাও তুমি কাউকে ভালোবাসো তখন বেশ একটা ধাক্কাই খেয়েছিলাম। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। দায়বদ্ধতা ছিল তোমার মায়ের প্রতি, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তোমার ফুপুকে এই বিয়ের, আমার উপর যে কতটা চাপ ছিল তা শুধু আমি জানি। আমি ওয়াদা ভঙ্গ করা পছন্দ করি না তা তুমি ভালো করেই জানো, কিন্তু তাও সেবার হয়তো ওয়াদাটা ভাঙতাম যদি এইটা তোমার মায়ের শেষ ইচ্ছা না হতো। উপরন্ত, বেশির ভাগই সবাই তোদের বিয়ের কথা জেনে গিয়েছিল এখন বিয়েটা যদি না হতো দুই পরিবারের কি পরিমাণ অসম্মান হতো তুমি ভাবতে পারছো? তোমার গায়ে তেমন কোন তকমা না পড়লেও নুরির গায়ে পড়তো। এই সমাজে একটা মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গাটা মানেই মেয়ের চরিত্রে দোষ বা ত্রুটি আছে। তাই দুই পরিবারের সম্মান আর নিজের মৃত স্ত্রীর ইচ্ছাটা রাখতেই তোমায় বাধ্য করি বিয়েটা করতে। জানি এইটা হয়তো তোমার কাছে কোন কারণপূর্ণ বিষয় না, কিন্তু একবার নিজেকে আমার জায়গায় রেখে ভেবে দেখো। কি পরিস্থিতিতে ছিলাম আমি৷

অরণ্য সবটা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

— কারণ যাই হোক, তুমি বিয়েটা দিতে চেয়েছিলে, দিয়ে দিয়েছ। এখন এইসব বলার মানে হয় না।

— আমার কথাটা…

অরণ্য শাখাওয়াত সাহেবকে বলতে না দিয়ে বলে,

— সবার দিকটা দেখতে গিয়েই হয়তো আমাকে জীবন্ত লাশ বানাতে একবারও ভাবলে না তুমি। নিজের প্রতিশ্রুতি রাখতে গিয়ে তুমি শুধু আমার জীবন না আরও দুইটা জীবন নষ্ট করে দিয়েছ।

— আমি তো মানছি, আমি দোষ করেছি। আমার উচিৎ ছিল তোমাকে আগেই এই সম্পর্কে জানানোর।

অরণ্য শ্লেষের হাসি হেসে বলে,

— আসলেই হয়তো তাই। বিয়ের বিষয়টা না হোক অন্তত এতটুকু জানানো উচিৎ ছিল যে, আমার কাউকে ভালোবাসার অনুমতি নেই। তাহলেই তো হতো। কষ্টটা নাহয় তখন আমি এক তরফা সহ্য করতাম,অন্য কেউ আমার মত এই মরণ যন্ত্রণায় ভুগতো না।

— দোষ যেহেতু আমি করেছি সেহেতু শাস্তিটা আমারই প্রাপ্য হোক। নুরিকে এর মাঝে টেনো না। মেয়েটার এখন তোমাকে বড্ড প্রয়োজন, সপ্তাহখানিক হয়েছে সে নিজের বাবাকে হারিয়েছে। ওর উপর দিয়ে কি যাচ্ছে একবার ভাবো? না খাচ্ছে, না ঘুমাচ্ছে, সারাদিন কান্না করতে করতে দিন পার করছে। এইসময়ে অন্তত মেয়েটার পাশে থাকো তুমি।

অরণ্য শুধু নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকালো শাখাওয়াত সাহেবের পানে। শাখাওয়াত সাহেব আবার বললেন,

— মানিয়ে নাও না সবটা। বিয়ে বিষয়টা তো আর ফেলনা না। বিয়ে যেহেতু হয়েছে সেহেতু এইটাকে মেনে নাও। মেয়েটাকে একটু আগলে নাও।

অরণ্য দ্বিরুক্তি না করে উঠে দাঁড়ায়। গিটারটা টেনে নিয়ে হাঁটা দেয় সামনের দিকে। বা দিকে বাঁক দেওয়ার আগমুহূর্তে অরণ্য ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,

— নিচে চল বাবা। এত রাতে তোমার ছাদে থাকা ঠিক না, শরীর পরে খারাপ করবে৷

কথাটা বলেই অরণ্য চলে যায়। শাখাওয়াত সাহেব অরণ্যের যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আনমনে।

_________________

ইস্তাম্বুলের বুক্র শৈত্য প্রবাহের মৌসুম চলছে প্রায় মাসখানেক ধরেই। দিন কয়েকের মাঝেই হয়তো দেখা মিলবে এই বছরের প্রথম তুষারকরের। হিম বাতাসের পরশ হতে রক্ষা পেতে সবার গায়ে চড়েছে উষ্ণীষকমল কাপড়। মাথায় উলের তৈরি টুপি, হাতে গ্লাভস, পায়ে বুট ছাড়া রাস্তায় দেখা যায় না কাউকে।

আজ পরিবেশ শীতলতায় একটু বেশিই বিভোর। হিম হাওয়ার আনাগোনা বেশ। দ্যুতি রাস্তার ধারে আঁটসাঁট হয়ে হাটছে। হাতে স্টারবার্গের কফি। দ্যুতি তাতে টুকরো টুকরো চুমুক বসাচ্ছে আর এগিয়ে যাচ্ছে ভার্সিটির মিট পয়েন্টের দিকে। আজ একটা প্রেজেন্টেশন আছে বলে এই শীতে ভার্সিটি যাওয়া, নাহলে সে কখনো এমনদিনে বের হত না। হঠাৎ দ্যুতির ফোন বেজে উঠতে দ্যুতি কানটুপির ফাঁকে ইয়ারফোন গুঁজে নেই। সাথে সাথে শরীরের কম্পন ধরে যায়। ইয়ারফোনটাও জমে একদম বরফ হয়ে আছে। দ্যুতি একটু উসখুস করে ফোনটা রিসিভ করতেই শারমিন বেগম বলে উঠে,

— তুমি নাকি ভার্সিটি গিয়েছ?

— জি আন্টি, প্রেজেন্টেশন ছিল আজ একটা তাই আসতে হয়েছে। কেন কিছু কি হয়েছে?

— তেমন কিছু না। তা কখন আসবে?

দ্যুতি নিজের হাত ঘড়ির দিকে একবার নজর ঘুরিয়ে বলে,

— সন্ধ্যা বা রাত হবে।

— তাহলে একা আসার প্রয়োজন নেই৷ আমি নিদ্রকে পাঠিয়ে দিব নে তোমায় আনতে। আজ সন্ধ্যার দিকে হ্যাভি স্নোফল হওয়ার চান্স আছে। এইসময় একা আসাটা রিক্স বেশি৷

— আন্টি কিছু হবে না। আমি আসতে পারবো।

শারমিন বেগম গলা গরম করে বলেন,

— বেশি কথা না। যা বলছি তা শুনো।

দ্যুতি মিনমিনে স্বরে বলে,

— জি আচ্ছা৷

— আল্লাহ হাফেজ।

দ্যুতি কথাটার প্রত্যুত্তর করে ফোনটা রেখে দিয়ে আনমনে হালকা হাসে। বিরবির করে বলে,

— আমার ভাগ্যেই হয়তো এত শাসন করা মানুষ জুটে। ভিনদেশে এসেও ছাড় নেই। বাংলাদেশে ছিল অরণ্য ভা….

কথাটা বলতে নিয়ে থমকায় দ্যুতি। কাকে স্মরণ করতে নিচ্ছিল তা ভেবেই দমে যায় সে। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মনের দুয়ারে স্মৃতিচারণ হয় কিছু মিষ্টি প্রহর। দ্যুতি ক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন দেয় কফিতে। মিট পয়েন্টের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিরবির করে বলে উঠে,

— স্মৃতিদের আমি ছাড়লেও তারা আমায় ছাড়লো না। কি ভাগ্যই না আমার।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here